কমলের সাথে আমার বিয়ে ভেঙে গেছে, বাবা আদনানের সাথে কথাবার্তা বলেছেন। খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আমার ভেতর কতটা জোর থাকতে পারে বুঝতেই পারছেন। কিন্তু তবুও মনের ভেতর খচখচ করছে। ওর সাথে কথা বলার কোনো রুচিই হচ্ছে না। কিন্তু বারবার ফোন করে যাচ্ছে। না ধরেও পারা যাচ্ছে না। আদনানকে বললাম পরে ফোন করছি। এরপর কমলের ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করলাম,
"আপনি কেন এই দুশ্চরিত্রা মেয়েকে ফোন করেছেন?"
"তিন্নি এ কথা মা বলেছেন, আমি বলিনি।"
"আচ্ছা? বাদ দিন, আপনি কেন ফোন করেছেন সেটা বলুন।"
কমল কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে এরপর বলল,
"সেদিনের জন্য আমি লজ্জিত তিন্নি। রাগ উঠলে আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। আমি জানি আমি যা করেছি খুব খারাপ করেছি। এর কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।"
"আর কিছু বলার আছে?"
"আছে।"
"বলে ফেলুন।"
"ঝামেলার আগেরদিনও যখন তোমরা আমাদের বাড়িতে এলে, আমি বলেছিলাম তোমাকে এখনো ভালোবাসি না। কথাটা ভুল ছিল নিজেও জানতাম না। তুমি যখন বিয়ে ভেঙে দিতে চাইলে, তখন বুঝলাম কতোটা ভালোবেসে ফেলেছি।"
"ভালোবেসে ফেলেছো বলেই নিজের সম্পত্তি ভেবে এসে গায়ে হাত তুলেছো?"
"ভুলটা এখানেই হয়েছে আমার। এই রাগ আমি বংশগত ভাবেই পেয়েছি। আমাদের বংশের সবাই এমনিতে ভালো মানুষ। কিন্তু রাগ উঠলে, দুনিয়া লন্ডভন্ড করে দিতে এক মিনিট ভাবে না। আমার সেদিনের রাগটা একা তোমার উপর ছিল না। অনেকটা নিজের ভাগ্যের উপর ছিল। যখনই কাউকে ভালোবেসে ফেলি, তখনই তাকে হারাতে হয়। রাগগুলো জমা ছিল। সব রাগ তোমার উপরে গিয়ে পড়েছে।"
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ঝগড়া বা তর্কের সময় মূল পয়েন্ট ভুলে যাব না এটা তো অসম্ভব। কমল বলল,
"তিন্নি তোমাকে বলেছিলাম, তোমার সবকিছুতেই একটা ভীষণ গভীরতা আছে। সেই গভীরতাটা খুব কৌতূহল জাগায় আমার। কিন্তু গভীরতাটা কীসের তা আজও আবিস্কার করতে পারিনি। মনে আছে?"
আমার মনে পড়লো। কিন্তু সেই কথা এখানে কীভাবে আসলো বুঝতে পারছি না। বললাম,
"হ্যাঁ, মনে আছে।"
"সেটা এখন আবিস্কার করে ফেলেছি। জানতে চাও কী?"
"কী?"
"আদনানের জন্য তোমার ভালোবাসা। তুমি সেই ভালোবাসার ঘোর থেকে বের হতেই পারোনি কখনো। সেই ভালোবাসাই তোমাকে সবসময় উদাস করে রাখতো। আর সেই উদাসীনতাই তোমাকে আকর্ষণীয় করে তুলতো। একেক মানুষের একেক জিনিস তাকে আকর্ষণীয় করে। কিন্তু কারও উদাসীনতাও যে তাকে আকর্ষণীয় করতে পারে সেটা জানা ছিল না। এইজন্যই তোমার চোখে আমার জন্য কখনো ভালোবাসা দেখতে পাইনি। যা দেখেছি তা কেবলই সমীহ ছিল।"
আমি চমকে উঠলাম কথাগুলো শুনে। আমার ভেতরের বিরক্তিভাব চলে গেল। বললাম,
"আমি যে আদনানকে ভালোবাসি এবং আমার অনুভূতিটা প্রখর সে কথা তো তোমাকে বলেছিলাম, রিসোর্টের পুকুরপাড়ে বসে। তুমি হেসেছিলে।"
কমল মৃদু হেসে বলল,
"হ্যাঁ কিন্তু রিয়েলাইজ করতে পারিনি। ঠুনকো অতীত ভেবেছিলাম। আমার বোঝা উচিত ছিল, একটা মেয়ে হবু স্বামীকে তার যেই অতীতের কথা বলতে পারে সেই অতীত এতটাও ঠুনকো না। আমি তোমাকে এধরনের কিছু বলেছিলাম যে, আমাদের সবারই এমন হয়ে না ওঠা প্রেম, খুচরো ভালোবাসা থাকে। কিন্তু বুঝিনি নিয়তির খেলায় তোমার জীবনের সেই না হয়ে ওঠা প্রেম আর খুচরো ভালোবাসা আসলে আমি। তোমার সত্যিকারের ভালোবাসা আদনান। যে ভালোবাসার জন্য তোমার মত একটা সহজ সরল মেয়ে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যাওয়া বিয়ে ভেঙে দিতে পারে। বাবাকে বাঘের মত ভয় পাওয়া মেয়েটা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার কথা বলতে পারে! বিরাট সাহসের ব্যাপার।"
আমি আবারও কথা খুঁজে পাচ্ছি না। কমল বলল,
"এনিওয়েস, তোমার গায়ে হাত তুলেছি বলে খুব খারাপ লাগছে। মাফ করে দিও। বেস্ট উইশেশ ফর ইউ।"
"আমাকেও মাফ করে দিও। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু.."
"লাভ ইজ ব্লাইন্ড তিন্নি। আমি জানি। তোমার দোষ নেই। আমরা প্রত্যেকেই পরিস্থিতির স্বীকার। যাই হোক, তোমার জন্য শুভ কামনা। যদি সম্ভব হয় আমার উপর রাগ রেখো না। ভালো থেকো।"
ফোন রেখে আমি দীর্ঘ সময় একা বসে ভাবলাম। কমল আমার কাছে মাফ চাইলো এবং আমার তরফ থেকেও মাফ চাওয়াটা আদায় করে নিল, কেবলই কথার গুণে। আমরা মানুষের কথার জাদুতেই মুগ্ধ হই। কথার জাদুতে একদিন আগের করে যাওয়া সহিংসতাকেও ভুলে যাই। এ জগতে যে যত কথা জানে তার তত সুবিধা। এজন্যই বেশিরভাগ মানুষ এক্সট্রোভার্ট মানুষদেরকে পছন্দ করে। এরা আনন্দ দিতে পারে, বিনোদন দিতে পারে, হাসাতে পারে। নিজের কোনো অনুভূতিই চাপা রাখতে পারে না। তেমনি রাগ উঠলেও সেটা চেপে রাখতে পারে না, হিংস্র হয়ে যায়। আজ নতুন করে উপলব্ধি করলাম, সিনেমায় রাগী নায়কের রাগ দেখে ক্রাশ খাওয়া যায় কিন্তু বাস্তবে রাগী মানুষের সাথে সুখ মেলে না। একজন ভালো মানুষের সব ভালো গুণ বরবাদ হয়ে যায় শুধু রাগ থাকলে। যেমন কমল। তারচেয়ে আমার মনে হয় আদনানের মত ইন্ট্রোভার্ট মানুষই ভালো। সব অনুভূতি যেমন চাপা রাখে তেমনই রাগও চাপা রাখবে। অথচ এই মানুষগুলোই সবার কাছে অবহেলিত। কিন্তু আদনান, রাগ উঠলে সত্যিই চাপা রাখে কিনা বা কী করে সে বিষয়ে আমার আইডিয়া নেই। আইডিয়া নিতে হবে। আইডিয়া কীভাবে নেওয়া যায় সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে হবে।
আদনান সেদিনই এসে তার পাসপোর্ট, আইডেন্টিটি কার্ড, অন্যান্য কাগজপত্র ও কিছু ঠিকানা দিয়ে গেল। তারপর থেকে আমাদের বাড়িটা মরা বাড়ির মত হয়ে রইলো। ৪/৫ দিন কেটে গেছে। একটা গুমট ভাব। মায়ের রাগ কমে এসেছে৷ কিন্তু বাবারটা বোঝা যায় না। বাবা আদনানকে মেনে নেয় না আবার মানাও করে দেয় না। ফিফটি ফিফটি চান্স নিয়ে এভাবেই দিন কেটে যেতে লাগলো আমাদের। আমার বাসার বাইরে যাওয়া নিষেধ। টিউশনিতেও যেতে দেয় না। বাধ্য হয়ে জরুরি ভিত্তিতে ছুটি নিয়েছি। বাইরে যাওয়া বন্ধ তাই আদনানের সাথে দেখাসাক্ষাৎ সেভাবে হয় না। মাঝে মাঝে আদনান এসে কিছুক্ষণের জন্য রাস্তায় দাঁড়ায়। আমি বারান্দায় যাই। সে আমাকে দেখে, আমি তাকে দেখি। প্রতিদিন একই দৃশ্যে দেখা যায় তাকে। চুলগুলো এলোমেলো। দুই হাত জিন্সের পকেটে। কাটা কাটা চেহারাটাতে এত মায়া! এত মিষ্টি! রোগা পাতলা লম্বা শরীর, ঢিলেঢালা শার্ট পড়ে। শার্টের ভেতরে যত জায়গা ফাঁকা থাকে তাতে তার সাথে আমিও ঢুকতে পারব। এইসব নিষিদ্ধ চিন্তাভাবনাও আজকাল আসে আমার মাথায়! শেইম অন ইউ তিন্নি। আদনান যখন আসে, চোখে চোখ পড়লে সে একটা অপ্রশস্ত হাসি দেয়। তাকে প্রাণ খুলে হাসলে কেমন লাগে আমি জানি না। সে কি তার জীবনে প্রাণ খুলে হেসেছে কখনো?
.
.
.
চলবে.........................................................................