দুপুরে ভাত খেতে আর নিচে নামেনি মানুষী। অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করছিল, কি যেন অদ্ভুত নয়নে দেখছিল, ভাবছিল! কোনোটাই মস্তিষ্কে স্থির চিত্তে স্থান করে নিতে পারছে না। হুরহুর করে এসে হুরহুরিয়েই বিদায় নিচ্ছে ব্যস্ততা দেখিয়ে। চেহারায় বিন্দুমাত্র চিন্তার রেশ নেই। তবুও সূক্ষ্ণ কি যেন ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দিচ্ছে, হায়! এত অসহ্য দু:খী লাগছে কেন নিজেকে? আমি তো ভালো আছি, ছিলাম। অন্তত এটাই তো জানতাম এতকাল!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশ্বাস টানতেই দরজা খুলে গেল। সৎবিৎ ফিরলো। শায়লা খাতুন এসেছেন। শুভ্র প্লেটে ভাত, মাছআলু তরকারি। নি:শব্দে বিছানার একপাশে প্লেট রেখে তিনি মেয়ের দিকে একপলক তাকালেন। কোনোরুপ কথা বললেন না। তিনি কি এখনো রেগে আছেন?
মানুষী ধীর গলায় ডাকলো, "মা?"
শায়লা খাতুন শুনেও শুনলেন না যেন। পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই মানুষী আবার ডাকলো, "মা? কথাটা তো শোনো একবার! সাদিফ ভাইয়ের সাথে আমার কিছু নেই। ছাদে যা শুনেছো ওগুলো সব মিথ্যে। এমন কিছু কোনোকালেই আমাদের মাঝে ছিল না।"
পায়ের গতি থেমে গেল। স্থির হলো। মানুষীর চেহারায় লাবণ্যময়ী এক অন্যরকম ছোঁয়া আছে। তাকালে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, মায়া মায়া লাগে। মা বলে সেই মায়া বোধহয় তার বেলায় একটু বেশিই খাঁটে। শায়লা খাতুন ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন, "আমি ন'মাস পেটে ধরেছি তোকে, মানুষী। মিথ্যে কাকে বলছিস? কেন বলছিস? বোকা আমি?"
"আমি সত্যি বলছি মা। ওই লোক ইচ্ছে করে এমন করছেন। ভাইয়া আমাকে পছন্দ করেননা। আমিও না। তুমি প্লিজ বাবাকে বোঝাও। চাচাদেরও! এসব বিয়ে টিয়ে নিয়ে ভাবতে মানা করো।"
"আমি মানা করতে পারবো না। তুই মানা করতে চাইলে গিয়ে কর।"
"মা!"
নেতিয়ে পরা আত্মচিৎকারে মিইয়ে গেল মানুষী। নড়চড়ে উঠলো। ঘাড়ের মধ্যিখানে কি যেন কামড়ে ধরেছে। সূক্ষ্ণ ব্যথায় শরীর মুচড়ে ওঠার পূর্বেই কানের কাছ দিয়ে একটা মশা ভনভন শব্দে উঁড়ে গেল। মলিন মুখটা হঠাৎই শক্ত, গম্ভীর, স্থির। মশার কামড়ে? নাহ্। ব্যথাটা দৈর্ঘ্যে সামান্য হলেও প্রস্থে অসীম।
"আমি সাদিফ ভাইকে বিয়ে করতে পারবো না, মা। উনাকে আমার পছন্দ না।"
গলা কাঁপলো। নমনীয় চোখে কিসের যেন আন্দোলন হুট করেই উদয় হলো। শায়লা খাতুন অকপটেই টের পেলেন তা। মেয়েটা তার কান্না আটকে রেখেছে। কিন্তু কেন? সাদিফকে কি সে সত্যিই পছন্দ করে না? তবে ছাদে ওসব কি ছিল? কিছুপলক প্রশ্নাত্মক দৃষ্টে চেয়ে থেকে শায়লা খাতুন চলে গেলেন। নির্লিপ্ততার বেশ ধরে থাকা উদগ্রীব মানুষীকে একা ফেলে। মানুষীর চোখ তখন টলমল। ও প্রচন্ড আত্নকেন্দ্রীক একটা মেয়ে। তবে ইমোশনের স্বতঃস্ফূর্ত ভান্ডারও যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে রাখে। কথায় কথায় কাঁদার একটা স্বভাব আছে। মন খারাপ হলে নির্ঘুম রাত্রি জাগার একটা অভ্যাস আছে। কত দিন, মাস, বছর মানুষী সাদিফের জন্য অকারণেই কেঁদেছে! রাত জেগেছে! সাদিফ এসবের কিছু জানে না। দেখেনি কখনো। সদা গম্ভীর করে রাখা মুখটা দেখতে দেখতে ছোটবেলার ছিঁচকাঁদুনে মানুষীকে হয়তো ভুলেই বসেছে।
দৈবাৎ, ঘরে রঞ্জনের আকস্মিক আগমন ঘটে। সাথে কেউ নেই। একাই এসেছে। ধপ করে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরেছে নির্বিকার। পরপরই দু'হাতে পেট চেপে ব্যথিত হওয়ার ভান করে বলে, "তোরা আর শান্তি দিলিনারে মানুষী! একটু তো অসুস্থই হয়েছিলাম, তারমধ্যে এতকিছু ঘটিয়ে ফেললি?"
পেটটা ক্ষুধায় কেমন বিশ্রী ভাবে ডেকে উঠছে। মানুষী রয়েসয়ে বেসিন থেকে হাত ধুঁয়ে এলো। ভাত নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বসলো বিছানার একপাশে। তরকারির ঘন ঝোল ভাতে ভালোভাবে মাখাতে ব্যস্ত হয়ে নির্জীব কণ্ঠে শুধাল, "কেন এসেছ?"
নাহ্! প্রশ্নটা ভালো লাগলো না। সিলিংয়ের দিকে চেয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল রঞ্জন। খিটখিটিয়ে বলল, "কেন এসেছি? অসুস্থ ভাইয়ের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করে তুই এমন বেয়াদব হয়েছিস কখন, মানুষী? তোর মতো অভাগীকে এই রঞ্জন ভূঁইয়া দেখতে এসেছে এটাই তো তোর সৌভাগ্য।"
"এই অভাগী একা থাকতে চাইছে ভাইয়া। তুমি চলে যাও।" শান্ত, শীতল, নিবিড় কণ্ঠ।
রঞ্জন উঠে বসলো। কিন্তু গেল না। পেটের মারাত্বক ব্যথাটা সকালেই কমেছে। তবুও কিসের যেন চিনচিনে ব্যথায় হাঁটতে চলতে কষ্ট হয়। পেট মোচড় দেয়। চোখ-মুখ বিকৃত রেখে রঞ্জন ওভাবেই জিজ্ঞেস করে, "সাবানার মতো নাটক করছিস কেন? কি হয়েছে? ছোটবেলায় না সাদিফ ভাই এই করেছে ওই করেছে, ওকে আমার হয়ে মারো— এইসব বলে বিচার দিতিস? এখন কেন দিচ্ছিস না? বেশি বড় হয়ে গেছিস? নিজের বিচার নিজেই করতে শিখেছিস বুঝি?"
ভাত খেতে খেতেই মানুষীর ঠোঁট ভেঙ্গে আসলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো ও। অথচ হলো না। লম্বা অশ্রুরাশি লহমায় গাল ভেঁজালো এত নিষ্ঠুরতা নিয়ে! মানুষী ভেঁজা কণ্ঠে হাহাকার করলো, "আমার সবকিছু অসহ্য লাগছে ভাইয়া। এভাবে.. হুট করে আমি বিয়েটা করতে পারবো না।"
"তার মানে বিয়েতে তোর আপত্তি নেই?"
"আছে। আমি ওই লোককেই বিয়ে করবো না। যে লোক আমাকে বুঝতে চায় না, আমি তার সঙ্গে সারাজীবন কাটাবো কিভাবে?"
দীর্ঘশ্বাসটা জোড়ালো হলো। রঞ্জন চোখ মেলে জানালার দিকে তাকালো। রোদের তাপ একটু একটু করে বাড়ছে। জানান দিচ্ছে, গ্রীষ্মের দেড়ি নেই। শীত এইতো! ক'দিন বাদেই বিদায় নেবে। রঞ্জন সাবধানে শুধাল, "তুই কি আর সাদিফকে ভালোবাসিস না?"
"নাহ্।" অকপটে বলা মিথ্যা। রঞ্জন শব্দ করে হেসে ফেলল। এত ঝংকার হাসিটাতে! মানুষীর কানে বাজে। জোড়পূর্বক একেকটা ভাতের লোকমা মুখে পুরে সে। অথচ গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে। নিশ্বাস ভারী হচ্ছে।
রঞ্জন হাসি থামিয়ে বলে, "তুই বড় হয়ে গেছিস মানুষী। মিথ্যা বলতে শিখেছিস।"
"আমি মিথ্যা বলছি না।"
"তোদের ঝামেলাটা আসলে কোথায়? তোরা দু'জন এত মিথ্যুক কেন?"
মানুষী ভাবতে বসলো। আসলেই তো! তাদের ঝামেলাটা বাস্তবিকই কোথায়? তাদের দুজনের একত্রিত উপন্যাসটা তেমন বড় নয়। ছোটখাটো। প্রতিটা পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে, আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করেও উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু জানে, সাদিফের কঠিন চড়ের বিপরীতে মানুষীর সামান্য অভিমান হয়েছিল। সেই অভিমান জমতে জমতে এখন শক্ত পাথর হয়েছে। সাদিফ কখনো সেই পাথর গলাতে আসেনি। সেদিন থেকে মানুষী প্রতিটা ক্ষণ সাদিফের অপেক্ষা করে গেছে। সাদিফ আসবে, তার অভিমান ভাঙ্গাবে, মানুষী নব কিশোরীর ন্যায় ক্ষমা করে দিবে তার প্রেমিক পুরুষটাকে। কিন্তু কই? অপেক্ষা এত দীর্ঘ কেন? মানুষী মাঝে মাঝে অবাক হয়, তার মতো একটা মেয়ে কিভাবে এই নিরামিষ, ইতর, ছন্নছাড়া একটা লোককে ভালোবেসে ফেলল? যে তাকে বোঝে না, নিজেকে বোঝাতে চায় না।
•••••••••••••
রাত দশ'টা নাগাদ সাদিফ ভাইয়ের এক মেসেজ এলো। মানুষী দেখলো সাড়ে দশটায়। নোটিফিকেশনে ক্লিক করতেই আগামাথাহীন বার্তা বিরক্ত করল তাকে। ভ্রুত্রুটি হলো আপনাআপনিই। মেসেজে বান্দা লিখেছে, "তুই নাকি আমাকে বিয়ে করতে চাইছিস না? শুনেছি, আমার মতো ইতরের সাথে তোর প্রেম প্রেম রব উঠায় লজ্জায় ভাত অব্দি গিলতে পারছিস না? আমাদের তো কখনো প্রেম হয়নি, মানুষী। ইগো যে যুগলের সিস্টেমে আছে, তাদের কখনো প্রেম হতে পারে না। তুই ওদের বলে দিস, ভালোবাসা সম্ভব হলেও প্রেম অসম্ভব। ওসব তারছেঁড়া মানুষের কাজ। আমি কি তারছেঁড়া নাকি?"
হাপিশ নয়নে মেসেজে কয়েকবার চোখ বুলালো মানুষী। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। অত:পর লিখল, "ভালোবাসা হলে প্রেম হতেও সময় লাগে না, সাদিফ ভাই। আপনি চূড়ান্তপর্যায়ের খাচ্চর বিধায় সেটা বুঝতে পারছেন না। ইতরদের বোধশক্তি কম। আর হ্যাঁ, লজ্জা পাচ্ছি না আমি। আমার বমি আসছে।"
সাদিফ মেসেজটা দেখল কি-না জানা নেই, তবে মিনিট পেরোনোর পূর্বেই হন্তদন্ত পায়ে হাজির হলো মানুষীর ঘরে। লোকটার নূন্যতম ম্যানার্স নেই। কোনোরূপ আগাম বার্তা ছাড়াই গটগটিয়ে ঘরে ঢুকে পরেছে। কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে দাঁড়িয়েছে মানুষীর সম্মুখে। কেমন যেন অচেনা দৃষ্টি। মানুষী দেখলো, লোকটার দৃষ্টি পাল্টাচ্ছে। কোমলতায় জড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধ নয়ন আস্তে আস্তে কঠিন পারদে নিমজ্জিত হয়ে মিইয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। অথচ কণ্ঠসর শান্ত, অশান্তের মাঝামাঝি।
"তোর আমাকে দেখে বমি পায়, মানুষী?"
"হ্যাঁ, পায়।"
সাদিফ তাকিয়ে রয়। মানুষী অপেক্ষা করে, সাদিফ হয়তো এবার তার অভিমান ভাঙ্গাবে। অথচ লোকটা তখনো নির্লিপ্ত। কিয়ৎক্ষণ মানুষীর পানে চেয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বসলো। পেছনের দিকে হাত ঠেকিয়ে ভর ছাড়লো সুঠাম শরীরের। ফ্যানের দিকে মুখ উঁচিয়ে বলল, "আজকে ক্রিকেট খেলেছিরে। শরীরে এত ব্যথা!"
মানুষী ততক্ষণে জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হতাশা লুকিয়ে নিখুঁত স্বরে বলল, "তো? আমি কি করবো?"
"হাত-পা টিপে দেয়।"
"আপনার প্রেমিকাদের বলুন।"
"আমার তো প্রেমিকা নেই।"
"করুন একটা প্রেম নাহয়। প্রেমিকা হয়ে যাবে।"
"প্রেমিকা ছোট ছিল যখন, তখন আমি পাত্তা দেইনি। এখন বড় হয়ে সে আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না।"
মানুষীর গলা কাঁপলো বোধহয়, "আপনি চেষ্টা করেছেন কখনো?"
"চেষ্টা করিনি বলছিস?"
মানুষী আশ্চর্য হয়ে তাকালো। লোকটা ইতোমধ্যে বিছানায় শুয়ে পরেছে। হামি দিচ্ছে। চোখে এত এত রাজ্যের ঘুম!
"আপনার চেষ্টায় কমতি ছিল সাদিফ ভাই।"
"বলছিস?" সাদিফ হাসলো। আস্তে আস্তে নিশ্বাস ফেললো। দীর্ঘনিশ্বাস। সিলিংয়ে তাকিয়ে কি যেন খুঁজলো খুব করে। পেল না। এরপর উদাস চোখগুলো বুজে বিড়বিড়ালো, "ইগো... আমাদের ভেতরে অনেক ইগো, মানুষী। তুই আমার অপেক্ষা করছিস। আমি তোর অপেক্ষা করছি। ব্যাপারটা দু'জনেই জানি, বুঝি। তবুও আমরা এত যোজন যোজন দূরে!"
"আপনি চলে যান, সাদিফ ভাই। আপনাকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।"
কণ্ঠে কি কান্নার আভাস ছিল? হ্যাঁ, ছিল। সাদিফ চট করে চোখ মেলল। মানুষীর দিকে তাকিয়ে বুঝলো, মেয়েটা কাঁদছে না। চোখে মুখে বেদনার রেশ মাত্র নেই। তবে কি সে ভুল শুনেছে? ভুল অনুভব করেছে? মানুষী আবার বলল, "চলে যান।"
সাদিফ যায় না। অবাধ্য হয়। সবসময়কার মতো। আকস্মাৎ বলে, "আই অ্যাম স্যরি, মানুষী।"
"হু?"
মানুষী যেন বুঝলো না। অবাক হয়ে স্থবির হলো। শরীরের শিরা-উপশিরায় কি দারুণ কম্পন! বেদনা! হাহাকার! অভিমানটা বুঝি আরও জড়ালো হলো? ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এবার প্রকাশ্যে কেঁপে উঠলো মানুষী। ডান চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়ালো খুব ধীর গতিতে। হতবাক হয়ে ভাবলো, সাদিফ ক্ষমা চাইলে না তার অভিমান গলে যাবে? কই? গলছে না তো! কষ্ট হচ্ছে। কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছে। মানুষী সেই মুহুর্তে বুঝে ফেলল, সাদিফকে সে হারিয়ে ফেলেছে। আর বুঝি আশা রইলো না? আর বুঝি কিশোরী দিনের প্রেমটা হয়ে উঠবে না? হাত উঁচিয়ে ভেঁজা গালটা মুছলো সে। তাকালো নিষ্প্রাণ পলকে। শান্ত গলায় অনুরোধ করলো, "আপনি চলে যান, সাদিফ ভাই। দয়া করুন।"
সাদিফ এবার আর দিরুক্তি করেনি। চলে গেছে।
.
.
.
চলবে.........................................................................