নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ০৫ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে এক কালো শক্তপোক্ত হাত নওরিজ মাহবুবের কলার চেপে ধরে। সাথে সাথেই যেন পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রকমের শান্ত হয়ে যায়। নওরিজ ঘার নিচু করে স্বীয় শার্টের কলারে থাকা গন্ডারের মতো হাতটার দিকে তাকায়। নখে ময়লা জমে আছে। সে এক মুহূর্তও নেয় না হতাটা সরিয়ে দিতে। পরপর মাটিতে পেড়ে ফেলে এলোপাথাড়ি ঘুষিতে ঘায়েল করে। মুখাবয়ব তাঁর ভয়ঙ্কর। বলিষ্ঠ একাধারে থাবায় ডাবলু নাম নেশাখোর লোকটা গা ছেড়ে দেয়। নাক মুখ ফেটে গলগলিয়ে তাজা রক্ত বহমান। ডাবলুর পক্ষের লোকজন, মাস্তান গুলোও কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়ে। এতোটা হিংস্রতা কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না তাদের। রক্তিম চোখজোড়া যেন আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলছে দাউদাউ। কপালের নীল শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। মুষ্ঠিময় হাতের একেকটা থাবা যেন অসুরের শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে নিজ লোকের এমন পরিণতিতে তাঁরা চুপ থাকে না। তেড়ে আসবে নওরিজ মাহবুব খেয়াল করে হাত থামিয়ে দেয়। ডাবলুর বুকের উপর থেকে উঠে গমগমে আওয়াজে হুঙ্কার ছাড়ে,

-" কেউ হাতাহাতি করার চেষ্টা করলে তাঁর হাত আমি নওরিজ কুচি কুচি করে শকুন দিয়ে খাওয়াবো!"

গ্রামের লোকজন কেউই আর সাহস করে না হাতাহাতি করার। তাঁরা নওরিজ মাহবুবকে চেনে তো। বান্দা সুবিধার নয়। তবে শহুরে গোছের মাস্তান গুলো ওঁত পেতে থাকে; ঝামেলা একটা পাকাবেই সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সবার হঠাৎ থেমে যাওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বাকিরা থেমে গেলেও এক লোক ভিড় ঠেলে তেড়ে যায় একটা সেগুন কাঠের তৈরি লাঠি হাতে। সময় না নিয়েই আক্রমণ করে বসে নওরিজের উদ্দেশ্যে। ঘটনা অতি দ্রুত ঘটায় নওরিজ ঠাহর করতে একটু সময় নেয়। সরে গেলেও কাঁধ বরাবর আঘাত লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজে নেয়। ততক্ষণে নওরিজের লোকজন ক্ষেপে যায়। পাগলা কুকুরের মতো আক্রমণ করে বসে আগত লোকটার উপর। অপর পক্ষের লোকজন পিছু হটে হঠাৎ এমন হিংস্র গ্যাঞ্জামে। নওরিজ হাতটা ঝাঁকায়। হাতে রক্ত দেখে গা চিটচিটে করে ওঠে। পাশে থুতু ফেলে। হাত এখন পরিষ্কার না করলেই নয়! পাশ থেকে সালেহউদ্দিন নওরিজের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-" বাবা তুমি ঠিক আছো? চোট বেশি লাগে নাই তো? এক কাম করো তুমিই বাইরে আসো ভিড় ভাট্টা থাইকা । কুত্তার বাচ্চার অতো সাহস তোমার গায়ে টোকা দেয়! শালারে মাইরা নদীতে পুইতা থুম!"

-" জি চাচা আমি ঠিক আছি।"

বলেই নওরিজ মাহবুব তার লোকদের ধমকে থামায়। তাকে আঘাত করা লোকটার প্রায় আধমরা অবস্থা। মাটিতে পড়ে গোংড়াচ্ছে কোনোরকম। নওরিজ তাঁর এক হাত পায়ের তলায় পিষ্ট করে হিসহিসিয়ে বলে,

-" ইচ্ছে তো করছে তোর হাতটাই আলাদা করে দিই। তবে আমি খুবই দয়ালু কি না!আমাকে জানলে এই ভুল করতিস না নিশ্চয়ই? তুই যেই শহর থেকে এসেছিস সেই শহরের বাপ আমি! আরেকবার এই এলাকায় দেখলে তোর চোদ্দ গুষ্টির রফাদফা করে দিবো! আর নামটা মনে রাখবি, নওরিজ মাহবুব খান!"

গমগমে সুরে হুঙ্কার ছেড়ে বলে নওরিজ মাহবুব। তাঁর পক্ষের যুবক ছেলেগুলো হৈ হৈ সুর তোলে। কেউবা সিটিও বাজায়। তবে এতো পুরুষের ভিতর মোটাসোটা একটা মহিলার আগমনে হঠাৎই পরিবেশ পাল্টে গেলো। ডাবলু ও আহত লোকটাকে কতক জন লোক চ্যাংদোলা করে নিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। নওরিজ ভ্রু কুঁচকে চায় মহিলার দিকে। খাঁটো মোটাসোটা বয়স্ক মহিলার চোখে মুখে রাগের প্রতিচ্ছবি। সে চেনে এই মহিলাকে। নেশারু বাবলুর সম্মানীয় শাশুড়ি আম্মা। তাঁর মরহুম দাদাজানের ফুফাতো বোন শেফালী বানু। মহিলার দাপট পাশের গ্রামে প্রচুর। তাঁর মাঝে মহিলা সুলভ কোনো আচরণই লক্ষ্য করা যায় না। কথা বলবে মনে হয় ভুমিকম্প হচ্ছে। তাঁর মধ্যে মেয়েলি স্বভাবের মধ্যে একটাই; পোষাক। তবে তারও ছিড়ি যা তা! নওরিজ বিরক্ত হয় ঢের। মহিলাকে দেখলেই তার গা জ্বলে ওঠে। মহিলাটি এগিয়ে এসে নওরিজের দিকে তাকিয়ে বলল,

-" সাহস তো ব্যাটার কম না।‌ তবে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করা কি ঠিক হলো?"

ভদ্রমহিলার নাম শেফালী। শান্ত ভাবেই বললো তবে তাঁর আওয়াজ শুনে যে কেউ মনে করে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে। নওরিজ বেজায় বিরক্ত হয়। থমথমে গলায় বলে,

-" এ জমি বিক্রি করে টাকা গিলেছে আপনার গুনধর জামাই! বছর না গড়াতেই আবার জমি দখল করতে আসে কোন যুক্তিতে? আপনি নিজেও তো সাক্ষী ছিলেন। ঝামেলা ঝুলিতে নিয়ে ঘুরেন আবার আত্নীয়তার দোহাই দেন?"

