সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সেহরিশকে খুবই প্রানবন্ত আর উচ্ছল দেখাল। রোদেলা ও সোহাকে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে একসঙ্গে নিচে নামল। নাস্তা শেষ করে এগারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সেহরিশ। চলে যাওয়ার আগে সোহাকে কথা দিয়ে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে সে।
দুপুর বারোটা নাগাদ সেহরিশ তার বিলাসবহুল জেগান ভিলায় এসে উপস্থিত হলো। ওর আসার আগেই সাদাফ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেহরক্ষী ও কয়েকজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের মানুষ কে সঙ্গে নিয়ে এসেছে । মি. এজম এরদান বললেন, 'আমরা লোকটির সন্ধ্যান পেয়েছি। গত সপ্তাহে যে লোকগুলো ধরে আনা হয়েছিল তাদের মধ্যে একজনের পকেটে একটা কাগজ পাওয়া গেছে। সে কাগজে ছোটো ছোটো অক্ষরে লিখা আছে মিলান শহরের ছোট্ট এক গ্রামের বাড়ির নম্বর। মৃত্যুর আগে লোকটা বলেছে এই বাড়িতেই থাকছে তাদের বস। আপনার অনুমতি ছাড়া আমরা কোনো কিছু করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি। এবার আপনি বলুন আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।'
সেহরিশ চোট করেই কিছু বলল না। খানিক ভাবলো, সেহরিশ বলল, 'আমরা এখনই মিলানো যাব। আমার ধারণা ওদের বসকে সেখানেই পাব।'
ছয় ঘন্টার পথ! গুগল ম্যাপে লোকেশন চেক করে সেদিকে এগিয়ে গেল। পুরোনো সব বাড়িঘর। আশেপাশের লোকজন উৎসুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে ওদের দেখছে। ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক দুজন গার্ড পাঠায়। এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ওদের কথাবার্তা শেষ দু'জনে ফিরে আসে। ফ্রাঙ্ক জিজ্ঞেস করল, 'কিছু জানতে পারলে?'
প্রথমজন বলল,
'হ্যাঁ! এই সোজা রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। এই রাস্তার শেষ মাথায় একটা ছোটো অরণ্য আছে আর অরণ্যের অনেকটা ভেতরে আছে দুইতলা বাড়ি। মাঝে মাঝে ওই বাড়িতে অনেকগুলো মানুষকে থাকতে দেখা যায়। স্থানীয়দের ধারণা ওরা কোনো ভালো মানুষ না কারণ দুই একজনের হাতে বন্দুক দেখেছে তারা। ভয়ে এই গ্রামের কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলতে যায় নি।'
সেহরিশ ওর কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেল। ফ্রাঙ্কের উদ্দেশ্য শক্ত গলায় বলল, 'সবাইকে বলো সতর্ক থাকার জন্য। যেকোনো সময় হামলা হলে ওরা যেনো পাল্টা হামলা করতে পারে।'
ফ্রাঙ্ক সেহরিশের কথামতো সবাইকে সতর্ক করে। এরপর বাগানের দিকে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগল।
সেহরিশের ধারণা এখানে একদম উল্টে গেল। অরণ্যের ঠিক মাঝখানে সাদা রঙের একটা বাড়ি সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাহির থেকে দেখে মনে হচ্ছে এখানে কেউ নেই। খুব সাবধানে ওরা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। চারিদিক বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। খাবার টেবিলে এখনো এ্যাঁটো খাবার পড়ে আছে। যার অর্থ এখানে মানুষ ছিল। এখন নেই। সাদাফ বলল, 'চারিদিক ফাঁকা। কেউ নেই। সবাই তো আমার আসার খবর আগেই জানতে পারে তারপর পালিয়েছে।'
সেহরিশ কথা বলল না। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সব। বেশ খানিকক্ষণ পর মুখ খুলল সেহরিশ। বলল, 'উঁহু, ওরা আমাদের আসার খবর শুনে পলায়নি। কারণ তারা আজ নয় এই জায়গা ছেড়ে চলে গেছে গতকাল।'
সাদাফ বিস্ফোরিত হলো। জিজ্ঞেস করল,
'তুই কি করে বুঝলি গতকাল গিয়েছে?'
