বুড়ো আঙ্গুলটা লাল হয়ে গেছে। ফলে উৎকন্ঠিত চিংকি সাথে সাথে নিজের ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরলো আঙ্গুলটা। জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার শিরদাঁড়ায় উষ্ণ রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। নরম ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো শরীর। শিরা উপশিরায় রক্তের বেগ বাড়লো। স্পন্দিত হল হৃদয়। জাওয়াদের উচিত স্বভাববশত হাতটি সরিয়ে নেওয়া। অতিরিক্ত পরিষ্কার স্বভাবের কারণে এসব তার পছন্দ নয়। তার প্রাক্তন শাম্মী যখন তার কাছে আসতে চাইতো সে এড়িয়ে যেত। ফলে শাম্মীর মনে হতো জাওয়াদ তার প্রতি আকৃষ্ট নয়। এ নিয়ে তাদের মাঝে অনেক ঝগড়া হত। প্রতিবার জাওয়াদের একটা কথা থাকতো,
“আমার এগুলো পছন্দ নয়। হাত ধরে রাখা অবধি আমি টলারেট করতে পারি কিন্তু এর থেকে বেশি আমার থেকে আশা করো না।”
কথাটা শাম্মীর কাছে অপমানজনক মনে হত। ফলে ঝগড়ার রেষ বাড়তো। কিন্তু চিংকির এমন কাজে তাকে ঠেলে দিতে পারলো না জাওয়াদ। মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো এক অদ্ভূত ঘোরের মাঝে সে রয়েছে। চিংকির চিন্তিত মুখবিবরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো সে। নয়ন সরাতে পারছে না। নিঃশ্বাস ভারী হলো। তার ঠোঁটজোড়াকে স্পর্শ করার ইচ্ছে হলো। আনমনেই দুরত্ব ঘুঁচিয়ে নিলো। জাওয়াদ নিজের স্বভাব বহির্ভূত একখানা কাজ করে বসলো। নিজের আঙ্গুল মুক্ত করে আবার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো চিংকির নরম ঠোঁট। চিংকি কেঁপে উঠলো তার স্পর্শে। পরিস্থিতির আভাস পেতেই রক্তিম হয়ে উঠলো তার গাল। লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। ওড়না হাতের ফাঁকে শক্ত করে ধরলো। জাওয়াদের গাঢ় দৃষ্টি আঁচ সে না তাকিয়েও পেলো। গভীর সেই দৃষ্টি। চিংকির হৃদয় কাঁপছে। দোদুল্যমান তার অনঢ় প্রহরী। জাওয়াদ লাজুক চিংকির লজ্জাকে পরিহাস করতে পারলো না। বরং তার হৃদয় কৌতুহলী হলো। জাওয়াদের মনে হলো সে কোনো নিশিপদ্মকে দেখছে যাকে ছুঁয়ে দেখার প্রলোভন জাগলো মনে। দুহাতে তার মুখখানা তুলে ধরলো। চিংকির মুখমন্ডলে আছড়ে পড়লে জাওয়াদের উষ্ণ নিঃশ্বাস। চিংকি চোখ তুলে তাকালো জাওয়াদের চোখে। তার ঘোরলাগা চোখের ভাষা পড়তে সময় নিলো। অন্তস্থলে বিশাল কালবৈশাখী দলা পাকালো। সেই ঝড়ের প্রলেপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সমস্ত জড়তা। কাঁপছে তার ঠোঁট। নাকের উপর জড়ো হয়েছে ঘর্মকণা। তাদের মাঝের দুরত্ব খুব ক্ষীণ। হয়তো সেই দুরত্বও ঘুচে যেত হয়তো কিন্তু সেই সময় জ্যোতির গলার স্বর শুনতে পেল জাওয়াদ। সাথে সাথেই দূরে সরে গেলো। চা নিয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। জ্যোতি রান্নাঘরে আসতেই চিংকিকে শুধালো,
“ভাইয়া কি চা নিয়ে গেছে?”
চিংকির গলায় দলা পাকাচ্ছে কথা। শ্বাস ঘন হয়ে গেছে। হৃদস্পন্দনের বেগ বেসামাল। জ্যোতি তাকে পুনরায় শুধালো,
“তুমি ঠিক আছো ভাবি? এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?”
চিংকি কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তার গাল গরম হয়ে গেছে। একটু আগের ঘটনা ভাবতেই লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। ভাগ্যিস জ্যোতি এসেছিলো!
********
জাওয়াদ নিজের রুমে চেয়ারের উপর বসলো। তার সামনে পড়াবাবার লাল-পানীয়। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। চিংকির সামনে গেলেই সে কেনো দুনিয়া ভুলে যায়? জ্যোতির কন্ঠ না পেলে সে কত বড় একটা ভুল করে বসতো! সে তো কখনোই এমন ছিলো না। জাওয়াদের জীবনে নারী সঙ্গের অভাব কখনোই ছিলো না। এখনো নেই। অফিসেও তার জনপ্রিয়তা অন্যরকম। জুনিয়র মেয়েরা তার সাথে কথা বলার ছুঁতো খুঁজে। কিন্তু জাওয়াদ কখনোই তাদের প্রতি এভাবে সব ভুলে চিন্তা চেতনা মুদে ডুবে যায় নি। তবে কি পড়া-বাবার কথা সঠিক! চিংকির সাথে এমন কিছু আছে যা তাকে প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে? যদি সেটাই সঠিক হয় জাওয়াদকে এই অখাদ্য নোংরা পানি খেতে হবে। এবং তাও অতিসত্ত্বর।
********
বিয়ের সব কাজ স্ফুর্তির সাথে শুরু হয়েছে। জাওয়াদের মামী দুদিন যাবৎ কনের জন্য শাড়ি পছন্দ করছে। এসবের মাঝে জাওয়াদকেও জোরপূর্বক ফাঁসানো হয়েছে। যতই হোক বউ তার, তাই তার দায়িত্ব বিয়ের শাড়ি পছন্দ করা। পাভেলের উপর যদিও রাগ কমে নি জাওয়াদের। কিন্তু তার পার্টনার অফ ক্রাইম বলতে এই একটি ছেলেই আছে। তাই রাগ থাকলেও তাকে কাঁধছাড়া করতে পারছে না জাওয়াদ। পাভেলও হবু স্ত্রীর বড় ভাইকে সম্মান করছে। আগে নানারকম টিপ্পনী করলেও এখন সেগুলো করছে না। ফলে যখন জাওয়াদ বললো,
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি পড়াবাবার পানি খাবো।”
পাভেলের অনেককিছু বলার থাকলেও সে সব গিলে হাসি মুখে বললো,
“কিন্তু চিংকির লালা পাবি কি করে?”
জাওয়াদ গম্ভীর মুখে বললো,
“তোর অনেক বুদ্ধি, তাই আমাকে বুদ্ধি দে।”
পাভেলের ইচ্ছে হয়েছিলো জাওয়াদকে বেধরক পিটাতে। কিন্তু নিজেকে সামলালো। বেজারমুখে বললো,
“আমার অনেক ভাগ্য ভালো, তোর বোন তোর মতো গান্ডু না।”
“গালি দিচ্ছিস আমাকে? বেশি কথা বললে কিন্তু বিয়ে ক্যান্সেল।”
“না জাহাপনা, আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা? যাক গে, ওকে চুমু খেয়ে নে।”
জাওয়াদ মুখ বিকৃত করে রাগী চোখে তাকাতেই পাভেল বুঝে গেলো তার বুদ্ধি জাওয়াদের পছন্দ হয় নি। ফলে গলা খাকারি দিয়ে বললো,
“মজা করছিলাম।”
“তুই আমার সাথে কাল শপিং এ যাচ্ছিস। আর খবরদার জ্যোতির আশেপাশেও থাকবি না। যদি আমার বোনের আশেপাশে তোকে দেখি একদম মেরে ভর্তা করে ফেলবো।”
“জি জাহাপনা।”
শাড়ির দোকানে বসে আছে সবাই। একের পর এক শাড়ি দেখা হচ্ছে। চিংকির পছন্দের রঙ লাল। কিন্তু মামীর ভাষ্য,
“এখন সবাই লাল পড়ে, তুমি পড়বে আলাদা কিছু।”
ফলে একের পর এক দোকান ই বদল হচ্ছে কিন্তু কনের শাড়ি এখনো কেনা হয় নি। চিংকি খুব-ই ক্লান্ত। শপিং করা, দোকান ঘোরা তার অপছন্দ। আগে জানলে আজ দুটো ভিডিও শ্যুট করে ফেলতো। জাওয়াদ একবার শুধালো,
“তোমার কি ক্লান্ত লাগছে? কিছু খাবে?”
চিংকি মাথা নাড়িয়ে না বলল। ভাগ্যিস মানুষটা পাশে ছিলো। ক্ষণে ক্ষণে তার খোঁজ খবর নিচ্ছে, কথা বলছে। নয়তো চিংকি অস্বস্তিতেই শেষ হয়ে যেত। জ্যোতিও মামীর কাজে বিরক্ত। ফলে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“মামী, আলাদা আলাদা করতে করতে তুমি তো ভাবিকে মঙ্গল গ্রহের জীব বানিয়ে দিচ্ছো। শাড়ি তো না যেনো হিরে খুঁজছো। আর তো এনার্জি নেই।”
“চুপ কর তুই।”
বিবাদের মধ্যে চিংকির নজর আটকালো হালকা আকাশী একটা শাড়িতে। শাড়িটা গায়ে ফেলতেই দোকানদার বললো,
“আফা, আপনের গায়ে মানাইবো।”
জ্যোতিও সাথে সাথে বললো,
“ভাবি, এটাই নাও।”
চিংকি প্রথমেই তাকালো জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদের চোখও তখন চিংকিতে নিবদ্ধ। চিংকিকে নীলে খুব-ই চমৎকার লাগে। শুধু চমৎকার বললে ভুল, নীলে চিংকিকে নিজের নিজের লাগে। তার হৃদস্পন্দন বেসামাল হয়ে যায়। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। ফলে দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
“ভালো লাগছে না। অন্যকিছু দেখো।”
ফলে অনেক পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও চিংকি শাড়িটা কিনলো না। জ্যোতি বিদ্রুপ টেনে বললো,
“ভাবি, তুমি এখনই ভাইয়ার কথায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?”
চিংকি মৃদু হাসলো। কিন্তু উত্তর দিল না। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে একটি হালকা গোলাপি শাড়ি পছন্দ করা হলো। সেটাই বিয়ের জন্য কেনা হলো। কেনাকাটা শেষে একটি দোকানে হালকা কিছু খাওয়া দাওয়া করার জন্য বসলো তারা। এর মধ্যেই পাভেল জাওয়াদের কানে কানে বললো,
“দোস্ত উপায় পেয়ে গেছি চিংকির লালা জোগাড়ের।”
.
.
.
চলবে.......................................................................