কাছে আসার মৌসুম - পর্ব ০৭ - নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি - ধারাবাহিক গল্প


তুশির পাতলা শরীরটা শক্ত হয়ে চেয়ারে সেঁটে গেছে। নড়ছে না। চোখের পাতা পড়ছে না। যেন পোক্ত পাথর খণ্ড।  
ফরসা, ফ্যাকাশে মুখটা থমথমে বানিয়ে ও গাঁট হয়ে রইল।
নার্স মেয়েটা হাসল তাতে। ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজটা ভালো করে লাগাল সূচ ছেদ করা ক্ষতর জায়গায়। তুশির তাও নড়চড় দেখা গেল না। মেয়েটা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“ হয়ে গেছে আপু। এবার একটু নড়ুন। ব্যথা কিন্তু বেশি পাননি।” 

তুশি কথা বলল না। রুষ্ট নয়নে অচল সিরিঞ্জটাকে দেখল।
চিকিৎসক দুটো ওষুধ লিখে দিলেন। হাতের ব্যথা বাড়লে পেইন কিলারও আবশ্যক। বিজ্ঞ মানুষটা কঠিন শুদ্ধ ভাষায় অনেক কিছু বললেন! 
কিন্তু তুশি ওসব শুনলো না। প্রেসক্রিপশনে তার মনোযোগের ছিঁটেফোঁটাও নেই। অমন শক্ত ইংরেজি সে পড়া তো দূর,আগামাথাই বুঝবে না। আর এসব ওষুধ টষুধের দরকার কী? 
শুধু শুধু টাকা নষ্ট। তুশির হাত-টাত কেটে গেলে দাদি পাতা বেটে একটা টোটকা বানিয়ে দেয়। ওটাই দেবে,ব্যস! ব্যথা ভ্যানিশ। 

ও গোটানো শার্টের হাতাটা ফের কনুই অবধি নামাল। ইনজেকশানে ব্যথা তো পায়নি। কিন্তু ভয় লাগছে একটু! আবার সেই আগের মতো পেকে-টেকে যাবে না তো! কী যে দরকার ছিল এই পুলিশের ওকে হাসপাতালে আনার! ওদিকে জেলে ভরতে রেডি,আবার ডাক্তারও দেখায়! 
সে বিরক্ত চোখে ইয়াসিরের দিক চাইল। চোখাচোখির আকস্মিকতায় ভড়কে গেল অমনি। হাস্যহীন মানব ওকেই দেখছিল। তীরের ফলার মতো চাউনি তার মুখবিবরে আটকে। যার পরতে পরতে বিরক্তি! তুশির থেকে সেই বিরক্তি হাজার খানেক বেশি। 
এক বার ওকে দেখছে,পরের বার হাতটায়। তুশি এই চাউনি বুঝল না। বিভ্রান্ত হয়ে ইয়াসিরের দৃষ্টি অনুসরণ করল। 
ছোট্ট কলিজা ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল অমনি। ইয়াসিরের লোমশ হাতটা খামচে ধরেছে ও। সফেদ নখ ডুবে গেছে হলদে ত্বকের ভিড়ে। 
ধড়ফড় করে হাত সরাল মেয়েটা। 
তুঁতলে গেল কথা বলতে গিয়ে,
“ সরি সার! আই নট সি ইউ।” 

ইয়াসির চুপ। তার নম্রতাহীন চামড়া ভেদ করে একটু রক্ত উঁকি দিচ্ছে। তুশি জ্বিভ কাটল। 
হুতাশে ছারখার হয়ে ভাবল,
“ ওরে তুশিরে! ভয় পেলি ভালো কথা। একে ধরলি কেন? দরকার হলে কারেন্টের তার চেপে ধরতি। এখন যে পুলিশ ব্যাটাকে খামচে রক্ত বের করে দিয়েছিস,এই ছুঁতোয় আবার কোর্টে তুলবে না তো?” 
তুশি টের পেলো তার মাথার ওপর ভোঁ ভোঁ করে শনিদেব ঘুরছেন। মোটা গোফ নাঁচিয়ে নাঁচিয়ে বলছেন,
“ ইয়াসির একটা কুফা! ওকে দেখলেই তোর দিন ভালো যায় না। দূরে থাক ওর থেকে,দূরে থাক।” 
তুশি ঘাড় নাড়ল সজোরে। পণ করল বসে বসে,
“ আজ থেকে ও ইয়াসিরের ছায়াও মাড়াবে না।” 

