মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৫৩ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


অনন্যা ভার্সিটি ছুটির পর ধীর পায়ে মামার বাসার দিকে হাঁটছে। মাথার ভেতর কৌশিক স্যারের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, এই রিংটা মামার বাসায় যাওয়ার পথে কিনেছিলেন। সে হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশের দোকানগুলোর দিকে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা জুয়েলারি শপ Diamond World Ltd. সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে ঝলমল করে লেখা নামটা দেখে সে কিছুক্ষণ দ্বিধায় পড়ে রইল।

যাবে? না যাবে না? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবশেষে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল। দোকানের স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই শীতল বাতাস গায়ে লাগলো। জায়গাটা বেশ আলোকিত, চারপাশে ঝলমলে হীরার গহনা সাজানো।

অনন্যা একটু অস্বস্তি বোধ করল। জীবনে প্রথমবারের মতো সে কোনো জুয়েলারি শপে এসেছে। কাঁধে ব্যাগটা ঠিকঠাক করে নিয়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। দোকানদার তাকে লক্ষ করছিলেন, অনন্যা নিজের হাতে পরা রিংটা খুলে সামনের ডেস্কে রাখলো। মধ্যবয়সী দোকানদার রিংটা হাতে নিয়ে এক নজর দেখেই চিনে ফেললেন। হালকা হাসি দিয়ে বললেন,
"এটা আমাদের এখান থেকেই কেনা হয়েছে।"

অনন্যার মনে একরকম স্বস্তি নেমে এলো। সন্দেহের কুয়াশা কিছুটা কেটে গেল। সে দ্রুত জানতে চাইল,
"এরকম আরেকটা রিং হবে? মানে, এই যে উপরাংশে পাথর দিয়ে অর্ধেক চাঁদের নকশা?"

দোকানদার মাথা নেড়ে বললেন, 
"হ্যাঁ, অবশ্যই। দেখাচ্ছি, একটু অপেক্ষা করুন।"

অনন্যা মাথা নাড়লো, দোকানের কাচের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। দোকানদার শোকেসের ভেতর থেকে একটা ছোট বাক্স বের করলেন, তারপর ঢাকনা খুলে একটা রিং বের করে আনলেন।

অনন্যা দ্রুত নিজের রিংটার পাশে রাখল। একদম এক!
নকশা, আকৃতি সবকিছু মিলিয়ে একদম হুবহু এক রকম। কিন্তু হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন খোঁচা দিলো,
স্যারের আঙুলের মাপ তো নেওয়া হয়নি! সে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। যাই হোক, মাপ পরে ঠিক করা যাবে। আগে দামটা তো জানতে হবে।

অনন্যা কিছুটা দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
"কত হবে এটার দাম?"

দোকানদার মৃদু হেসে বললেন,
"এই রিং এর দাম সাধারণত সত্তর হাজার, তবে আপনি যেহেতু অন্যের রেফারেন্সে এসেছেন, পাঁচ হাজার কম রাখবো।"

অনন্যা কয়েকবার চোখের পলক ফেলল। মনে হলো, দামের কথা শোনার পর শরীর থেকে সমস্ত শক্তি বেরিয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে রইল।
এত দাম! লজ্জায় মুখ দিয়ে টু শব্দটিও করতে পারলো না। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়বে সে‌।

অনন্যা কাঁপা গলায় বললো,
"আরো কম রাখা যায় না?"

"না যথেষ্ট কমেই বলেছি।"

অনন্যা হেসে বললো,
"ঠিক আছে।এটা থাকবে না? নাকি স্টক আউট হয়ে যাবে?"

"না থাকবে। আর আপনি চাইলে অর্ডার করেও বানাতে পারেন।"

"ঠিক আছে ‌। আমি টাকা নিয়ে আবার আসবো।"

"জ্বি, ধন্যবাদ ম্যাম।"

অনন্যা রিং ফেরত নিয়ে ধীর পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখটা একদম শুকনো হয়ে গেছে তার। কে বলেছিল লোকটাকে এত দামি কিছু কিনতে? এটা কিনবে কীভাবে এখন? টিউশনির পয়সায় মাসে পাঁচ হাজার আসে, আর এই রিং এর দাম পঁয়ষট্টি ! কীভাবে হবে? তার মধ্যে সেমিস্টার ফিও আছে, যদিও এইবারের ঝামেলা আগেই কেটে গেছে, কিন্তু সামনের জন্য তো কিছু রাখতে হবে!

