আশিয়ানা - পর্ব ৯৪ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


ঝলমলে আলোর পসরা নিয়ে উদিত হয়েছে নির্মূল গোলাকার চাঁদ। আলোর আলোয় চকচক করছে চারিপাশ। স্বচ্ছ আকাশে শুভ্র খন্ড খন্ড ভাবে উড়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো মেঘের গায়ে মাখায় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। শীতল হাওয়া বইছে! নিরব, নিস্তব্ধ চতুর্দিক।
বারান্দার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ানো রোদেলা। আকাশের দিকে মুখ করে যেনো গভীর শ্বাস নিচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাচ্ছে তার ক্লান্তি ও হতাশা গুলো। কতোটুকু পারলো কে জানে! আকাশ আজ তুলনা মূলক ভাবে বেশি স্বচ্ছ! জ্যোৎস্নার আলো বিচিত্র রশ্মিতে পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখছে। অথচ তার জীবনে কত অন্ধকারের ছাঁয়া। 
রোদেলার মনে হতে লাগল। সে স্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভেঙে গেলেই সবকিছু আগের মতো প্রান্তবন্ত হয়ে উঠবে। হারানো মানুষ গুলো কে আবার ফিরে পাবে। 
রোদেলার মনে হওয়া সর্বপরি ভুল ছাড়া আর কিছু না। মৃত্যু মানুষ কখনো ফিরে এসছে? উঁহু, না। মৃত্যুর পর কেউ আর ফিরে আসতে পারে না। রোদেলা আবারও ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল সে নিঃশ্বাস। হারানোর পাল্লা দিনকে দিন ভারী হয়ে উঠছে। এখন বিষাদ ও অসহায় লাগেছে। সবকিছু এমন কি নিজেকেও। রোদেলা হঠাৎ সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। সোহার সাড়াশব্দ নাই। নড়ছেও না মেয়েটা। রোদেলার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে ছিল সে। রোদেলা বুঝতে পারছে না, তবে কী ঘুমিয়ে গেছে সোহা?
রোদেলা বারান্দা থেকে রুমে এল। আলগোছে সোহাকে তার বিছানায় শুয়ে দিয়ে ওর পাশেই বসে রইল। ওকে একা রেখে কোথাও যাবে না, রোদেলা। হুট করে ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখতে না পেয়ে যদি কান্না করে? না, না, সোহাকে কাঁদতে দেখতে পারবে না রোদেলা। সন্ধ্যা থেকেই তো কাঁদছে ও। আর কত?
রোদেলা আলতোভাবে সোহার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।

আজ এক দিন তূর্ণ আর জুবিয়া মারা গেছে। সোহাকে নিয়ে ভোর রাতে বাড়ি আসছে রোদেলা। সারাটা দিন সোহা রোদেলার সঙ্গে সঙ্গে ছিল। রোদেলার সাথে টুকটুক করে হেঁটেছে আবার খেলা করছে। খাবার খেয়েছে তার হাতেই আবার যখন ঘুম পেয়েছে তখন তার কোলেই ঘুমিয়েছে।
সোহার জন্য কাঁদতেও পারে নি রোদেলা। পাছে ওর কান্না দেখে যদি সোহা ভয় পায়? সেহরিশ এখনো ফেরেনি। রোদেলা বার বার ঘড়িতে সময় দেখল, কয়েকবার ফোন করার কথা মাথায় এনেও ঝেড়ে ফেলেছে। তূর্ণ আর জুবিয়ার জানাজা, কবরস্থানে দাফন এর কাজগুলো সম্পূর্ণ করে তবে ফিরবে সেহরিশ। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল রোদেলা।

সেহরিশ বাড়ি এল। তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা। দরজা ভেড়ানো ছিল। রুমের ভেতর ঢুকে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সেহরিশ। রোদেলা আর সোহা দু'জনে ঘুমাচ্ছে দেখে সে আর ডাকলো না। সেহরিশ তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখল। খটখট শব্দে ঘুম ভাঙলো রোদেলার। তড়িঘড়ি করে উঠে বসল সে।
সেহরিশ আয়নার দিকে তাকিয়ে একবার রোদেলাকে দেখল তারপর শীর্ণ কণ্ঠে বলল, 
  'ঘুম ভাঙানোর জন্য সরি।'

রোদেলা খাট থেকে পা নামাল। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে দাঁড়াল সেহরিশের সামনে। ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
  'আপনি কখন আসছেন? আমায় ডাকেন নি কেন?'

সেহরিশ জবাবে বলল,
  'তোমাকে দেখে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছিল, ঘুমিয়েছিলে তাই হুট করে ঘুম ভাঙাতে চাইনি।'

সেহরিশ রোদেলার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিছানার উপর শোয়া সোহার দিকে তাকাল। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি আবারও রোদেলার দিকে ফিরে এল। সেহরিশ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, 
  'ও জ্বালিয়েছে অনেক?'

রোদেলা ডান থেকে বামে নিবিড়ভাবে মাথা নাড়লো, 
  'না। কিন্তু সন্ধ্যার পর জুবিয়া আর তূর্ণ ভাইয়ের কাছে যাবে বলে কান্না করেছিল।'

সেহরিশ একটু ভাবলো। ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে খুলতে প্রশ্নটা সে করল,
  'তারপর! তুমি কি বলে শান্ত করেছ?'

রোদেলা অপরাধীর মতন মুখ করে বলল,
  'মিথ্যা বলেছি! জুবিয়ার সাথে আমার সবসময় কথা হতো। সেসময় জুবি সব কথা আমাকে বলতো। সোহার সম্পর্কেও সব বলতো। তূর্ণ ভাইকে কনসার্টের জন্য এদেশে ওদেশে যেতে হতো। আর প্রতিবার সোহা তার মাকে জিজ্ঞেস করতো তার বাবা কোথায়? কান্না করতো বাবার কাছে যাবে। সে সময় জুবিয়া বলতো, তার বাবাকে টিভিতে দেখানো হবে। এজন্য বাবা গিয়েছে বাহিরে। ছোট্ট সোহা, বাবাকে টিভির পর্দায় অনেক দেখেছে। তাই ওর জন্য বিষয়টি আনন্দের। সে যতবার তূর্ণকে টিভিতে দেখে ততবার টিভির উপর চুমু খায়।' বলে থামল রোদেলা। একটু দম নিয়ে আবারও বলতে লাগল, 'তাই আমি সেই কথাটাই সোহাকে বলেছি। সারাদিন ও ভালো ভাবে ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই কান্না শুরু করে। ওইটুকু মেয়ে, মৃত্যু কী? সে তা জানে না। বুঝিয়েও লাভ নেই। বুঝবে না। তাই ওর কান্না থামানোর জন্য বলেছি ওর বাবা-মা দূর দেশে চলে গেছে। আমরা এখন থেকে তাদের টিভিতে দেখব।' সোহা কথাটা শোনামাত্র লাফানো শুরু করে। এক সময় পর রোদেলার গালে আলতোভাবে চুমু খায়। রোদেলা তাকে জড়িয়ে ধরে। এরপর কেটে যায় অনেক সময়। রোদেলা চুপ করে রইল। 

সেহরিশ পুরো শরীরে ঘুরে রোদেলার মুখোমুখি হলো। বলল,
  'পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং গাড়ির মধ্যে যে দুজন লোক ছিল তাদের মধ্যে একজন বেঁচে ছিল তখনও। ওনার সঙ্গেও কথা হয়েছে। তাদের গাড়ির ব্রেক ফেইল হয় তাই ওরা গাড়িটা ওইপথে নিয়ে যায়। কারণ সে পথে গাড়ি চলাচল কম। কিন্তু হঠাৎ তূর্ণ আর জুবিয়ার গাড়ি ওদের সামনে চলে আসে আর এক্সিডেন্টটা হয়। সে যে মানুষ এতোগুলা কথা বলেছে উনিও একটু আগে মারা গেছেন।' এটুকু বলে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল সেহরিশ। 

সোহা ঘুমের ঘোরে নড়ছে। অস্ফুট আওয়াজে কিছু বলছে সে। সেহরিশ সরু চোখে তাকিয়ে দেখল। এরপর হেঁটে গেল বিছানার পাশে। সোহার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সেহরিশ। এরপর রোদেলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'খেয়েছে ও?'
  'হ্যাঁ, কিন্তু অল্প।'

সেহরিশ ওর হাতটা বিছানার উপর রাখে। অপ্রত্যাশিত ভাবে সোহা ওর ছোটো হাতের মুঠোয় সেহরিশের তর্জনী আঙুলটা ধরে মুষ্টিবদ্ধ করল। সেহরিশ বসা থেকে উঠতে যাবে তখন বিষয়টি লক্ষ্য করে সে। সোহা মৃদু কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, 'বাবা!'

সোহার কণ্ঠে ডাকটি শুনে সেহরিশ থমকে গেল। আর সাথে সাথে সেহরিশর মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল অনুভুতি নামতে লাগল। বুক চিরে বেরিয়ে এল ভারী দীর্ঘ শ্বাস। রোদেলা শান্ত কণ্ঠে বলল,
  'সোহা, আপনাকে ওর বাবা ভাবছে। হয়তো তূর্ণর হাত ধরে ঘুমানোর অভ্যেস তার।'
সেহরিশ হঠাৎ ফ্যাসফেসে গলায় বলল, 'বাবা? আমি!'
রোদেলা দু'দিকে মাথা নাড়ল। তারপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, 'আমি কথাটা সেভাবে ভেবে বলিনি৷ সোহা যেভাবে আপনার হাত ধরেছে সেটা দেখে আনমনে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।' রোদেলা কথাটুকু শেষ করে মাথা নিচু করে রাখল। সেহরিশ তাকাল সোহার দিকে। এতো গভীর ভাবে সে কখনো সোহাকে লক্ষ্য করেনি। সোহার চোখ, গাল, কান, নাক, কপাল, চুল বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সেহরিশ। হঠাৎ বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল সে। এই ব্যথাটা কিসের? সে বুঝতে পারল না। অকস্মাৎ একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। দুহাতে সোহাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল সেহরিশ। চিনচিনে ব্যথাটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল। সোহা বিড়বিড় করে আবারও বলল, 'বাবা।'
সমুদ্রের বিশাল ঢেউ কিনারায় এসে বাড়ি খাচ্ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেহরিশের শক্ত মন নরম হয়ে গলে যাচ্ছে। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঢেউ তার মন ও মস্তিষ্ককে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। সেহরিশের শুকনো ঠোঁট জোড়া আলতোভাবে ছুঁয়ে দিল সোহার ললাট।

•••••••••••••••••

দু'হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে জোহান। এপর্যন্ত সেহরিশ কে মাত দেওয়ার হাজারও কূটকৌশল অবলম্বন করেছে সে। কোনোটাতেই সেহরিশ ভেঙে পরে নি। বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে। তাকে এমন কোনো প্ল্যান করতে হবে যেটায় খুব সহজে সেহরিশের ইচ্ছা শক্তি দূরত্ব হবে আর তাকে হারানোও সহজ হয়ে উঠবে। এমন কী উপায় আছে? বিশাল বারান্দার মাঝখানে দাঁড়িয়ে জোহান পায়চারী করছে। যা করার খুব জলদি করতে হবে। সাদাফ তার খোঁজ করছে। ইতিমধ্যেই তার বেশ কয়েকজন লোককে তুলে নিয়ে গেছে তারা। নিজের জীবন দিয়ে জোহানকে আড়ালে রেখে আত্মহত্যা করে সে লোকজন। এতটুকু নিশ্চিত সেহরিশ এখনো তাকে খুব জলদি খুঁজে পাবে না। জোহান একহাতে কপাল চাপড়াতে লাগল। 

শত্রুর কথা মাথায় রেখে সেহরিশ, তূর্ণ, সাদাফ ওদের সুরক্ষা দ্বিগুণ করেছে। এই সময় ওদের ক্ষতি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। জোহান ভিন্ন চিন্তা করতে লাগল। এরপর কাকে টার্গেট করবে সে? বেশ কিছুদিন পর মিলান থেকে রোমে এল জোহান। আর সেদিন ভোরেই শুনতে পেল তূর্ণর এক্সিডেন্টে গত হওয়ার কথা। নিজ বাড়ির বাগানে বসে প্রকৃতির মজা নিচ্ছিল জোহান। ঠিক সে সময় তার ব্যক্তিগত এসিসির তার দিকে দৌঁড়ে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, 'বস, দারুণ খবর এনেছি। শুনলে আপনি খুশিতে লাফিয়ে উঠবেন।'

জোহান ভ্রু কুঞ্চিত করল। প্রশ্ন করল, 'কি খবর?'
  'মাহাবুব তূর্ণ গতরাতে কার এক্সিডেন্ট করছে। তূর্ণ আর ওর ওয়াইফ এক্সিডেন্টেই মারা গেছে।'
জোহানের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল,
  'তুমি যা বলছ সত্যি তো?'
  'হ্যাঁ বস। আমি মাত্র ব্রেকিং নিউজ দেখেই এলাম।' এই বলে একটা ট্যাব জোহানের দিকে এগিয়ে দিল। 

জোহান ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। সহসা চেয়ারে ধপ করে বসে গেল সে। তারপর! অট্টহাসি দিয়ে উঠল। ট্যাবের স্ক্রিনে তাকিয়ে তূর্ণর মরার খবরটা আরও একবার পড়ল। জোহানের হাসির শব্দ বাড়ল। জোহান ওর পা দু'টো টেবিলের উপর তুলে চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিল। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বলল, 'ওকে মারার জন্য কত ফাঁদ ভেবেছি। আর দেখো নিজেই টপকে গেছে।'

জোহান সশব্দে হাসতে লাগল। তারপর আবারও বলল,
  'আজ তো উৎসব হবে। মহা ভোজনের আয়োজন করো। আমার যে আজ আনন্দের দিন।'

••••••••••••••••

এক মাস কেটে গেছে! এরমধ্যে সোহার সঙ্গে সেহরিশ এর সম্পর্ক আগের চেয়ে গাঢ় ও মজবুত হয়েছে। এখন বেশিরভাগ সময় সেহরিশের সঙ্গেই থাকে সোহা। মাঝেমধ্যে বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে তখন আগের মতো টিভি অন করে তূর্ণর একটা কনসার্টের ভিডিও চালু করে দেয় রোদেলা। কিছুক্ষণ টিভি দেখে শান্ত হয় সে। সেহরিশ আজ বাড়িতে নেই। সোহা বার বার সদরদরজার দিকে ছুটে যাচ্ছে। সেহরিশ এসেছে কি-না দেখার জন্য। একটু পর উদাস মনে রোদেলার পাশে এসে বসে। 

রোদেলা একবার সোহার দিকে তাকাল। মিষ্টি করে হেসে বলল, 'চুলগুলোর কি অবস্থা। একদম এলোমেলো হয়ে গেছে। আসো আমি আঁচড়ে দেই।'

সোহা ডানে-বামে মাথা নাড়ল। সে আঁচড়াবে না। এরপর উঠে ছুটে গেল দরজার দিকে। সহসা সেহরিশের পায়ের সঙ্গে ধাক্কা খেল সে। পড়ে যাবে সে সময় তাকে ধরে কোলে তুলে নিল সেহরিশ। মৃদু গলায় বলল, 'কি হয়েছে? এভাবে ছুটে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?'

সোহা কিছু বলল না। রোদেলা বলল,
  'এই নিয়ে একশোবার দরজার কাছে গিয়েছে। আপনার জন্য সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছে। আমার হাতে একদম খেতে চায় না। সন্ধ্যা থেকে এখনো কিছুই খায়নি। বায়না ধরেছে আপনাকে ছাড়া খাবেনা। চুলগুলোর কি অবস্থা! আঁচড়াতেও দিচ্ছে না আমাকে।'

রোদেলা একসাথে এতোগুলো বিচার দিল সোহার নামে। সোহা ঠোঁট উল্টিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেহরিশ সোহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
  'বাবার সাথে খাবে?'
সোহা উপর নিচ মাথা নাড়ল। যার অর্থ হ্যাঁ। সেহরিশ আবারও বলল, 'বাবা চুল আঁচড়ে দিবে?'
সোহা হাসল।

সেহরিশ সোহাকে নিয়ে বসল সোফায়। চোখের ইশারায় রোদেলা কে বলল চিরুনি টা দেওয়ার জন্য। চিরুনি দিল রোদেলা। এরপর সে খাবার টেবিল সাজানোর জন্য চলে গেল। দুজন স্টাফকে আদেশ দিল কিচেন থেকে একএক করে সব খাবার টেবিল এনে রাখার জন্য। তারা সে কাজ করতে লাগল।
সেহরিশ আলতো ভাবে সোহার চুল আঁচড়ে জুটি করে দিল। সোহা খুশিমনে সেহরিশের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেল। সেহরিশ হাসল। বলল, 'এখন খাবে তো?'
সোহা উপর নিচ মাথা নাড়ল। 

সোহা, রোদেলা আর সেহরিশের মাঝখানে বসেছে। ও নিজের হাতে অল্প অল্প খেতে পছন্দ করে। সেহরিশ একে জিজ্ঞেস করল, 'মজা হয়েছে?'
  'হুম।' বলল সোহা।
  'তোমার মাম্মাহ এর হাতের রান্না মজা হয়?' প্রশ্ন করল সেহরিশ। সোহা ঘুরে তাকাল রোদেলার দিকে। তারপর হাসিহাসি মুখে মৃদু গলায় বলল, 'হ্যাঁ।'

সেহরিশ সোহার মাথায় হাত রেখে বলল, 
  'খাবার শেষ করে আমরা বাহিরে হাঁটতে বের হবে। ওকে?'
সোহা প্রফুল্লচিত্তে বলল, 'ওকে।'
রোদেলা তাকাল সেহরিশের দিকে। চোখের ইশারায় জানতে চাইল এতো রাতে বাহিরে যাওয়ার দরকার কী? সেহরিশ আলগোছে রোদেলার হাতখানা ধরে তাকে আশ্বস্ত করল। কিছু হবে না। সে তো আছে।

চারদিক নিরব। রাস্তার দু'ধারে ফুল গাছগুলোতে ফুল ফুটে আছে। সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে বাতাসে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে চারিদিক স্পষ্ট দেখা যায়। সোহা, রোদেলা ও সেহরিশের হাত ধরে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে পা তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে সে। মনে তার খুব আনন্দ। মাঝেমধ্যে কোমল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের। সোহা এবার সেহরিশ আর রোদেলার হাতখানা ছেড়ে সোজা পথের দিকে একটু দৌঁড়ে গেল। রোদেলা বলল, 'সাবধানে। পড়ে যাবে।'

সেহরিশ প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সোহাকে খুশি দেখে সে-ও খানিকটা হাসল। এরপর রাস্তার পাশের গাছগুলোর দিকে তাকাল। একটু ঝুঁকে গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ল সেহরিশ। রোদেলা তা দেখল, বলল, 'রাত্রি বেলা গাছ থেকে ফুল-ফল বা পাতা ছিঁড়তে হয় না।'
সেহরিশ তার কথাটা হাওয়া উড়িয়ে দিয়ে বলল,
  'হুঁশ এসব কুসংস্কার!'

সেহরিশ এক পা দু পা করে এগিয়ে এল রোদেলার দিকে। তারপর আলগোছে রোদেলার কানের ভাঁজে গুঁজে দিল সে ফুলটি। সেহরিশের চাঁদের কানে ঠাই পেল একটা স্নিগ্ধ ফুল। রোদেলা লজ্জা পেয়ে মৃদু হাসল। সোহা দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে দৌঁড়ে কাছে এল আবার। তারপর বলল, 'বাবা, আমারও ফুল চাই।'
সেহরিশ কুটিল হাসল। এরপর হাঁটু ভাজ করে সোহার সামনে বসে জিজ্ঞেস করল, 'আমার রাজকুমারীর কোন ফুলটা চাই?'

সোহা হাত জাগিয়ে একটা ফুল দেখিয়ে দিল। সেহরিশ ওটাকেই সন্তর্পণে তুলে আনলো। এরপর আগের মতো যত্নে করে সোহার কানেও গুঁজে দিল ফুলটি। সোহা ঝটপট জড়িয়ে ধরল সেহরিশকে। রোদেলা একগাল হাসল। তার জীবনের শূন্যস্থানটা অলৌকিক ভাবে সোহা ঘুচিয়ে দিয়েছে। সে এখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বন্ধু হারানোর বেদনা জেঁকে বসে বুকে।

সেহরিশ, সোহা কে ঘাড়ে নিয়ে হাঁটতে লাগল। একহাতে সোহার হাত ধরে রাখছে যেনো সে ভয় না পায়। অন্য হাতে ধরল রোদেলার হাত। এরপর তিনজন অবলীলায় হেঁটে যেতে লাগল বাড়ির দিকে। সোহার আদো আদো কণ্ঠে বলা কথা আর সেহরিশের জোকস শুনে সশব্দে হাসতে লাগল রোদেলা। ধীরে ধীরে ওদের ছায়াটা মিলিয়ে যেতে লাগল অন্ধকারে।

রাতের বারোটা তখন। রোদেলার ঘুম পাচ্ছে। সোহাকে নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। সেহরিশ ডিভান সোফায় শুয়ে টেবিলল্যাম্পের অল্প আলোয় বই পড়ছে সেহরিশ। হঠাৎ আবিস্কার করল তার বুকের উপর কারো হাত। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে দেখল সোহা। সেহরিশ অবাক হলেও ঠোঁটে হাসি বজায় রাখল। রোদেলা ঘুমিয়ে গেলেও সোহা এখনো ঘুমায়নি। 

সোহা সেহরিশের বুকে মাথা রেখে শুয়ে রইল। ছোটো ছোটো হাতটা রাখল সেহরিশের বুকে। এরপর নিষ্পলক তাকিয়ে দেখল সেহরিশ বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহাও অনেকক্ষণ বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থেকে সেহরিশের বুকে ঘুমিয়ে গেল। একটু পর খেয়াল করল সেহরিশ। ঠোঁটের কোণে দূর্লভ হাসির রেখা ফুটে ওঠল তার। সেহরিশ ওর একটা হাত সোহার পিঠে রাখল তারপর লাইট অফ করে সে সোহাকে নিয়ে বিছানায় গেল। একহাতে রোদেলাকে কাছে টেনে বুকের একপাশে তার মাথাটা রাখল আর অন্য পাশে ঘুমন্ত সোহা। রোদেলার মাথায় হাত রেখে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করল। সেহরিশের ঠোঁটে তখনো এক চিলতে হাসি লেপ্টে আছে। 
এখানেই তার স্বর্গ সুখ।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp