মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৫১ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"শুনেছি, আমার বন্ধুদের সৌজন্যে তোকে ছয় ঘণ্টা ক্লাসরুমে বন্দি থাকতে হয়েছে।"

অনন্যা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করল, "তোমার শরীর কেমন এখন?"

"আমি ফিটফাট হয়েই এসেছি দেখতেই পারছিস নাকি কানা হয়ে গেছিস? দেখি তোর চোখ!"

অনন্যা হতচকিত হয়ে তাকালো,
"এভাবে কথা বলছো কেনো?"

আরণ্যক একটু কাছে এগিয়ে আসলো। অনন্যা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আশেপাশে তাকালো। ঢোক গিলে এক কদম পিছিয়ে গেলো। আরণ্যক অনন্যার মাথার তালুতে হাত রেখে নিচে ঝুঁকে মেয়েটাকে থামালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
"দি গ্রেট আইকে স্যার তোকে রুম থেকে বের করেছে। তাই না?"

"ভাইয়া! আশেপাশে সবাই দেখছে। তুমি একটু দূরে সরে দাঁড়াও।"

"সো হোয়াট? আমি কি তোর জামাই লাগি নাকি বয়ফ্রেন্ড যে সবাই দেখে উঁহু আহা করবে? এমনিতেও তোর হাতের রিংটাই সব বলে দিচ্ছে। আমার কিছু বলতে হবে না।"

অনন্যা মাথা নিচু করে আঙুলে পরা রিংটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল ওর মধ্যে। আরণ্যকের আচরণ ক্রমশ বিরক্তিকর ঠেকছিল।
সে আশপাশে তাকিয়ে দেখল, কেউ লক্ষ্য করছে কিনা? কিন্তু আরণ্যক ওকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিল না।
ছেলেটা একটু ঝুঁকে গম্ভীর স্বরে বলল, 
"কি? উত্তর দিচ্ছিস না কেন?"

অনন্যা বিরক্ত মুখে বলল, 
"হুম! তাতে কী?"

আরণ্যক ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি টেনে বলল, "কৌশিক স্যার তোর হাসবেন্ড, রাইট?"

অনন্যা হুম বলতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকাল আরণ্যকের দিকে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আরণ্যক মৃদু হাসল, অনন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে আনলো।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
"সেদিন লোকটার কথাবার্তা শুনে চেনা চেনা ঠেকছিল। তাছাড়া, অন্ধকারের মাঝেও উনার শরীরের গঠন দেখে বুঝতে পারছিলাম, বিদেশি হবে। পরে তোর রুমে বন্দি থাকার ঘটনা শুনলাম, জানলাম কৌশিক স্যার বাঁচিয়েছে। ঈরাকে ফোন দিয়ে শেষে নিশ্চিত হলাম।"

অনন্যা দাঁত কিড়মিড়িয়ে ঈরাকে কয়েকটা গালি দিয়ে বসলো। 
আরণ্যক আবারো বলল,
"ক্লাসের মাঝে তোকে বেশি বকে লোকটা। এটা আমার একদম পছন্দ হয়নি। যদি বাড়াবাড়ি করে, আমাকে বলিস। তবে লোকটা খারাপ না। তোর জন্য উনার চোখে একটা অদ্ভুত ব্যাকুলতা দেখি সবসময়। বেশি ডেসপারেট থাকে। এখন মনে পড়ছে, আমি তোর পাশে বসলেই রেগেমেগে ফায়ার হয়ে যেত, আর শেষে রাগ ঝাড়তো তোর ওপর!"

অনন্যা শুধু "হুম" বলল, চকলেট জুসের দিকে চোখ নামিয়ে ধীর স্বরে ধন্যবাদ জানাল। ঈরার কথা ভাবতে না ভাবতেই, হঠাৎ ঈরা এসে হাজির। ছুটে এসে অনন্যার হাত চেপে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
"বাসায় যাবি চল।"

অনন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকাল, 
"কেন?"