চিন্তায় অনন্যার মাথায় হাত চলে গেল। বুকের ভেতর চাপ চাপ এক অস্বস্তি কাজ করছে। ঘুমের মধ্যেও এই চিন্তায় সে বিরবির করে যাচ্ছে। 

সকালের নরম আলো অনন্যার রুমে প্রবেশ করছে। অনন্যার বিরবিরানি শুনে পল্লবী শোয়া থেকে উঠে বসলেন, বিরক্ত হয়ে অনন্যাকে ঠেলা দিয়ে বলল,
"মুখ বন্ধ করে ঘুমা।"

অনন্যা ফুস করে শ্বাস ছাড়ল। ঘুমের ঘোরে মুখের কোণা দিয়ে হালকা লোল গড়িয়ে পড়ল। পল্লবী হাই দিতে দিতে ফ্রেশ হয়ে আসলেন। সকাল সকাল উঠে চা খাওয়ার অভ্যাস তাদের।সে রান্নাঘরের দিকে ধীর পায়ে এগোলো। কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকতেই একটা যুবকের দেখা পেয়ে আর্তচিৎকার দিয়ে বসলো। কিন্তু সেই আর্তচিৎকার বলেছেন স্থায়ী হলো না। যুবকটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। পল্লবী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কয়েকবার চোখ পিটপিট করলেন, মনে মনে নিশ্চিত হতে চাইছেন, যা দেখছেন তা সত্যিই বাস্তব কিনা।

যুবকটি সামনে এসে দাঁড়াল। চোখের পাতলা ভ্রু কুঁচকে একপাশে হেলিয়ে তাকাল, ঠোঁটের কোণে হালকা এক রহস্যময় হাসি তার, যা‌ দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়, রহস্যের আঁধারে ডুবিয়ে নিয়ে যায়। কৌশিক শীতল কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
"মাদার ইন ল?"

পল্লবী হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখের সামনে ধরা দিয়েছে এক অবিশ্বাস্য রূপবতী যুবক! তার গায়ের রং ফর্সার ওপর হালকা সোনালি আভা ছড়িয়ে রেখেছে। যুবকের উপস্থিতি আশপাশের সবকিছু ঝলমল করে তুলেছে, ঠিক যেনো কোনো শিল্পীর নিখুঁত হাতে আঁকা এক জলজ্যান্ত চরিত্র। গাঢ় নীল রঙের ভারী পোশাক পরে আছে, ভেতরে হয়তো আরো কয়েকটা পোশাক আছে। হাতে কালো হ্যান্ড গ্লাভস। কিছু এলোমেলো লম্বা খুচরো চুল কপালের ওপর নেমে এসেছে, কিছু অংশ আবার অর্ধেক ঢেকে রেখেছে তার তীক্ষ্ণ চোখ। আর সেই চোখ! চোখের মণি সম্পূর্ণ আকাশ বহন করছে।

পল্লবী অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন,
"কী?"

"আপনিই অনন্যার মা,তো সেই হিসেবে আমার মাদার ইন ল! আপনার চিৎকার শুনেই সম্পর্কের হিসাব কিতাব সব বুঝে গেছি। হা হা হা! অনন্যাও হুটহাট এমন করে। দুজনেই খুব কিউট।"

পল্লবী হাসার চেষ্টা করে বললেন,
"তো তুমিই অনন্যার সেই বিদেশি স্যার মানে জামাই?"

কৌশিক চুপচাপ মাথা নেড়ে ফিরে গেল চুলোর সামনে। পল্লবী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ছেলেটাকে দেখে তার মুখ তালাবদ্ধ হয়ে গেছে। শুনেছিলেন বিদেশি, কিন্তু এতটা হ্যান্ডসাম হবে, তা কল্পনাও করেননি।

কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলেন, স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললেন,
"তা বাবা! কী করছো?"