শেফালী তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ছেলেটাকে চেনে সে। এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে। আশপাশের গ্রামে ভালোই চর্চা হয়। তার উপর দুঃসম্পর্কের নাতি। কেউ তাঁর সামনে এভাবে গলা চড়িয়ে কথা বললে সোজা থাপ্পড় বসিয়ে দিতো। সে পানের পিক ফেলে বলে,

-" আমি জানতাম না হারামজাদা এই কাজ করছে। আমি পড়ছি ফ্যাসাদে। কোন কুলক্ষনে জানোয়ারের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে গেলাম! থাক সে কথা আর ভেজাল করিস না। আমি সবাইরে নিয়ে যাইতেছি। আর আইবো না।"

নওরিজ হাঁ না কিছুই বলে না। বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে। শেফালী নামক মহিলাটি এগিয়ে এসে নওরিজের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-" বাত্তে যাইস কথা আছে তোর সঙ্গে। বাড়ির রাস্তা ভুইলা গেছোস নি? ছোট্ট বেলায় কত যাইতি!"

জর্দা মেশালো পানের উটকো গন্ধে নওরিজের গা গুলিয়ে ওঠে। মহিলা যেখানে হাত রেখেছে মনে হয় জ্বলে উঠলো। সে তড়িৎ বেগে সরে দাঁড়িয়ে বলল,

-" যাবো ইনশাআল্লাহ!"

শেফালী ভ্রু কুঁচকে চায়। নওরিজ নিজ লোকের সাথে কথা বলার ব্যস্ততা দেখায়। শেফালী পরপর হেসে চলে যায় দাপুটে ভঙ্গিতে। ছেলেটাকে তাঁর ভারী পছন্দ! শেফালী নামক মহিলার প্রস্থানে ডাবলুর পক্ষের লোকগুলোও মানে মানে কেটে পড়ে। তারা চলে যেতেই নওরিজ ভিড় থেকে বেরিয়ে আসে। গমগমে আওয়াজে হুকুম তোলে,

-" জলদি পানি আন! সাথে স্যানিটাইজার! হ্যান্ড ওয়াশ হলে আরো ভালো হয়! আর নতুন টিস্যু বক্স।"

একটা ছেলে কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ ফিরে এসে বলে,

-" রিজ ভাই পানি নয় আনলাম তয় বাকি সানি হানি কই পামু?"

নওরিজ কটমট করে চায়। গায়ে লেপ্টে থাকা শার্ট খুলে হাতের রক্ত মুছে ছুঁড়ে ফেলে। বলিষ্ঠ দেহ উন্মুক্ত হয় নিমিত্তে।ফর্সা বলিষ্ঠ গতর নজর কাড়তে সক্ষম। বাম কাঁধে যেখানটায় আঘাত করেছিল সেখানে অল্প তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে। নওরিজ ধমকে বলে,

-" জাহান্নাম থেকে আন গাধার দল! পানি আন জলদি করে। ভালো পানি, পুকুরের পানি আনিস না যেন!"

ছেলেটা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে যায়। নওরিজ স্বীয় মুখ মন্ডল ছুঁতে নিয়েও ছোঁয় না। হাতে ওই নেশাখোরের রক্ত লেগে আছে। একটু পরেই ছেলেটা জগ ভরে পানি নিয়ে আসে। নওরিজ হাত ভালোভাবে কচলে ধুয়ে নেয়। মুখটাতেও পানির ছিঁটা দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। গা টা এখনো গুলাচ্ছে! আঘাতপ্রাপ্ত কাঁধে হাত দিয়ে পানি ঢেলে ডলে বলে,

-" আশে পাশে ফার্মেসী নেই, ওষুধের দোকান?"

মহির নামক এক ছেলে আঙ্গুল উঁচিয়ে সম্মুখে দেখিয়ে বলে,

-" রিজ ভাই আসেপাশে বলতে ওই সামনে রনজিৎ ডাক্তারের ক্লিনিক আছে। হের বাড়িতেই! যাইবেন?"

'চল' বলেই নওরিজ হাঁটা দেয়। এভাবে থাকা যাচ্ছে না। ক্লিনিক হয়ে এসে বাড়ির পথ ধরবে। তাঁর সাথে তার সব সাঙ্গ পাঙ্গ হাঁটা দেয়। নওরিজ ভ্রু কুঁচকে চায় তাদের দিকে,

-" কি চাই? আমার পিছু আসছিস কেন? সালেহ কাকা আপনি আর মহির তুই আয় সাথে। বাকিরা চলে যা। আর যেন কথাকাটাকাটি না হয়। একদল বাড়ি যা, দুই একজন এখানেই থাক। পরিস্থিতি যেন না বিগড়ায়!"

উপস্থিত সকলে নত মাথায় সায় জানালো। নওরিজ হাঁটা দেয় আবারও। সালেহউদ্দিন ও মহির তাঁর পিছনে। কাঁচা রাস্তায় লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায়। পথিমধ্যে একটা ভ্যান ওয়ালার দেখা মিলে, তাতেই সাওয়ারি করে রনজিৎ ডাক্তারের বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়।

 পুরনো আমলের একটা একতলা ভবন। ভবনের একপাশে ছোট একটা কুঠির। সেখানেই ডা. রনজিৎ চ্যাটার্জি নিয়মিত রুগি দেখে। তবে আজ বন্ধের সাইনবোর্ড ঝুলছে দেখে নওরিজ মাহবুব ত্যাক্ত শ্বাস ছেড়ে ভ্যান চালককে বললো,

-" চাচা গাড়ি ঘুরান। চেয়ারম্যান বাড়ি যাবেন এক টানে!"

ভ্যান চালক হেসে বলে,

-" রনজিৎ ডাক্তার বাত্তেই আছে। ভিতরে গিয়া আপনের কথা কইলেই ছুইটা আইবো! ওই যে হের বাড়ির ছাদে কারা জানি কতা কয়! ডাকলেই সাড়া দিবো নে!"

সালেহউদ্দিনও সায় জানালো! খেয়াল করে একতলা বাড়ির ছাদ থেকে মেয়েলী হাসির আওয়াজ ভেসে আছে। সাথে পুরুষের দুষ্টু মিষ্টি গলা। সালেহউদ্দিনের ভ্রু কুঁচকে যায়। ভ্যান থেকে নেমে কয়েক কদম এগিয়ে ডাক দেয়,

-" রনজিৎ কাকা? আছেন নি বাড়ি? রনজিৎ কাকা?"

বলেই উৎসুক নজরে মাথা তুলে ছাদের পানে তাকায়। ছাদে উপস্থিত সবাই উঁকি দেয়। হাস্যোজ্জ্বল চেনা মুখাবয়ব দেখে থমকায় সালেহউদ্দিন। অবাক চাহনিতে চায় পরিচিত মানবীর পানে। মুখগহ্বর হতে অস্ফুট স্বরে নির্গত হয়,

-" সুরেলা?"