বিল মেটানোর পর্ব এলো। তুশি ভারি চিন্তায় পড়ল আবার। এমন গোরুর ইনজেকশান দিয়েছে,সাথে দশতলা ব্যান্ডেজ হাতে! কত টাকা আসবে?  
নিশ্চয়ই অনেক! হাসপাতালও তো হাইফাই দেখতে। বিলের দ্বায় আবার ওর ঘাড়ে পড়বে না তো? 
তুশির বাম হাতটা ত্রস্ত পকেটে চলে গেল। মানিব্যাগে টাকা-টোকা নেই। ইয়াসিরকে বাঁচাতে আসার আগে একটার পকেট মেরেছিল,ওতে তেমন লাভ হয়নি। এখন ও টাকা দেবে কী করে? 
পরপরই পিঠটা সোজা করে ভাবল,
“ হোয়াই আই মানি গিভিং? আমিতো ইচ্ছে করে নট কামিং তাই না? যে কাম, সে গিভ!” 
কিন্তু ব্যাপার ঘটল উলটো। পুলিশের লোক দেখে চিকিৎসক একটু গদগদ হওয়ার চেষ্টা করলেন। খুব আদিখ্যেতা করে বললেন,
“ বিল দিতে হবে না। আপনারা দেশের সেবা করছেন,আমরাও করছি। একই তো বলুন!” 
কিন্তু ইয়াসির তো এসব শোনার লোক নয়। সে টাটু শব্দবিহীন ওয়ালেট বের করল। সেটা মেলতেই পাশে থাকা তুশির চোখদুটো লোভে চকচক করে ওঠে। 
এক হাজার টাকার নোট দেখে জ্বিভে ঠোঁটটা ভেজায় দুবার। হাতের আঙুলগুলোতে নিশপিশ শুরু হয়। কিন্তু না! আজ তো এই ভুল করলে চলবে না। ইয়াসির যা চালাক! ধরতে পারলে রুহানের মতো পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলবে। 
কিন্তু তুশির হাতটা যে কথা শুনছে না। ও ছুটে যেতে চাইছে। ছো মেরে ওয়ালেটটা নিয়ে পালানোর প্রয়াস ভারি হচ্ছে ক্রমে। 
নিজেকে সামলাতে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা। মুখটাকে ঘুরিয়ে,মুঠো করে রাখল হাত দুটো। ওদিকে তাকাবেও না,চুরির ইচ্ছেও হবে না। 
ইয়াসির টেবিলের ওপর আস্ত নোট রাখল। ভীষণ ধীর তার স্বর,
“ রাখুন!” 
সহকারী ছেলেটা চিকিৎসকের মুখের দিকে চাইল। নীরবে শুধাল,কী করবেন? 
চিকিৎসক আর গাঁইগুঁইয়ে গেলেন না। মাথা নাড়লেন সম্মতিতে। 

তুশি উঠে দাঁড়াল। 
ইয়াসিরের হাতের ফোনটা ভাইভ্রেট হচ্ছে সমানে। গ্লাস প্রোটেক্টরের এক কোণা ভাঙা। ধস্তাধস্তিতে হয়েছে হয়ত। তুশি ঢোক গিলল মুগ্ধ চোখে । এরকম একটা ফোন কিনতে হলে,ওকে ঠিক আর কয়টা পকেট মারতে হবে? 
তুশির বহুদিনের ইচ্ছে,ওর একটা জব্বর ক্যামেরার স্মার্টফোন হবে। সানগ্লাস চোখে দিয়ে স্টাইল মেরে মেরে ছবি তুলবে সে। ওসব কাজে টিনটিন, বাবলু এ দুটোকে খাটাবে তখন! 

