"স্যরি"
"হুমম!"
"সত্যি স্যরিইইই, শিকদার!"
"বুঝছি তো। কতবার বলবেন?"
"যতবার ভিতরে শান্তি না পাচ্ছি।"
"স্যরি শব্দটা এতবার শোনার পর আর জীবনে কারো কাছ থেকে শুনতে ভালো লাগবে না মনে হচ্ছে।"
"ঠিক আছে। সারা জীবন আমার থেকেই শুনতে থাকো তাহলে।"
অনন্যা ফিক করে হেসে উঠলো। কৌশিক উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছে ধীরে ধীরে, দীর্ঘ ক্লান্তির পরে সোফার পাশে মেঝেতে বিশ্রাম নিয়েছে দুজনে। কৌশিকের বাঁ হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে অনন্যাকে।
কৌশিক তার ঠান্ডা উন্মুক্ত শরীর নিয়েই পাশ ফিরলো। অনন্যার মাথা তার বাহুর আশ্রয়ে, ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। অনন্যার নরম গালে হাত রাখতেই, হঠাৎ চিৎকার মেরে ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো অনন্যা!
কৌশিক চোখ কুঁচকে তাকালো, ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
"কী? কী হলো?"
"আপনি একটা বরফের খাম্বা। মনে হচ্ছে বরফের একটা খণ্ডের মধ্যে মাথা গুঁজে রেখেছি।"
কৌশিক আরো গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকলো। হাতটা গাল থেকে সরলো না, বরং আরো আলতো হলো তার ছোঁয়া। সামনের এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো সে। তারপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ওষ্ঠ ছুঁইলো অনন্যার ওষ্ঠের ক্ষতের ওপর। হালকা, ঠান্ডা আলতো ছোঁয়ায় ভরপুর একটা চুমু। অনন্যার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কৌশিকের দিকে। কিন্তু কৌশিক থামলো না, ধীরে ধীরে গলার কাছে নামলো। লালচে দাগগুলোতে আবারও স্পর্শ করলো তার শুষ্ক গোলাপী ঠোঁট, মনে হলো তার আদরেই ক্ষতগুলো ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাবে।
অনন্যা স্তব্ধ হয়ে রইলো, গলার স্বর মৃদু ফিসফিসিয়ে বেরিয়ে এলো,
"একটু আগেই তো মেডিসিন দিলেন।"
কৌশিক তার উন্মুক্ত গলায় গরম সরম শ্বাস ফেলে বললো, "স্যরি, প্রিন্সেস! ব্যথা করছে এখনো?"
"ব্যথা কম!"
কৌশিক অনন্যার গলায় মুখ গুজে ফেললো। শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেলো অনন্যার। স্যারের চুল আঁকড়ে ধরলো সে। কিন্তু কৌশিক আর কিছু করলো না। শুধু ধীরে ধীরে অনন্যার বক্ষস্থলে নেমে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো।
অনন্যাও সাদা টাইলসের মেঝেতে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকলো। শরীরের ঠান্ডা ভাব ধীরে ধীরে কমে আসছে। স্যারের শরীর উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। অনন্যা স্যারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
কৌশিক অনন্যার বক্ষস্থলে মাথা রাখা অবস্থায়ই নিজের হাত অনন্যার পোশাকের নিচে উন্মুক্ত পেটে স্পর্শ করল, শীতল স্পর্শে নিজের সমস্ত দাবিটুকু রেখে দিলো,
"অন্য কোনো পুরুষের জন্য আর কখনো কষ্ট পাবে না, প্রিন্সেস।"
অনন্যা চুপচাপ স্যারের চুলে আঙুল চালালো, ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু হাসলো, "ঠিক আছে।"
কিয়ৎক্ষণ পর কৌশিকের ঠান্ডা, শুষ্ক ওষ্ঠ পোশাকের ওপরেই অনন্যার বক্ষস্থলে ছোঁয়া দিয়ে গেলো। এরপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে আনলো, গালের ওপর একখানি নরম চুম্বন রেখে আরও কাছে এগিয়ে এলো। দুজনের মধ্যে দূরত্ব এক বিন্দু পরিমাণ। কৌশিকের গরম নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছে অনন্যার ঠোঁটে, ক্রমাগতভাবে ভারী করে তুলছে পরিবেশ।
কৌশিক ফিসফিস করে বললো,
"তোমার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রুও যদি পড়ে সেটা আমার জন্য হোক, সহ্য করে নেবো।
কিন্তু অপর পুরুষের জন্য তোমার চোখের অশ্রুকণা, আমার শরীরে বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার সমান।"
অনন্যা চোখ পিটপিট করে তাকালো। তারপর আচমকা স্যারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কৌশিক ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো, তারপর অনন্যার পাশে শুয়ে নিজের মাথার নিচে হাত রেখে পাশে তাকিয়ে বললো,
"আবার কী?"
অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে থাকলো, তারপর হঠাৎ উঠে স্যারের কোমরে চেপে বসলো। কৌশিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো, মেয়েটার আচরণ একেবারে অপ্রত্যাশিত।
অনন্যার আঙুল কৌশিকের বুকের ওপর চেপে বসলো, সে দ্রুতগতিতে উচ্চারণ করলো,
"আজকে আবারো মেরে ফেলতেন আমাকে! রিডো ছিলো বলে নাহলে তো...!"
রিডো ঘরের এক কোণে বসে সম্মতি জানাতে জোরে গর্জন করলো। অনন্যা রিডোর গর্জন শুনে হেসে ফেললো, ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ মিশিয়ে বললো,
"দেখলেন? ওই নিরীহ প্রাণীটাও বোঝে আপনি কী করতে যাচ্ছিলেন! হুহ! লেটস ডাই টুগেদার? আহা, আসছে!"
কৌশিক দ্রুত উঠে বসল, অনন্যা তার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলো। দুজনের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটা মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেল। কৌশিক সামান্য ঝুঁকে অনন্যার গালে হাত রাখলো, তার শক্তপোক্ত আঙুলের স্পর্শে মেয়েটার ত্বক হালকা শিহরিত হলো।
গভীর দৃষ্টি স্থাপন করে বললো,
"হুম, ভুল কি বলেছি? কিছুই তো করলাম না।"
অনন্যার চোখ দুটো কিছুক্ষণ স্যারের মাঝে হারিয়ে গেলো। কিন্তু হঠাৎই সম্বিত ফিরে পেতেই সে কৌশিকের বুকে জোরে এক ধাক্কা দিলো।
"ধ্যাত! কী বেশরম! আমার শরীরের দিকে তাকান তো, কী অবস্থা করেছেন! আমি কিছু করেছি আপনাকে? আমাকে বিধ্বস্ত করে এখন কী সুন্দর নির্দোষ মুখ নিয়ে বসে আছেন!"
কৌশিক চোখ আধবোজা করে হাসলো, তারপর দু'হাত মেলে ধরলো। নেশাময় কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
"করো, যা মন চায় করো। আই এম অল ইউরস, প্রিন্সেস।"
স্যারের কণ্ঠের গভীরতায়, সেই চ্যালেঞ্জিং আকাশি দৃষ্টিতে, অনন্যার শ্বাস একটু থমকে গেল। সে মাথায় হাত চেপে ধরলো। কৌশিক ফিচেল হাসি হেসে অনন্যার দুই গাল চেপে ধরে বললো,
"অওও! লজ্জা পেয়েছো? দেখি মুখটা দেখি একটু!"
অনন্যা বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে চাইলো, কিন্তু কৌশিক ততক্ষণে তার কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলেছে। মেয়েটা বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই কৌশিক হালকা হেসে তার কানের লতিতে নরম কামড় বসিয়ে দিলো। অনন্যা নিজেকে সামলাতে স্যারের পিঠ খামচে ধরলো, হালকা ঢোক গিললো।
কৌশিক মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বললো,
"হেই, প্রিন্সেস! আই এম ডায়িং! ইউ আর কিলিং মি!"
কৌশিকের কণ্ঠে একধরনের নেশা ছড়াচ্ছিল। সেই নেশাময় কণ্ঠ অনন্যার শরীরে মিশে রীতিমতো সেখানেও নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিলো।
অনন্যা হতচকিত হয়ে তাকাতেই কৌশিক তাকে আরো কাছে টেনে নিলো। এক ঝটকায় মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরে আবারো সটান শুয়ে পড়লো মেঝেতে।
********
"এই রাত করে আপনি সাইকেলিং করতে চাইছেন?" অনন্যা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
কৌশিক অনন্যার মাথায় একটা স্কার্ফ সুন্দর করে পেঁচিয়ে দিলো, তারপর মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হুম! রাতের সময় রাস্তা শূণ্য থাকে। অন্ধকার আকাশের নিচে সাইকেল চালাতে অনেক বেশি ভালো লাগবে।"
অনন্যা মুখ ফুলিয়ে রাখলো। কৌশিক অনন্যার গাল টেনে হাসিমুখে তাকিয়ে আবারো বললো,
"এমন মুখ করে লাভ নেই। আমি অনেক স্ট্রিক্ট প্রফেসর। কেউ কিছু শিখতে চাইলে না শিখিয়ে দম নেই না। তাই, মানিয়ে চলো।"
কথা শেষ করে কৌশিক অনন্যার হাতের কব্জি ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। দুজনেই গ্যারেজ থেকে সাইকেল বের করে সরু রাস্তা ধরে জঙ্গলের নিচে রাস্তায় নেমে গেলো। অনন্যাকে সাইকেলে উপরে বসাতে গিয়ে দেখা গেলো তার পা নিচে পৌঁছাচ্ছে না। অনন্যা হাসিমুখে বললো,
"এই সাইকেল আমার জন্য নয়, স্যার।"
কৌশিক তার দিকে তাকিয়ে বললো,
"হুম! এই সাইকেল বৃদ্ধদের জন্য নয়।"
অনন্যা চোখমুখ কুঁচকে বললো,
"এই কি বললেন? বৃদ্ধ কে?"
কৌশিক এক চমৎকার হাসি দিয়ে বললো,
"তুমি! আর কে হতে পারে?"
"হ্যাঁ??"
"হুম,পরিশ্রম করতে চাও না। বৃদ্ধ নয় তো কী!"
অনন্যা হঠাৎ কৌশিককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কৌশিক এক পা পিছিয়ে গেলো, মজা করতে করতে অনন্যাকে প্রলুব্ধ করলো। অনন্যা দ্রুত সাইকেল চালানোর চেষ্টা করলো, কিছু সময় ধরে এলোমেলোভাবে সাইকেল চালাতে লাগলো সে। কৌশিক টেনশনে সাইকেলের পিছু দৌড়াচ্ছে। তারপর একসময় ব্যালেন্স হারিয়ে অনন্যা ধপাস করে নিচে পড়ে গেলো।
কৌশিক ছুটে গিয়ে অনন্যার পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। তাকে সাহায্য করতে গেলে অনন্যা হাত সরিয়ে জোরে বললো,
"আমি পারবো।"
কৌশিক হাসতে হাসতে বললো,
"আরে শিকদার, মজা করছিলাম তো। বসার জায়গাটা নিচে নামালেই তো সব ঠিক হয়ে যেতো।"
"হু! সুন্দরীদের কাছে যান, আমি তো বৃদ্ধ মহিলা!"
কৌশিক হেসে অনন্যাকে তুলতে সাহায্য করলো।গলা নামিয়ে বললো,
"তোমাকে আগে শেষ করে নেই, তারপর সুন্দরীদের কাছে যাবো।"
কৌশিকের এহেন কথায় অনন্যার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। সে কিছু বলার আগেই কৌশিক সাইকেলটি উঠিয়ে অনন্যার কোমড় ধরে সামনের সিটের আগের অংশে বসিয়ে, নিজে সিটে বসে বললো,
"প্রথমেই তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। ধীরে ধীরে পা চালাতে হয়। বেশি বেশি প্র্যাকটিস করলে দেখবে, দুই দিনেই শিখে যাবে।"
অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নাড়ালো। কৌশিক আরও একটু কাছে এগিয়ে এসে বললো,
"আমার হাতে এক হাত রাখো। তাহলে পড়বে না।"
অনন্যা তার কথা মেনে কৌশিকের হাত ধরলো, আর সাইকেলের হ্যান্ডেলগুলো ভালোভাবে ধরে রাখলো। কৌশিক প্যাডেল চালাতে চালাতে সাইকেলটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলো। অনন্যা তার চালানো পরখ করছিলো। ফুরফুরে বাতাসে মনটা ভালো করে দিচ্ছিলো।
রাতের নরম হাওয়া দুজনের গায়ে নিঃশব্দে মাখামাখি খেলছিল, দুজনের মনটা একে অপরে সীমাবদ্ধ করে যাচ্ছিলো। চারপাশ নিস্তব্ধ রাস্তা, মাঝে মাঝে হুট করে পাশ দিয়ে চলে যায় বিশাল মালবাহী ট্রাক, আবার হঠাৎ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসতে থাকে দূর দূরান্ত থেকে। সরু কাঁচা রাস্তার দু'পাশে ঘন সবুজ গাছের সারিরা চোখ পাকিয়ে দুজনকে চুপটি করে দেখে নেয়, পাতার ফাঁক গলে চাঁদের সাদা আলো পড়ে মাটিতে সোনালি ছাপ ফেলে দেয়। সাইকেলের টায়ারের নিচে খসখসে শুকনো পাতার মৃদু শব্দ কানে ভাসতে থাকে।
সামনের দিকে ধীর গতিতে এগিয়ে যায় তারা। ফুরফুরে বাতাস চুলে আলতো খেলা করতে থাকে, কৌশিকের সামনের চুলগুলো উল্টো পথে উড়তে থাকে, দৃশ্যমান হয় তার স্নিগ্ধ ললাট, সৌন্দর্যের এক নাম নিয়ে বয়ে বেড়ায় দুজনে, রাতের আকাশের নিচে। সমগ্র মহাবিশ্ব ও হয়তো জেনে যায় বহুকাল আগে যে পুরুষটি এক নারীকে ধোঁকা দিয়ে এক অমৃত শক্তির অধিকারী হয়ে গিয়েছিল, সেই নারীর এক অনন্য রূপে আসক্ত হয়ে পড়েছে আজ।
বাতাসের শীতল পরশ শরীরে ছড়িয়ে দেয় এক নিশ্চুপ প্রশান্তি। অনন্যার চোখ আকাশের দিকে চলে যায়, যে আকাশে অসংখ্য ছোট ছোট তারার ঝলকানি মিলেমিশে তৈরি করে এক অলৌকিক দৃশ্য।
"ওয়াও! আজকের আকাশটা অসাধারণ!"
অনন্যার কণ্ঠে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে রেখে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে, সেই নীল বিস্তৃতির গভীরতা মাঝে হারিয়ে গেছে হঠাৎ।
কৌশিক সাইকেলের গতি একটু কমিয়ে অনন্যার দৃষ্টি অনুসরণ করে উপরে তাকালো, তারপর হুট করে বলে উঠলো,
"আজকে আমার জন্মদিন!"
অনন্যা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বললো,
"সত্যি?"
কৌশিক একমুহূর্ত থেমে মাঝরাস্তায় সাইকেল দাঁড় করালো। আকাশের দিকে ইশারা করে বললো,
"ওই যে, দুটো তারা পাশাপাশি জ্বলজ্বল করছে, দেখতে পাচ্ছো?"
অনন্যা সাইকেল থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকালো। চাঁদের ম্লান আলোয় তারা দুটো আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
"মায়ামী বলেছিলো, বছরে একবার এমন দুটো তারা পাশাপাশি আসে। আর ঠিক সেদিনটাই আমার জন্মদিন ঘোষণা করা হয়!"
কৌশিকের কণ্ঠ ধরা ধরা, পুরোনো কথা মনে পড়ে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আছে ঠিক তারা দ্বয়ের শ্বেত আলোটার মতো।
অনন্যা কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে, তারপর প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে বললো,
"ওওও! কিন্তু এই মায়ামীটা কে?"
কৌশিক ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বললো,
"আমার মা! মাকে আমার মাতৃভাষায় মায়ামী বলা হয়।"
অনন্যা বিস্মিত হয়ে উঠলো,
"বাহ! বাবাকে কী বলেন আপনি?"
"আরবান!"
"আর স্ত্রীকে?"
"আবেলা!"
অনন্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কৌশিক মৃদু হেসে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে নেমে বললো,
"আমি যাই উচ্চারণ করি তোমার কাছে বোধগম্য হবে না। অন্য ভাষায় কিছু বললে তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে না? এটা তেমনি।"
"হওও! এটা কোন ভাষা স্যার?"
কৌশিক হেসে বললো,
"খুঁজে বের করো।"
অনন্যা ঠোঁট উল্টে ফেললো। তারপর আচমকা বললো,
"চোখ বন্ধ করুন। আপনার বার্থডে কাউন্ট ডাউন করি। যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাও!"
"কিন্তু..."
অনন্যা স্যারের দুই গালে হাত রেখে আবেগী কণ্ঠে বললো,
"প্রিন্স! আমরা সুখময় সময় চাইলেই নিজের হাতের মুঠোয় নিতে পারি। যখন থেকে বলবো আমি সুখে আছি, ঠিক তখনই আমাদের সুখ শুরু হবে। তো চলুন শুরু করি। আমাদের দুজনের একসাথে পথ চলা এখান থেকেই নাহয় শুরু হোক!"
কৌশিক উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলো। অনন্যা পেছনে হাঁটতে হাঁটতে 'দশ, নয়,আট,...!'এভাবে ধীরে ধীরে গুনতে লাগলো। এক আসার আগে কিছুটা সময় নিলো অনন্যা। তারপর আবারো স্যারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে 'এক' উচ্চারণ করলো। উচ্চারণ করতেই কৌশিক ধীরে ধীরে চোখ খুললো। চোখের সামনে ঠিক তখনই ধরা দিলো অনন্যার মুখ। ল্যাম্পপোস্টের নরম সোনালি আলো তার মুখের উপর ঝরে পড়ছে। গভীর চোখ দুটো এক অনন্ত সাগর। চোখের ভাষায় ডুবে যাচ্ছে কৌশিক।
কৌশিক অস্ফুট স্বরে বলল,
"আমার বউ!"
খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো অনন্যা। এক হাত দিয়ে মুখে হাত চেপে ধরে বললো,
"আপনার কণ্ঠে কেমন শোনাচ্ছিলো। বিদেশি একসেন্ট ব্যবহার করলেন কেনো?"
কৌশিক ঠোঁট উল্টে বললো,
"হয়ে গেছে। কিন্তু 'বউ' শব্দটা আজ আমি নতুন শিখেছি।"
অনন্যা বিস্তৃত হেসে বললো,
"ওয়াও!"
"আমার বউ!"
অনন্যা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে উচ্চারণ করলো,
"হ্যাপি বার্থডে, প্রিন্স!"
কৌশিক বার কয়েক পলক ফেলে অনন্যার হাতের দিকে তাকালো। অনন্যার হাতে এক গুচ্ছ ঘাস! কৌশিক ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো। হাত বাড়িয়ে ঘাসগুলো হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। অনন্যা বললো,
"আশেপাশে ফুল থাকলে আপনাকে ফুল উপহার দিতাম।"
"ইটস ওকে! তুমি আছো এটাই যথেষ্ট।"
অনন্যা হতচকিত হলো। মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে থাকলো স্যারের দিকে। কৌশিক হঠাৎ কি করলে কে জানে! তার হাতে ধরে রাখা সবুজ ঘাসের উপর ছোট ছোট জোনাকি পোকারা এসে বসতে লাগলো। নরম আলোয় তারা টিমটিম করে জ্বলছে, রাতের আঁধারে ছোট ছোট তারার ঝিকিমিকি। অনন্যা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো, তার চোখের গভীরে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো।
রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ ডানা ঝাপটার শব্দ ভেসে এলো। অনন্যা উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দুজনের মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক রাত পাখি গোল গোল করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো, তাদের ডানা বাতাস কেটে এক অদৃশ্য মিউজিক সৃষ্টি করছে। কিচিরমিচির শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিলো চারদিকে।
কৌশিক মুচকি হেসে অনন্যার বিস্ময়কর মুখশ্রী দেখছিলো। তারপর মেয়েটার চিবুক আলতো হাতে ধরে তার মুখটা ঘুরিয়ে দিলো। অনন্যার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো উঁচু নিচু গাছের পাতার ফাঁকে বসে থাকা হলুদ-কমলা চোখের পেঁচাগুলোর দিকে। প্রথমে তারা অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে ছিলো, কিন্তু মুহূর্ত পরেই তাদের চোখের বিন্যাস বদলে গেলো। ছোট বড় মণিরা একত্রে মিলেমিশে ইংরেজি বর্ণমালা গড়ে তুলতে শুরু করলো।
শেষ ফলাফল এসে থামলো,
THANKS PRINCESS
অনন্যার নিঃশ্বাস আটকে এলো। তার হৃদস্পন্দন খুব জোরে হতে লাগলো। এমন আশ্চর্যজনক দৃশ্য সে জীবনের প্রথমবার দেখলো।
পেছন থেকে কুকুরের মধুর ডাক ভেসে এলো, দূর থেকে বাঘের গর্জন কানে পৌছুলো জোরালো ভাবে। পুরো জঙ্গল জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাদের মুহূর্তের সাক্ষী হতে।
"স্যার! কক..কী হচ্ছে এসব?"
অনন্যার কণ্ঠ চাপা বিস্ময়ে কেঁপে উঠলো।
কৌশিক সাইকেলের নেটে জোনাকি পোকার আলো জ্বলজ্বল করা ঘাসগুলো রাখলো। সেই আলো নিঃশব্দে মিশে যেতে লাগলো রাতের নরম বাতাসে।
কৌশিক কাছে এগিয়ে অনন্যার গলায় তার শীতল হাত রেখে বললো,
"আমি খুব খুশি হয়েছি।"
"হা?"
"এটা আমার ধন্যবাদ জানানোর স্টাইল!"
অনন্যা বিস্ময়ে অভিভূত হলো। রাতের পাখিরা তাদের সুরেলা কণ্ঠে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো। দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, নিকটবর্তী গাছের পাতার মৃদু ফিসফিসানি, মিলেমিশে একাকার হয়ে গানে মত্ত হয়েছে।
কৌশিক উচ্চারণ করলো,
"তোমাকে বিয়ে করার জন্য একদিন আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলে। মনে আছে?"
অনন্যা মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়লো, একদিন সন্ধ্যায় ভার্সিটির মাঠে হুট করে কৌশিক স্যারের গলা জড়িয়ে ধরে অনন্যা বলেছিল,
"ধন্যবাদ! ধন্যবাদ সেদিন আমাকে বিয়ে করার জন্য। ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য।"
অনন্যা ঘটনাটি মনে করে মাথা নাড়লো। কৌশিক অনন্যার দিকে আরও একটু কাছে এগিয়ে এসে, সিলভার রঙের প্লাটিনামের আংটি পরিহিত বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে তার গাল বুলিয়ে বললো,
"আজ আমি তোমাকে বলছি। ধন্যবাদ আমাকে বিয়ে করার জন্য। ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য।"
.
.
.
চলবে.........................................................................