সুরেলা ডাক শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে বারি খেতেই নওরিজ সজাগ হয়। ঝড়ের বেগে ভ্যান থেকে নেমে ছাদের দিকে ঘার উঁচু করে চায় অবাক চোখে। সুরেলা এখানে কি করে?

ছাদে দন্ডায়মান কিশোরীর চোখে মুখে আকাশসম আতংক। ভয়ে চোখ মুখ বিবর্ণ হয়ে আসে। লুকিয়ে পড়ারও কোনো অবকাশ নেই। বাবা তো দেখেই নিয়েছে! তাঁর পিঠে আজ কাঁচা কুঞ্চি ভাঙবে! এভাবে হাতে নাতে ধরা পড়বে সুরেলা ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি। সে অসহায় চোখে পাশে দন্ডায়মান বান্ধবীর পানে তাকায়। তবে বান্ধবীর চাহনি ভিন্ন কিছু বলছে। তাঁর চোখের আকার ক্রমশই বড় হয়। তড়িঘড়ি ঘার ঘুরিয়ে বাম পাশের রাস্তায় তাকায়। নওরিজ মাহবুবকে দেখে আরেকদফা শক খেলো যেন। ভয়ের থেকে বেশি লজ্জাটাই পেলো। শার্ট বিনা বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে। গতরের প্রতিটা পেশি যেনো নির্লজ্জের মতো চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে। সুরেলা নতমুখে কেটে পড়ে সাথে সাথে।

••••••••

রনজিৎ বাবুর ক্লিনিকে নওরিজ মাহবুব। শুধু ক্লিনিক বললে ভুল হবে ক্লিনিকের ওয়াশ রুমে হাত ধুচ্ছে অনবরত। এই নিয়ে চারবার ধোঁয়া হয়েছে পাঁচবার ভালোভাবে হ্যান্ড ওয়াশ ব্যবহার করে হাত ধুয়ে নেয়। মুখটাতেও কয়েক ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসে। রনজিৎ বাবু পরিষ্কার একটা গামছা দিলেও নওরিজ ভদ্রতার সাথে নাকচ করে বলে,

-" দরকার নেই দাদা! আপনি একটু স্যাভলন তুলো লাগিয়ে দিন এইখানটায়!"

নিজ কাঁধে ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলে! রনজিৎ বাবু হেসে স্যাভলন তুলো সহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি এনে নওরিজকে বসতে ইশারা করে। নওরিজ চেয়ারে বসলে ভদ্রলোক ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে করতে বলে,

-" ড্রেসিং করিয়ে দিচ্ছি। নইলে ইনফেকশন হবে।"

নওরিজ কিছু বলে না। সালেহউদ্দিনের মুখটা থমথমে। সুরেলার উপর চটে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। রনজিৎ বাবু তা লক্ষ্য করে। সুরেলা নামক মেয়েটা এই জন্যই এতো ভয় পেয়ে আছে ! সে সালেহউদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-" সালেহউদ্দিন তোমার মেয়েটা ভারী পছন্দ হয়েছে আমার। কি সুন্দর কন্ঠ তাঁর! নামটা যেন সার্থক! সুরেলা। বয়স থাকলে আমিই ঘরে লুকিয়ে রাখতাম।"

নওরিজ মাহবুব ভ্রু কুঁচকে চায়। ব্যঙ্গ করে বলে,

-" উঠোন পেরুলেই শ্মশান ঘাট! অথচ ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনেন? ভালো হয়ে যান দাদা!"

বৃদ্ধ রনজিৎ বাবু হেসে ওঠে সাথে সাথেই। জবাবে বলেন,

-" স্বপ্ন দেখতে দোষ কিসের বাপু? স্বপ্ন মানুষকে কাজ করার স্পৃহা জাগায়। তোমার স্বপ্ন নেই মানে তুমি নিঃষ্কর্মণ্য অলস ব্যক্তি। যতো স্বপ্ন দেখবে জীবন ততো সফলতা আসবে।"

কথাগুলো ভালো লাগলেও নওরিজ মাহবুব গম্ভীর মুখে বসে থাকে। রনজিৎ বাবু আবারও বলতে শুরু করে,

-" আজ আমার নাতনির আশির্বাদ। নাতনি তো ভয়ে হাঁটু কাঁপা কাঁপি। কৃষ্ণ ঠাকুরের পায়ে পড়ে কেঁদে যমুনা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিছুতেই পাত্র পক্ষের সামনে যাবে না। তাই ওর বান্ধবী দু'টোরে আসতে বলেছিলাম। সুরেলা আর মারিয়া এসেছে যদি মেয়েটা একটু ভরসা পায়। আসলে বন্ধু বান্ধব থাকলে ভীতি কেটে যাবে। হলোও তাই মেয়ে হাসছে, মজা করছে, লাজে রাঙা হচ্ছে! সালেহউদ্দিন তুমি কিন্তু মেয়েকে বকবে না বলে দিলাম! সন্ধ্যায় আশির্বাদ হবে, আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো বাছা দু'টোকে!"

সালেহউদ্দিন কিছু বলবে তাঁর আগেই নওরিজ গমগমে সুরে বলে ওঠে,

-" বাড়ির মেয়ে এতো বেলা অন্যের বাড়ি পড়ে থাকবে ব্যাপারটা অনেকেই ভালো চোখে দেখবে না দাদা! যুগ জামানা ভালো না। পাত্রপক্ষের সাথে নিশ্চয়ই অনেক ছেলেপুলে আসবে! আর আপনার বাড়িতেও জোয়ান ছেলে কম না।মেয়ে বড় হয়েছে অন্যের ঘরে পাঠাতে হবে। এসেছিল, থেকেছেও কিছুটা সময়। আপনি ওদের পাঠিয়ে দিন অনুগ্রহ করে।"

-" আমরা পর হলাম বুঝি? ধর্ম এক না বলে কি পর করে দিচ্ছো বাছা?"

বৃদ্ধার কথায় নওরিজ ঠোঁট চেপে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,

-" ধর্ম টানছেন কেন? আপনিও মানুষ আমিও মানুষ! ভেদাভেদ কিসের? আমাদের ধর্ম শান্তি শৃঙ্খলা শেখায় উগ্রতা নয়। বিকেল অবধি ঠিক আছে সন্ধ্যার পর যুবতী মেয়ে অন্য বাড়িতে থাকবে শোভা দেখায় না। আশাকরি বুঝতে পারবেন!"

-" নিয়ে যাস। আমি তো সাত পাকে বেঁধে ঘরে তুলছি না!"

রনজিৎ বাবু হেসে বলে ওঠেন। কাঁধে ছোট্ট করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে কিছু ওষুধও দেন। নওরিজ উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে টাকা বের করবে বৃদ্ধা অজুহাত দেখিয়ে ভেতরে চলে যায়। নওরিজের বুঝতে বাকি থাকে না। সে কাঠের টেবিলে টাকাগুলো রেখে বেরিয়ে যায় ক্লিনিক থেকে। অপেক্ষায় কারো আগমনের। সালেহউদ্দিন দাঁত কটমট করে। মেয়েটার সাহস কত? স্কুলে যাওয়ার নাম করে হিন্দু বাড়িতে টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এর পায়ে জলদি শিকল দিতে হবে! তিনি আর কারো কথাই শুনবেন না। 

ইতিমধ্যে রনজিৎ বাবু হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আসেন। তাঁর পিছনে দুই কিশোরী নতমুখে এগিয়ে আসে। নওরিজ ভ্রু উঁচিয়ে চায়। বোরকা নেকাবে মুড়ে আছে এখন। ছাদে তো বোরকা ছাড়াই হি হি হা হা করছিলো। সাথে আরও কিছু ছেলেমেয়ে ছিলো। নওরিজের মেজাজ তুঙ্গে। কতবড় সাহস মেয়েটার! তাকে মিথ্যে বলেছে। তার কথা অমান্য করে ফন্দি এঁটে চৌদ্দ মুল্লুক ঘুরে এখানে এসেছে! রাস্তা দিয়ে এলে তো তাঁর নজরে পড়তোই। সুরেলা ধীর পায়ে হেঁটে বাবার পাশে দাঁড়ায়। মারিয়াও তাঁর সাথী। রনজিৎ বাবু চলে গেলে সালেহউদ্দিন বলে,

-" রিজ বাবা তুমি যাও মহিররে নিয়া। আমি মাইয়া দু'টোরে নিয়া আইতাছি।"

-" একসাথেই যাই চাচা। ভ্যান তো আছেই পা ঝুলিয়ে বসলে আটবে। আর মহির তুই হেঁটে চলে যা?"

মহির মাথা কাত করে সায় জানালেও তার যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে আড়চোখে সুরেলার দিকে চায়। চেয়ারম্যান চাচা এর কথাই বলেছিলো? এই মেয়েটাকেই তো বিয়ে করতে হবে। সে তো প্রথমে নাক সিঁটকিয়েছিলো। কাইলা ভুত বিয়ে করবে নি? সে মহির মোল্লা যেমনই হোক গায়ের রং সহ মাশাআল্লাহ দেখতে খারাপ না শুধু চালচুলো নেই এই যা। তবে সুরেলাকে এখন দেখে মনে হলো ওতটাও খারাপ নয়। চোখ দু'টো মনে হয় কোনো বশীকরণী মন্ত্র! আর গায়ে গতরেও ভালোই হবে মনে হয়! ভেবেই তাঁর চিত্ত টগবগিয়ে ওঠে। দাঁত বের করে হেসে সুরেলা নামক রমনীর আপাদমস্তক দেখে নেয়। তবে কারো ধমকে হুঁশ ফিরলো বোধহয়। মানে মানে কেটে পড়ে তৎক্ষণাৎ। ভ্যানের একপাশে পা ঝুলিয়ে নওরিজ ও সালেহউদ্দিন। অপর পাশে সুরেলা ও মারিয়া। চালক প্যাডেল ঘুরিয়ে ভ্যান টানে জোড়েই। কিশোরী দ্বয়ের মুখটা শুকনো দেখায়। কত কষ্ট করে পাড়ার মধ্যে দিয়ে ঘুরেফিরে বান্ধবীর বাড়ি পৌঁছালো‌ তবে শেষ মেষ ধরা খেয়েই গেলো। মারিয়ার অবশ্য ভাবান্তর নেই কিন্তু সে বান্ধবীর দুঃখে ব্যথিত নয়নে তাকায়। মেয়েটার চোখ টলমল করছে। সে জানে সালেহ চাচা বাড়ি ফিরেই গন্ডগোল একটা বাঁধাবেই। সে ভ্যানের কিনারায় থাকা বান্ধবীর হাতে হাত রাখলো। সুরেলা তাকায় তাঁর পানে। মারিয়া চোখে আশ্বাস দেয়। বান্ধবীর মন ভালো করতে ঘার একটু বাঁকা করে পেছনের দিকে ইশারা করে। সুরেলা ভ্রু কুঁচকে ঘার ঘুরায়। বলিষ্ঠ ধবধবে ফর্সা পিঠ যেন তাঁর চক্ষু লজ্জা শতগুণে বাড়িয়ে দিলো।কান ভারী হয়ে আসে। মনে মনে 'আস্তাগফিরুল্লাহ' জপে। বেহায়া বেলাজ পুরুষ মানুষ! কিভাবে খালি গতরে আছে? লজ্জার মাথা খেয়েছে নিশ্চয়ই। এ লোকের শার্ট কোথায় গেলো? 

মারিয়াকে তার বাড়ির রাস্তায় নামিয়ে ভ্যান চালক চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে এগোলে সালেহউদ্দিন ভ্যান থামাতে বলে। থামলে নেমে এসে সুরেলাকেও নামতে ইশারা করে। সুরেলা নেমে বাবার পাশে দাঁড়ায় নতমুখে। নওরিজ ভ্রু কুঁচকে চাইলে সালেহউদ্দিন বলে,

-" তুমি যাও রিজ বাবা। আমরা এই চড়া পাতাইলা যামু। দুই মিনিটও লাগতো না।"

নওরিজ আড়চোখে সুরেলার পানে চায়। মলিন নত চোখ জোড়া দেখে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে বলে,

-" চাচা আমার খামারে কিছু কাজ আছে। আজকেই করা জরুরী। আপনি আমার সাথেই চলেন। সুরেলা একাই যেতে পারবে এটুকু পথ। কি রে পারবি না?"

সুরেলা হ্যা বোধক মাথা নাড়লো ঘন ঘন। বাবা এখন ও বাড়ি গেলে রাতে দেড়িতে ফিরবে। আবার নাও ফিরতে পারবে। সে যাইহোক তাঁর জন্য ভালো। রাতে ভাইয়ের সামনে কিছু বলতে পারবে না। তার মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। মাথা তুলে তাকায় সম্মুখে ভ্যানে বসা অর্ধ নগ্ন লোকটার পানে। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে দেয় লাজে।

•••••••••••

নীল অম্বরে সাদা সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। ভেলায় ভেসে বেড়ায় হাজারো স্বপ্ন! ইচ্ছরা ডানা ঝাপটায়! হালকা পাগলা হাওয়া এলোমেলো সুর তুলে বসন্তের আগমনী বার্তা দিয়ে যায়। চেয়ারম্যান বাড়ির ছাদে বসে কিশোরী রূপসা। দুই হাত মেলে রোদ পোহায় হাতের মেন্দি বাটা শুকানোর উদ্দেশ্যে। ফর্সা হাতে পানের খর মিশ্রিত মেন্দি পাতা পাটায় বেটে হাতে লাগিয়েছে। মেন্দির গন্ধ আশে পাশে মো মো করছে। এরই মাঝে ভাতের প্লেট হাতে ছামিনা বেগম এসে মেয়ের পাশে টুল টেনে বসে। রূপসা মুচকি হেসে হা করে। ছামিনা বেগম মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেয়। রূপসা চিবোতে চিবোতে নিজ মেহেদী দেওয়া হাত দেখিয়ে বলে,

-" আম্মু সুন্দর লাগছে না? গাঢ় রঙ না হলে কিন্তু আমি কেঁদে দিবো!"