কৌশিক চায়ের কেটলির হাতলটা ঠিক করতে করতে শান্ত গলায় বলল,
"চা বানাচ্ছি। কাউকে দেখলাম না, তাই নিজেই বানাতে এলাম।"

পল্লবী দ্রুত বললেন, 
"আরে! তুমি কেনো বানাচ্ছো? যাও বসো, আমি করে নিয়ে আসছি।"

কৌশিক হেসে বলল, 
"ঠিক আছে, আপনি করুন। আমি এদিকেই আছি।"

পল্লবী কৌশিকের হাসিটা দেখে এক মুহূর্ত চুপ করে গেলেন। এত সহজ, এত আপন ভঙ্গিতে ছেলেটা কথা বলছে, মনে হচ্ছে অনেকদিনের চেনা কেউ।

কৌশিক একপাশে সরে দাঁড়াল। পল্লবী চায়ের কাপ গুছিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন চা তৈরি করতে।

কিছুক্ষণ নিরবতার পর কৌশিক তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
"আমার সাথে অনন্যার বিয়ে হয়েছে। তাই আমি ওকে কোথাও যেতে দেবো না।"

কৌশিকের কন্ঠ প্রচন্ড ধারালো ছিল যার ফলে পল্লবী হাতের কাজ থামিয়ে দিলেন। চোখ তুলে কৌশিকের দিকে তাকালেন, বললেন,
"আমিও ওকে তোমার কাছে যেতে দেবো না।"

কৌশিক হাত ভাঁজ করে নির্ভার ভঙ্গিতে বলল,
"আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি, ডিয়ার মাদার-ইন-ল। এন্ড অনন্যা কান্ট লিভ মি।"

"এতোটা কনফিডেন্ট কীভাবে?"

কৌশিক মুচকি হাসলো, চোখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
"বিকজ আই ক্রিয়েটেড হার ফিলিংস!"

অনন্যার মা ঘুরে কিছুক্ষণ কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
"কিন্তু অনন্যা তো তোমার সাথে যেতে চায় না। ও চায় আমাদের সাথে থাকতে।"

কৌশিক কঠোর হলো, গলা উঁচিয়ে বললো,
"আপনি হুট করে ওকে রেখে চলে গেলেন, তারপর হুট করে এসে নিজের কথার জালে ওকে ফাঁসিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না! আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার পুরো অধিকার আছে অনন্যার উপর। তাই ও মানুক আর না মানুক, আই ডোন্ট কেয়ার। আই জাস্ট ওয়ান্ট হার ক্লোজ, এরাউন্ড মাই আইসাইট!"

পল্লবী এতোক্ষণে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে তিনি চা বানাতে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কৌশিক কিছুই বুঝলো না। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে অনন্যার মায়ের দিকে।

পল্লবীই বললেন,
"আমি অনন্যাকে নিচ্ছি না।"

কৌশিক চমকে উঠলো। পল্লবী আরো বললো,
"আমার মেয়েটাও তোমাকে চায়। এতোক্ষণ তোমার সাথে একটু মজা করছিলাম। কিছু মনে করো না, জামাই।"

কৌশিকের চোখ থেকে এখনো সন্দেহ যাচ্ছে না। সে মুখ খুলে বললো,
"অনন্যা বলেছে ও আমাকে চায়?"

পল্লবী মাথা নাড়লেন। বলতে লাগলেন কালকে রাতের কথা।

"মা ও মা! উঠো।"

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর পল্লবী উঠে বসলেন। বিরক্তের সাথে বললেন,
"কী? ম্যা ম্যা করছিস কেন? ঘুমটা ভেঙে গেলো।"

"আমি তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবো। তুমি মাথা ঠান্ডা করো।"

"কালকে সকালে বলা যেত না?

"না। এখন বলে তারপর আমি ঘুমাবো। নাহলে ঘুমাতে পারছি না।"

পল্লবী বিরক্ত হয়ে ঢুলতে ঢুলতে বললেন,
"ঠিক আছে বল কি বলবি!"

"আমি! আমি স্যারকে খুব পছন্দ করি। উনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।"

অনন্যার মা হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। মেয়ের গালে এক হালকা থাপ্পর বসিয়ে বললেন,
"আবার কার কথা বলছিস? জামাই রেখে আবার কোন স্যার? ছিহ! অনন্যা তুই আমার মেয়ে হয়ে কিভাবে চরিত্রহীন হতে পারলি? হ্যাঁ? এই শিখেছি তোকে? এখন সমাজ আমার উপরে আঙুল তুলবে। তখন আমি কি বলবো ওদের?"

অনন্যা মায়ের কাঁধে হাত রেখে বললো,
"আরে মা! স্যার মানে আমার জামাই। উনি আমার ভার্সিটির প্রফেসর। তাই মুখে বারবার স্যার এসে পরে।"

"ও সেটা তো বলবি‌। তাহলে এখন মায়ের চেয়ে স্যার বড় হয়ে গেলো?"