'খাবার থেকে একটা বাজে স্মেল আসছে। প্লেটে খাবার শুকিয়ে চলটা লেগে গেছে। তাছাড়া যাওয়ার আগে এই বাড়ির মালিক চারিদিক গুছিয়ে রেখে গেছেন। সে যদি পালাতো এতো কিছু করার সময় পেতো না। তাছাড়া উপর তলার একটা ঘরে ঢুকে ছিলাম। দেয়ালের একপাশ শুধু আমাদের মুখ দিয়ে ভরা।'
সাদাফ ভ্রু কুঞ্চিত করে। বলল,
'মানে?'
সেহরিশ হাসল। খুব সামান্য। তারপর বলল,
'দেয়ালে আমাদের ছবি টাঙানো আছে। আর ছবির উপর লাল কালির দাগ ও সাথে চাকুর কোপ। মনে হচ্ছে এর পেছনে যে আছে সে আমাদের প্রাণ নিতেই মেতে উঠেছে। বলে থামল সেহরিশ। তর্জনী আঙুল ঠোঁট ছোঁয় খানিক ভাবলো তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে ফের বলল, 'বাড়ির চারপাশটা না দেখে স্বস্তি পাচ্ছি না।'
সকলে একইসঙ্গে বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখল, গাছের পাতার তলায় বেশ কিছু জুতার ছাপ। সেহরিশ নিজেই পাতা সরিয়ে দেখতে লাগল। এই গোটা সময় একটা কথাও বলেনি সাদাফ। কাজ করতে দিয়েছে সেহরিশ কে। গাছের পাতার তলায় একটা আংটি খুঁজে পেয়েছে সেহরিশ। আংটি নিয়ে এল সাদাফের কাছে।
মি. এজম এরদান ছো মেরে আংটিটা হাতে নিল। উল্টেপাল্টে দেখল কিছুক্ষণ। হুট করে বলে উঠল, 'এইটা সাধারণ আংটি না। এর উপর ঢাকনস সিস্টেম করা৷ আর এর নিচে আছে প্রাণঘাতী বিষ।'
সাদাফ ভ্রু কুঞ্চিত করল। শুধাল,
'তুমি কি করে বুঝলে এর মধ্যে বিষ আছে?'
মি. এজম এরদান কথা বলল না। নখ দিয়ে খুঁচিয়ে উপরের শক্ত ঢাকনা সিস্টেমটা খুলল সে। সেহরিশের দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমরা যাদের ধরে নিয়ে যেতাম তারা হুট করে মারা যেতো। অথচ আত্মহত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র আমরা তাদের কাছে পাই না বা রাখি না। এই প্রশ্নটা আমার মাথায় অনেক দিন ধরেই ছিল। এই বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক রিসার্চ করেছি। তখনই এমন একটি বিষয় ধরতে পারি। কিন্তু ততদিনে লাশ গুলো আমরা সমুদ্রের তলায় পৌঁছে দিই নয়তো আগুনে পুড়িয়ে ফেলি। কিন্তু আজ এই আংটির সিস্টেম দেখে আমি শতভাগ নিশ্চিত হই। এই বিষ শরীরে প্রবেশ করার পাঁচ মিনিটে মানুষ কে মেরে ফেলে।'
সেহরিশ নাছোড় গলায় বলল, 'খোঁজা খুঁজি করলে আরও কিছু তথ্য পেতে পারি। যা আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সে ধারণা দিবে।'
এইসময় ফ্রাঙ্ক বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে এল। তার হাতে একখানা কাগজ। ফ্রাঙ্ক হাঁপাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে ফ্রাঙ্ক ফিসফিসে গলায় সেহরিশের কানে কানে বলল, 'বস, এই কাগজটা দেখুন।'
এই বলে সেহরিশের দিকে কাগজটা এগিয়ে দিল। সেহরিশ দেখল, কাগজের উপর তারই ছবি। ছবিটির নিচে ডানে লিখা সেহরিশ ও বামে লিখা জেগান। সেহরিশ নামের নিচে এপর্যন্ত যতজনকে মারা হয়েছে সবার নাম লিখা আছে। আর জেগান নামের নিচে লিখা আছে, জেগানের প্রখর বুদ্ধিমতা ও শত্রুকে ঘায়েল করার সব ধরনের টেকনিক। সেহরিশ চোখ বুজে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।
শত্রু তার খুব কাছের কেউ! কিন্তু কে? কাগজের লেখা প্রিন্ট করা। সেহরিশ চোয়াল শক্ত করল। ভারী গলায় বলল, 'আমাদের এখানে থেকে আর কাজ নেই। যত জলদি সম্ভব রোমে ফিরে চল।'
কথাটা শেষ করে সাদাফের দিকে তাকাল সেহরিশ। বলল, 'আমরা হেলিকপ্টারে যাব। আমাদের শত্রু যেই হোক সে আগে থেকে বুঝতে পারছিল আমরা এখানে আসব। তাই দলবল নিয়ে রোমে চলে গেছে। আমাদের জলদি পৌঁছাতে হবে। জলদি।'
মি. দাসন কৌতূহলি হয়ে জিজ্ঞেস করল, 'বস, আপনি কি করে বুঝলেন শত্রু রোমে অবস্থান করছে?'
সেহরিশ কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। সমস্বরে বলল, 'আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে বলছে ওরা রোমে আছে। কারণ আমাদের পরিবার সেখানেই।'
রাত একটা নাগাদ বাড়ি এল। রুমে ঢুকে সোহাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সেহরিশ। রোদেলা তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশের দিকে তোয়ালে এগিয়ে দিল। রোদেলা বলল, 'এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আমি জিজ্ঞেস করব না৷ নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আটকে গেছিলেন। আপনি কথা দিয়ে গেছেন ওকে তাড়াতাড়ি আসবেন।' কথাটা শেষ করে রোদেলা ইশারায় সোহাকে দেখাল। সেহরিশ গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল রোদেলা। জড়িয়ে ধরল সন্তপর্ণে। এভাবেই থাকল দীর্ঘক্ষণ। একটুও নড়ল না। রোদেলা নিশ্চুপ। সেহরিশ ছোটো বাচ্চার মতোন মিশে যেতে চাইছে রোদেলার বুকের মাঝে। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সারাদিনের ধকলের পর শরীর আর চলছিল না। সবটুকু ভার ছেড়ে দিল সেহরিশ। সঙ্গে সঙ্গে রোদেলা তাকে শক্ত করে ধরল। কিন্তু অমন বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ কে সে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না। সেহরিশ নিজেকে মূহুর্তে সামলে নিল। বলল, 'আমার সর্বস্তরের লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা তুমি। রোদ!'
রোদেলা থমকাল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইল সে। এভাবে ভালোবাসার কথা মানুষটা তাকে কখনো বলে নি। কিংবা আমি তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটিও সেহরিশ তাকে আজ পর্যন্ত বলে নি৷ কিন্তু ভালোবাসা প্রতিটি কাজে ও পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়েছে রোজ।
••••••••••••••••
অনেক দিন বাদে সেহরিশ আবারও তার জেগান রূপে ফিরে এল। তার ভাবনার ভুবনে একে একে আলোড়ন তুলতে লাগল অদৃশ্য শত্রুর মুখোশ উন্মোচন। একের পর এক কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তই সে নিতে পারছিল না। এখন থেকে এক এক করে সবগুলো হত্যাকান্ড মেলাবে সেহরিশ। আবারও গবেষণা করবে সব ঘটনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। সেহরিশ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে যাবে জেগান ভিলার উদ্দেশ্য। সেহরিশ তার শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে একবার তাকাল রোদেলার দিকে। রোদেলা জিজ্ঞেস করল, 'এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছেন?'
সেহরিশ স্পষ্ট করে কিছু বলল না। রোদেলার কপালে আলতোভাবে চুমু খায়। এরপর বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। দুপুরের খাবার শেষে ঘুমিয়েছে সোহা। এখন একটানা তিনঘণ্টা ঘুমাবে সে। এই তিনঘণ্টার মধ্যে সেহরিশ চলে আসবে। সোহার কপালে ছড়িয়ে পড়ে আছে ওর ছোটো ছোটো চুল। চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় সেহরিশ। রোদেলা বলল, 'আপনি ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন কেনো? আপনার ফিরে আসতে কত দেরি হবে?'
সেহরিশ স্মিত হাসি মুখে বলল,
'এটা সাদাফকে দিতে হবে। এই ব্যাগের কাজ আমার না। এটা সাদাফকে দেবো আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষ করেই তোমার কাছে চলে আসব।'
এই বলে বিছানা থেকে উঠল সেহরিশ। সোহার ঘুমন্ত মুখটা একবার ঘুরে দেখল তারপর রোদেলার হাত ধরে বলল, 'চলো! তুমি আজ হাঁটতে হাঁটতে আমার সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত যাবে।'
রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'আপনি যতক্ষণ না যাবেন ততক্ষণ গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকব? এইতো।'
সেহরিশের গালভরা হাসি। বলল, 'হুম। ঠিক বুঝেছ। এবার চলো।'
সেহরিশ রোদেলার হাতখানা ধরে চলতে লাগল। সেহরিশ বের হবে এজন্য পাঁচটা গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বডিগার্ডরা লম্বা সারি বেঁধে দাঁড়ানো। ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক সেহরিশের গাড়ির দরজার সামনে আছে। সেহরিশের পাশে রোদকে দেখে মাথা নিচু করল সবাই। গাড়ির ঠিক সামনে এসে থামল সেহরিশ। রোদেলার কাঁধের উপর হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বলল,
'আমার জন্য অপেক্ষা কোরো। আমরা আজ সোহাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে।' রোদেলা মাথা নাড়লো। সেহরিশ একটু ভেবে বলল, 'আর রোদ, তুমি সারাদিন এটা ওটা করতেই থাকো। বাড়িতে এতগুলো স্টাফ আছে কি জন্য? শুনি! শোনো তোমার কিছুই করতে হবে না। তুমি এখন গিয়ে সোহার সঙ্গে ঘুমাবে। বুঝেছ?'
রোদেলা ঠোঁট টিপে হাসল। এটা দেখে সেহরিশও না হেসে পারল না। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হলো। প্রবল বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে চারিপাশ। শব্দ শুনে সেহরিশ ভিলার দিকে ছুটে আসে সেহরিশ, রোদেলা, ফ্রাঙ্ক ও বডিগার্ডরা। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। বাড়ির দেয়াল ভেঙে পড়ছে। আগুন নেভানোর জন্য ছুটে যায় বডিগার্ডরা। ফ্রাঙ্ক দ্রুত ফায়ারসার্ভিস অফিসে কল করে। আগুনে দগ্ধ হয়েছে বাড়ির ভেতর বিশজন স্টাফ ও সোহা। সেহরিশ হতভম্ব হয়ে গেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইল সে।
সোহার কথা হঠাৎ রোদেলার মনে এল। রোদেলা মূহুর্তে উন্মাদের মতন করতে লাগল। চিৎকার করে করে বলল, 'আমার সোহা! সোহা রুমে ঘুমাচ্ছে। ওকে বাঁচান। আমার সোহা।'
রোদেলা কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। তাকে দু'হাতে ধরল সেহরিশ। ভয়াবহ অগ্নিকান্ড দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছিল প্রায়। রোদেলা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে বাস্তবে ফিরে এল সেহরিশ। রোদেলা কে সুরক্ষিত জায়গায় রেখে ছুটে যেতে লাগল বাড়ির সদরদরজার দিকে। ফ্রাঙ্ক পিছু নিল তার। দুইহাতে জাপ্টে ধরল সেহরিশকে। এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে সে প্রবেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে। সেহরিশ প্রাণপণ চেষ্টা করল ফ্রাঙ্কের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর। বলল,
'ছাড়ো আমায়। আমার রাজকুমারী ভেতর ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তাকে বাঁচাতে হবে যেতে দাও আমাকে।'
ফ্রাঙ্ক ছাড়লো না। ওর সাথে যুক্ত হলো তিন থেকে চারজন বডিগার্ড।
একটু পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এল। তার পরপরই আসে পুলিশ। দুই ঘন্টা পর বাড়ির আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ততক্ষণে সব শেষ। সেহরিশ বিধস্ত অবস্থায় বসে আছে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আগুনের উত্তাপের কারণে বাড়ির কাছাকাছি ঘেঁষা যাচ্ছে না। চারিদিকটা খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগল পুলিশ। পুলিশ অফিসার জানায় বাড়ির ভেতর কোথাও আগে থেকে বোমা রাখা ছিল। আর বোমা বিস্ফোরণের কারণে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেহরিশ ফ্রাঙ্কের দিকে তাকাল। এক সপ্তাহের ভেতর বাহিরের কেউ বাড়িতে আসে নি। শুধু বাড়ি পরিস্কার করার জন্য চারজন কর্মী এসেছিল। বাড়ির উত্তর দিক থেকে হ্রাস ছুটে আসে। বলল, 'স্যার, দেখবেন চলুন।'
সেহরিশ ও কয়েকজন পুলিশ অফিসার তার পিছু পিছু এল। সেহরিশের বাড়ির উত্তর দিকের দেয়ালে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা, 'Vendetta' সেহরিশের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। vendetta ইটালিয়ান শব্দ। এর অর্থ প্রতিশোধ!
জেগান ভিলা! সেহরিশ রোদেলাকে সোজা করে বিছানায় শুইয়ে দিল। এরপর পাতলা কম্বল দিয়ে শরীর ঢেকে দিল। সাদাফ অকারণে দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশের অভিব্যক্তিকে আমলে নিয়ে বলল, 'কিছু কি লক্ষ্য করছিস?'
সেহরিশ তাকাল। জিজ্ঞেস করল, 'কি বিষয়ে?'
'যেভাবে আমরা গোডাউনে আগুন লাগিয়েছি...' সাদাফ বলতে বলতে থেমে গেল, রোদেলার দিকে তাকিয়ে ফের সেহরিশের দিকে তাকিয়ে বলল, 'এখানে নয়। বাহিরে চল।'
সেহরিশ বাহিরে এল। সাদাফ বলল, 'দুই বছর আগে রোদেলাকে সে রাতে যে গোডাউন থেকে উদ্ধার করার পর। ওই গোডাউন আমরা আগুনে জ্বালিয়ে দিছিলাম। সেখ আমরা ছাড়াও তৃতীয় ব্যক্তি ছিল। যে মার্কাসের গাড়ি করে আসছিল। আমরা তাকে পাইনি। সে-ই কিন্তু আসল কালপ্রিট।'
সেহরিশ মেরুদণ্ড টানটান করে বলল, 'মানুষ মাত্রই ভুল। মানুষ যখন নিজেকে সবচেয়ে বড় ভাবতে শুরু করে তখনই নিজের অজান্তেই মারাত্মক ভুল করে বসে। আর জন্য সারা জীবন আফসোস করতে হয়।' সাদাফ ভ্রু কুঞ্চিত করল। সে সেহরিশের কথার অর্থ বোঝেনি। সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। ফোনের গ্যালারিতে গেল। দেয়ালে লিখা Vendetta শব্দটির একটা ছবি তুলে নিয়ে এসেছে সেহরিশ। সাদাফের দিকে ফোনটা ঘুরিয়ে দিল। সাদাফ দেখল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, 'এটা তো দেখেছি। আবার দেখাচ্ছিস কেন?'
সেহরিশ চাপা হাসল। বলল, 'শত্রুর ভুল। ও নিজেকে খুব সেয়ানা মনে করে। অতি চালাক হতে গিয়ে মারাত্মক ভুল করে গেছে। Vendetta এই লেখার ধরণ অন্য রকম।
সাদাফ আবারও ভালো করে দেখে জিজ্ঞেস করল,
'কেমন?'
সেহরিশ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
'আমাদের শত্রু কে? আমি ধরতে পারছি। এই হাতের লেখার ধরণ শুধু একজনেরই।'
সাদাফ জানতে চাইল,
'কে? আর লেখাটা কার?'
সেহরিশ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
'জোহান।' কথাটা বলে বেশ খানিকক্ষণ সাদাফের দিকে তাকিয়ে রইল সেহরিশ। বলল,
'জোহানের লেখার স্টাইল আমি কখনই ভুলব না।'
সাদাফ নিশ্চুপ। সেহরিশ শক্ত গলায় বলল,
'আমি সম্ভবত জানি জোহান এই মুহূর্তে কোথায় থাকতে পারে। আমি এখনই তার সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে যাব। সে তার সমস্ত অন্যায়ের শাস্তি পাবে।' সেহরিশ থামল। একটু পর সাদাফের কাঁধে হাত রেখে ফের বলল, 'আমি না আসা পর্যন্ত রোদেলার দেখাশোনার দায়িত্ব তোর।'
সাদাফ বলল, 'জোহান এত কিছু করেছে। আমি ভাবতেও পারছি না।'
'জোহান কে আমরা কখনো সন্দেহ করিনি। তার স্বভাবের সাথে এতো জঘন্য সাজিস যায় না। তবু সে করেছে। তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে।'
'তোর কি ধারণা জোহান এখন কোথায় আছে?'
'পম্পেই!'
'ও ওখানে কি করবে? সে জায়গা তো ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুদ্ধ আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত আগুনে ছাই হয়ে গিয়েছিল।'
'রোম শহরের খুব কাছেই কিন্তু সাধারণত কোন সাধারণ মানুষের পায়ের ধুলো পড়ে না ওখানে, ফলে আশ্চর্য ভাবে সেসকলের লোকচক্ষুর অন্তরালেই ওখানে থাকতে পারে।'
'তুই কিভাবে সিওর হচ্ছিস যে তোর ধারণা 100% সঠিক হবে?'
'হাই-স্কুলে জোহানকে অনেকবার বলতে শুনেছি।'
'কী?'
'জোহান শান্ত জায়গা পছন্দ করে। যাতে সে কখনো লুকিয়ে থাকলে কেউ তাকে খুঁজে না পায় আর এই ধরনের জায়গাগুলির মধ্যে সে পম্পেইকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।'
'আমি তোর সঙ্গে যাব।' উদ্বিগ্ন গলায় বলল সাদাফ।
'নাহ! আমি একা যাব।'
•••••••••••••••
রোদেলা চোখ খুলে চারদিকে তাকাল। ঝাপসা চোখে সে কিছুই স্পষ্ট দেখতে পেল না। দু'হাতে চোখ কচলাতে লাগল। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে বসল রোদ। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিতে আঁতকে উঠল সে। অচেনা বাড়ি। চার দেয়ালের রঙ কালো, আর লাল রঙের রেক । রোদেলা মেঝেতে পা রাখল। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে মাথায় হাত রেখে ভাবতে লাগল তার এখানে আসার কারণ। কিছুক্ষণ পরেই তার চোখজোড়া কোল থেকে বেয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা। রুম থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো ছুটতে লাগল রোদেলা। পুরো বাড়িতে সে একা! কোথাও কেউ নেই। আরও একবার আঁতকে উঠল সে। সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নিচে নামল। এবার কোনদিকে যাবে? এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তা নির্বাচন করে বামদিকে দৌঁড়ে গেল। বিশাল এক অন্দরমহলে এসে পৌঁছালো রোদেলা। দামি দামি আসবাবপত্র গুলো সে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। বুকের ভেতর ভয় তখন ভয়াবহ ভাবে চেপে বসেছে। দুটো চিন্তা তার মাথায় ঘুরছে। এক. সে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। দুই. তাকে আবারও কেউ কিডনেপ করেছে। রোদেলার গলা শুকিয়ে গেল। ভয়ার্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে তাকাল। অন্য দিকে তাকিয়ে পেছনে যেতে লাগল রোদেলা। সহসা ওর হাতখানা লাগল টেবিলের কোনায়। সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের নিচ থেকে একটা গুপ্ত দরজা খুলে গেল। রোদেলার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গেছে। সে সঙ্গে বুকে জমাটবদ্ধ হচ্ছে কৌতূহল! রোদেলা পা বাড়াল। সরু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল সে। চারিদিক স্বচ্ছ, লাইটগুলোর আলোয় সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রোদো নিশ্চল হেঁটে যেতে লাগল। কারাগারের মতো একেকটি কক্ষ, দরজায় সবগুলোয় তালা ঝুলছে। ভেতরে তার যন্ত্রপাতি বানানোর জিনিসপত্র। একটা ঘরে ঢুকে থমকে গেল রোদেলা। অস্ত্রসজ্জিত রুমটা দেখে থরথর করে কাঁপতে লাগল রোদেলা। সে যে পথে এসে পথেই দৌঁড়ে পালালো। রোদেলা টেবিলের সে সুইচটা আবারও চাপলো। নিঃশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে রোদ। সহসা একটা কণ্ঠস্বর শুনে তটস্থ হয়ে গেল সে।
সাদাফ বলল,
'রোদেলা কি করছ এখানে? আমি তোমাকে সে কখন থেকে খুঁজছি। তোমাকে রুমে দেখতে না পেয়ে সারা বাড়ি খুঁজে ফেলছি।'
রোদেলা ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখে পানি টলমল করছে। রোদেলা রূঢ় গলায় জিজ্ঞেস করল, 'এসব কি হচ্ছে ভাই? আমি সত্যটা জানতে চাই। একের পর এক খুন, কিডনেপ, বাড়িতে আগুন, আর আমি এখানে কি করে আসলাম? তাছাড়া আমার সোহা কোথায়? আমি এসব কিছুর উত্তর জানতে চাই। সত্যটা আমাকে বলুন।'
সাদাফ আড়চোখে রোদেলার পেছনের টেবিলটা দেখল। প্রশ্নবিদ্ধ করল রোদেলাকে। সাদাফ বলল, 'গুপ্তকক্ষে গিয়েছিলে?'
রোদেলা চোট করে জবাব দিল না। একবার ঘুরে পেছনে তাকাল সে। তারপর নিবিড়ভাবে উপরনিচ মাথা নাড়লো। সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। এখন আর কোনো কিছু লুকিয়ে ফায়দা নেই। সাদাফ বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে জেগান এর সত্যিটা রোদেলা কে জানালো। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে রোদেলা। পৃথিবীর আর কোনো কিছুই জেনো তাকে স্পর্শ করছে না। সাদাফ বার দুয়েক তাকে ডাকলো।
রোদেলা তটস্থ গলায় বলল,
'আমি যাবো তার কাছে। আমাকে নিয়ে চলুন।'
সাদাফ শুধাল,
'তার কাছ কোথায়?'
'উনি যেখানে গেছেন সেখানে, পম্পেই।'
সাদাফের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। রোদেলার শান্ত স্বভাব দেখে কি করবে বুঝতে পারছে না।
.
.
.
চলবে.........................................................................