-" টকটকে রঙ হবে দেখেনিস। তোর ভাই কোথায় গেছে বলেছে কিছু?"

মায়ের প্রশ্নে রূপসা হেসে বলে,

-" সিন ভাইয়ের গ্যারেজে গেলো তো। বাইক টা পরিষ্কার করতে।"

-" ওহ্। আচ্ছা শোন? সিনানের বোনটা মানে সুরেলা কেমন রে? আমার তো মনে হয় ঝগরুটে স্বভাবের!"

মায়ের কথায় রূপসা ভ্রু কুঁচকে চায়। হঠাৎ সুর আপার কথা কেন জিজ্ঞেস করলো?

-" ভালোই তো মনে হয়। আমার সাথে তো কখনো ঝগড়া করে নি তাই বলতে পারবো না। হঠাৎ ওর কথা জিজ্ঞেস করলে যে?"

-" না এমনিতেই! কাল পরশু তোর বড় আপা আসবে।"

মায়ের কথায় রূপসা খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে। উপচেপড়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,

-" সত্যিই?ও আসলে বাবু না হওয়া অবদি আর যেতে দেবো না। দুলাভাইও আসবে?"

-" সেটা তো বললো না।তবে ও একা থোরাই না আসবে, জামাই সাথেই আসবে বোধহয়!"

ছামিনা খাতুন বলে মেয়ের মুখে লোকমা তুলে দেয়। রূপসা খাবার চিবোতে চিবোতে বোনের গল্পে মেতে ওঠে। এরই মাঝে কাজের মেয়ে এসে জানালো রওশন ও তাঁর এক বন্ধু এসেছে। ছামিনা খাতুন মেয়ের মুখে শেষ নিবালা পুরে দিয়ে তড়িঘড়ি করে পা চালায়। রূপসা কিছু সময় বসে থাকে। হাতের মেহেদী প্রায় শুকিয়ে এসেছে। সে মুচকি হেসে ছুটে যায় ছাদ থেকে। তার রিনিঝিনি নুপুরের শব্দ ঝংকার তোলে। হাতের মেহেদী ধুয়ে নেয় ঝটপট। লাল খয়েরী মেহেদী রাঙা হাত। রূপসা নাক টেনে সুবাস নেয়। এখনো মেন্দির ঘ্রাণ নাকে বাজে। সে মুচকি হেসে আবারও ছুটে যায় দুই পাশের স্কার্ট হালকা উঁচিয়ে।

বসার ঘরে দামি সোফায় বসে সিনান সালেহ। সে আসতে চায় নি; রওশন জোর করে টেনে আনলো ভেতরে। সে তো বাইরেই অপেক্ষা করছিলো! ঠোঁট চোখা করে ত্যাক্ত শ্বাস ছাড়লো সে। পাশে বসা রওশন বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বলে,

-" কি খাবি বল? চা নাকি শরবত?"

-" তোর মাথা খাবো। জলদি গিয়ে তৈয়ার হইয়া আয়! খেলা শুরু হইবো চারটায়। অহন সারে তিনটা বাজে!"

-" যাচ্ছি ভাই। সবসময় মেজাজ তুঙ্গে থাকে তোর। বলি স্বভাব পাল্টা নইলে বউ টিকবো না একটাও!"

-" তাহলে বিয়ের কার্যক্রম চলমান থাকবে। একটা চলে গেলে আরেকটা।"

ফটাফট জবাবে রওশন ভ্রু উঁচিয়ে চায়। এই শালার সাথে কথায় পারা যাবে না। সে উঠে দাঁড়ালো। ঘরে যাবে এর আগেই ছামিনা খাতুনের আগমন ঘটে। সিনান ছোট্ট করে সালাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করে। ভদ্র মহিলা হেসে জবাব দিয়ে সড়াইখানার দিকে চলে যায়। ছেলের বন্ধু এসেছে, খালি মুখে বসিয়ে রাখা যায়? একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করা যাক। এমনিতেই ছেলেটা কখনোই অন্দরমহলে আসে না। আজ যখন এসেছে খালি মুখে যেতে দিবেন না। 

বসার ঘরে সিনান সালেহ একা বসে নখ খুঁটতে থাকে দাঁত দিয়ে। বিরক্তিতে মুখটা ঠাসা। এখানে আসাই ভুল হয়েছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে। সে যেতোও যদিনা রওশনের মা অপেক্ষায় না থাকতে বলতো। হঠাৎ নুপুরের রুমঝুম শব্দে সিনান সালেহের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে শব্দ বুনছে। পাশে তাকাতেই হাস্যোজ্জ্বল এক রমনী নজর কাড়ে। সে তৎক্ষণাৎ নজর সরিয়ে নতমুখে বসে রয়। ভুলক্রমেও তাকায় না আর সেদিকে। রূপসা ঘনঘন পলক ফেলে। শব্দ করে ফ্লোরে পা ফেলে নুপুর বাজিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে; মেহেদী রাঙা হাতে নীল রাঙা কাঁচের চুড়ি বাজায় টুংটাং! যখন কিশোরী মনটা বুঝতে পারলো তাঁর চেষ্টা সফলকাম হবে না তখন রাগ হয় প্রচুর। সবাই তাঁর দিকে মুগ্ধ চোখে হা করে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার বাহানা খোঁজে। অথচ এই খিটখিটে সিনান ভাই কথা বলা তো দূর তার দিকে ভালো করে তাকায়ই না। সে গাল ফুলিয়ে সিনানের সম্মুখে দাঁড়ালো। হাত জোড়া বাড়িয়ে বলে,

-" সিন ভাই? দেখোনা কত সুন্দর রঙ এসেছে? সুন্দর লাগছে না?"

-" হুঁ!"

তাঁর ছোট্ট জবাবে কিশোরী মন ভারী নাখোশ দেখালো। তবে সেটা সিনান সালেহের নজরে পড়েনি। পড়বে কিভাবে? তাঁর নতমুখের চাহনি যে মেঝেতে আটকে। রূপসা থমথমে অভিমানী স্বরে বলে,

-" তুমি তো দেখলেই না। না দেখে আন্দাজে বললে? এই দেখো কি সুন্দর টকটকে রঙ এসেছে!"

নাহ্ নিষ্ঠুর নির্দয় লোকটা তাকালোই না। তড়ে কিশোরী মনটা ভেঙে চুরমার করে দিল তাঁর বরফ শীতল ধারালো অস্ত্র দ্বারা,

-" আপনিতেই খুশি হবো। আমি আপনার কোনো আত্নীয় নই; না কোনো বন্ধু! তুমি ডাক শোভা দেয় না!"

রাগে অষ্টরম্ভা কিশোরী ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায়। তাঁর প্রস্থানে সিনান সালেহ আটকে রাখা শ্বাস টানলো। আলালের ঘরের দুলালিকে দেখলেই কানে নিচে চটকানা দেওয়ার ইচ্ছে জাগে!এতো ঢং এতো আহ্লাদ দেখলেই গা জ্বালা করে। সিনান সোফায় গা এলিয়ে বসে তবে আরেক নমুনার আগমনে একটু অপ্রস্তুত দেখায়। সম্মুখে দন্ডায়মান ভদ্রলোকের চোখ মুখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তাঁর এখানে আসা উনার পছন্দ হয় নি। সে ছোট্ট করে সালাম দেয়। রমজান মিয়া গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে,

-" তুই এখানে কি করছিস?"

তুই সম্বোধন টা পছন্দ হলো না সিনানের। কথা বলার ভঙ্গিমায় নিতান্তই হেয় সুর! তবুও যথেষ্ট নম্র গলায় বলে,

-" স্কুল মাঠে খেলা আছে। আমিও খেলছি সেখানে। যাওয়ার পথে রওশনের সঙ্গে দেখা। যাবে বলে টেনে এনে তৈরি হতে ছুটেছে!"

রমজান মিয়া দাঁত কিড়মিড় করে।আগে তো বাড়িতে ঢুকতো না। আজ অন্দরমহলেও ঢুকে পড়েছে! দিন দিন যেন মাথায় চড়ে বসবে। এটাকে এখানেই থামানো দরকার। এই ছোট ছোট চাল ভারী না পড়ে তাদের উপর। সে খানিকটা হেসে অপর সোফায় বসে বলে,

-" দেখ সিনান। আমি স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করি। শোন? বন্ধুত্ব বা যেকোনো সম্পর্ক সব সময় সমানে সমানে হতে হয়। একটু উনিশ বিশ মানিয়ে নেওয়া যায়। আকাশ পাতাল...? আমার ছেলেটার পিছনে ঘুর ঘুর করা বাদ দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগী হ! বুঝাতে পেরেছি?"

সিনান সালেহের গম্ভীর মুখটা অতি স্বাভাবিক। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-" আমিও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে বড্ড অপছন্দ করি চাচা স্যরি ছোট সাহেব! আপনার ছেলেকে বলে দিবেন আমার কাছে এসে বিরক্ত না করতে। আমি ভাই খেটে খাওয়া ব্যস্ত মানুষ। কাজ না করলে পেটে ভাত জোটে না। কাজ বাদ দিয়ে নামের বন্ধু টন্ধুর পেছনে ঘুরে বেড়ানোর বিন্দুমাত্র শখ নাই। আসি আসসালামুয়ালাইকুম!"

বলে অপেক্ষা করে না এক মুহূর্তও। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায় হনহনিয়ে। ছামিনা খাতুন ট্রে ভর্তি নাশতা ফলফলাদির সমাহার এনে সিনানের খোঁজ করে। রমজান মিয়া রাগি চোখে তাকিয়ে কিছু না বলেই চলে যায়। তন্মধ্যে রওশন গুনগুন করতে করতে উপস্থিত হয় সেখানে। বন্ধুকে না দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। ক্ষ্যাপাটে সিন চলে গেলো নাকি তাকে রেখে?

••••••••••

সন্ধ্যা গড়িয়ে মেদিনী একটু আঁধারে নিমজ্জিত হতেই বিদ্যুৎ মহাশয় দোর আটকে পিরিতি করতে ব্যস্ত। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে বেশি দিন হয়নি। এখনও সেভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে নি। তাই বিদ্যুৎ আসলো কি গেলো তাতে কারও হেলদোল নেই। বিদ্যুৎ এর পরলোকগমনে সুরেলা চাপা স্বরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ব্যাটারি চালিত লাইটের আলোয় কুপিতে কেরোসিন ঢেলে কুপি জ্বালায়। নিভু নিভু কুপি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে আলোকিত করে ঘর। সুরেলা লাইট নিভিয়ে কুপি হাতে দাঁড়ায়। সোনা রাঙা আলোয় শ্যামল মুখটা জ্বল জ্বল করে ওঠে। ডাগর ডাগর চোখে যেন এক অন্যরকম দ্যুতি জ্বলে ওঠে। চোখের কর্নিয়ায় ক্ষীণ আলোর প্রতিচ্ছটায় মনে হচ্ছে এ কোনো জাদুকরনী রাজকন্যা! সুরেলা কুপিটা নিয়ে উনুন পাড়ে মাটির দেয়ালের উপর রেখে দেয়। শান্তি বেগম রান্না চড়িয়েছে। শুঁটকি মাছের ঘ্রাণে সুরেলা নাক টেনে উচ্ছসিত স্বরে শুধালো,

-" শুঁটকি মাছ রান্ধছিস মা? পুঁই শাকের ডগা দিছোস নি?

-" হুম! গেদা আমার শুঁটকি মাছ চোক্ষেও দেখবার পারে না। দেখলেই তো বাড়ি মাথায় তুইলা নিবো। ঘরে আর কিছুই নাই যে!"

শান্তি বেগম বেজার মনে প্রত্যুত্তর করলো। সুরেলা চুপিচুপি গলায় আওড়ায়,

-" শাপলার মায়ে মুরগি রান্ধছে। একটু নিয়া আসি? কইলেই দিবো!"

-" এক থাপ্পড় দিমু। ছ্যাঁদড় ছেমড়ি জানি কুনকার! না খাইয়া থাকমু মানষে জানবো না। উনি তরকারি চাইতে যাইবো। আর তোর ভাই খাইবো? আলু, মুরগির ডিম সিদ্ধ দিছি। কষাইয়া দিবোনে! আপনে যেনো হেইডাতে ভাগ বসান না!"

মায়ের ধমকে সুরেলার মুখখানা চুপসে যায়। সে কি আনতে গিয়েছে নাকি। সে ধুরুমধাম পায়ে চলে যাবে শান্তি বেগম হাঁক ছেড়ে বলে,

-" কনে যাস ড্যাং ড্যাং কইরা? বিউটিরে পানি দে। শুকনা ক্ষ্যার খাইছে!"

সুরেলা কল চেপে বালতি ভরে। গরুর চাড়িতে পানি দিয়ে হাঁফ ছাড়লো। গরুর ফোঁস ফোঁস করে ছাড়া শ্বাস সুরেলার মুখে লাগতেই সুরেলা ছিটকে সরে যায়। গরুটা শুধু গা ঘেষবে। কাছে আসলেই মাথা টান টান করে গলায় হাত বুলিয়ে দিতে ইশারা করবে। এবারও তাই করলো। সুরেলা ভেংচি কেটে গলায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভালোই লাগে কি সুন্দর তুলতুলে নরম গলা।

-" নেহায়েৎ ভাই তোরে আহ্লাদ করে। বউটউ বলে ডাকে মধ্যেসধ্যে! তাই আদর করি। আদরে আদরে বাঁদর হয়ে যাস না বিউটি ভাবী!"

বলেই হেসে ওঠে। কি দিন কাল এলো ভাই! গরু কেও ভাবী ডাকতে হয়। তাঁর হাসি থামতেই সিনান সালেহের ডাক ভেসে আসে। ডাকটা শুধু তাঁর না মহাশয়ের গিন্নীর শ্রবণ ইন্দ্রিয়েও পৌঁছেছে। হাম্বা হাম্বা সুর তুলে ডাকে। সুরেলা ছোট ছোট চোখে চায়। এই দুদিনেই এতো মহব্বত? তাঁর মহব্বতের টানেই বোধহয় ছুটে এলো সিনান সালেহ। চাঁদের ম্লান আলোয় সুরেলা খেয়াল করে ভাইয়ের গলায় মেডেল। গেঞ্জিটাতেও কাঁদা মেখে আছে। নিশ্চয়ই খেলায় জিতেছে! সে খুশি হয়ে বলে,

-" ভাই তোমার দল‌ জিতছে তাই না? কি প্রাইজ দিলো?"

-" এই যে টিনের একখান মেডেল। দেড়শ টাকার একখান কাপ। সব খেলোয়াড় গোরে একশ টাকা আর ভরপেট খাওয়াইলো!"

শান্ত গলায় বলেই সিনান গলার মেডেল বিউটি নামক রমনীর গলায় পড়িয়ে ললাটে একটা চুমু এঁকে বলে,

-" আমার সোনা ময়না হাম্বা এইটা তোর।"

বিউটি খুশি হলো কিনা বোঝা গেলো না। জিভ বের করে মেডেল গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সিনান সালেহের দিকে মুখ এগিয়ে 'মোও' সুরে ডাকে। সুরেলা ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

-" তোমার বউ সোহাগ চায়। একটু সোহাগ করো?"

বলেই হাসতে হাসতে চলে যায়। সিনান সালেহ ধমক দিতে গিয়েও দেয় না। সুরেলা উনুন পাড়ে পিঁড়ি পেতে বসে। শান্তি বেগম সিলবার কার্প মাছ কুটছে, সুরেলা গালে হাত দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে।মাছ কাটা দেখতে ভালোই লাগছে।সিনান গোরপাড় থেকে বেরিয়ে এলে শান্তি বেগম তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

-" গেদা মাছ তো আনছিস! তরি তরকারি কিছুই নাই। হলুদ, রসুন ও আনা লাগতো!"

-" খালি নাই নাই নাই! ওইডা আনো এইডা আনো। আমি তো আছি হুকুমের গোলাম। যার যা দরকার খালি কবি আইনা দিমু! সাথে ট্যাকার বান্ডিলও দিস। বাড়িতে আসতে পারি না ওনাদের শুরু হইয়া যায়।"

খ্যাঁক করে ওঠে মায়ের উপর। শান্তি বেগম কাঁচুমাচু মুখে মাছ কাটায় মনোযোগী হয়। মেজাজ সবসময় তাআয় উঠে থাকে! সুরেলা ভাবে মানে মানে কেটে পড়বে। কেননা ভাই এর পরের গোস্বা তাঁর উপরেই যে ঝাড়বে। তবে কেটে পড়ার আগেই ঝাড়ি একটা খেলোই। সিনান সালেহ ধমকে বলে,

-" কই যাস তুই? সারাদিন খালি টই টই কইরা বেড়াস। বাড়ির কাজ করতে গা চুলকায়? দু'দিন পর শাশুড়ির ঝাটার বাড়ি খাইয়া ফিরলে খবর আছে!"

সুরেলা করুন মুখ বানিয়ে মায়ের পাশে বসে। মা মেয়ে দুজনের মুখটাই চুপসানো বেলুনের মতো হয়ে আছে।

নিকষ আঁধারে নিমজ্জিত অন্ধকারে দূর অম্বরে জোৎস্নার মেলা বসেছে। সেই জোৎস্নার আলোয় শুকনো মাটির উঠোনটাও যেন চকচক করছে। উঠোনের এক কোনায় গোরপাড়ে গরুটা বসে জাবর কাটছে। মশা মাছি ভোঁ ভোঁ শব্দের সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গোয়াল ঘরের পেছনের দিকটায় বাঁশঝাড়ে কিছু একটা আছে ‌। শুকনো বাঁশের পাতা মড়মড়ে শব্দ সৃষ্টি করছে ‌ শেয়াল হতে পারে! বারান্দায় বসে সালেহউদ্দিন হোঁ হোঁ ধ্বনিতে ডেকে উঠতেই বাড়ির উঠোনের কুকুর ছুটে এসে ভুক ভুক ধ্বনি তুলে ঝোপঝাড়ের দিকে ছুটে যায়। সালেহউদ্দিন খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। দোচালা ঘরের রোয়াকে পাটি পেতে খেতে বসেছে বাবা ছেলে। কুপির নিভু নিভু আলোই সম্বল। বিদ্যুৎ মহাশয়ের খবর এখনো পাওয়া যায় নি। এরমধ্যেই কুপির কেরোসিন ফুরিয়ে যেতে বসেছে। শান্তি বেগম ছেলের পাতে ভাত দেন। সালেহউদ্দিনের পাতেও দিবে তিনি বারণ করে বলে,

-" কি সব হুনি তোর পোলার নামে? কি সব দল বানাইবো! পাশের এলাকার সুরুজ হারাম খোরের সাথে গুসুর ফুসুর আলাপ চালায়। চেয়ারম্যান বাড়ি এ নিয়া কথা হয় হেয় খোঁজ কি রাহে? এসব থাইকা দূরে থাকতো কইস!"

শান্তি বেগম অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকায়। সিনান বিরক্ত হয় ঢের। কাঠ কাঠ সুরে বলে,

-" আপনার মাথা হেগের মুন্ডু! দল বানাবো তবে সেইটা স্বেচ্ছাসেবক দল। রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো উঠবস নাই। গ্রামের উন্নয়ন আর সাধারণ মানুষের জন্য এই দল। রিজ ভাই নিজে সাহায্যের হাত বাড়ায়ে দিছে।"

সালেহউদ্দিন পুরোপুরি না বুঝলেও আর কথা বলার সাহস করে না। শান্তি বেগম ছেলের হয়ে গোটাকয়েক গুনের কথা গায়। গর্ব করে বলে,

-" গরিবের ঘরে জন্ম নিছে তো কি হইছে? আমার পোলা রাজপুত্তুর আমার কাছে। এইটুকু থাইকাই সংসারে শুধু দিয়াই যাইতেছে। অথচ ওর সাথ কার পোলাপাইন বিয়া কইরা বউ নিয়া আলাদা খায়। বাপ মায়ের খোঁজ অবদি নেয় না।"

সালেহউদ্দিন বিরক্ত হলেও কিছু বলে না; খাওয়ার মাঝেই বা হাতে পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা মলিন নোট বের করে সিনানের ভাতের থালার সামনে রেখে বলে,

-" কাল চেয়ারম্যান আইবো বাত্তে। ভালো মন্দ কয়ডা খাওয়ার জোগাড় করিস। এই পাঁচশর সাথে কিছু ভইরা বাজার করে আনিস! শান্তি তোর বড় লাল মোরগটা জবাই দিস!"

শান্তি বেগম ভাবনায় পড়ে হঠাৎ চেয়ারম্যান আসার কারণ? তাদের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করবেন তো? সিনানের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে।তবে টাকাটা পকেটে তুলতে সময় নেয় না।ঢকে ঢকে পানি পান করে বলে,

-" গরিবের বাড়ি হাতির পারা? উদ্দেশ্য টা কি? তাদের বাড়ির দুলালিরে দিবো না কি? তয় আমার বিয়ে সাদি করার দেড়ি আছে আব্বা!"

তাঁর স্পষ্ট গলা। সালেহউদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,

-" মাটিতে বইসা চাঁন্দ ধরার শখ পোলার। সুরের জন্য বিয়ার প্রস্তাব দিছে একখান!"

সিনান অবাক হয় ঢের। বিয়ের প্রস্তাব? নিশ্চয়ই রওশনের জন্য! নিমিষেই মেজাজ বিগড়ে যায়। বিকেলের অপমান টা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আজ বিকেলের আগে হলেও সে খুশি হতো কিন্তু এখন খুশি হতে পারলো না। বন্ধু বা যেকোনো সম্পর্ক সমানে সমানে হতে হয় যে।নইলে সুখ অনুভব করা যায় না।আকাশ আর পাতালের সম্পর্ক হয় বুঝি? অন্যদিকে শান্তি বেগম বেজায় খুশি হয়। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,

-" কও কি? বিয়ার প্রস্তাব? কার লগে?"

-" খুশি হওনের দরকার নাই। ওই মহির আছে না আমাদের লগে ঘোরে ফিরে? ওর লগেই বিয়া ধরছে!"

সালেহউদ্দিনের কথায় সিনান অবাক হতে নিয়েও হয় না। নিজের উপরই হাসি পায়। কি উটকো ভাবনা তাঁর। সে হেসে বলে,

-" ভালোই তো। পছন্দ হইলে দিয়া দেন। এমনিতেও পাত্রপক্ষ শুধু আসে আর খেয়ে দেয়ে সাবাড় করে সেই যে ফেরোয়ারি হয়!জবাব টাও দেয় না! এটা তো বাড়ির কাছেই। মেয়েও চোখে চোখে থাকবো।"

সালেহউদ্দিন অবাক হয় ঢের। এটা কি সত্যিই সিনান বলছে? সে অবাক স্বরে শুধালো,

-" কি কস? আমি তো ভাবছিলাম তুই শুইনাই বাড়ি ঘর মাথায় তুলবি। তাছাড়াও আমারও মত নাই। মহির আমার মাইয়ার যোগ্যই না!অহন চেয়ারম্যান সাবের মুখের উপর তো না করতে পারি না। আইলে তুই মানা কইরা দিস!"

সিনান খাবার শেষ করে থালায় হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। গামছায় মুখ মুছে বলে,

-" আমি মানা করার কে? আপনের মাইয়া আপনে যা ভালো বুঝেন করেন! আমি এর মধ্যে নাই। কিভাবে বিয়া দিবেন খরচা পাতিরও একটু হদিস কইরেন! আর মহির তো আপনার লগেই ঘোরে ফিরে। বাপ মা নাই একলার সংসার করবো!"

-" এক নম্বরের ধরিবাজ ও! লুইচ্চাও।কয় ট্যাকা কামাই করে? বউ ছল পালবার পারবো? নেশা পানিও খায়। তার লগে সংসার করতে পারবো সুর?"

-" ক্যান পারবো না? আমার মায়ে সংসার করতেছে না? সুরও পারবো! আপনি কয় ট্যাকা কামান? কয়ট্যাকা দেন সংসারে? নেশা পানি খান না?"

সিনান সালেহের গম্ভীর হেয় সুর। সালেহউদ্দিনের মুখটায় যেন কেউ ঝামা ঘষে দিলো। স্বীয় ছেলের কাছে এভাবে অপমানিত হয়ে বেশ চটে যান। ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে হনহনিয়ে বাড়ির আঙিনা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। শান্তি বেগম আতংকিত হয়ে ক্রন্দনরত দূর্বল গলায় বলে,

-" সিনের আব্বা? কই যান এই রাইতের বেলায়।"

কিন্তু তার গলা শোনার কেউ অপেক্ষায় নেই। সিনান তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে বলে,

-" তুই কান্দস ক্যান? মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্তই! খাইয়া নি জলদি কইরা! আমি বিউটিরে ঘরে তুলি!"

বলেই গুনগুন করতে করতে সে গরুর কাছে চলে যায়। শান্তি বেগম আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদে। কান্নার সুর ছেলে অবদি পৌঁছালে আবার শুরু হবে আরেক কেচ্ছা। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ফেলে বনে বাদাড়ে ঘুরতে ফিরতে। শান্তির জীবনে এই অশান্তির শেষ কোথায়?

কপাটের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সুরেলা সরে যায়। শান্ত সুবোধ বালিকার ন্যায় চৌকিতে উঠে কাঁথায় গলা অবধি ঢেকে নেয়। কাঠের জানালার কপাট খুলে দূর অম্বরে জোৎস্না ঢালা শশধরের পানে চাকায় উদাসীন চোখে। জানালা দিয়ে উঁকি দেয় এক মুঠো জোৎস্না। কিশোরী হাসিমুখে তাকে বরণ করে নেয় না। সখী জোৎস্নার সাথে রোজকার গল্পের খুঁটিনাটি শোনায় না। অভিযোগের সুর তোলে না সুরেলা। তাকে উপেক্ষা করে স্বীয় উদাসীকে বেছে নেয় কিশোরী। সখী তাঁর ভেংচি কেটে চলে যায় দূরত্ব মেপে। সাথে সাথেই কিশোরীর আঁখি যুগ্ম ভরে ওঠে বিষাদে।
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp