ঘোড়াশালায় বহু সংখ্যক ঘোড়ারই সমাগম রয়েছে। রানি নিখুঁত ভাবে সবগুলো ঘোড়া পর্যবেক্ষণ করছেন কেবল। তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে হ্যাব্রো। সে রানির মতিগতি আজ বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন করাও যে শোভনীয় নয়! কী করবে ভেবে না পেয়ে অবশেষে সে ধৈর্য হারা হলো। ভেতরে চেপে রাখা প্রশ্নের ঝুলি থেকে বের করল সবে মাত্র একটি প্রশ্ন। তা-ও উৎকণ্ঠা বিহীনই শুধাল, "আপনার রাজ ঘোড়া থাকতে কেন অন্য ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছেন, রানি? মার্জনা করবেন প্রশ্ন করলাম কিন্তু আপনার এহেন কর্মকাণ্ড আজ আমাকে বড়ো আশ্চর্য করছে!"
রানির তখনও তীর্যক দৃষ্টি ঘোড়াগুলোর দিকেই। জবাবে বললেন, "রাজ ঘোড়াটি রাজা হ্যাভেনকে দিয়ে দিতে হবে, হ্যাব্রো। এবং উনার ঘোড়াশালের ঘোড়া দিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। তাই ঘোড়া দেখছি।"
রাজাকে কেন ঘোড়া দিতে হবে এই প্রশ্নটিও মনে উঁকিঝুঁকি দিলো হ্যাব্রোর কিন্তু জিজ্ঞেস করার আর প্রয়োজন বোধ করল না। কারণ আর কেউ না জানলেও সে অন্তত জানে রানি অকারণে কিছু করেন না। যেহেতু এটা করছেন সেহেতু নিশ্চয় কোনো কারণ রয়েছে।
রানির অবশেষে একটি ঘোড়া পছন্দ হলো। ধূসর রঙের ঘোড়াটি। কী সুন্দর চোখ টান টান। রানির সাথেই ছিলো হ্যাভেন। রানি ঘোড়াটির দিকে আঙুল তাক করে বললেন,
"এই ঘোড়াটি নির্বাচন করলাম।"
রাজা হ্যাভেন ঘোড়াটির দিকে ভালো করে তাকালেন। ঘোড়াশালের প্রতিটি ঘোড়া সম্পর্কেই তার ধারণা রয়েছে। এবং সেজন্য এই ধূসর রঙের ঘোড়াটিও সে চেনে। তাই রানিকে কিছুটা সাবধান করতে বললেন,
"এই ঘোড়াটি প্রচণ্ড উগ্র। আপনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারেন।"
"থাক, এত আমাকে নিয়ে আপনার ভাবনা মানায় না। আমি আপনার প্রতিপক্ষ বর্তমানে।"
"প্রতিপক্ষ বলে তো খারাপ চাইতে পারছি না।"
"ওহ্! তাই না-কি? এগুলো তবে কি ভালো চাওয়ার উদাহরণ ছিলো! আশ্চর্য!" কথাটির মধ্যে তুমুল হেয় করার আভাস অনুভব করা গেলো। হ্যাভেনের মুখটি ছোটো হয়ে এলো। সে ঘোড়াটিকে বের করার নির্দেশ দিল।
ঘোড়াটি বের করতেই রানি এগিয়ে গেলেন। ঘোড়া ধরে রাখা লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, "নাম কী ওর?"
লোকটি উত্তর দিতে পারলেন না। মাথা নত করেই রাখলেন। লোকটির হয়ে জবাব দিল হ্যাভেন। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, "ঘোড়ার আবার নাম হয় নাকি? তাছাড়া ঘোড়াশালে এত গুলো ঘোড়া, নাম কতোগুলোর রাখবে?"
হ্যাভেনের জবাব রানির হাসি ছাড়া আর কিছুই এলো না। সুরমায় আচ্ছাদিত টানা টানা চোখ গুলো বাঁকিয়ে রাজা হ্যাভেনের দিকে তাকিয়ে রানি মুচকি হাসলেন। রঙ্গ করে বললেন,
"আপনার প্রাসাদ ভরা বহু আত্মীয় স্বজনদের দেখলাম। সকলের নাম কি আপনার অবগত?"
হ্যাভেন যদিও বুঝল না প্রশ্নটি করার যৌক্তিক কারণ কী। তবুও উত্তরে বলল, "হ্যাঁ।"
"এতগুলো মানুষের নাম অবগত যার, সে ঘোড়ার নাম নিয়ে এতটা দ্বিধাদ্বন্দে কেন? এরা অবুঝ প্রাণী বলেই কি রাজা তাদের নাম মনে রাখতে পারবেন না? আমি তো আমার ঘোড়া— কেশর, ভৃঙ্গ, তুরাগ, বৃশ্চিক সবার নাম মনে রেখেছি। রাতে কোন ঘোড়াটি বেশি ডাকে , কখন কখন ডাকে তা-ও আমার অবগত। আমার খাঁচায় আটকানো পায়রাটির অব্দি নাম আছে। আপনাকে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে একটি পরামর্শ দিই। রাজ্য জুড়ে যত মনুষ্য প্রজাতির আত্মীয় পালছেন, যত্ন করছেন, তাদের এক ভাগ যত্ন এই জন্তুদের করবেন। দেখবেন আপনার শোক সবার আগে ওদের ছুঁবে এবং আপনার হয়ে শোকে ডুবে যাওয়ার জন্য শেষমেশ ওরাই থাকবে। মনুষ্য জাতির কৃতজ্ঞতা শূন্যের কোঠায়। প্রাণীদের এসব নেই। দশজন মানুষ পালার চেয়ে একটি জন্তু পালবেন বিপদে, দুঃসময়ে কাজে আসবে। এত বড়ো নান্দনিক রাজ্যের রাজা আপনি অথচ কাকে ভালোবাসলে সুখ পাবেন আর কাকে ভালোবাসলে শোক, তা-ই জানেন না দেখছি! বড়োই লজ্জার।"
রানির তাচ্ছিল্যে রাজা হ্যাভেন কোনো রাগ দেখাল না। তাল মিলিয়ে হাসল কেবল। খুব ধীরে, কেবল রানিই যেন শুনতে পায় এমন করে বলল,
"আমি কেবল এ-ই ভাবছি, জন্তুদের যে এমন ভালোবাসে, মানুষকে না জানি সে কেমন ভালোই বাসবে!"
রানি জবাব দিলেন না আর। বিনা বাক্য ব্যয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘোড়াশাল থেকে।
উৎকণ্ঠা নিয়ে শুরু হয়ে গেলো প্রতিযোগিতা। সেকেন্ডের ভেতরই দু'টো ঘোড়া যেন দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেলো।
খোলা ময়দান জুড়ে তখনও দর্শকের হৈচৈ। তাদের রাজা সবচেয়ে উত্তম বলে একেক জনের অহংকারে বুক ফুলে উঠল। লিলি উড়ন্ত ধূলো গুলোর মানে তাকিয়ে সগর্বে বলল,
"আমি জানি আমার ভ্রাতাই জয়ী হবে। ঐ সুন্দরী রানির সমস্ত অহংকার চূর্ণ হবে।"
লিলির বলা বাক্য শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়ল ফ্রেয়া। যামিনী সাথে সাথে বলল,
"তোমারই না অহংকার চূর্ণ হয় তা দেখো, রাজকুমারী লিলি। নিজের গর্দান দিয়ে সেই অহংকারের ভুল শুধরাবে তুমি। লিখে রাখো।"
লিলি আরও কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারল না রানি ইথুনের জন্য। স্বামীর ভগিনীর উপর রানি ইথুনের কিঞ্চিৎ রাগও জন্মাল বোধহয়। কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠেই সে লিলিকে প্রাসাদের ভেতরে চলে যেতে বলল। তার চতুর মস্তিষ্ক রানি কামিনীকাঞ্চন সম্পর্কে কিছু ধারণা তো রপ্ত করেছেই। যে নারীর নিজেকে নিয়ে এতটা আত্মবিশ্বাস তাকে হারানো চারটিখানি কথাতো নয়! লিলি তো বলেই শেষ। কিন্তু একটিবার মেয়েটি নিজের ভূতভবিষ্যৎ এর কথা ভাবছে না।
রানি ইথুন ক্ষমা চাইল যামিনীর কাছে। কোমল কণ্ঠে বলল, "লিলি নেহাৎই ছেলেমানুষ। ওর কথা ধরবেন না আপনারা। মনে রাগ নিবেন না।"
নরম যামিনী সেই কথায় বিষণ্ণ শ্বাস ফেলল, "কিন্তু আমাদের রানি ছেলেমানুষ নন। তাকে এমন অপমানসূচক কথা বলা উচিত হয়নি রাজকুমারীর। দুঃখের বিষয় হলেও বলতে হচ্ছে যে, রাজকুমারী লিলির প্রাণবায়ু আর মাত্র তিনদিনের। যেই মুহূর্তে প্রতিযোগিতা শেষ হবে সেই মুহূর্তে ওর প্রাণ যাবে।"
রানির প্রতি যামিনীর এই দীর্ঘ বিশ্বাসে কিঞ্চিৎ অবাক হলো রানি ইথুন। প্রশ্ন ছুঁড়ল, "আপনি এতটা নিশ্চিত কীভাবে?"
"রানি কামিনীকাঞ্চনের সাথে আমাদের বসবাস। তিনি অকারণে একটি নিঃশ্বাসও ত্যাগ করেন না। তাই এটা কখনোই ভাববেন না যে রাজকুমারী লিলির ছেলেমানুষির সাথে তাল মেলাতে উনি এই ময়দানে নেমেছেন। নিশ্চয় তিনি যা বলেছেন তা পরিপূর্ণ রাখবেন বলেই পা বাড়িয়েছেন।"
কথাটি বলেই হাসল যামিনী। চকচক করে উঠল তার চোখ জোড়া। যা দেখে রাজমাতা প্রাচী , রানি ইথুন অব্দি কেঁপে উঠল ভেতর ভেতর। একমাত্র চোখের মণির প্রাণ সংশয়ের আশংকায় ভীত হলো অন্তর।
১৮....
বেলা প্রায় গড়িয়ে এসেছে। আকাশের কোল ঘেষে ভানুর উদ্ভাসিত কমলা রঙের আলোটুকু ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। বালুর খোলা বৃহৎ জায়গাটিতে কেবল শোনা যাচ্ছে ঘোড়ার টগবগ টগবগ করে চলার শব্দটুকুই। কখনো রানির ঘোড়াটি এক কদম এগিয়ে যাচ্ছে তো কখনো রাজির ঘোড়াটি।
বালু উড়ছে থেকে থেকে। রানি ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে টেনে ধরে রেখেই নিজের গায়ের পোশাকটির বর্ধিতাংশ দিয়ে ঢেকে নিলেন মুখ। কমলা রঙের আলোটি রানির চোখে অন্যরকম আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাজা হ্যাভেনের ঘোড়া ও রানির ঘোড়াটি প্রায় একসাথেই। দু'জনের দৃষ্টিই পথের বাঁকে। কিন্তু ধূলোর এমন বেখাপ্পা উড়ো উড়ি রাজার ধ্যানে বিশাল বাঁধা হয়ে যাচ্ছে। বার বার নিয়ন্ত্রণ ছুটে যাচ্ছে হাত থেকে। রানি এই ব্যাপারটি বেশ অনেকটা সময় খেয়াল করেছেন। এবং অবশেষে নিজের কোমরের ওড়নার মতন জড়িয়ে থাকা অতিরিক্ত কাপড়টি খুলে ছুঁড়ে মারলেন রাজার দিকে। নিজের লক্ষ্যের দিকেই নজর রেখে ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
"কাপড়টি জড়িয়ে নিন চোখেমুখে। ধূলো থেকে বাঁচবেন।"
আচমকা উড়ে আসা কাপড়টি পেয়ে স্তম্ভিত হলেন রাজা। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকালেন রানির দিকে। দুপুরেই যে নারীটিকে প্রতিযোগিতায় হারানোর জন্য সে নোংরা একটি ছলের আশ্রয় নিলো সেই নারীটিই কি-না তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন?
এ কি পরোক্ষ ভাবে তুচ্ছ করা নয়? রানি প্রচণ্ড চতুর। কোন জবাবটি কীভাবে দেওয়া প্রয়োজন তা খুব ভালো করেই জানেন।
হ্যাভেন কাপড়টি দিয়ে চোখ-মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলল,
"ছলের প্রতিত্তোরে সাহায্য করার অভিনব কৌশল রানি কামিনী ব্যতীত বোধকরি এ জগতে আর কারো নেই।"
"যুদ্ধে কৌশল দরকার, রাজা হ্যাভেন। তবেই না জিতবো!"
"তাই বলে হিংসের পরিবর্তে হিংসে না দিয়ে, দিয়েছেন অভ্যর্থনা। ছলের বিপরীতে ছল না দিয়ে, দিয়েছেন সহায়তা। এই কৌশলে যুদ্ধ কেন স্বয়ং পৃথিবীই তো জয় করে ফেলবেন, রানি কামিনীকাঞ্চন!"
"ওসব মন ভোলানো কথা নিজের সঙ্গিনীর জন্য রাখুন, রাজা। পরনারীর মন ভুলিয়ে কী আর হবে?"
"মন ভুলিয়ে যদি রানি কামিনীকাঞ্চনকে পাওয়া যেতো তবে এত রাজ্যের রাজাদের ভেতর হাহাকার থাকতো না।"
"আপনার বুঝি বড়ো মায়া হয় তাদের জন্য?"
"হয় বৈকি! আমিও জানতে চাই, আপনার ভেতর কী এমন আছে যার জন্য এত আকুলতা সকলের!"
"বেশি জানতে আসবেন না যেন। রানিকে পাওয়ার আকুলতা ছোঁয়াচে বড়ো! পরে না আপনার ভেতরেও সেই ছোঁয়াচে রোগ তৈরি হয়ে যায়! আমার আবার পুরুষে অভক্তি। আপনারা যে কেবল ছলই জানেন। কাম, ছল ছাড়া পুরুষ জাতিই হয় না।"
শেষ কথাটি বলতে বলতে রানির কণ্ঠের ধ্বনি বদলে গেলো। এতক্ষণের তাচ্ছিল্য এখন পুরোপুরি ঘৃণায় রূপ নিলো যেন। হ্যাভেন এক পলক দেখল সেই ঘৃণা ঝরা চোখ দু'টো। তার রাগও হলো খানিক। পুরুষ জাতি নিয়ে রানির এমন বিদ্বেষ মোটেও মেনে নেওয়ার মতন নয়।
১৯.....
ঝলমলে আলোয় আলোকিত প্রাসাদ। বাহিরে যে পর্যাপ্ত রাত নেমেছে তা বোঝবার জো নেই। কোথাও হাস্যালাপ চলছে তো কোথাও বাক্যালাপ। প্রাসাদ জুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ।
রাজমাতা প্রাচীর ঘরে চলছে আলোচনা। রাজা হ্যাভেনের মাতুল, পিতৃব্য, মামীশ্রী সহ কক্ষ ভর্তি আত্মীয়।
রাজমাতা প্রাচীর ভঙ্গুর কণ্ঠ। সন্তানের বিপদের আশংকা বুক জুড়ে,
"যদি রানি কামিনী জিতে যান?"
হ্যাভেনের মাতুল নোভান নিজের ভগিনীকে আশ্বস্ত করে বললেন,
"আমাদের হ্যাভেন কম নয়। তোমার চিন্তা কীসের?"
হ্যাভেনের পিতৃব্য আরও উৎসাহ নিয়ে বললেন, "প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন জায়গায় বিপদ রাখবো রানি কামিনীর জন্য। কোনো ভাবেই জয়ী তাঁকে হতে দিবো না।"
"কিন্তু প্রতিযোগিতায় ছল করা কি মোটেও সাজে? হ্যাভেন শুনলে ক্ষুব্ধ হবে।" রাজমাতার বুক ভর্তি সংশয়।
"ওকে না জানালেই হবে। আপনি নির্দেশ দিন রাজমাতা। আমরা ব্যবস্থা করছি।" নোভানের আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর।
রানি দোনোমোনো করলেন। অতঃপর বললেন, "আমার সন্তানদের যাতে ভালো হয়, তা-ই করো।"
কক্ষের কোথাও তখন ইথুন ছিলো না। ইথুন থাকলে কখনে এমন ছলনায় সম্মতি দিতো না।
হ্যাব্রো তার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষটিতে তখন দাঁড়িয়ে আছে জানালার দিকটায়। ফুরফুরে বাতাস এসে লাগছে গায়ে। নূপুরের শ্রুতিমধুর ধ্বনি তুলে কক্ষে প্রবেশ করল যামিনী। মনটা তার অস্থির লাগছে ভীষণ।
হ্যাব্রোর ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হ্যাব্রো বুঝল এই উপস্থিতি কিন্তু ফিরে তাকাল না। একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
"কিছু প্রয়োজন আপনার?"
যামিনী এই প্রশ্নটিরই অপেক্ষায় ছিলো। প্রশ্নটি শোনার সাথে সাথে মাথা নাড়ালো। তৎক্ষণাৎ বলল,
"মনটা কেমন যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। সখির কথা মনে পড়ছে।"
"আচ্ছা।"
"তোমার কী মনে হয়? সখি জিতবে তো?"
এবার হ্যাব্রো একটু নড়ল বোধহয়। কণ্ঠে আগের মতনই গাম্ভীর্যতা, "রানি কামিনীর সখি হয়ে আপনার মনের এমন সংশয় বড়োই নিন্দনীয়।"
হ্যাব্রোর এই ভারি বাক্যে কম্পন বইলো যামিনীর শরীরে। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, "না, না, তুমি ভুল বুঝছো।"
"তা হলে মার্জনা করবেন। তবে, আপনার সখির উপর আপনি ভরসা রাখতে পারেন। উনি হারার জন্য পৃথিবীতে জন্মায়নি।" হ্যাব্রোর কণ্ঠে কী এক জোর! যামিনী মুগ্ধ হলো রানির প্রতি হ্যাব্রোর এই একনিষ্ঠ বিশ্বাস দেখে। প্রশংসা করে বলল,
"তোমার এতটা বিশ্বাস সখির উপর?"
"সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? আমি তার শ্বাস শুনলেও বুঝি কোনটা হতাশার আর কোনটা দীর্ঘশ্বাস। তার পায়ের ধ্বনি শুনলে আমি বুঝি কোনটা চঞ্চল ও চিন্তিত আর কোনটায় স্বাভাবিকতা। আমি বিশ্বাস রাখবো সেটাই স্বাভাবিক। এবং আপনি বিশ্বাস রাখবেন সেটাই উচিত।"
"তুমি সখির এত কিছু বুঝো! আর কারো কিছু কি বুঝো তুমি?"
"না। আর কেউ রানি নন আর না আর কারো প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে।" হ্যাব্রোর ভীষণ অকপটের স্বীকারোক্তি। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে কাঁটার মতন বিঁধলো যামিনীর অন্তরে। তার এতক্ষণের চকচক করতে থাকা চোখে ঝুপ করে নেমে এলো অবসাদ। কত কিছু বলতে গিয়েও ওষ্ঠের কাছটাতে এসে থেমে গেলো সবটা। কি'বা বলবে আর? যারা মন ভাঙে তাদের কি মনের ব্যথার কথা জানার আগ্রহ থাকে কখনো? তবে আগ বাড়িয়ে কি'বা বলবে?
২০.....
উচ্চ রবে ঘোড়া গুলো ছুটতে ছুটতে নিবিড় জঙ্গলে এসে পৌঁছালো। মাথার উপর একটি চাঁদের স্বচ্ছ জোছনার আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই চারপাশটা দেখার জন্য। রানি ভাবলেন জঙ্গলের ভেতরে গিয়েই মশাল ধরাবেন। কিন্তু তার আগেই তার ঘোড়াটি প্রচণ্ড শোরগোল শুরু করল। এতক্ষণের শান্ত ঘোড়া উগ্র হয়ে উঠল। দড়ি টেনে ভারসাম্য বজায় রাখা রানির জন্য কষ্টের হয়ে উঠল। এবং মুহূর্তেই ঘোড়াটির বেসামাল নড়চড়ে রানি ছিটকে গিয়ে পড়লেন মাটিতে। ডান পায়ে পেলেন প্রচণ্ড ব্যথা। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ভয়ঙ্কর আর্তনাদ। কিন্তু ততক্ষণে রাজা হ্যাভেনের ঘোড়াটি দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গিয়েছে।
.
.
.
চলবে..........................................................................