ভাবতে ভাবতে ওর 
আচমকা নজর পড়ল লম্বা মানুষটার কপালের কোণায়। একটা আড়াআড়ি কাটা দাগ দেখেই বলল, 
“ এ কী! আপনারও তো কপাল কাটা। সিস্টার,ওনাকেও বান্ডিল করে দিন।” 
মেয়েটি বোকা চোখে চাইল। 
“ বান্ডিল? ওহ! 
ব্যান্ডেজ?” 
“ ইয়েস ইয়েস। ইংরেজি বলেছি দেখে বুঝতে সময় লাগল? এসটেরেঞ্জ।”

তুশি একটা ভালো কথা বলেছে। কিন্তু ইয়াসির কেমন খ্যাক করে উঠল,
“ তোমাকে এত বেশি বুঝতে হবে না। আমার ব্যাপার আমি দেখে নেব। যাও,বের হও এখান থেকে!” 
মেয়েটা ভারি আশ্চর্য হলো। তর্কে না গিয়ে মুখ বাঁকাল। 
কাঁধ উঁচিয়ে বিড়বিড় করল,
“ না করলে নাই।  
আমার কী ভাই?” 
ইয়াসিরের ফোন তখনো বাজছে। সোজা হাসপাতালের বাইরে এসে কল রিসিভ করল। তুশি ঠিক পেছনেই ছিল। ওকে থামতে দেখে দাঁড়াল সেও। 

“ হ্যালো।” 
“ আপনি কোথায়? আমি তো অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।” 
মেয়েলি কণ্ঠ!  
ইয়াসিরের কপালে ভাঁজ বসল। বিভ্রম নিয়ে স্ক্রিনটা দেখল ফের। ওহ,সেই তুশি! 
ফোনটা কানে গুঁজে বলল,
“ সরি, আমি আজ দেখা করতে পারছি না। আপনি বাসায় ফিরে যান।” 
মেয়েটির কণ্ঠে রাগ,বিস্ময় দলা পেঁকে এলো। 
“ ফিরে যান মানে? আমি এক ঘন্টা যাবত রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি,আর আপনি এখন বলছেন চলে যেতে? এটা কি ফাজলামো হচ্ছে?”

 ইয়াসিরের কণ্ঠ অটল,
“ সরিটা আমি আপনাকে সেজন্যেই বলেছি। নাহলে ইয়াসির আবরারের মুখ থেকে এসব শব্দ সহজে বের হয় না! 
আমার এদিকে একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। এখন শাহবাগে যাওয়া সম্ভব নয়! ইউ গেট ব্যাক টু ইয়র হোম!” 

মেয়েটি হয়ত আরো কিছু বলতো! কিন্তু ঐটুকু ভদ্রতা ইয়াসির দেখাল না। খট করে লাইনটা কেটে দিলো। তার মাথার শিরা দপদপ করছে ব্যথাতে। কপালের এক পাশ বিবশ প্রায়! রক্ত জমাট বেধে কালো হয়েছে সেখানে। চিন্তায় কোষগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার যোগাড়। এই এট্যাক রুস্তম করেছে ও নিশ্চিত। কিন্তু সেটা প্রমাণ করবে কী করে? রুস্তম তো সহজে পেছন ছাড়বে না মনে হচ্ছে! ইয়াসির অস্থির চিত্তে দু আঙুলে ভ্রুয়ের মাঝখান ঘষল। আচমকা চোখ পড়ল পাশে। একটা খাটো ছায়ামূর্তি তার ঠিক কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। চট করে পিছু ফিরল সে। 
 তুশি কান খাড়া করে শুনছিল এতক্ষণ। ওপাশের নারী আওয়াজটাও পরিষ্কার বুঝেছে। ইয়াসির তাকাতেই দাঁত বের করে হাসল। 
ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ গালফেন্ড রাগ করেছে বুঝি?” 

ইয়াসিরের তপ্ত কণ্ঠস্বর ছুটে এলো সহসা,
“ শাট আপ! দাঁত বন্ধ করো। আর এখান থেকে চুপচাপ বিদেয় হও। ” 
তুশি থতমত খেল। পরপর কপাল কুঁচকে ভাবল,
“ বারবার চুপচাপ চলে যেতে বলে কেন? কথা বলতে বলতে গেলে কী অসুবিধে আছে? আশ্চর্শ ব্যাটা একটা!” 
মেয়েটা বিরক্তি গিলে নিলো। আলগোছে ভেঙচি কেটে হাঁটা ধরল সোজা। এক পা বাড়াতেই পিছু ডাকল ইয়াসির,
“ দাঁড়াও। এই চোর!” 
তুশি থমকায়। জ্বিভ তুলে চ সূচক শব্দ করে একটু! 
ও চোর না। বারবার চোর চোর করে কেন? 
ফিরল ঠোঁট ফুলিয়ে। ইয়াসির কড়া কণ্ঠে শুধাল,
“ সেদিন অয়নের ওয়ালেট কে নিয়েছে?”

তুশির বুক ধক করে ওঠে। অয়ন নামটা সে চেনে না। কিন্তু পুলিশ ব্যাটা এমন শক্ত করে নাম নিয়েছে যখন,তখন সেদিনের ওই ছোকরাই হবে!
ও আমতাআমতা করে বলল,
“ হু অয়ন? আই নট নো অয়ন।” 
“ বাংলায় কথা বলতে পারো না? মৃগী রোগ আছে?” 

“ এ্যাহ?”
ইয়াসিরের কণ্ঠে কঠোরতা। আঙুল তুলে বলল,
“ শোনো,সেদিন হাতে পাইনি বলে ছাড়া পেয়েছিলে। প্রমাণ নেই বলে আজ আবার ছেড়ে দিলাম। তাই এখন সোজা বাসায় যাবে। যদি রাস্তাঘাটের কোথাও দেখেছি, ঘাড় ধরে এনে লক-আপে ভরে দেব।
মনে থাকবে?” 
তুশি ভেতর ভেতর রোষে ফেটে পড়ল। দাঁত চিবিয়ে ভাবল,
“ রাস্তায় থাকব না মানে? 
রাস্তা কি তোর বাপের শালা?” 

ইয়াসিরের গুরুভার স্বরে নড়েচড়ে উঠল,
“ কী হলো? কথা কানে গিয়েছে?” 
তুশি বাধ্য! নিশ্চুপ মাথা কাত করল।
ছোটো শব্দে জানাল,
“ মনে থাকবে সার।” 
“ যাও।” 
তর্জনে ঘুরে হাঁটা ধরল তুশি। বিড়বিড় করে বলল,
“ শালা! তুশির সাথে হম্বিতম্বি? 
খালি হাতে সুযোগ আসুক একটা। 
তোর করব এমন হাল,
হবি ফুটো নৌকার, ছেড়া পাল।” 

******* 

অয়নের পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। ফুরফুরে মেজাজে হল ছেড়ে বেরোলো সে। সুদর্শন পুরুষের ঠোঁটের হাসি বসন্তের বাতাসের মতো প্রানবন্ত। যতটা আশা করেছিল,ততোধিক ভালো হওয়ায় মুখবিবরে আনন্দের জ্বলজ্বলে ছটা। 
এমন চলতে থাকলে বেস্ট শিশুবিদ হওয়া থেকে আটকাবে কে? 

অয়ন একা নেই। দুপাশে আরো কজন বন্ধু! কথা বলতে বলতে ক্যানটিনে যাচ্ছিল সবাই। হঠাৎ কানে এলো দারোয়ান তর্ক করছেন কারো সাথে। 
কেউ একজন ঢুকতে চাইছে ভেতরে। পরীক্ষার সময় বলে তিনি কিছুতেই
রাজি হচ্ছেন না। 
অয়নের পা জোড়া থমকাল চেনা ঐ ঝুমঝুমে স্বরে। 
“ আঙ্কেল প্লিজ যাই না একটু! 
এখানে আমার পরিচিত একজন আছে। গেলে কিচ্ছু হবে না।” 
 ঝট করে ঘুরে চাইল সে। 
চমকে গেল অমনি। কাঁধে ব্যাগপ্যাক ঝুলিয়ে,কলেজ পড়ুয়া ইউশা দাঁড়িয়ে।  
ঘেমে নেয়ে একাকার মেয়েটা। দুপাশে দুটো লম্বা ঝুটি ঝুলছে। রোদের আলোয় চকচক করছে ফরসা মুখ।
বিস্ময়ের তোড়ে অয়নের ঠোঁট দুই প্রান্তে চলে গেল। বন্ধুদের ভিড় ছেড়ে ত্রস্ত সরে এলো এপাশে। ইউশা তখন দারোয়ানকে মানাতে ব্যস্ত। 
অয়ন অবাক হয়ে ডাকল,
“ ইউশা!”
তুরন্ত,পিছু ফিরল কিশোরী। ঠোঁটে হাসির বান ছুটিয়ে বলল,
“ অয়ন ভাই! পরীক্ষা শেষ হয়েছে? দেখো না,আমি কখন এসেছি! কিন্তু এই আঙ্কেল আমাকে কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছিলেন না।” 
অয়ন তাজ্জব তখনো। 
“ তুই এখানে কীভাবে এসেছিস? আর,আর কার সাথে এসেছিস?” 
দারোয়ান শুধালেন,
“ আপনি চেনেন ওনাকে?” 
জবাব দিলো ইউশা,
“ চেনেই তো। আমি সেই কখন থেকে আপনাকে বলে যাচ্ছি এখানে আমার চেনা লোক আছে,তাও শুনছিলেন না। এবার বিশ্বাস হোলো তো?” 

অয়ন ধৈর্য হারিয়ে ইউশাকে এপাশে টেনে আনল। 
“ তুই এতটা পথ একা একা এসেছিস? বাড়ি না গিয়ে এখানে কেন এলি?” 

“ একা আসিনি তো। আমার এক বন্ধুর সাথে এসেছি। ও আমাকে এখানে রেখে বাসায় চলে গেছে। তোমার পরীক্ষা কেমন হোলো, বললে না তো?”
ইউশা যত স্বাভাবিক , অয়নের চমক ততটাই গাঢ়। কত বাচ্চা একটা মেয়ে! এখনো ঠিক করে রাস্তা পার হতে জানে না। সে কলেজ শেষে উলটোপথ ধরে এখানে আসবে কেন? এখানে যে ওর ক্লিনিক্যাল টেস্ট চলছে এটাই বা জানল কী করে? অয়নের মাথায় অনেক প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর দিলো না ইউশা। স্ফূর্ত গলায় পালটা প্রশ্ন করল,
“ আমাকে দেখে খুশি হওনি, অয়ন ভাই?” 
ওর হাঁ করার আগেই,ওপাশ থেকে অয়নের নাম ধরে ডাকল কেউ। একইসাথে ফিরল ওরা। বন্ধুদের ভেতর হতে একজন দুষ্টুমির বান ছুড়ল,
“ কী বন্ধু! কে ইনি? আমাদের ভাবি নাকি? ” 
অন্যজন বলল,
“ এতকাল সিঙ্গেল থেকে শেষে বাচ্চা পটালি অয়ন!” 

বাকিরা হইহই করে হাসল। ওদেরও পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স চলছে। অথচ দুষ্টুমির বেলায় এরা সব যেন সেই ভার্সিটির ছাত্র! কথাগুলো শুনে লজ্জায় নুইয়ে গেল ইউশা। 
পলাশের ঝাঁক ছুটে এসে বসল দুগালে। ফোলা মুখখানা নামাল নিচে। অয়নের বন্ধুদের মুখে ভাবি ডাক যেন অমৃতের মতো। 
কিন্তু চটে গেল অয়ন। রেগে রেগে বলল,
“ বাজে কথা বলবি না। ও আমার ছোটো বোন,ইউশা।” 
“ ওহ,সরি!” 
ইউশার হাসিটা দপ করে নিভে যায়। আহত চোখ তুলে চায় তার দিকে। 
বোন! অয়ন ভাই ওকে এখনো বোন ভাবে? 

অয়নের চোখেমুখে বিরক্তি। ইউশার ব্যথাতুর চাউনিতে তোয়াক্কাই নেই। খপ করে ওর হাতটা ধরল। এক টানে গেটের বাইরে এনে বলল,
“ কেন এসছিস এখানে? দেখলি ওরা কীসব বাজে কথা বলছে!” 
ইউশার লালচে ঠোঁট ফুলে যায়। মনে মনে বলে,
“ বাজে কই? ওরা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কথাটা বলেছে, অয়ন ভাই। তুমি গাধা, তাই বোঝোনি।” 
 
কিন্তু জিভ থেকে খসাতে পারল না। মুখ ভার করে মাথা নামাল। 
অয়নের চোখে লাগল ব্যাপারটা। 
ইউশার মন খারাপ ওর ভালো লাগে না। মেয়েটা চঞ্চল! চঞ্চলরা সব সময় চাঁদের মতো হাসবে,ঝর্ণা হয়ে ছুটবে। ওদের কালো মুখে মানায় কখনো?
ফোস করে দম ফেলে বলল,
“ আচ্ছা বেশ,যা হয়েছে হয়েছে। কী খাবি বল?” 

ইউশা চুপ। চিবুক গলায় ফেলে রাখল। অয়ন বলল,
“ শুরু হয়ে গেল? খাবি কিছু? না উবার ডাকব?” 
ইউশার শব্দ নেই। সুকোমল গাল ফুলে আছে রাগে।
অয়ন হাসল এবার। বলল,
“ হয়েছে,এত অভিমানের দরকার নেই। চল, আইসক্রিম কিনে দেই।” 

উত্তরের অপেক্ষায় সে রইল না। মেয়েটার হাত টেনে নিয়ে গেল ওপাড়ে। ফুটপাত ধরে অনেকগুলো ভ্যান বসে সেখানে। 

অয়ন একটা বাটারস্কচ নিলো। ইউশার পছন্দের এটা। 
মেয়েটার অভিমান গলে জল হলো সহসা। অয়ন ভাই কী সুন্দর মনে রাখেন,ওর পছন্দের কথা! 
সুনয়না আলগোছে হাসল। যে হাসি অয়নের চোখে পড়বে না। মানুষটা বিল মেটাতে ব্যস্ত যখন,ও প্যাকেট খুলে খেতে থাকে। 
ফাকফোঁকড়ে আড়চোখে চায় কবার! 
খেতে গিয়ে ঠোঁটের এক পাশে আইসক্রিম লেগে গেল! অয়ন দেখল সেটা। 
 বীতস্পৃহ সে। ভ্রু কুঁচকে বলল, 
“ বড়ো হবি না, ইউশা?” 

মেয়েটার চোখ নিষ্পাপের মতো,, 
“ কী করেছি?” 
অয়ন কথা বলে না। পকেট থেকে রুমাল নিয়ে চুপচাপ ঠোঁটে চেপে ধরে। লেগে থাকা আইসক্রিম বড়ো যত্নে মুছে দেয়! 

যতটা যত্নে শ্বাস আটকে পড়ল ইউশার। মেরুদণ্ড ধনুকের মতো সোজা হয়ে গেল! সাথে হাড় ছুঁয়ে নেমে চলল অনুভূতির এক হিম হিম স্রোত।
অভিমানে টইটম্বুর নজরজোড়ায় তার মেখে এলো প্রেম। যে প্রেমের তোড়ে অয়নের প্রতি সে বহুবার হারায়। বিমোহে বুঁদ হয়েই ঠোঁট নাড়ল ইউশা,
“ ডাক্তারির পড়া খুব কঠিন না, অয়ন ভাই?”
“ হু। কেন?” 
“ বুঝতে কষ্ট হয় না তোমার?” 
“এখন আর হয় না।” 
ইউশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। 
কিন্তু বাইরে নয়, মেটাল বুকেই। 
ভাবল আনমনে,
“ আমার মনটাতো তার চেয়ে সহজ অয়ন ভাই! অত কঠিন পড়া বুঝতে কষ্ট না হলে,এটা বুঝতে এত কষ্ট কেন তোমার?” 

*******

বিকেল নাগাদ শওকত সাহেবের কাছে ফোন এসেছে। করেছেন, কনে তুশির পিতা এরফান শেখ। 
বিয়ের কথাবার্তা চলছে এতদিন,কিন্তু ইয়াসির এখনো তার মেয়ের সাথে দেখা করেনি। আজ আসবে বলেও আসেনি,মেয়েটাকে মোড়ের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে ফেরত পাঠিয়েছে। 
এসব নিয়ে এক বিস্তর অসন্তুষ্টি সবার। শওকত কী বলবেন! ইয়াসির তাকে মানে না। নিজ চেষ্টায়, পরিশ্রমে পুলিশ অফিসার হওয়ায় সেই দাপট এখন আরো প্রগাঢ়। 
কিন্তু ব্যাপারটা তো একটু হলেও ম্যানেজ দেয়া দরকার। তাই বোঝালেন নিজের মতো! 
অত ভালো পরিবার,সুনাম কানায় কানায় দেখে মেয়ের বাবা অবশ্য গদগদ বটে! ফের আপ্লুত হলেন প্রসংশায়। 
ইয়াসিরকে নিয়ে গত মাসখানেক যা সব হচ্ছে! তার মতো ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া যে অনেক কিছু!  
তাই আর বিশেষ গোঁ ধরেননি। শুধু বলেছেন ছেলেকে একটু বোঝাতে,যেন মেয়েটাকে সময় দেয়। 
শওকত আশ্বাস দিয়ে ফোন রাখলেন
ঠিকই, কিন্তু দুশ্চিন্তার কালো মেঘে ডুবে গেলেন তারপর । ইয়াসির তো কথাই বলে না। 
কী বোঝাবেন? কীভাবে বোঝাবেন? পাশে বসতে গেলেও উঠে যায়। বেশি বাড়াবাড়ি হলে,বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। 
শওকত পোড়া শ্বাস ফেললেন। চোখের সামনে একটা বিশ্রী অতীত হাহাকার করে উঠল।  
এক ভোরে ঘর ভরতি মানুষের মাঝে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। 
তারপর চোখের সামনে একটা লাশ। কাফনে মোড়ানো একটা ছোট্ট দেহ। পাশে তনিমার আহাজারি! বাকিদের কান্না! লাশের রক্তশূন্য মুখখানা ভেবেই,
চট করে চোখ খিচে নিলেন শওকত। গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে হাতের কব্জিতে পড়ল। পরপর, নজর ফিরিয়ে বেড সাইড টেবিলটায় ফেললেন। 
পূর্ণাঙ্গ পরিবারের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি সেখানে। ফুটফুটে 
তিন ছেলের সাথে তিনি আর তনিমা। বহু বছর আগের ছবি এটা।
ভদ্রলোক ফ্রেম তুলে হাত বোলালেন সায়নের গায়ে। 
ভাঙা স্বর হতে কিছু কাতর শব্দ বেরোল,
“ আমাকে ক্ষমা করিস, বাবা। তুই অন্তত আমাকে ক্ষমা করিস! এক ছেলে মৃত্যুর দ্বায় নিয়ে আরেক ছেলের চোখে ঘৃণ্য হয়ে বেঁচে থাকা একজন বাবার কাছে কতটা যন্ত্রণার! তুই তো বুঝবি,তাই না?”
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp