"লারা! স্যার এখনো বাড়িতে আসছে না কেনো? উনার তো ডিনার করার সময় হয়ে গেছে।"
লারা রান্নাঘরে কাজ করছিল। অনন্যার কথায় সে হেসে বললো,
"তোমরা জামাই বউ! জানলে তুমিই আমার থেইকা বেশি জানবা। আমি ক্যামনে কইতাম?"
অনন্যা ডাইনিং টেবিলে চিন্তিত হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মাথা নাড়িয়ে উচ্চারণ করলো,
"স্যার, এক সপ্তাহ ধরে এমনটা করছে। স্যারের দেখাই ঠিকমতো পাচ্ছি না। কয়দিন রাতে একসাথে কত কথা বলতাম। এখন তো স্যার রাতে বাসায়ই থাকে না। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।"
লারা একটু গলা নামিয়ে বললো,
"কাল অনেক রাইতে সাব রে আইতে দেখছি।"
অনন্যা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো,
"তারপর কি হলো?"
"আমি পানি ভরতে গেছিলাম। পরে গিয়া দেখি সাব খাবার খুঁজতাছে।"
অনন্যা আগ্রহী গলায় বললো, "তারপর?"
"আমি টেবিলে খাবার বাইরা দিলাম। সাব সুন্দর মত খাইলো, এক্কেবারে শান্তি পাইরা খাইলো!"
অনন্যা চিন্তিত মুখে বসে রইলো, ঠোঁট ফুলিয়ে। সেদিন রাতের ঘটনাগুলো বারবার মনে পড়ছে। স্যার হঠাৎ করেই দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর অনন্যার হাতের স্পর্শে লাল গোলাপ সাদা হয়ে যাওয়া! ঠিক সেই মুহূর্তে বাজ পড়েছিল আকাশে। অথচ সেদিন আবহাওয়া একদম পরিষ্কার ছিল, বজ্রপাত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু হলো।
বজ্রপাত হওয়ার মাত্র দশ মিনিট পর স্যার ফিরে এসেছিলো, কিন্তু তার আচরণ তখন কেমন জানি অস্বাভাবিক লাগছিল। দরজা খুলে অনন্যাকে বললো,
"ঘুমিয়ে পড়ো।"
অনন্যা বারবার জানতে চেয়েছিল,
"কি হয়েছে? কেন এমন করলেন?"
কিন্তু কোনো উত্তর দেয়নি কৌশিক স্যার।
পরদিন সকালে আবার নতুন এক খবর ছড়িয়ে পড়লো, বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডের মৃত্যু! রাতের বজ্রপাতে নাকি মারা গেছে সে। পুরো ঘটনা এক অদৃশ্য ভয়ের আবরণে ঢেকে ফেললো অনন্যাকে। কিন্তু অনন্যা নিশ্চিত সকালে উঠে যে একটা স্বপ্ন দেখেছিল তার সাথে কৌশিক স্যারের অতীত জড়িয়ে। কিন্তু কেন? স্যারের অতীত অনন্যার স্বপ্নে ধরা দেবে কেন? আর যে ভাষায় তারা কথা বলছিল, সেটাই বা কী? এত অচেনা, এত অজানা! তবুও যেন খুব চেনা পরিচিত সবকিছু।
অনন্যা আচমকা বলে উঠলো,
"লারা! তোমার কি কখনো জানতে ইচ্ছে করে না স্যার কে? কি তার পরিচয়?"
লারার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি খেলা করলো, তার ফর্সা ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। পাতিলে খাবার নাড়তে নাড়তে সে বললো,
"না ম্যাডাম! প্রথম প্রথম কৌতূহল ছিল। জানার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কালের সঙ্গে সঙ্গে সেই ইচ্ছা ফিকে হয়ে গেছে। আমার তো কোনো সন্তান নাই। যখন সাবের জন্য কাম করা শুরু করলাম, ধীরে ধীরে মনে হইলো সাব আমার সন্তান। একটা বড় বাচ্চা! বাচ্চাগো মতো ঝগড়া করে, হুকুম দেয়, আবার পছন্দ না হইলে কড়া কথা শোনায়। হুটহাট এমন সব কাণ্ড করে যে মাঝে মাঝে হাসি পায়।"
লারার চোখে পুরোনো দিনের স্মৃতি ভেসে উঠলো, সে মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
"সাবে যখন কোনো রেসে পুরস্কার জিতেন, আমাদের দেখান। আমরা খুশি হইয়া হাততালি দেই। ভালো খাবার রান্না করি। কত যে আনন্দের মুহূর্ত আছে! মনে পড়লে চোখে পানি আসে, ম্যাডাম।"
অনন্যা চুপচাপ শুনছিল।
লারা ধীরে ধীরে বললো,
"আমার মনে হয়, যদি আমরা সাবের আসল পরিচয় জানতাম, তাহলে এমনটা থাকতো না। সবকিছু একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেলে হয়তো আর এতটা আপন মনে হতো না। আমার এও মনে হয়, যেদিন সাবের আসল পরিচয় জাইন্যা যামু, ওইদিন এই বাড়িতে আমার শেষ দিন হইবো। এজন্য আমি জানতে চাই না।"
একটু থেমে সে মৃদু হেসে বললো,
"আমি চিরকাল একটা ধোঁয়াশায় থাকতে চাই। সাবের সেবা করতে চাই। সাবকে আমার সন্তানের চোখে দেখতে চাই।"
অনন্যার ও হঠাৎ মনে হতে লাগলো, যদি সে সবটুকু জেনে যায় তাহলে হয়তো খুব খারাপ কিছু হবে। অনন্যা চিন্তা করতে করতে ধীর পায়ে রুমে ফিরে এল। লারার কথা এখনো কানে বাজছে। কিছু সত্য না জানাই ভালো। কিন্তু এই ‘না জানা’ অনুভূতিটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে।
পড়ার টেবিলে বসে বই খুললো সে। পৃষ্ঠাগুলোতে চোখ বুলালেও মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিল না। কৌশিক স্যারের কাছ থেকে কত কিছু শেখার ছিল! অথচ এখন তার দেখা পাওয়াই যেন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে গেছে। একই বাড়িতে থেকেও সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ক্লাসের মাঝের সামান্য কয়েক মুহূর্ত ছাড়া আর কোথাও মুখোমুখি হওয়া হয় না।
অনেকক্ষণ পর লারা এসে খেতে ডাকলো। ডাইনিং টেবিলে সবাই জড়ো হলো, কিন্তু কৌশিক স্যার ছিল না। নিকও নেই। অনন্যার বুকটা ভারী হয়ে গেল। খাবার গলা দিয়ে নামছিল না। কেমন এক শূন্যতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। মানুষ আছে, অথচ মনে হয় কিছু নেই, কেউ নেই! কৌশিক স্যার তো বলেছিল তার সাথে, তার পাশে থাকতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে ভালোবাসতে। তাহলে আবার কেনো দুরত্ব সৃষ্টি করতে চাওয়া?
অনন্যা ফোনটা বের করে আরো কয়েকবার কল দিলো, কিন্তু আগের মতোই বলা হচ্ছে, সংযোগ সম্ভব নয়। হতাশ অনুভব করলো অনন্যা। কেমন দম বন্ধ হতে শুরু করলো। স্যার কি তাহলে কোনো গুরুতর সমস্যায় পড়েছে?
চোখের সামনে কৌশিক স্যারের সাথে কাটানো প্রতিটা স্মৃতি ভাসতে লাগলো। কত সুন্দর ছিল না সময়গুলো? সুখী সময় খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় তাই না? জীবন আবার ঝরে পরা শীতের শুকনো পাতার মতো মনে করিয়ে দেয়,
তোমার স্বপ্নে আঁকা সুখ,
তোমার কল্পনায় গড়া হাসি,
সবই তো কেবল ভাবনার খেলা।
তুমি কি সত্যিই ভুলে গেছো?
তোমার পথচলা ছিল কাঁটায় ঢাকা,
তোমার আকাশ ছিল অন্ধকারে ঢাকা।
অনন্যা বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
কৌশিক গভীর রাতে ফিরেছে। দরজাটা ধীরে খুলে রান্নাঘরে ঢুকলো। নিঃশব্দে ডিনার সারলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে তার ফেরা, তার উপস্থিতি। নিজের রুমে যাবার আগে একবার অনন্যার রুমের দরজায় দাঁড়ায়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে, অনন্যার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া। টেবিলের ওপর খোলা বই, পাশে ফোনটা রাখা।
কৌশিক ধীরে নিচু হলো, আঙুল বুলিয়ে দিলো অনন্যার গালে। গরম শ্বাস পড়ছে মেয়েটার, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো কৌশিক, ঠোঁটের কোণে একটুকরো ম্লান হাসি ফুটে উঠলো।
কৌশিকের জীবন এক অদৃশ্য শিকলে বাঁধা। অনন্যা সেই আঁধারে এক টুকরো আলো! নরম, উষ্ণ, আশ্বাসবাণী হয়ে এসেছে। কিন্তু আলো কি অন্ধকারকে মুছে ফেলতে পারে? না, পারেনি। কখনো পারবেও না।
কৌশিক জানে, সে বদলাবে না। বরং দিন দিন আরও কঠিন হয়ে উঠবে, আরও ভয়ানক হবে। সময়ের আগেই সবকিছু ধসে পড়ছে, নিয়তিও তাকে টেনে নিচ্ছে এক অন্ধকার গহ্বরে। আর হয়তো, সবটাই তার নিজের ভুলের ফলাফল।
কৌশিক ধীরে ঝুঁকে অনন্যার শ্যামল গালে আলতো চুমু খেলো। নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে । অনন্যার গভীর ঘুমে ঢেকে থাকা প্রশান্ত মুখ, নিঃশ্বাসের ভারসাম্য আর আবছা চাঁদের আলোয় ঝলমলে চুলের আভা,সবকিছু এক শান্তির ঘেরাটোপ তৈরি করেছে। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে ফিরে গেলো কৌশিক। দরজা বন্ধ করেই নিঃশব্দে জামা খুললো। শুভ্র আলোর নিচে তার উন্মুক্ত শরীর দৃশ্যমান হয়েছে।
আয়নার সামনে দাঁড়াতেই কৌশিকের দৃষ্টি আটকে গেলো নিজের বাম বাহুর দিকে। শিরাগুলো উন্মোচিত হয়ে উঠেছে, বাহুর প্রতিটি ভাঁজে দাগ কেটে কেটে গভীর নীল রঙ ছড়িয়ে পড়েছে উপর পর্যন্ত, মনে হচ্ছে শরীরের ভেতর দিয়ে জ্বলছে চিকন নীল বাল্ব।
কৌশিক এক ধাপ সামনে এগিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব গভীরভাবে দেখলো, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো সবটা। শিরাগুলো ধকধক করছে, নীল আলো ক্ষীণভাবে স্পন্দিত হচ্ছে। তার ভেতরে কোনো শক্তি ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
কৌশিক পিছন ফিরে বিছানার পাশে নত হয়ে বসে পড়লো। শিরায় শিরায় হিমশীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে, বরফ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট আক্ষেপ। কিন্তু এই পরিণতি অনিবার্য ছিল, সৃষ্টির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউই মুক্ত থাকতে পারে না।
বহুদূরের এক বিলুপ্ত দেশে একটানা বয়ে চলেছে ল্যুমিস নদী যা লোককথায় জাদুকরী নদী বলে পরিচিত। তার স্বচ্ছ পানিতে প্রতিফলিত হয় আকাশের রং, প্রতিটি তরঙ্গে বহমান থাকে এক রহস্যময় শক্তি। বিশ্বাস করা হয়, নদীর গভীরে লুকিয়ে আছে প্রাচীন এক সত্তার আশীর্বাদ, যা একসময় বায়ু, বজ্রপাত আর আকাশের শক্তির সঙ্গে মিলেমিশে জন্ম দিয়েছিল এক অতুলনীয় সৃষ্টির। সেই সৃষ্টির ক্ষমতা সীমাহীন। অমরত্ব দান করা থেকে শুরু করে প্রকৃতির গতিপথ পরিবর্তন করা পর্যন্ত। বায়ু থামিয়ে দেওয়া, আকাশ থেকে বজ্র ডাকিয়ে আনা, বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করা!
কৌশিকের শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় সেই শক্তির প্রবাহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাবে বয়ে চলছে। একসময় এই শক্তির জোরেই সে এক বার অনন্যাকে মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। নিজের অস্তিত্বের একটি অংশ বিলিয়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু এই আত্মত্যাগের মূল্য দিতে হয়েছিল তাকেও। নিজের ভেতর কিছু হারিয়ে যেতে দেখেছে, অনুভব করেছে শূন্যতা। শরীরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া অনুভব করেছিল কৌশিক। সেই জ্বালাপোড়া সামলাতে এক দম্পতির প্রাণ নিতে হয়েছিল।
কিন্তু তারপরও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি কৌশিক।নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে সে আবার ফিরে গিয়েছিল ল্যুমিস নদীর কাছে। নদী তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল পূর্বের রূপ, শরীরে ফিরেছিল শক্তি, আত্মায় এসেছিল স্থিরতা। কিন্তু নদী শুধু ফিরিয়ে দেয় না, সে ভবিষ্যৎও দেখায়।একটি আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস রেখে দিয়েছিল কৌশিকের জন্য।
এখন, আয়নার সামনে বসে নিজের শিরায় বয়ে চলা সেই নীল আভা দেখে কৌশিক বুঝতে পারছে। ইতিমধ্যে ঝড়ের সূত্রপাত শুরু হয়ে গেছে। তার নিজের প্রতি হেয়ালিপনা, অনন্যার জন্য অনুভব করা সবকিছুই ধীরে ধীরে তাকে এক অনিবার্য পতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নিক সেদিন ভুল বলেনি। কৌশিক আর সেই পূর্বের কৌশিক নেই, যে একসময় ভালো মন্দের সীমারেখা বুঝতো। এখন সে একজন শিকারি, প্রতিদিন মানুষ হ/ত্যা করছে, তাদের শরীরের শক্তি শুষে নিচ্ছে, অথচ নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না।
আয়নার প্রতিচ্ছবিতে হঠাৎ দৃশ্যমান হয়, কৌশিকের চারপাশে অসংখ্য কালো ছায়া ঘুরছে। কালো ছায়াগুলো ক্ষুধার্ত, উন্মত্ত, তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে চায়।সেই মানুষগুলোর কালো ছায়া যাদেরকে কৌশিক শেষ করে দিয়েছে, তারাই চারপাশে ঘুরে ঘুরে কৌশিককে খুবলে খেতে চাইছে।
******
সকাল সকাল অনন্যা কৌশিকের দরজায় অনবরত কড়া নাড়ছে। স্যার অনেক দেরিতে বাড়ি ফিরেছে নিশ্চয়ই। কৌতূহল আর উদ্বেগে অনন্যার মন ছটফট করছে, অথচ একদিকে তাকে ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছা করছে না। তবুও, মনে হচ্ছে কথা বলা দরকার। কিছু সময় পর অনন্যা সাড়া না পেয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। আর সহ্য করতে না পেরে দরজায় এক জোরালো লাত্থি দিয়ে চিৎকার করে বললো,
"এই বড় ইঁদুর! দরজা খুলুন! কি হয়েছে আপনার?"
কৌশিক তবুও দরজা খুললো না। এর পর নিজের বাহু দিয়ে দরজাটা ঠেলে খোলার চেষ্টা করলো অনন্যা। ক্লান্তি নিয়ে সে আবার বললো,
"প্রিন্স! দরজাটা খুলুন প্লিজ! আপনাকে খুব মিস করছি।"
কৌশিক কিছু সময় নিয়ে দরজা খুললো। অনন্যা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো। কালো রঙের পোশাক পরিহিত কৌশিকের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। স্যারের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। চোখগুলো আগের তুলনায় ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে, গভীর মায়া জড়িয়ে আছে চোখ দুটোতে। অনন্যা কতক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকলো। কৌশিক ও আঁখি সরায়নি। অনন্যার সাথে তাল মিলিয়ে সেও চোখ মেলে ধরেছে, নিজের মনে অনুভূতি জাগানো মেয়েটিকে আবারো সূক্ষ্মভাবে দেখে নিচ্ছে। হঠাৎ অনন্যার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
"আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই না?"
কৌশিক চমকে উঠলো, হৃৎপিণ্ডে ধ্বক করে একটা আওয়াজ হলো। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো সে। অনন্যা আবারো বললো,
"আপনি তিনটে গোলাপ দিয়েছেন। এর অর্থ আপনি জানেন, আপনি আমাকে ভালোবাসেন।"
"না! ভালোবাসা শব্দটা আমার জীবনে নেই। আমি তিনটে গোলাপের অর্থ বলেছিলাম তোমাকে।"
কৌশিক চোখ ফিরিয়ে নিলো।
"কিন্তু!"
"অনন্যা শিকদার! ক্লাস আছে যাও। পরে কথা হবে।"
অনন্যা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
"পরে কখন কথা হবে? আপনি আমাকে সময় দিচ্ছেন না। আপনি বলেছিলেন আমরা স্বামী-স্ত্রী।"
"আমার ভালো লাগছে না, শরীর ক্লান্ত। বিশ্রাম নেবো। দুপুরে ক্লাস আছে। তুমি চলে যাও। আমি পরে যাবো।"
অনন্যা ক্ষুব্ধ হয়ে কৌশিক স্যারকে ধাক্কা দিতে দিতে বিছানায় বসিয়ে দিল। স্যারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে অনন্যা তার মুখ তুলে নিজের দিকে স্থির করলো। গালে হাত রেখে নরম গলায় বললো,
"আপনার কি হয়েছে? আমাকে বলুন। কষ্ট শেয়ার করতে হয়, স্যার।"
কৌশিকের নির্লিপ্ত উত্তর,
"কিছু হয়নি।"
"হয়েছে! আপনি আমাকে ডাকছেন না কেন? আমি আপনাকে খুব মিস করছি। "
কৌশিক কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। অনন্যা ধীরে ধীরে তার মুখটা কৌশিকের কাছে এগিয়ে আনলো, আর হঠাৎ করেই কৌশিক টেনে নিলো অনন্যাকে। এক মুহূর্তে তাকে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো। দুই হাত দিয়ে জাপটে ধরে অনন্যার বুকে আস্তে করে মাথা রেখে দিলো। অনন্যা কিছু সময়ের জন্য থমকে গেছে। তারপর স্যারের মাথায় নিজের হাত রেখে খুব আস্তে আস্তে বিলি কেটে দিতে লাগলো। অনন্যা বুঝতে পারলো না স্যারের কি হয়েছে। কিন্তু কোনো একটা অসুখে ভুগছে সে। বিষয়টা ভাবতেই অনন্যার হৃদয়ে চিনচিনে ব্যথা আরম্ভ হয়েছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি হয়েছে স্যারের। সে কি পারে না স্যারের সব অসুখ সারিয়ে দিতে?
কৌশিক হঠাৎ করেই আরও শক্ত করে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরলো। তার শ্বাস ভারী হয়ে উঠলো, গলা কাঁপছে। স্যারের ঠোঁট অনন্যার কানের কাছে গিয়ে স্পর্শ করলো, ফিসফিসিয়ে বললো,
"প্রিন্সেস, ইউ আর রাইট। প্রিন্স লাভস ইউ!"
অনন্যার বিলি কেটে দেওয়া হাতটা হঠাৎ থেমে গেলো, তার চক্ষু যুগল বড় হলো। কৌশিকের কণ্ঠস্বর, তার ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়া অনন্যার হৃৎপিণ্ডে তিনটে লাল গোলাপ ফুটিয়ে দিয়ে গেলো। অনন্যা স্তম্ভিত হলো, শরীর জুড়ে অজানা শিহরণ বয়ে গেল। তার হৃৎপিণ্ড হঠাৎ অবাধ্য হয়ে উঠলো, খুব জোরে স্যারের নাম নিয়ে ডাকতে লাগল। অনন্যার হাত কৌশিক স্যারের গালে গিয়ে থামলো।
হঠাৎ এমন আচরণের মানে বুঝলো না অনন্যা। তাহলে অনন্যাও কী কৌশিক স্যারের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়লো?
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন কয়েক মিনিট পার হতেই হঠাৎ কৌশিক অনন্যাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো। তার হাত টেনে ধরে দরজার বাহিরে বের করে দিল। অনন্যা কয়েকবার দরজা খুলতে বললো। কিন্তু খুললো না কৌশিক। অনন্যা বিস্মিত হলো, মনোক্ষুণ্ন হলো সে। কিন্তু কৌশিক স্যার কেনো হঠাৎ এমন করে উঠলো বুঝতে পারলো না।
******
আরণ্যক আজ এক সপ্তাহ পর বিশ্ববিদ্যালয় পা রেখেছে। বাসায় সবার জ্বালাতনে ভার্সিটিতে কি নিজের বাড়ির সীমানাও পার করতে পারেনি এই কদিন। চারপাশে পরিচিত পরিবেশ, পরিচিত মুখ, কিন্তু তার নজর খুঁজছে একজনকেই। সবাই হাই, হ্যালো দিয়ে যাচ্ছে। কেউ তার খবরাখবর জিজ্ঞেস করছে। আরণ্যক সকলের সাথে অল্প কথায় ই কাজ মিটিয়ে ফেলছে।
ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে এখন, হাতে একটা চকলেট জুস। এই জুস অনন্যা পছন্দ করে, অনেক পছন্দ। সে জানে, যেখানেই থাকুক, এই জুস দেখলেই অনন্যা খুশি হবে।
পা উঁচিয়ে, চোখ বড় বড় করে চারদিকে তাকাচ্ছে আরণ্যক। এক হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো ঠিক করে নিলো। অসুস্থ থাকায় চেহারার পুরোনো সেই জ্যোতি হারিয়ে গেছে। এটা আরণ্যক একা নয়, সবাই বলছে।
কিন্তু কোথায় গেল মেয়েটা? এখনো আসছে না কেনো? আজকের রুটিনে ওদের তো এরপরে ক্লাস থাকার ও কথা না!
অস্থির হয়ে একটু ঘুরে দাঁড়ালো আরণ্যক। আর তখনই অনন্যাকে দেখা গেলো মুখে চিন্তা নিয়ে হেঁটে আসতে। আরণ্যক দ্রুত এগিয়ে গেলো ওর কাছে। চোখের সামনে বাড়িয়ে দিল চকলেট জুস। অনন্যা ভ্রু কুঁচকে পাশে চোখ ফেরালো, দেখা গেলো আরণ্যকের ফুরফুরে হাসি।
আরণ্যক বললো,
"স্যরি, অনু।"
অনন্যা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। আরণ্যক অনন্যার হাত ধরে মুঠোয় জুস ধরিয়ে দিলো।
.
.
.
চলবে.......................................................................