ঈরা নিঃশ্বাস নিল, তারপর বলল, "তোর মা, ভাই এসেছে!"

"মা, ভাই?"

আচমকা অনন্যার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।আরণ্যকও সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে রইল।

ঈরা বলল, 
"হু! আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, এক্ষুনি তোকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে।"

অনন্যার কপালে ভাঁজ পড়ল। 
"আমি তো কয়দিন ধরে ফোন দিয়েছিলাম! কেউ ধরল না কেন?"

ঈরার চোখে অনিশ্চয়তা!
"অনেক বড় সমস্যায় পড়েছিল। আমিও জানি না। বাসায় গেলে সব বুঝবি।"

অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, "ঠিক আছে, চল।"

ঈরা আর অনন্যা দ্রুত পা বাড়ালো।

আরণ্যক একটু এগিয়ে এসে হাত বাড়াল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। 
অস্ফুট স্বরে বলল, 
"আমাকেও জানাস।"

কিন্তু মনে হয় না দুজনের কেউ তার কথা কানে তুলেছে। আরণ্যক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। গেইটের দিকে তাকিয়ে অনন্যার চলে যাওয়া দেখল সে। এক মুহূর্ত থেমে থেকে আবার মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ মাথা উঁচু করে তিন তলার বারান্দার দিকে তাকাল। কৌশিক স্যার ফোনে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে পায়চারি করছে। তবে তার দৃষ্টি গেইটের দিকেই নিবদ্ধ।
আরণ্যকের ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,
"এই লোকটার প্রতি আমি বড্ড জেলাস! কেনো? কেনো জেলাস হতে হবে, আরণ্যক? ইশশ! লোকটা কীভাবে পেয়ে গেলো না তোকে? আমি পেলাম না কেনো? "

আরণ্যক আবারো গেইটের দিকে তাকালো, বললো,
"অনন্যা, আমি না একটা বই লিখবো। সে বইতে শুধু তুই আর আমি থাকবো। কৌশিক স্যারকে একদম ডিলিট করে দেব। তুই ভাববি, সে আমাদের জীবনে কখনো ছিলই না। ভালো হবে না?"

আরণ্যক মৃদু হাসল,
"সে বইয়ে আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা থাকবে না। থাকবে না আমার মধ্যে কোনো ভীতু মনোভাব। শুধু আমি আর তুই! আমাদের সুন্দর একটা দুনিয়া। তুই সেই বইয়ে শুধু আমাকে চিনবি! আমার দিকেই থাকবে তোর সব মনোযোগ। খুব সুন্দর হবে না?"

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার পিছনে ফিরে তাকাল আরণ্যক। কৌশিক স্যার এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কী যেন গভীরভাবে ভেবে যাচ্ছে।

আরণ্যকের মনে হলো, এই লোকটাকে সে আগেও কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে? সেটাই কিছুতেই মনে পড়ছে না।

জীবনে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে, যেখানে মনে হয়, এটা তো আমি আগেও দেখেছি! অথবা এই ঘটনাটা আমার সাথে আগেও ঘটেছে, আমি আগেও এটা অনুভব করেছি! মনে হয় বাস্তবতা আমাদের সামনে নতুন নয়, বরং বারবার ঘটনার পুনরাবৃত্ত হচ্ছে।এই ঘটনাকে বলা হয় দেজা ভু। 

ফরাসি শব্দ দেজা ভু এর অর্থ আগেও দেখা। মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশ স্মৃতি সংরক্ষণ করে। যদি পুরনো কোনো স্মৃতি হালকা পরিবর্তিত হয়ে মস্তিষ্কে ফিরে আসে, তাহলে মনে হয় আমি আগেও এটা দেখেছি! দেজা ভু সাধারণত মানসিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ঘটনা, যেখানে মস্তিষ্ক হঠাৎ করে কোনো নতুন পরিস্থিতিকে আগের কোনো অভিজ্ঞতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে, যদিও বাস্তবে এমন কিছু ঘটেনি। আবার! আবার ঘটতেও পারে। হতে পারে সেটা প্যারালাল ইউনিভার্সে অথবা অতীতের জীবনে ঘটে গেছে। আরণ্যকের ও কৌশিক স্যারকে দেখে এমনটাই অনুভূত হচ্ছে। তবে তাদের কি আগেও দেখা হয়েছিল? নাকি সবটাই আরণ্যকের নিছক চিন্তা! এই প্রশ্নের উত্তর তো ইতিহাসই দিবে।

*****

অনন্যা মামার বাসায় ফিরেছে। বাসার পরিবেশটা থমথমে হয়ে আছে, মনে হচ্ছে সবাই কোন কিছুর শোকে আছে। ঈরার সাথে ধীরে ধীরে চৌকাঠ পেরোল সে। ঈরা মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। রিকশায় আসার সময় ঈরাকে বকাঝকা করেছে অনন্যা, কেন আরণ্যককে জানাতে গেল! এই নিয়ে রাস্তাতেই তর্ক বেধেছিল। ঈরা ধৈর্য ধরে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে আরণ্যক আগেই সব বুঝে গিয়েছে। তার কিছু বলার দরকার পড়েনি।

অনন্যা বসার ঘরে পা রাখতেই চোখ পড়ল সোফার দিকে। ওর মা পল্লবী বসে আছেন, তার মুখশ্রী চিন্তায় ভরপুর। তিনি নিজের ভেতরেই হারিয়ে গেছেন। অনন্যা থমকে গেলো, ওর মা এতো চিকন ছিমছাম হয়ে গেলো কবে? বুকের মধ্যে একটা পাথর ধস করে পরে গেলো অনন্যার। কেমন যেন ভারি ভারি লাগছে সবকিছু। পাশেই বসে আছে ছোট ভাই, পূর্ব আহনাফ শিকদার। ফোনে নিমগ্ন সে। অনন্যার থেকে তিন বছরের ছোট। দিন দুনিয়ার খবর নেই, সারাদিন ফোন নিয়ে বসে থাকতো। আজ ও ব্যতিক্রম নয়। তবে বেশ লম্বা হয়ে গেছে, চেহারায় একটা আলাদা পরিপক্কতা। অনন্যার মনে হলো, চেনা মুখটা খানিকটা অচেনা হয়ে গেছে। ওদের সম্পর্কটা সবসময়ই ছিল ঝগড়াঝাঁটির। বাবা-মা নাকি শুধু অনন্যাকেই বেশি ভালোবাসে, তাকে নয়। এটাই ছিল পূর্বের চিরন্তন অভিযোগ। রাগ দেখিয়ে বলতো, "আমি না থাকলে তোরা বুঝবি!" অথচ আজ এত বছর পর, অনন্যাই ওদের কাছ থেকে দূরে, আর পূর্ব প্রতিটা মুহূর্ত ওদের পাশে। কিন্তু এখন? এখনও কি পূর্বর সেই অভিযোগগুলো আছে? নাকি সময়ের সাথে সাথে ক্ষোভ কোথাও গলে গেছে, কোথাও হারিয়ে গেছে? 

পল্লবী মাথায় হাত রেখে বসে আছেন, ক্লান্তির ভারে নুইয়ে পড়েছেন তিনি। অনন্যার গলা শুকিয়ে গেল।

"মা?"
শব্দটা খুব আস্তে বের হলো, কিন্তু পুরো ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।

অনন্যার মা দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। দ্রুত কাছে এসে শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, মনে হলো একটু দূরে গেলেই আবার হারিয়ে ফেলবেন। কাঁধে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি, আর অনন্যা যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু মা যখন কান্নায় ভেঙে পড়লেন, তখন আর পারলো না। সেও চোখ বন্ধ করে কেঁদে উঠলো। ঈরা একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, যেন এই আবেগঘন মুহূর্তের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। ভিতর থেকে মামীও বেরিয়ে এসেছেন, অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন মা মেয়ের এতোদিন পরের দেখা।

পূর্বও ফোন সরিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছোটবেলায় দেখা দুষ্টু অনন্যা, যে কি না তার সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করতো, আজ সে কাঁদছে।

পল্লবী অনন্যার মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,
"অনন্যা। কেমন আছিস তুই?"

অনন্যা নাক টেনে বললো,
"তুমি যেরকম রেখে গিয়েছিলে।"

"আমরা ভালো নেই রে, মা। আমাদের ক্ষমা করে দে।"

অনন্যা কিছুই বুঝতে পারছে না। মামী সুযোগ বুঝে ঈরার কাঁধে হাত রেখে নিচু স্বরে বললেন, 
"তুই রুমে যা, একটু বিশ্রাম নে।"

ঈরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, বোঝাতে চাইলো সে এখানে উপস্থিত থাকতে চায়। কিন্তু মায়ের কঠিন দৃষ্টি দেখে আর প্রতিবাদ করলো না। মনখারাপ নিয়ে ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে চলে গেলো।

ঘরটা হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। শুধু অনন্যার বুকের ভেতর দমচাপা উত্তেজনা টের পাওয়া যাচ্ছিলো।

পল্লবী চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন,
"আয়! রুমে চল।"

অনন্যা কাঁপা গলায় বললো,
"বাবা?"

"আসেনি।"

অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো। পূর্ব কিছুটা উত্তেজিতভাবে এগিয়ে এসে অনন্যার কাঁধে হাত রাখলো। তার উচ্চতা অনেকটাই বেড়ে গেছে, এখন অনন্যার থেকে এক ধাপ লম্বা। 

"তকে মিস করিনি।" বলেই হালকা হাসি দিলো পূর্ব।

পূর্বর কথার ধরন দেখে হেসে ফেললো অনন্যা। বিদেশে গিয়ে কথায় বিদেশি ভাইব বসিয়ে ফেলেছে। অনন্যা মাথায় এক গাট্টা মেরে, একটু কটু গলায় বললো, "আমিও করিনি, ছাগল! তোকে কে মিস করে? সারাদিন পিঁপড়ের মতো ঘরের এক কোণায় ফোন নিয়ে পড়ে থাকিস! মিস করবো কেন?"

পূর্ব মাথায় হাত দিয়ে বিরক্তের সাথে আহ্ শব্দ করে বলল,
"মাম্মা! দেখো না আপু কি বলছে! এতো দিন পরে আসলাম তাও ঝগড়া করছে!"

"তো কি করবো?তোকে ঘাড়ে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরবো হু? তুই কি আমার প্রাণের ভাই নাকি? তুই হচ্ছে ছাগল। ছাগল ই থাকবি!"

"মাম্মাআ?"
পূর্ব জোরে ডাক দিলো। অনন্যা মুখ বাঁকালো। পল্লবীও হেসে ফেললেন।

******

নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে পল্লবী ও অনন্যা।

পল্লবী ধীরে বললেন, 
"অনন্যা! আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি।"

অনন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পল্লবী অনন্যার হাত মুঠোয় ধরে চাপা কণ্ঠে বললেন, 
"প্লিজ, না করিস না। অনেক আশা নিয়ে এসেছি। আমরা অনেক বড় ভুল করেছিলাম তোকে একা রেখে চলে গিয়ে।"

পল্লবীর কণ্ঠ কাঁপছিল, দৃষ্টিতে অপরাধবোধ। অনন্যা নীরবে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিলো, সোজা হয়ে বসল। গলার স্বর শক্ত করে বললো, "তুমি হয়তো জানো, আমার একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।"

পল্লবী শান্ত গলায় বললেন, 
"হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু আমি তোর বিয়ের জীবনে বাধা দিচ্ছি না। তোর জামাই থাকুক এখানে, পরে টাকা-পয়সা জোগাড় করে তোর কাছে চলে আসবে। তাছাড়া শুনেছি, বিয়ে জোর করেই হয়েছে, তোর কোনো ইচ্ছা ছিল না। তাহলে যেতে সমস্যা কোথায়?"

অনন্যা গভীর শ্বাস নিলো, মুখ শক্ত করে বললো, 
"আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি শুরু থেকে গুছিয়ে বলো। আর আমার হাতে বেশি সময় নেই, একটু পর টিউশনি আছে। তাই যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।"

পল্লবী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। চোখ বোলালেন পুরো রুমজুড়ে। দেয়ালের গায়ে সাজানো অসংখ্য ছবি! অনন্যা, ঈরা আর নোহারার স্মৃতিগুলো সম্পূর্ণ ঘরজুড়ে চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা একমাত্র ফ্যামিলি ফটোটা চোখে পড়লো। পাশের দেয়ালে অনন্যার বাবা আর ছোটবেলার অনন্যার ছবি দুলছে। বাপ মেয়ে দুজনের মুখে প্রাণখোলা হাসি।

পাশেই পূর্বর সাথেও একটা ছোটবেলার ছবি ঝুলছে। ছোট্ট অনন্যা হাসিমুখে পূর্বর হাত ধরে আছে। কিন্তু পল্লবী খেয়াল করলেন, তার সাথে অনন্যার একটা আলাদা ছবি নেই।

একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটে উঠলো, তবু বুকের ভেতরটা মোচড় দিলো। কত শত মুহূর্ত পার হয়ে গেছে, তবু এই ঘরে তার সাথে অনন্যার কোনো চিহ্ন নেই? একটাও নেই?

হাত বাড়িয়ে দেয়ালের ছবিগুলো ছুঁয়ে দেখলেন পল্লবী, স্পর্শ করে মুছে দিতে চান ফেলে আসা সব অভিমান। কাঁপা গলায় বললেন,
"অনন্যা! আমিই তোকে খুব করে চেয়েছিলাম।"

অনন্যা থমকে গেলো, চোখ বড় করে তাকালো মায়ের দিকে। 
পল্লবী ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন,
"তোর বাবার সাথে আমার প্রেমের বিয়ে। প্রেম বললে ঠিক প্রেমও না, এক দেখায় মনের টান। কিন্তু তখন আমার বিয়ের আয়োজন প্রায় শেষ। তোর বাবার পড়াশোনা শেষ হয়নি, কোনো চাকরি নেই, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তবু সব বাধা পেরিয়ে, একরকম হুট করেই আমরা বিয়ে করেছিলাম। মনের টান কি একটা জিনিস বোঝ!

লোকমহল্লার কথা সামলাতে সবাই বললো, এই বিয়ে পরিবারের ইচ্ছাতেই হয়েছে। কিন্তু সত্যিটা ছিলো অন্যরকম। তোর বাবা টাঙ্গাইলে থাকতো, তার পুরো পরিবারই ছিল যৌথ পরিবার, শিকড় গেঁথে আছে গ্রামের জমিতে। ছেলেকে শহরে পাঠিয়েছিলো ভালো করে পড়াশোনা করে বড় কিছু হবে বলে। কিন্তু সে ফিরে গেল বউ নিয়ে, অর্ধসমাপ্ত পড়াশোনা ফেলে রেখে! পরিবারের কাছে এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় অন্যায়। ওরা সাফ জানিয়ে দিলো, আমাকে ছেড়ে না দিলে তার জন্য ওখানে জায়গা নেই। ওরা সব মেনে নেবে কিন্তু আমাকে না। তোর বাবা নড়ল না। বললো, বিয়ে করেছে মানে সারাজীবন পাশে থাকবে। তবু যাওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে এলো, হয়তো মনে মনে বুঝেছিল, সহজ পথ তার জন্য নেই।

তখন আমাদের এই বিল্ডিংটা ছিল পাঁচতলা। পুরোটা ছিল আমার বাবার মালিকানায়। বাবার রাগ ছিল প্রবল, মেয়েকে ঘরে থাকতে দিলেন, কিন্তু জামাইকে নয়। তোর বাবা সেই ধার করা টাকা দিয়ে বাবার কাছ থেকে চারতলার এক ফ্ল্যাট কিনলো। ঘরটা তখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। আসবাব বলতে কিছুই নেই, দেয়ালে কোন স্মৃতির চিহ্ন নেই। আমরা দুজন একসাথে, অথচ কতটা শূন্যতা আমাদের ঘিরে ছিল।

তোদের বাবার তখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি। চাকরি খুঁজতে বের হতো, কিন্তু মেলে শুধু ছোটখাটো কাজ। সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে ফিরতো, আর আমি রান্না করে অপেক্ষা করতাম।

আমারও তখন পড়াশোনা শেষ হয়নি। আমাদের সময় মেয়ে মানেই ছিলো আঠারো হলে বিয়ে, তারপর ঘর-সংসার। একদিন বন্ধুর সাথে মিলে ব্যবসা শুরু করলেন তোর বাবা। ব্যবসা বলতে মোবাইলের দোকান। ছোট চাকরিতে পাওনা সব টাকা ঢেলে দেয় সেদিকে। প্রথম তেমন চলেনি। অনেক হতাশ হয়ে পড়েছিল সবাই সাথে আমিও।"

পল্লবী একটুখানি থামলেন। অনন্যা চুপচাপ শুনছিলো।

"তারপর, এরকম টেনেটুনে চলছিল সবকিছু। কয়েক বছর পরের কথা বলি, একদিন একটা মিরাকল ঘটে। আমাদের ঘরের জন্য টেলিভিশন কিনতে গিয়ে, সেন্ট মার্টিনের ট্রিপের টিকিট জিতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার ইচ্ছা দুজনের কারোরই ছিল না, কারণ বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কিন্তু মা বাবা বারবার বলছিলো। তাছাড়া আমরা দুজনে কোনো রেস্ট ও পাচ্ছিলাম না, আলাদা কোন সময় অনেকদিন কাটানো হয়নি। তাই শেষমেশ চলে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম, এসব ট্রিপে হয়তো ঠক খাবো। কিন্তু কিছু হয়নি। খুব সুন্দর ঘুরলাম সকলের সাথে।

তবে, ফেরার দিন আবহাওয়া ছিল ভয়াবহ। প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে বাস দেরি করলো, জানানো হলো আজ আর ফেরা হবে না। রাতের দিকে তোর বাবা খাবার আনতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়। আমাকে হাসপাতাল ছুটে যেতে হয়েছিল। বড় কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, তবে হাতে এক জায়গায় কেটে ফুটে যায়। 

আমি হাসপাতালে বসে আছি, আর হঠাৎ আশেপাশে বিশাল হইচই শুনলাম। এক অদ্ভুত কোলাহল। শোনা গেল, একটা দুধের শিশু ছেঁড়া দ্বীপের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মৃত প্রায়, তবুও মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। বাচ্চাটির খবর জানার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল। অনেক খোঁজখবর চালানো হলো, কিন্তু শিশুর মা বাবার কিছুই পাওয়া গেল না, শিশুর কোনো পরিচিতি মিলল না। হাসপাতালটা তখনো আতঙ্কে ছেয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর, শুনলাম, শিশুটি আর বাঁচবে না, মারা গেছে। তখন বাইরে তুমুল ঝড়, বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। আমরা সকলে মিলে ভিতরে প্রার্থনা করতে লাগলাম। সবাই শুধু এটাই চেয়েছিল, শিশুটি যেন বাঁচে।"

পল্লবী থেমে থেমে বললেন,
"আচমকা আকাশে বজ্রপাত হয়। এক তীব্র শব্দে গোটা আকাশ কেঁপে ওঠে। তখনই শোনা গেল, শিশুর চিৎকার। পুরো হাসপাতাল থমকে গেল সেই চিৎকারে। ঠিক যেন কোনো মিরাকল, কোনো আশ্চর্য কিছু শিশুটিকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলো! চিকিৎসকরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।"

অনন্যা তখনো তাকিয়ে, তার মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এতো বড় ঘটনা বলার পেছনে কারণ কী? 

অনন্যা শেষমেশ জিজ্ঞেস করে বসলো,
"তারপর শিশুটির কী হয়?"

"ওই শিশুটিই এখন আমার সামনে বসে।"

অনন্যা হতবাক। যেন বজ্রপাত হলো মাথার ঠিক ওপরে। মুহূর্তেই হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেলো, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। চোখের সামনে চারপাশটা কেমন ঘোলাটে লাগতে শুরু করলো। সে চমকে উঠে দাঁড়ালো, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। এক ধরনের শূন্যতা তাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। মনে হলো বহুদিন ধরে গাঁথা পরিচয়ের মাটি মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

সে নিজের পোশাকের প্রান্ত মুঠোয় চেপে ধরল, গলার স্বর কাঁপতে কাঁপতে অস্ফুট স্বরে বলল,
"আমি?"

পল্লবী নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকালেন, চোখ ভরে এলো অশ্রুতে। তার কণ্ঠেও অনুরণিত হলো একই রকম এক অদ্ভুত শিহরণ,পল্লবী কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
"আমি জানি না সেদিন কেন এমনটা করেছিলাম। মনে হচ্ছিল কোনো শক্তি আমাকে তোর কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তুই তখন ছোট্ট একটা প্রাণ, নিঃশ্বাসের জন্য লড়াই করছিলি। আমি তোকে কোলে তুলে নিই, তখনও শরীরটা নরম ছিল, নিস্তেজ, কিন্তু উষ্ণতা ছিল। আমি অনুভব করলাম, তোর বুকের ভেতর ছোট্ট একটা হৃদপিণ্ড এখনও ধুকপুক করছে। আমি বলে উঠলাম, আমি ওকে নিয়ে যাবো।

তোর বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বলেছিল, এটা পাগলামি, আমরা কীভাবে ওকে মানুষ করবো? আমাদের নিজেদের জীবনটাই তখন অনিশ্চিত। কিন্তু আমি কিছু শুনতে পাইনি। মনে হচ্ছিল, আমি যদি তোকে ছেড়ে দিই, তাহলে হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করবো।"

"এর অর্থ আমি তোমাদের নিজের না?"

পল্লবী ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। চোখ ভরে এলো মমতায়, কপালের ভাঁজে জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো মুহূর্তেই নরম হয়ে গেলো। মেয়ের গালে আলতো করে হাত রাখলেন, আঙুলের স্পর্শে মায়ের সমস্ত আবেগ জড়িয়ে ধরে পড়লো হাতের মুঠোয়,

"না! তুই আমার নিজের অনন্যা। তোকে আমি আমার বুকে চেপে বড় করেছি। তোর গায়ের রঙ আমার মতো, তোর অভ্যাস আমার মতো, তুই আমারই ছায়া। পুরো দুনিয়া যদি বলে তুই আমার নিজের না, আমি মানবো না। তুই আমার হৃদয়ের অংশ, আমার নিঃশ্বাসের মতো সত্য।"

অনন্যার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো,
"লাভ কী? সেই তো রেখেই চলে গেলে।"

"এই যে এসেছি নিয়ে যেতে।"

অনন্যা চোখের অশ্রু মুছে ফেলল,
"আমি যাবো না। বাবাও তো চায় না আমি যাই।"

পল্লবী নিঃশ্বাস ফেললেন। 
"না! তোর বাবা নিজের বিবেকের সাথে লড়াই করছে। সে তোর কাছে আসতে চায়, তোকে বলতে বলেছে, সে তোর জীবনের ভুল দরজা।"

"তাহলে বাবা কী জানে না? ভুল দরজাকে খুলে দেখতে হয়?"

অনন্যা থেমে সন্দেহের সহিত বললো,
"আর তোমাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হয়েছে। কি হয়েছে আসলে?"
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp