বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের পুরোনো ক্রিকেট ম্যাচ হলেও ড্রইংরুমে বসা সবার আগ্রহই অনেকটা নতুন, স্পষ্ট, উত্তেজনাপূর্ণ। মেজো চাচা তালহা ভূইঁয়া বাজারে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন। মাঝপথে বাংলাদেশের পরপর দুটো ছক্কা দেখে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। রঞ্জনের পাশে বসলেন। অনাদরে হাতের বাজারের ব্যাগটা অতি তুচ্ছভাবে পরে রইলো সোফার পায়ের কাছটায়। কণ্ঠে বিস্ময় চুইয়ে চুইয়ে তিনি বললেন, “কি শর্ট মারলো রে রঞ্জন! খেলাটা আমি আগেও দেখেছি। এ খেলায় বাংলাদেশ জিতবে না রে। তবুও যে মারাত্বক খেলে!”
রঞ্জনের মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। বিরক্ত কণ্ঠে শুধাল, “তোমারে স্পয়লার কে দিতে বলছে চাচা? এইটা কেমন কথা?”
“চুপ থাকো তুমি। চাচার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে?”
“তুমি না বাজারে যাবা? যাচ্ছো না কেন?”
“যাবো। খেলাটা দেখে নেই।”
মানুষী তখন ধুতরাকে মেহেদী লাগাতে ব্যস্ত। পাশে মিতা আর প্রান্ত বসা। বাম হাতের পিঠে কিসব নতুন নতুন ফুলের ডিজাইন দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে প্রান্তর। ড্যাবড্যাব চোখে মানুষীর মেহেদী লাগানো দেখতে দেখতেই বলল, “তুমি বাজারে গেলে আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবা, আব্বু।”
মিতা বলল, “আমিও খাবো। আমার জন্যও আনিও।”
কৃষ্ণ পাটি ছেড়ে রঞ্জনের পাশে গিয়ে বসল। সে ভেবেছিল দু'হাতের তালুতে মেহেদী দিয়ে একটা ফুল আঁকবে। বড় ভাই যেহেতু লাগাচ্ছে না সেজন্য আপাতত মেহেদী লাগানোর চিন্তাটা বাদ দিলো। টেবিলে আপেল কেটে রাখা। সেখান থেকেই একটা টুকরো মুখে পুরে বলল, “তাইলে আমরা কি দোষ করছি, চাচা? আমগো সবার লাইগাও আনতে হইবো।”
রঞ্জন যেন বিরক্ত হলো কৃষ্ণর কথায়। এ ছেলে এত সরল! বুদ্ধীর ছিঁটেফোঁটা নেই। এই ধামরা বয়সে চাচার থেকে কিনা চকলেট খাবে, ছে:! কনুই দিয়ে একটু জোড়েই কৃষ্ণর পেটে খোঁচা মারলো রঞ্জন। কৃষ্ণ ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলেও বিশেষ পাত্তা দিলো না। তালহা ভূঁইয়াকে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার চকলেট-টকলেট লাগবে না, চাচা। বুইড়া হয়ে গেছি। এসব মুখে রুচে না। তুমি বরং কচকচে দুইটা এক'শ টাকার নোট দিয়ে দাও। তোমার লম্বা আয়ুর জন্য দোয়া করে দিবোনে।”
পরপরই মোনাজাত ধরে বলল, “ইয়া আল্লাহ্, আমার চাচাকে তুমি লম্বা আয়ু দাও। এ জীবনে তিনি তেমন কিছু করতে না পারলেও গিনিসবুকে যেন বয়স নিয়ে এককোণায় নাম লিখাতে পারেন। ও আল্লাহ, তুমি আমার চাচাকে দুই'শ তিন'শ বছরের জন্য এ পৃথিবীতে বোঝা হিসেবে রেখে দাও। এই সবাই বল, আমিন।”
সবাই একসাথে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “আমিন।”
তালহা ভূঁইয়া বিরক্ত হলেন। উঠে দাঁড়ালেন। সোফার পাশে পরে থাকা বাজারের ব্যাগটা বড় আদরের সঙ্গে হাতে তুলে বললেন, “বোকা পাইছো আমাকে? আমি তোমাদের টাকা দেই আর তোমরা মজায় মজায় সিগারেট ফুঁকো? বুঝি না মনে করো?”
কৃষ্ণ দাঁত বের করে হাসলো। নিষ্পাপ কণ্ঠে শুধালো, “তাইলে চলো একলগে খাই। সাথে চা টা-ও খামুনে।”
রঞ্জন তাল মেলালো, “চলো না চাচা। আমি সাদিফকেও ডেকে আনছি। মোড়ের দোকানে একসাথে খাবো।”
তালহা ভূঁইয়া একটুখানি ভাবলেন। রয়েসয়ে উত্তর দিলেন, “সাদিফের তো জ্বর। ও আসবে?”
“আসবে না কেন? আমি ডাইকা আনতেছি। সিগারেটের কথা হুনলেই আইয়া পরবো।” বলে কৃষ্ণ সাদিফকে ডাকতে চলে গেল।
নিশ্চুপ মানষী মেহেদী লাগাতে লাগাতে সেসব দেখলো শুধু। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, এই সাদিফ নামক উগ্র লোকটা এ বাড়ির সব ছেলেদের নিজের মতো ইতর বানাতে উঠে পরে লেগেছে। বড় চাচার ভয়ে আগে কেউ এ বাড়িতে সিগারেটের নাম তো দূর! সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি কখনো। অথচ এখন! লোকটা আস্তে আস্তে সবাইকে নিজের মতো নির্লজ্জ বানিয়ে ফেলেছে। বড় চাচাও সেখানে প্রথম সারির একজন।
••••••••••••••
শহুরে চালচলন থেকে গ্রামের নিয়মকাননগুলো প্রায় পুরোটাই ব্যতিক্রম, ভিন্ন। সন্ধ্যা হতে না হতেই এখানে নিঝুম নিস্তব্ধতা নেমে এসে জানান দেয় ' কেউ কোথাও নেই'। কিংকর্তব্যবিমুঢ় প্রকৃতিতে হঠাৎ হঠাৎ কোকিলের সুমধুর ডাক শুনেও শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ভয় লাগে বিশ্রীরকম। তারওপর শীতের মৌসুমে ভৌতিক রসহ্যগুলো যেন আরেকদফা বেড়ে যায়। গ্রামের দক্ষিণের বড়সড় বাজারের ছোটখাটো চায়ের দোকানে বয়স্ক নানা-দাদারা বহু বছরের জমানো গল্পের হাড়ি নিয়ে বসেন। কে কোন বছরে বাঁশ বাগানে সাদা শাড়ি পড়া এক চুন্নি দেখেছিল, নদীর পাড়ে কাঁটা মুরগি দেখেছিল— এসব। তাদের আসরে উৎসুক হয়ে এগিয়েও আসে কত বয়সের কত মানুষ! কুয়াশায় অতশত দেখা যায় না। দোকানের কমদামি ঝিমানো আলোয় দূর্বল চিত্তে দাদাদের মুখের রোমাঞ্চকর অঙ্গভঙ্গি দেখেই ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠে কয়েকজন। ভয়ে, উত্তেজনায় মিইয়ে গিয়ে সেদিন আর ঘুম হয় না। এমতাবস্থায় রাতে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারটায় নাখোশ ছিলেন হাকিম ভূঁইয়া। হুশিয়ারি কণ্ঠে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ন'টার আগে বাড়ি ফেরা চাই।
মানুষীদের বাড়ির দশঘর পরেই হলুদের অনুষ্ঠানটা। বাজারের সবচে’ বড় মুদির দোকানি রাজীব হায়দারের ছোট মেয়ের গায়ে হলুদ। তিনি বার বার করে বলে গেছেন, বাসার সবাই যেন অনুষ্ঠানে আসে। এটা তার বিশেষ অনুরোধ। বাড়ির সবাই না গেলেও নিয়ম রক্ষার্থে বাড়ির ছোট সদস্যদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মানুষী ভেবেছিল, সাদিফ হয়তো যাবে না। শীতের সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে লোকটার জ্বর বেড়েছে। গা কাঁপানো বিশ্রী রকম জ্বর যাকে বলে?
সুন্দর মতো হলদে শাড়ি পরে মানুষী উঠোনে গিয়ে ঠিকঠিক দেখলো সাদিফ ফিটফাট হয়ে রঞ্জনের সাথে কথা বলছে। জ্বর জ্বর চোখ দুটো সে কি লাল! মানুষী হঠাৎ খেয়াল করলো, লোকটার দাড়ি বেড়েছে। ঘন দাড়ির অদলে অন্যরকম গাম্ভীর্য ফুঁটে আছে মুখাবয়বে। অথচ সাদিফের মধ্যে গাম্ভীর্যতা বলে কিছু নেই। অন্তত মানুষীর বেলায় কখনোই ছিল না। সে সদা দেখে এসেছে, শহর থেকে আসা তার সাদিফ ভাইকে সে দেখতে যায়নি বলে রেগেমেগে তার বেণুনী টেনে ধরেছে লোকটা। ক্ষোভে খিটখিটিয়ে উঠেছে, “আমি আসবো শুনিসনি? নিচে যাসনি কেন? তোর উচিত ছিল কাল রাত্রি থেকে বাড়ির গেটের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করা।”
গ্রামের কাঁচা-পাকা পথটা বাঁশঝাড়ে ভরা। আশ্চর্য ভাবে কুয়াশার আঘোরে আবদ্ধ আকাশের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও উঁকি মেরে চাঁদ তাকিয়ে আছে। বাঁশের আড়ালে একটা জোনাক পোকাও দেখতে পেল মানুষী। প্রান্তও দেখলো সেটা। সঙ্গে সঙ্গে চিল্লিয়ে উঠল, “জোনাক পোকা! জোনাক পোকা! ওই মিতাপু, ধুতরা! দেখ না! কি সুন্দর!”
ফোনের ফ্লাশটাইট-টা প্রান্তর মুখের ওপর ধরে রঞ্জন অবিশ্বাস নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এই শীতে তোর সাথে প্রেম করতে জোনাক পোকা আসবে।”
“আরেহ্ আমি সত্যি বলছি। এই মানুষী বুবু! তুমি বলো, তুমি দেখোনি জোনাক পোকাটাকে?”
মানুষী জবাব দিবে, তার পূর্বেই রাস্তার পাথরের সাথে ঠেশ খেয়ে পরে যেতে নিচ্ছিল সে। সাদিফ কোত্থেকে এসে বাহু টেনে ধরলো। গমগমিয়ে বলল, “খেয়াল কোথায় থাকে তোর?”
মানুষী নিরুত্তর। সাদিফ তার বাহু ছেড়ে হাত ধরেছে। শক্ত করে। সেই ঠুনকো ছোঁয়ায় ও আবিষ্কার করলো, অভদ্র লোকটার আসলে অনেক জ্বর। জ্বরে রীতিমতো শরীর কাঁপছে। মানুষী সহজেই টের পাচ্ছে শরীরের অনির্দিষ্ট উত্তাপটুকু। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “জ্বরের ঔষধটা খেয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি বিশ্রাম না নিয়ে এসেছেন কেন? গায়ে হুডি ছাড়া কিচ্ছু পরেননি। ঠান্ডা লাগছে না?”
“লাগছে। তুই তো আমাকে একটু জড়িয়েও ধরতে পারিস, মানুষী।”
মানুষী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনার আসা উচিত হয়নি। ঘুমে চোখ মেলতে পারছেন না।”
সাদিফ জ্বরের ঘোরে ফের আগামাথাহীন কথা বলল, “তোকে আজ ভীষণ অদ্ভুত লাগছে, মানুষী। আমি বাসায় বসে থাকলে তো তোকে দেখতে পারতাম না।”
আধো আলো আধো অন্ধকারে কেউ তাদের খেয়াল করলো না। সম্ভাবনা নেই। তবুও মানুষীর মনে অবাঞ্চিত ভয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানারা ভীড় জমিয়েছে। সে চট করে সাদিফ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে সাদিফ ম্লান কণ্ঠে বলল, “তুই সবসময় আমাকে মাঝপথে ছেড়ে চলে যাস, মানুষী। আমি একা ভয় পাই, জানিস না?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না। শাড়িটা তাড়াহুড়োয় পরেছিল। এখন বেকায়দা ঠেকছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
“কথা বলবি না? তোর জন্য বাদাম এনেছিলাম।”
“কোথায়?”
পকেট হাতড়ে বাদাম বের করলো সাদিফ। খোসা ছাড়ালো। মানুষীর হাতে দিয়ে বলল, “এটা খেয়ে আর চাবি না। আর অল্প একটু আছে। ওটা আমি খাবো।”
.
.
.
চলবে.........................................................................