অনন্যা গভীর শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
"তোমাদের চেয়ে কেউ বড় হতে পারে না, মা। তুমি আর বাবা আমাকে ভালোবাসা দিয়েছো, আগলে রেখেছো। আমি হয়তো তোমাদের নিজের সন্তান নই, কিন্তু কখনো তা বুঝতে দাওনি। কখনো আমাকে শুনতে হয়নি যে আমি এতিম, আমার কেউ নেই।

হতে পারে, যে আমাকে জন্ম দিয়েছিল, সে আমাকে ঘৃণা করত অথবা আমি তার জন্য এক কলঙ্ক ছিলাম। নাহলে নিজের সন্তানকে কেউ এভাবে ফেলে চলে যায়? কিন্তু সেটা নিয়ে আমি আর ভাবতে চাই না। কারণ তুমি আমাকে নিজের কাছে রেখেছো, চেয়েছো বা না-চেয়েছো, সবকিছু দিয়েছো।

আমি স্বীকার করছি, এতদিন আমি তোমাদের ভুল বুঝেছিলাম, রাগ করেছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, তোমাদেরও তখন কিছু করার ছিল না। সবসময় সব কিছু সম্ভব হয় না। মানুষের স্বপ্ন থাকে, কিন্তু বাস্তবতা সব সময় তা পূরণ হতে দেয় না।

আমি জানি, তোমরা আমাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলে, কিন্তু পারোনি। হয়তো সেই বাধ্যবাধকতার জন্যই আমাকে রেখে যেতে হয়েছিল। কিন্তু এখন, যখন তোমাদের সত্যিই আমার প্রয়োজন, তখন আমার কাছে এসেছো। আমাকে মনে পড়েছে তোমাদের। এতেই আমার খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু..."

পল্লবী অনন্যার হাত ধরে থামিয়ে বললেন,
"এমন তো না যে আমরা তোর কথা ভাবিনি, অনন্যা। প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্ত তোকে মনে পড়ত। তোকে কি করে প্রথম সন্তান না ভেবে থাকতাম? দূরে রেখে দেওয়া কি খুব সহজ ছিল? এত বছর তোকে নিজের কাছে রেখেছি, আর তারপর তোকে ছেড়ে দেওয়াটা আমাদের জন্যও কতটা কষ্টের, তা তুই কি বুঝতে পারছিস?

প্রথম দিকে প্রতিদিন ফোন করতাম, তোর খবর নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু একসময় দেখলাম, সময় আর মিলে না। আমাদের ব্যস্ততার সময় তোকে পাওয়া যেত না, তোর ব্যস্ততার সময়ে আমরা ফোন করতাম, তখন তুই ঠিকমতো কথা বলতে পারতিস না। এভাবেই ধীরে ধীরে সব কমে গেল। কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা তোকে ভুলে গেছি।

তুই হয়তো ভাবছিস আমি খুব লোভী হয়ে গেছি, তাই না? হ্যাঁ, আমি লোভী! কারণ আমি আমার সন্তানকে আবার কাছে পেতে চাই। আমাদের অবস্থা যে খারাপ চলছে, সেটা কেউ জানে না। আমরা সবাইকে বড় মুখ করে বলেছিলাম, তাই এসব সইতে হলো। তাই এতদিন ফিরে আসার কথা ভাবিনি।

তোর বিয়ে হয়েছে, সেটাও এখানে এসে জানতে পেরেছি! আমরা তো তোকে ফ্যামিলি হিসেবে ফিরে পেতে চেয়েছি, তোর পাশে থাকতে চেয়েছি। সেটা যদি ভুল হয়, সেটাকে যদি লোভ বলা হয়, তাহলে হ্যাঁ, আমি লোভী!"

অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
"আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো। কিন্তু আমি আসলে আমার বাবাকে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু আমি স্যারকে ছেড়ে যাবো না। আমি উনাকে কথা দিয়েছি আমার মৃত্যু পর্যন্ত উনার সাথে থাকবো। আমরা একসাথে ঘরের মধ্যে সুন্দর আকাশ দেখেছি। সেই আকাশ তৈরির মাঝে উনার সীমাহীন অনুভূতি যা আমার জন্য ছিল তা খুব গভীরভাবে আমি বুঝতে পারি।"

অনন্যা হাত বাড়িয়ে আঙুলের রিং দেখালো। মিষ্টি হেসে বললো,
"উনি আমাকে অর্ধেক চাঁদের টুকরো দিয়েছেন। মানে উনার হৃদয়টা আমার নামে করে দিয়েছেন। আমি উনাকে কথা দিয়ে কথার খেলাপ করতে পারি না। আমি আসলে উনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আজকেই তো পারছি না। এসব বলতে আমার একটুও লজ্জা করছে না। আমি উনাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভালোবাসতে চাই, মা। তুমি কি আমাকে এসব কিছু হতে বঞ্চিত করবে? তুমি কি আমার সুখ কেড়ে নিবে?"

পল্লবী স্থির হয়ে বসে রইলেন। কিছু সময় পর হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"তোকে জোর করবো না। তুই নিজের ইচ্ছায় যা মন চায় করিস। নিজের মনকেও জোর করিস না। বাকি কথা পরে হবে। আমি ঘুমাই।"

পল্লবী শুয়ে পরলেন। অনন্যার আরো কথা ছিল কিন্তু বলতে পারলো না।

কৌশিক মুগ্ধ হয়ে অনন্যার মায়ের কথা কথা শুনছিল। 
পল্লবী চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলো। কৌশিক হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক বসালো। 

পল্লবী বললেন,

"শেষের মাসটা আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিল। কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না, এমনকি অনন্যাকেও ফোন করা হয়নি। নিজেদের চিন্তায়ই বাঁচতে পারছিলাম না। অন্যের ঘাড়ে চেপে বসা কতটা অস্বস্তিকর, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারো? ঠিক সেই অবস্থায় ছিলাম আমরা। তার ওপর ওষুধের খরচ, সংসারের টানাপোড়েন সব মিলিয়ে দিনগুলো বিষাদে ভরা ছিল।

তার সঙ্গে পূর্ব তো একেবারে শয়তান! ওকে জন্ম দেওয়াটাই ভুল ছিল মনে হয়। পড়াশোনার কোনো চিন্তা নেই, আমাদেরও না। সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকে, কয়েকজন অনলাইন বন্ধু জুটিয়েছে, তাদের সঙ্গে গেম খেলে, ঘুরে বেড়ায়। ওকে সামলাতে সামলাতেই অস্থির হয়ে আছি।

যাই হোক, আমি অনন্যার বাবাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম, ওকে নিয়েই ফিরব। তখন উনি নতুন চাকরি খুঁজছিলেন, আর আমি জানতামই না যে অনন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। এখানে এসে যখন জানলাম, তখন ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে প্রচণ্ড ঝগড়া হলো। রাতে একসঙ্গে খেতেও বসিনি। অনন্যাকে পাঠিয়েছি, আমার টাকা দিয়ে খাবার কিনে এনেছে ও।

তারপর অনন্যার মামীর সঙ্গেও কথা কাটাকাটি হলো। আমাদের সঙ্গে কথা না বলে আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে, আমি চুপ করে থাকব? পরে শুনলাম, তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও জানলাম, এই বিয়েতে কারো মত ছিল না। তাই তখন বলেছিলাম সব ছেড়ে দিতে।

কিন্তু যদি জানতাম, তোমরা দুজন একে অপরকে এতটা ভালোবাসো, তাহলে এসব বলতাম না। যাই হোক, আমরা কোনোভাবে মানিয়ে নেব। শুধু চাই, তোমরা সুখে থাকো।"

কৌশিক তৃপ্তি সহকারে চা শেষ করে বললো,
"মাদার ইন ল, কত লাগবে বলুন আমি সাহায্য করবো!"

পল্লবী হাত নাড়িয়ে বললো,
"না বাবা। আমি তোমার কাছ থেকে কিছু চাই না। শুধু মেয়েটাকে দেখে রেখো।"

কৌশিক পকেট থেকে ফোন বের করে নির্ভার কণ্ঠে বলল,

"কানাডায় আমার পরিচিত একজন আছেন। আপনার ফোন নাম্বার দিন, সব ডিটেইলস ওনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সরাসরি যোগাযোগ করবেন, উনিই সব ব্যবস্থা করে দেবেন। চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আর হ্যাঁ, অনন্যা যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। ওর নিজের শক্তি আছে। তাই ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। ও সুখেই থাকবে।"

পল্লবী থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। কৌশিক চোখ তুলে বললো,
"মাদার ইন ল, ডোন্ট ওরি। ফেইলর মিনস ট্রাই এগেইন এন্ড এগেইন।"
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp