-" ভাই তুমি শিঘ্রই কোনো ব্যবস্থা করো। ওই ফকিন্নীর মেয়েরে আমি কক্ষনো ছেলের বউ করবো না। সে ছেলে যতটা পাগলামি করবে করুক। তুমি শুধু মেয়েটার কোনো ব্যবস্থা করো!"
রমজান মাহবুবের কথায় নোমান মাহবুব বিস্তর হাসে। ভাইয়ের কাঁধ চাপড়ে আশ্বাস দেয়। শান্ত গলাতেই বলে,
-" তুই চিন্তা করিস না রমজান। আমি অর্ধেক কাজ সেরে ফেলেছি। মহিরের সাথে মেয়েটার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি সালেহউদ্দিনের কাছে। যদিও সালেহউদ্দিন এখনো কিছু বলে নি তবে সে আমার এক পালতু কু*ত্তা। মানা করতে পারবে না। তারপরও আমি আবার কথা বলবো!"
রমজান মিয়া স্বস্তির শ্বাস ফেলে। দুই মেয়ে আর একটা সোনার টুকরো ছেলে তার। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আরেকটা অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায়। মাধ্যমিকের পাঠ চুকালে তাকেও পাত্রস্থ করবেন বলে সীদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছেন। তবে ছেলেকে নিয়ে তার বড্ডো আশা! স্নাতক পাশ করে বাড়ি ফিরলো; মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির জন্য অপেক্ষায়। কিন্তু হঠাৎ ছেলের মতিভ্রমে তিনি বেজায় রুষ্ট! শেষমেশ কি না ফকিন্নীর ঝি! তিনি এটা কখনোই হতে দিবেন না। ভাবতে ভাবতেই রমজান মিয়া দাঁত কপাটি পিষ্ট করে। তন্মধ্যে উপস্থিত হন বাড়ির বড় গিন্নী। চেয়ারম্যান নোমান মাহবুবের সহধর্মিণী রেবেকা বানু। আটপৌরে কাতান শাড়িতে মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। সোফায় বসে আঁচলে চাবির গোছা বাঁধতে বাঁধতে বলেন,
-" রমজান ভাই রওশনটা এমন কেন হলো? বাপ চাচা মান্য করে না। বংশ গড়িমা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে দেখছি! একটু শাসনে রাখিয়েন হাতছাড়া না হয়ে যায়। সঙ্গ দোষে কিন্তু লোহাটাও ভেসে বেড়ায়!"
কথাগুলো যেন রমজান মিয়ার ভেতরের ক্ষোভ টা বাড়িয়ে দিলো। ছেলে যে ফকিন্নীর বাচ্চার সাথে ঘুরে বেড়ায়। গলায় গলায় ভাব যাকে বলে। ওই নিশ্চয়ই ছেলেটার কানে কুমন্ত্রা জপে বোনকে ঘারে তুলে দিতে চাইছে। কিন্তু তিনি তা হতে দিবেন না। সে থমথমে সুরে বলে,
-" কি করবো ভাবী? ছেলে কথা শোনে না। মায়ের আঁচলে থাকে সবকটা! আপনে একটু বুঝিয়ে বলবেন! আপনাকে মান্য করে ঢের!"
-' তা তো অবশ্যই! তবে আমি অবাক হই খান বংশের ছেলে হয়ে ওই জোলা বাড়ি ঘুরঘুর করে! আর ওই ঝিয়ের মধ্যে আছে টা কি? না রূপ সুরুত! মুখে মুখে তর্ক করে বেয়াদব! রওশন আসুক আমি বুঝিয়ে বলবো। দুনিয়াই কি সুন্দর সুরতের মেয়ের অভাব নাকি? যে নর্দমায় তাকাতে হবে! আমার ছেলে রিজ কে দেখেও তো কিছু শিখতে পারে নাকি? সবসময় তাঁর পছন্দ প্রথম শ্রেণীর! নিচের দিকে তাকাবেই না; তাঁর নজর ওই নীলাম্বরে!"
গর্বের সাথে বলে ওঠে রেবেকা বানু। তাঁর ক্ষুর রূপ ধারালো বাক্যে অহংকার ঠিকরে ঠিকরে পরে। রমজান মিয়াও ভাতিজার প্রসংশায় সহমত জানায়। যেমন ছেলেটার চিন্তা ভাবনা তেমনি তাঁর ধারালো ব্যাক্তিত্ব। কথা তো বলবে না যেন হুকুম তামিল করবে। তার কথার পৃষ্ঠে খোদ নোমান মাহবুবও ভাষা হারিয়ে বসেন।
-" কখনো কখনো প্রয়োজনের বেশি আত্মবিশ্বাস ভারী ভাবে আঘাত করে ভাবী। তবে আমাদের রিজ সবার থেকে আলাদা। ওর ভাবনা চিন্তার জগতটাও ওর মতোই আলাদা।"
ছামিনা খাতুন বলতে বলতে এগিয়ে আসেন ট্রে হাতে। টেবিলের উপর রেখে সেমাইয়ের বাটি একে একে সকলের হাতেই দেয়। রেবেকা বানু তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাঁর উপর। ছামিনা খাতুন মুচকি হাসেন। নোমান মাহমুদ চামুচে ভরে সেমাই মুখে নিয়ে প্রসন্ন হাসেন।
-" দেখতে হবে না ছেলেটা কার? ছেলে আমার মাশাআল্লাহ কোনো দোষ নেই। তবে রক্তটা একটু গরম। এটা দোষ হিসেবে নেবো না। যুবক ছেলে রক্ত টগবগ না করলে সে কিসের পুরুষ? তবে ছামিনা চিন্তা করো না কালকেই রওশনের ঝামেলা ছাঁটাই করে আসবো!"
ছামিনা খাতুন ভাসুরের কথায় মৃদু হেসে রেবেকা বানুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। জুতোর আওয়াজে সবাই পাশে তাকায়। সাদা কেডস পড়ে ধূসর রঙের শার্ট প্যান্টে নওরিজ মাহবুব এগিয়ে আসছে। মুখাবয়ব বরাবরের মতোই গম্ভীর। জোড়া মোটা ভ্রু যুগল সর্বদা কুঁচকে থাকে। সে এসে বাবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
-" কিসের ঝামেলা ছাঁটাই করার কথা চলছে আব্বা? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? আমাকে জানান নি তো!"
নোমান মাহবুব প্রসন্ন হাসেন। তাঁর কাজে ছেলের তদারকি করতে দেখে ভালো লাগে। আগে পিছে তাঁর সব দায়িত্ব ছেলের হাতেই তো সপে দিবেন এখন থেকেই হাতে হাতে কাজ করলে অভিজ্ঞ হবে। কেউ দমাতে পারবে না। তাছাড়াও তাঁর ছেলে দমে যাবার মতো পুরুষ নয়। তিনি হাসিমুখে প্রত্যুত্তরে বলেন,
-" ছোট খাটো শিকারে বাঘের কি কাজ? বাঘ নিশ্চয়ই মুরগি শিকার করবে না তাই না আব্বাজান?"
নওরিজ গাম্ভীর্য বজায় রেখে সায় জানালো। তবে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়তে দেরি করে না,
-" আব্বা ইদানিং দেখছি আপনি জিলেপি প্রেমী হয়ে যাচ্ছেন! তাও কোনো ভালো মানের রুচিশীল হোটেল হলেও মানা যেতো; ফুটপাতের মন্টু দোকানের জিলেপি! আব্বা জিলেপির সাথে আরও কিছু পাওয়া যাচ্ছে নাকি সেখানে?"
নোমান মাহবুবের হাত থমকায়। হা করা মুখটা বন্ধ করে; সেমাই ভর্তি চামচ বাটিতে রেখে ছেলের দিকে তাকায়। সন্দেহভাজন ওই ধারালো চাহনি উপেক্ষা করে হেসে বলে,
-" পাওয়া যায় তো! খুরমা,গজা, মিষ্টি আরও অনেক কিছুই বানায় মন্টু। বাবুর্চির হাত ভালোই ট্রাই করতে পারিস! তবে তুই তো আবার খুঁতখুঁতে স্বভাবের। ওই পরিবেশ তোর সাথে যাবে না।"
-" আব্বা হাওয়ায় উড়ে এলো কিছু খবর। আশাকরি দূরেই থাকবেন ওসব থেকে। নইলে সামনে বার চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে!"
ছেলের শান্ত গলার হুমকিতে ডরান না নোমান মাহবুব। হেসে ছেলের দিকে তাকায়। গম্ভীর মুখে বসে থাকা নওরিজ মাহবুব বাবাকে পরখ করে সুক্ষ্ম চোখে। নোমান মাহবুব ছেলের চাহনি লক্ষ্য করে বলে,
-" আমি তো ইস্তফা দিতেই চাই তবে আগে আপনে এলাকার হাল সমাচার বুঝে নেন। আজকালকার যুগে সৎ লোকের ভাত নাই!"
-" আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন এই দুনিয়া ছলনা বৈ কিছু না। পর দুনিয়ার কথা স্মরণে রাখবেন!"
বলেই নওরিজ অপেক্ষা করে না। সোফা ছেড়ে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। রেবেকা বানু পিছু ডেকে সেমাই মুখে দিতে বলেন। নওরিজ সেমাইয়ের দিকে তাকিয়ে কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আরেকটু কুঁচকে নেয়। না জানি কত সময় সেমাই ঢাকনা ছাড়া ওখানে পরে ছিলো। খাওয়ার প্রশ্নই আসে না। সে গম্ভীর মুখে পা বাড়াবে নোমান মাহবুব শুধালো,
-" কোথায় যাচ্ছেন?কাল মেম্বর এসেছিলো একটা দরকারে । কথায় কথায় বলল আপনি নাকি মেম্বরের ছেলেকে চর মেরেছিলেন? কোনো দূর্ব্যবহার করেছিলো কি?"
-" এক নম্বরের ক্যারেক্টারলেস জা*নোয়ারটা। মেম্বরের ছেলে তাই দাপট দেখিয়ে বেড়ায়। স্কুলের পেছনের দোকানে বসে অনর্গল সিগারেট টানে সাথে বাচ্চা ,বড় সব মেয়েদের উত্যক্ত করে বেড়ায়। আরও অনেক রিপোর্ট আছে। বেয়াদবটা আরেকবার সামনে পড়লে গরম পানিতে চুবিয়ে মারবো!"
নওরিজের গমগমে ভারী গলা। নোমান মাহবুব মাথা দুলিয়ে ছেলের কথার পৃষ্ঠে জবাবে বলেন,
-" ওহ্। আমি মেম্বরের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো। তুমি আগবাড়িয়ে ক্রোন্দোলে জড়িও না। তা তুমি কোথায় যাচ্ছো এই ভর দুপুরে?"
-" নেশারু ডাভলু নাকি কোথাকার মাস্তান নিয়ে এসেছে। যাই একটু দেখে আসি মাস্তানদের!"
কথা শেষ করে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায় নওরিজ। নোমান মাহবুবকে চিন্তিত দেখায়। ছেলেটার মাঝে লড়াকু মনোভাব স্পষ্ট ফুটে ওঠে। কোনো ঝামেলা না হয়! নেশারু লোকজন ভারী ভয়ানক হয়। এরা নিজের কথা যতটুকু না ভাববে তার থেকেও শত্রুর কথা বেশি মনে রাখবে! প্রতিহিংসায় দাউ দাউ করে জ্বলবে আর কিছুই চোখে দেখবে না।
•••••••••••
টিনের গ্যারেজে বসে চকচকা একটা বাইক পরিষ্কারে ব্যস্ত শফি। কাজটা সে অতি আনন্দের সাথে করছে। কেননা বাইকটা তাঁর ঢের পছন্দ হয়েছে। বাইকের ঝকঝকে আয়নায় নিজেকে দেখে স্বপ্নে বুনে ফেলে। একটা দামি লাল টুকটুকে বাইক কিনবে। তারপর লাল টুকটুকে বউকে বিয়ে করে বাইকে চড়ে দেশ বিদেশে ঘুরবে। আহা কি সুখ!! কিন্তু বাইক কিনতে তো মনে হয় অনেক টাকা লাগবে। সে পরনের হাঁফ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাঁর মালকড়ি বের করে। যমুনা সেতু আঁকা পাঁচ টাকার গোটাকয়েক কয়েন। এতে হবে কি? তাঁর চিন্তার মাঝেই সিনান সালেহের ধমক কানে বাজে,
-" শা*লা কামচোর চোখ খুইলা স্বপ্নে নাচো? বলি তোরে বেঁচলেও বাইকের ট্যাকা হইবো না। তাই দিবাস্বপ্ন বাদ দিয়া কাম কর!"
শফির দিলটাই টুট টুট টুট করে ভেঙে পড়লো। তবে সে একদিন বাইক কিনবেই । কিনে সিন ভাইরে দেখিয়ে দিবে। ওর সামনেই বউ নিয়ে ঘোরাঘুরি করবে। তখন শা*লা খাইস্টা চেয়ে চেয়ে দেখবে। কেননা ওই খচ্চর সিনান সালেহের কপালে বউ জুটবে না। যে মেজাজ রে বাবা! বউ কবুল বলতে একটু দেড়ি করলেই খেঁকিয়ে বলবে,
-" নাটক করোস লো গেদি? বিয়ের পিঁড়িতে বইসা রং ঢং করোস? কবুল বলতে এতো সময় লাগে? এতক্ষণ পাড়া পড়শী সবাই মনে মনে শ'বার কবুল বইলা আমার সাথে নিকাহনামা পইড়া ফালাইলো! তোমার কইতে শরম করে? থাপ্পড়ে যমুনায় ফালামু! বিয়ার মা*য়েরে বা*প"
তখন বউ কাজির সাথেই পগারপার। বিয়া আর জুটবো না কপালে। ভাবতেই শফি হাসিতে ফেটে পড়ে একা একাই। সিনান চোখ পাকিয়ে চায়। ধমকে বলে,
-" কাজ বাদ দিয়ে ভর দুপুরে ফ্যাক ফ্যাক করোস ক্যান হারামজাদা? তাও একাই! বলি ভুতে আছর করছে নি?"
শফি হাসি থামিয়ে দেয়। বাইক ভালোভাবে ধুয়ে সুতি ন্যাকড়া দিয়ে মুছে নেয়। হঠাৎ মাথায় কিছু খেলতেই শফি ন্যাকড়া রশিতে টাঙিয়ে বড় টায়ারের উপর বসে। আড়চোখে সিনানের দিকে চায়। যে কিনা লাল টুলে বসে কিসের যেন হিসেব নিকেষ কষছে। সে মিনমিনে সুরে বলল,
-" সিন ভাই ধমক না দিলে একটা কথা কইতাম?"
-" তাহলে দরকার নাই। ধমক তো আমি আগে পিছে দিমুই!"
শফি ভেংচি কাটলো বড়সড়। ধমকের তোয়াক্কা না করে বলে,
-" রওশন ভাইয়ের বাইকটা আমার হেব্বি পছন্দ হইছে। বলি ভাইয়ের বোন মানে রূপসা আপারে যদি আমি বিয়া করি তাইলে ভাই হুবহু এমন বাইক যৌতুকে দিবো না? দিলে আমি দুই পায়ে খাঁড়া!"
সিনান সালেহ ধমক দেয় না। কাঠের টেবিল খাতা কলম রেখে শফির দিকে ঘুরে বসে। মুচকি হেসে ওর দিকে আঙুল তুলে বলে,
-" শালা তুই শয়তানের মনটা বড়ই ভালা! তোর বুদ্ধি জব্বর। চাচিরে বইলা প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করি রইষ! তবে বিয়ের পরেও কিন্তু আপা ডাকিস না! লোকে মুখের উপর থুতু দিবো আহম্মক!"
শফি বুঝতে পারে না ভর্ৎসনা করলো নাকি প্রসংশা! সত্যিই কি মা'কে বলে প্রস্তাব পাঠাবে? সিনান সালেহ আবারও স্বীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শফি উদাস মনে ঠোঁট উল্টায়। রূপসা আপা বউ হলে মন্দ হতো না। আসমানের পরীর মতো দেখতে। দেখলেই চোখ জুড়ায় যায়! সে পুনরায় স্বপ্ন বুনে বাইকে বসে রূপসা আপারে নিয়ে দেশ-বিদেশে ভ্রমন করে। তবে কারো হস্তক্ষেপে ঠাস করে স্বীয় অবস্থানে ফিরে আসে। মাথা ডলতেই রওশন মাহবুব নজরে আসে।সে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
-" ভাই বাইক পুরাই ঝকঝকা কইরা দিছি! আমি এতো যত্ন কইরা জীবনে দাঁত টাও মাজি নাই যত সোহাগ কইরা আপনার বাইক পরিষ্কার করলাম!"
রওশন হেসে পকেট হাতরে শত টাকা কচকচা নোটটা শফির হাফ প্যান্টটার পকেটে ঢুকিয়ে দেয়।শফি দাঁত কেলানো প্রসারিত হয়। সিনান ভ্রু কুঁচকে চাইলে শফি চুপসানো মুখে টাকা টা ফেরত দিতে নিবে রওশন চোখে আশ্বস্ত করে সিনানের উদ্দেশ্যে বলে,
-" এরকম করলে কিন্তু আর তোর গ্যারেজে আসবো না। বন্ধু বন্ধুর জায়গায় ব্যবসা ব্যবসার জায়গায়। দু'টোকে একসাথে করলে তো পথে ভাঙা প্লেট নিয়ে বসতে হবে!"
সিনান কিছু বলে না। শফি সুযোগে টাকাটা পকেটে রেখে দেয়। ঘরে আসা লক্ষীকে কে ফিরিয়ে দেয়? রওশন সিনানের পাশে আরেকটা টুল টেনে বসে। টেবিলের উপর একটা প্যাকেট রেখে দেয়।সিনান হিসেবের খাতা বন্ধ করে দেয়। মাংসের কড়া ঘ্রাণ নাকে বাজে। সে রওশনের দিকে তাকায় শান্ত চোখে। রওশন বোধকরি বন্ধুর চোখের ভাষা বুঝতে পারলো।পিঠ চাপড়ে বলে,
-" ভং ধরিস না তো! দুপুর বেলায় না খেয়ে থাকবো নাকি? আমি আবার টাইম টু টাইম খাই। তাই বাজারের আকবরের হোটেল থেকে ভুনা খিচুরি আনলাম। সাথে কষা খাসির মাংস। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া চলবে। শফি? যা তো পানি আন জগ ভরে। এনেছি গোটা কয়েক প্যাকেট।"
শফি খুশি মনে জগ হাতে চলে যায়। জমিয়ে খাওয়া হবে আজ! সিনান গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো। রওশন কিছু বলবে সিনান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-" আমাকে টানবি না। আমি এই যে মুখ দিয়ে বললাম খাবো না, মানে খাবো না। সে তুই পায়ে পড়লেও না! সুর সকালে বাটিতে আমার দুপুরের খাবার দিয়েছে সেটাই গিলবো!"
বলেই টেবিলের নিচে থাকা টিফিন ক্যারিয়ার তুলে রাখে। সুরেলার নাম কর্ণপাত হতেই এক আলাদা আগ্রহ কাজ করে রওশনের মাঝে।রওশন টিফিন ক্যারিয়ার নিজের দিকে টেনে বলে,
-" আচ্ছা এটা আমি খেয়ে নিচ্ছি। তুই খিচুরি খা শফির সাথে। আমিও একটু খেয়ে দেখি বউয়ের হাতের খাবার! ও নিজেই রেঁধেছে বুঝি?"
বলেই ক্যারিয়ার খুলে রেখে বাটি খুলে নেয়। প্রথম বাটি ফাঁকা। নিচের বাটিতে মোটা চালের ভাত ডাল দেওয়া সাথে আলু ভাজি আর ভর্তা। রওশন কিছু বলবে তাঁর হাত থেকে বাটি কেড়ে নিয়ে সিনান সালেহ হেসে বলে,
-" এসব ডালভাত তোমার রুচবে না শালা বাবু! আর শোন আমার বোন তোরও বোন। আলটাম ফালটাম কথা বলবি না বলেদিলাম!"
-" তাহলে কি তোর বউ আমার বউ?"
রওশনের কথায় সিনান শাণিত নজর ফেলে খ্যাঁক করে ওঠে,
-" থাপ্পড়ে যমুনায় ফালামু শা*লা। আমার বউ তোর বোন লাগবো একেবারে আপন বোন!"
রওশন ভ্রু উঁচিয়ে চায়। বোন তো তাঁরও একটা আছে। সিনান বন্ধুর চাহনির মানে বুঝে তৎক্ষণাৎ সুধরে দিলো,
-" আলালের ঘরের দুলালি পালার শখ নাই! বলছি আমার বউ যেই হোক সে তোর বোন বুঝলি? আর আমার পুতুল বোনটাও তোর ধর্মের বোন। কু নজর দিবি না খবরদার!"
রওশন হেসে ওঠে তাঁর কথায়। বন্ধুর দিকে খানিক ঝুঁকে বলে,
-" ছোট বেলায় কে যেন বলতো, আমার পুতুল বোনটারে তোর বউ বানামু। তাহলে সে বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো অট্টালিকায় থাকবে। বোনের বড় ঘরের শখ পূরণ করবি! তো আমিও বন্ধু অন্তপ্রাণ!"
-" সেসব ছোট বেলার ছেলেমানুষী কথা। তখন তো এটাও বলেছিলাম আকাশে দুইতলা বাড়ি বানামু ! চার পাঁচটা রকেট, হেলিকপ্টার, বিমান কিনমু! নিজেই চালিয়ে সাত সমুদ্র পারি জমামু!তাহলে সেগুলার ব্যবস্থা আগে কর?"
খ্যাঁক করে বলে ওঠে সিনান। আসছে *নেংটা কালের কথা বলতে! রওশন কি বলবে ভেবে পায় না। এই শালার সাথে কথা বলা মানে নিজ গালে চটাস চটাস করে থাপ্পড় দেওয়া। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বিজ্ঞদের মতো বলে ওঠে,
-" বন্ধুর শখ ইচ্ছে আল্লাহর হাতে দিলাম। তবে বন্ধুর বোনেরটা আমিই পূরণ করবো। সুরেলা আমার হবে কি না সেটা তো ভবিষ্যৎ বলবে সিনান সালেহ!"
সিনান চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করলো। রওশন আপন মনে কথা বলতে বলতে প্যাকেট গুলো বের করে। শফি জগ পুরো করে আনলে তিনজনেই হাত ধুয়ে নেয়। সিনান নিজ বাটিতে হাত দিয়ে গপাগপ মুখে পুরে। রওশন ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। এই ছেলে একে বারে একরোখা জেদি। কারো কথাই শুনবে না। সে ও শফি প্যাকেট নিয়ে খাওয়া শুরু করে। রওশন সিনানের খালি বাটিতে খাসির মাংস ঢেলে নেয় একেবারে কষা কষা মাংস শুধু। ঝোল টোল নেই। শফি অবাক সুরে বলে,
-" রওশন ভাই আপনেরে তো খালিই মাংসই দিছে। সেদিন আমি সুর আপা জ্বরে পরলে কিনতে গেছিলাম হোটেল থেকে! উরিব্বাস এই টুক টুক দুই টুকরা দিলো বাকি সব টেলটলা ঝোল!"
সাথে সাথেই সিনান সালেহ বা হাতের গাট্টা পড়ে শফির মাথায়।শফি মুখ ছোট করে মাথা ডলে। সিনান শান্ত চোখে শাসিয়ে বলে,
-" তুই কে আর ও কে? আসছে নবাবজাদা!"
রওশন একটু ইতস্তত বোধ করে। সে তো সব বাড়ি থেকে এনেছে। হোটেলের ওই স্বাদ হীন খাবার সে শত চেষ্টা করেও খেতে পারবে না। সিনান রেগে না যায় তাই প্যাকেট করে মিথ্যে নাটক সাজালো। কিন্তু সে-ই জল সে-ই পানি! শফি ভেংচি কেটে খাওয়ায় মনোযোগী হয়। আহা কি সুস্বাদু খাবার! সিনান গম্ভীর মুখে খাবার গলাধঃকরণ করে। হঠাৎ রওশন কয়েক টুকরো মাংস সিনানের পাতে দিয়ে বলে,
-" তুই পা ধরতে বললে ধরবো খা না ভাই! বন্ধু না আমি তোর? সেই নেংটা কালের! এইটুকু অনুরোধ রাখবি না?"
সিনান পাতের মাংসের দিকে তাকায়। বোনটা খাসির মাংস পছন্দ করে। তাকে রেখে তাঁর গলা দিয়ে নামবে না। সে শফির পাতে দিয়ে বলে,
-" শফি আমার আপন জন। ও খাওয়া মানেই আমার খাওয়া! খুশি?"
রওশন গম্ভীর মুখে তাকায় কিছু বলে না। সিনান সালেহের এমন আচরণ তো নতুন নয়। এতো পুরনো সুর।
•••••••••••
সরোজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বালিকাদের ভবন থেকে দুটো স্কুল ব্যাগ পড়ে ধপাস করে। মড়মড় শব্দ হয় নিবিষ্ঠে। কনকচাঁপা নামক ভবনের পেছনে বাঁশ ঝাড়; তারই স্বল্প দূরে দিদির মুদির দোকান। দোতলা থেকে দু'টো স্কুল ব্যাগ নিথড় হয়ে পড়ে আছে বাঁশের পাতার উপর। দোতলা একতলার জানালার ধারে বসা কিছু মেয়েরা উঁকি দেয় নিচের দিকে। ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখেও ভাবান্তর দেখায় না। যেন এটা নিত্য মাফিক ঘটনা। সুরেলা ও মারিয়া একে অপরের বাহু আঁকড়ে বিজয়ী হেসে শ্রেণীকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। দোতলা পেরিয়ে নিচে নামে। পেছন দিক কার গেইটের কাছে গিয়ে দেখে একটা স্যার চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে। সুরেলা ভদ্র সুলভ হেসে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে। টাকলা গোছের স্যার জাজুসি নজরে তাকিয়ে সালামের জবাব নিয়ে প্রশ্ন করে,
-" এখানে কি চাই? স্কুল পালানোর ফন্দি আটছিস না তো দুজন?"
সুরেলা হে হে করে হেসে বলে,
-" কি যে বলেন না স্যার! আমরা পলাকু ছাত্রী নাকি! আমাদের মতো পানচুয়াল ভদ্র ছাত্রী স্কুলে আর খুঁজে পাইবেন না। ওই দিদির দোকানে রুটি কলা কিনতে যাচ্ছিলাম! আসলে টিফিন নিয়ে আসি নি তো! "
মধ্যবয়সী স্যারের মায়া হলো বোধহয়। মুচকি হেসে যেতে বলে। সুরেলা বান্ধবীর হাত মুঠোয় ভরে তড়িঘড়ি পা চালায়। ইশ্ ধরা পড়তে পড়তে বাঁচলো। গেইট থেকে বেরিয়ে ভবনের পেছনে যায়। পড়ে থাকা দু'জনের ব্যাগ ঝেড়ে কাঁধে চাপিয়ে বিশ্ব জয়ী হাসি ফুটিয়ে পা চালায়। দুই সই হাজারো গল্পের পাতা উল্টোপাল্টা করতে করতে পা বাড়ায়। তাদের হাসির ঝংকারে আশেপাশের মুরুব্বি গোছের লোকেরা তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিড়বিড় করে। এতে কিশোরী চঞ্চলা রমনী দ্বয়ের ভাবান্তর নেই। তাঁরা নিজেদের নিয়ে ব্যাস্ত কিনা! তবে পথিমধ্যে গন্ডগোলের আভাস পেয়ে তাদের রূহ কেঁপে ওঠে। কিছু লোকের গর্জন ভেসে আসে। দূরে ওই কাঁচা রাস্তার মোড়ে লোকে লোকারণ্য। সেখান থেকেই হুঙ্কার শোনা যায়। সুরেলা ও মারিয়া একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। রাস্তা বন্ধ তাঁরা তাঁদের গন্তব্য স্থলে যাবে কিভাবে? দু'জন দুঃখি মনে একেঅপরের দুঃখের পাতায় সান্ত্বনা সুর তোলে। স্কুল পালানোটাই তো বৃথা! ধ্যাত! উল্টো পথে পা বাড়ালে সুরেলা বান্ধবীর উদ্দেশ্যে বলে,
-" আরেকটু আগাই গিয়ে দেখি ঘটনাটা কি। চেয়ারম্যানের চামচাদের বেশি দেখা যাইতেছে যে। ওই উঠোনে যাই ওইখানে অনেক মহিলা আছে!"
মারিয়া সন্দেহ ভাজন চোখে তাকিয়ে বলে,
-" চেয়ারম্যানের পোলাও থাকবার পারে। সোজা কইরা বলতে পারিস না?"
-" তোর সবসময় বেশি বেশি। থাক ছেড়ি আমি গেলাম!"
সুরেলা মিছে রাগ দেখিয়ে এগিয়ে যায় উঠোনে মহিলাদের বৈঠকে। মারিয়া হেসে বান্ধবীর পিছু আসে। তখনই চেয়ারম্যানের পক্ষের কিছু লোকের নজরকাড়ে দুজন। এক কমবয়সী ছোকরা তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় গন্ডগোলের দিকে। বৈঠক থেকেই সুরেলা সব তথ্য সংগ্রহ করে নেয়। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সংঘর্ষ হয় দুই দলের। তারই প্রেক্ষিতে নেশারু ডাবলু শহর থেকে কিছু পাতি মাস্তান নিয়ে আসে। বাকি সবাই তো ভয়ে হাঁটু কাঁপা কাঁপি। তবে চেয়ারম্যানের পোলা আসলে ভরসা পায়। সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে যায় স্বীয় দলবল নিয়ে। সংঘর্ষ হয়নি তবে কথা কাটাকাটি চলমান। নেশারু ডাবলু ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে আসে চেয়ারম্যানের পোলার দিকে তবে গায়ে হাত তোলার সাহস দেখায় না। সব শুনে মারিয়া বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে দুঃখি গলায় বলে,
-" থাক ছেড়ি চিন্তা করিস না। তোর সেএএ একাই একশো।"
বলেই মুখ টিপে হাসে। সুরেলা চোখ রাঙানি দেয়। মারিয়া শোনার পাত্র মোটেই না। সে ধীমান সুরে খুঁচিয়ে চলেছে সুরেলাকে। সুরেলা বিরক্ত চোখে চায়। দাঁত কপাটি পিষ্ট করে ধমকে বলে,
-" আরেকবার আলটাম ফালটাম কথা কইলে পুরো ক্লাসে রটাই দিমু তুই বাংলা স্যাররে স্যারের নজরে না দেইখা জামাইয়ের নজরে দেখিস। স্বপ্নে দুই তিনটা বাচ্চাও উৎপাদন করছিস!"
ব্যস মারিয়ার জবান বন্ধ হয়ে যায়। সুরেলার কথা হালকা ভাবে নেওয়া মানে অঁছেলা বাঁশ নিজের দিকে টেনে নেওয়া। সুরেলা একটু ভাব নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নেয়। নেকাব টেনে ঠিক করে বলে,
-" অনেক সংঘর্ষ দেখলাম। এবার বাড়ি যাই! খিদায় পেট চু চু করে!"
দুই বান্ধবী উল্টোপথে পা বাড়ায়। হঠাৎ মারিয়ার মাথায় কিছু উঁকি দেয়। সে মুখ খোলে বান্ধবীর উদ্দেশ্যে কিছু বলবে কিন্তু কারো পিছু ডাকে বলা হয় না। দু'জন ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে দাঁড়ালো। একটা যুবক গোছের ছেলে। তাদের থেকে বড়ই হবে তবে ওতটাও না। সে নতমুখে দাঁড়িয়ে বলে,
-" গন্ডগোল আরও বাড়তে পারে। আপনেরা চইলা যান আপা। তয় মজিদের বাড়ির পুকুরের ওইপাশে কড়ি গাছ তলায় দাঁড়াইয়েন কিছু সময়। রিজ ভাই আইবো। অপেক্ষা কইরেন কিন্তু? নইলে ভাই রাইগা যাইবো।"
কথা শেষ করে অপেক্ষা করে না ছেলেটা। দৌড়ে চলে যায়। সুরেলা কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে তাঁর প্রস্থান দেখে। বান্ধবীর ধাক্কায় তার ধ্যান ভঙ্গ হয়। মারিয়া মিছে উঁহু উঁহু করে বলে,
-" তোর ঝগড়া দেখা সার্থক। তেনার নজরে পড়েছিস। চল মজিদের বাড়ির কড়ি তলায়। অপেক্ষায় থাকতে হবে না তেনার জন্য!"
সুরেলা কটমট করে তাকায়।
-" চুপ থাক! আমার ঠ্যাকা তেনার জন্য অপেক্ষা করার!"
-" ঠ্যাকা নেই বলছিস? অপেক্ষা না করলে কিন্তু ঝড়ের তান্ডব হবে সই! সামাল দিবার পারবা?"
-" আমি কেন দিবো সামাল? আশ্চর্য কথাবার্তা! বাড়ির পথ ধর!"
বলে পা বাড়ায় দুই বান্ধবী। দোনামোনা মনে অতি ধীর পায়ে মজিদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। বাড়ির পাশেই পুকুর। পুকুরের এক পাশ ঘেঁষে মাটির কাঁচা রাস্তা। রাস্তার অপর পাশে অনেক পুরনো কড়ি গাছ। মজিদ কবিরাজ সেই কড়ির গোঁড়ায় শান বেঁধে বসার ব্যবস্থা করেছে। জায়গাটায় পুরুষের আড্ডা চব্বিশ ঘন্টা। তবে গন্ডগোল বাঁধায় এখন ফাকাই আছে।যানজট বিহীন কাঁচা রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছে দুই বান্ধবী। সুরেলা অনবরত স্বীয় ঘর্মাক্ত হাত কচলাতে থাকে। চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে। মারিয়া অবশ্য বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা। বান্ধবীর বুক ফাটে তবে মুখ ফোটে না ব্যাপার স্যাপার। তখন তো তাচ্ছিল্যের সাথে বলে দিলো অপেক্ষা করতে বয়েই গেছে। এখন সেই মহারানী ছুঁতো খুঁজছে নানান রকমের। এই যে অতি ধীর গতিতে পা ফেলছে। আগা গোড়া বিহীন গল্প টেনে সময় পার করছে। মারিয়া মৃদু হেসে বলে,
-" পায়ে মেন্দি দিছোস? জোরে হাঁটুন গিন্নী বউ!"
সুরেলা বান্ধবীর হাত খপ করে টেনে ধরে মিনমিনে গলায় বলে,
-" একটু অপেক্ষা করি কি বলিস? যতই হোক চেয়ারম্যানের পোলা বলে কথা। ভবিষ্যতের চেয়ারম্যান। যদি কখনো বয়স্ক ভাতার জন্য যেতে হয়?"
মারিয়া তীক্ষ্ম নজরে তাকায়। দুষ্টুমির গলায় বলে,
-" বয়স্ক ভাতার দিয়া কি করবি? তাগড়া পুরুষ মানুষ পোষায় না?"
-" ছিঃ! আমি বয়স্ক ভাতা; ওই যে বয়স বেড়ে গেলে সরকার থেকে টাকা দেয় না? সেটার কথা বলেছি। তোর নষ্ট মন!"
-" তাই না?"
সুরেলা রেগে যায়। মারিয়া হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। সুরেলা অনুনয় বিনয় করে তাকে আটকে রাখে। শান বাঁধানো কড়ির গাছের নিচে বসে দু'জন। তাদের অপেক্ষার প্রহর ফুরোয় না। আধা ঘন্টার বেশি হবে দুই বান্ধবী বসে আছে অথচ কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির খবর নাই। অধের্য সুরেলার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে চুরমার। নওরিজ মাহবুবের উদ্দেশ্যে শুদ্ধ দেশি গালি পেশ করে বান্ধবীর হাত টেনে হাঁটা দেয়।
-" শালা খচ্চর! অহংকারী খাইস্টা লোক। হাতের কাছে পেলে ওই পুকুরে ঠেসে ধরতাম! মলমূত্রের কূয়ায় ফেলে দিতাম খুঁতখুঁতে লাট সাহেবকে!"
রাগে গজগজ করতে করতে মারিয়াকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মারিয়া হেসে বলে,
-" ওই তো তোর হাতের কাছেই আসছে। যদি ফেলতে পারিস তুই ফকিন্নীর ঝিঁয়েরে আমি কচকচা পাঁচশ টাকা দিমু!"
সুরেলা চোখ বড় বড় করে পেছনে তাকায়। ওই তো আসছে লাট সাহেব। গম্ভীর মুখে বড় বড় পা ফেলে। ভিজে ধূসর রাঙা শার্টটা গায়ে লেপ্টে। বলিষ্ঠ বুকটা দৃশ্যমান। কিশোরীর চিত্তে নড়বড়ে হয়ে আসে যেন। মোহিত হয় আঁখি যুগল; পলক ফেলতেও যেন ভুলে যায়। হনহনিয়ে হাঁটার দরুন ঘর্মাক্ত কপালে চুল গুলো বারংবার বাড়ি খাচ্ছে। কিশোরীর শখ জাগে চুল গুলো ছুঁয়ে দেওয়ার। বান্ধবীর ধাক্কায় কিশোরী যেন হুঁশে ফিরলো। লোকটা কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে? সুরেলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠে,
-" দাঁড়াতে বলেছিলেন কেন? আবার হুমকিও দিয়েছেন। আপনার রাগে আমার কি!"
নওরিজ মাহবুব ঠোঁট চেপে কপালে গড়িয়ে পড়া চুল গুলো পেছন দিকে ঠেলে দেয়। কপালে গড়িয়ে পড়া শ্বেদজল মুছতে মুছতে বলে,
-" কিছুই না: তাহলে দাঁড়িয়েছিস কেন?"
পাল্টা প্রশ্নে সুরেলা যেন ফ্যাসাদে পড়লো। কি জবাব দিবে ভেবে পায় না। নওরিজ মাহবুব শান্ত চোখে সম্মুখে দন্ডায়মান কিশোরীর আপাদমস্তক পরখ করে নেয়। সুরেলা দাঁতে দাঁত চাপে 'শালা লু*চ্চা'। সে আড়চোখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবীর দিকে তাকায়। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে; তবে সে একশত দুই ভাগ নিশ্চিত মেয়েটা দাঁত কেলাচ্ছে। নওরিজ হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে গমগমে আওয়াজে আবারও প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে,
-" সবে দু'টো বাজে। স্কুল তো সারে তিনটায় ছুটি হয়ে থাকে। আজ বৃহস্পতিবারও নয় যে হাফ ডে হবে! তাহলে এখানে কি করছেন দুজন? এটা তো বাড়ির পথও নয়!"
সুরেলা একটু ঘাবড়ায়। সাথে মারিয়াও! সুরেলা শুকনো ঢোক গিলে তীক্ষ্ম স্বরে বলে,
-" সেই কৈফিয়ত আপনাকে কেন দিবো?"
-" তো কাকে দিবি সুর?"
গমগমে সুরে সুরেলা থমকায়। কিশোরী তনু কেঁপে ওঠে। ওই ভারী গলায় তাঁর নামটা এমন কেন শোনায়? সে কি বলবে ভেবে পায় না। নওরিজ পকেটে হাত গুটিয়ে সিনা টান টান করে দাঁড়ায়। ধমকের স্বরে বলল,
-" ফকিন্নীর ঝিয়ের খুব গলা চলে তাই না? চাচাকে বলি তার মেয়ে স্কুল বাদ দিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়? তাহলে অতি শিঘ্রই স্বামীর বাড়ি গিয়ে তাঁর হাতের থাপ্পড়ে মিনিটে মিনিটে জ্ঞান হারাবি! আর বান্ধবী আপনার বাবাকে বলি?"
মারিয়া ঘন ঘন মাথা নেড়ে না বোঝায়। মিনমিনে গলায় বলে,
-" আর হবে না দুল.. থুক্কু ভাইজান!"
গম্ভীর নওরিজের অধরকোণ বেঁকে আসে। সুরেলা নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁত কপাটি পিষিয়ে পিষিয়ে বলে,
-" মারিয়ার নানির বাড়িতে যাচ্ছিলাম। মায়ের থেকে অনুমতি নিয়েই যাচ্ছি!"
নওরিজ ছোট ছোট চোখে চায়। সময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে ওই ডাগর ডাগর চোখের ঘন ঘন পলক ঝাপটানো। সেই চাহনি খুন করতেও সক্ষম। নওরিজ ঠোঁট চেপে কিছু ভেবে বলে,
-" সোজা বাড়ি যাবি এখান থেকে। আশেপাশে কোনো দিকে তাকাবি না। বুঝাতে পেরেছি?"
সুরেলা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নেড়ে সায় জানালো। পা বাড়াবে নওরিজ আবার ডাক দিলো।
-" রুমাল হবে তোর কাছে?
সুরেলা প্রশ্নাত্মক চোখে চায়। মাথা কাত করে হ্যাঁ বোঝায়। নওরিজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-" মুখ নেই তোর? বোবার মতো মাথা নাড়ছিস কেন? রুমালটা দে তো?
সুরেলা নাক মুখ কুঁচকে নেয়। তাঁর রুমাল কেন দেবে? সে ভাবে খাইস্টা লোকটা হয়তো ঘর্মাক্ত মুখ মুছবে। কপাল গলা দিয়ে ঘাম চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে যে। পুরুষালী ঘামের গন্ধে সুরেলা নাক মুখ কুঁচকে কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ হতে রুমালটা বের করতেই নওরিজ একপ্রকার ছিনিয়ে নেয়। এক কোণা ধরে ঘুমিয়ে ফিরিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করে,
-" নাক টাক মুছিস নি তো?"
-" অবশ্যই মুছেছি! একেবারে সর্দিকাশিতে মাখামাখি। আমার আবার ঠান্ডা বারোমাস!"
বলেই অপেক্ষা করে না সুরেলা। মানে মানে কেটে পড়লো সে। নওরিজ মাহবুব মুখাবয়ব থমথমে। কুঁচকানো কপাল শিথিল তবে আতংকিত! সে রুমালের এককোনা চেপে ধরে চোখ মুখ খিচে নেয়।
.
.
.
চলবে..........................................................................