অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ১০৯ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


——————
অতীত........
——————

হুসাইন আলীর সেই পুরোনো স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটাতে উপস্থিত হয়েছে প্রিয়তা, অর্থাৎ রাণী মীর্জা। বেশভূষাও তেমনই। কালো এক গেঞ্জি আর জিন্স। তবে চুলগুলো আজ খোলা। সঙ্গে আজও তনুজা এসেছে। নিয়মিত ভঙ্গিতে পেছনে হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তার বাঁ দিকে ঠিক দু হাত দূরত্বে। প্রিয়তার ঘনপল্লবযুক্ত চমৎকার চোখজোড়া টেবিলের ওপর রাখা জিনিসপত্রের ওপর। পান, জর্দা, সিগারেট, লাইটার সাজানো একটা থালা; কিছু কাগজপত্র। সঙ্গে একটা খোলা মদের বোতল। কিছুক্ষণ আগে তাতে চুমুক দিচ্ছিল হুসাইন আলী। পাঞ্জাবীর রঙ ছাড়া হুসাইন আলীর বেশে তেমন পরিবর্তন নেই। ওনার লোক টেবিলে কফি রাখতেই সোজা হয়ে বসল হুসাইন আলী। ধূর্ত চোখজোড়ার প্রবল দৃষ্টি ফেলে বলল, 'শওকত মীর্জার গুনবতী মেয়ে, রুদ্র আমেরের একমাত্র সম্মানীয় স্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলাপের সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য হলাম। আজ আবার আমার অসুস্থ ভাইয়ের গলায় ছু*রি ধরে আসোনি নিশ্চয়ই?'

মুচকি হাসল প্রিয়তা। হলদে গাল দুটোতে চমৎকার ভাজ পড়ল। অনেকটা ধীরেসুস্থে বলল, ' প্রথমত, রাণী মীর্জা বসে আছে আপনার সামনে। যে শুধুই নিজের । দ্বিতীয়ত, আপনার ভাইয়ের গলায় ছু*রি ধরার কোন প্রয়োজন এখনো অবধি পড়েনি। যদি পরে! আমি সেটাও করতে পারি।'

পাল্টা হাসল হুসাইন আলীও। খানিকটা জর্দা মুখে পুড়ে বলল, 'তাহলে হঠাৎ এখানে আসার কারণ? চুক্তি অনুযায়ী মাল দিতে? কিন্তু সেকাজেতো তোমার আসার কথা নয়। আসলেও এসময়তো একদমই আসার কথা নয়। আর শুধুমাত্র ডেইট ফিক্সিংয়ের জন্যে এতোদূর কষ্ট করে আসবেনা তুমি।'

হুসাইন আলীর কথাগুলোকে অযথা প্রলাপের মতো এড়িয়ে গেল প্রিয়তা। কফির মগটা হাতে তুলে বলল, ' আপনাকে এ সপ্তাহের মধ্যেই মাল ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল আমাদের। তাইতো?'

' তাই। তবে এখনো তা পৌঁছয়নি। এদিকে হাতে মাত্র দুদিন আছে।'

' আপাতত আপনার কাছে কোন অস্ত্র পৌঁছচ্ছেনা হুসাইন হাসেব।'

পান চিবোনো থামিয়ে দিল হুসাইন আলি। এমন গুরুগম্ভীর কথা বলেও কোন বিকার নেই প্রিয়তার মাঝে। অনেক বেপরোয়াভাবেই কফির মগে চুমুক দিল সে। হুসাইন আলী একটু নড়েচড়ে বসল। পান চিবুনো থামিয়ে দিয়ে বলল, 'মানে?'

ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যমাখা এক টুকরো হাসি দিল প্রিয়তা। চেয়ারে হেলানে দিয়ে বলল, ' মানেটা আপনি জানেন। আপনি এটাও জানেন এবারের ডেলিভারির মাল আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি। তার আগেই সোলার সিস্টেম ছিনিয়ে নিয়েছে সেসব। দুদিনের মধ্যে আপনাকে কেন, কাউকেই আমরা মাল দিতে পারবনা।' 

এটুকু বলে থামল প্রিয়তা। ভরকে গেল হুসাইন আলী। খানিকটা থতমত খেয়ে তাকাল সামনে বসে থাকা ভয়ংকর এই রমনীর দিকে। বুঝতে পারলনা, ঠিক কতটা জানে এই মেয়ে। হুসাইন আলীকে চমকে দিতে পেরে বরাবরের মতোই বাচ্চাসুলভ আনন্দ পেল প্রিয়তা। ভ্রুজোড়া সামন্য উঁচু করে বলল, 'আমার সামনে এতো ভালো অভিনয় করার কী কারণ হুসাইন হাসেব? কী প্রমাণ করতে চান? অভিনয়ে আপনি আমারও কাঠি কয়েক ওপরে?'

হুসাইন আলীর চোখেমুখে গাম্ভীর্য এসে ভর করল। থমথমে গলায় বলল, ' বিজনেস করলে খবর রাখতে হয়। এইটুকু সোর্স না থাকলে দেশের এক নম্বর অস্ত্র সাপ্লাইয়ার হতে পারতামনা আমি।'

' অবৈধ অস্ত্র সাপ্লাইয়ার।' সংশোধন করে দিল প্রিয়তা।

' ধন্যবাদ।' হুসাইন আলীর কন্ঠেও কৃত্রিম বিনয়।

প্রিয়তা মগটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, ' সোর্স থাকা ভালো। কিন্তু ডাবল গেইম খেলাটা আমি পছন্দ করিনা।'

হুসাইন শ্লেষ করে বলল, ' সিংহিনী বলছে আমি মাংস খাওয়া পছন্দ করিনা! ভারি মজারতো!'

প্রিয়তা হেসে ফেলল। দুহাত একত্রিত করে তাকাল হুসাইন আলীর চোখে, ' সিংহিনী অন্যের মাংস খাওয়া পছন্দ করেনা। কারণ তাতে নিজের ভাগে কম পড়ে যায়। শিকারের সর্বস্ব গ্রাস করতে ভালোবাসে সে। মজারই বটে। যাই হোক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে আমি জানি, রুদ্র তার ছিনিয়ে আনা অস্ত্রগুলো আপনার কাছেই বিক্রি করেছে। সুতরাং কোন লস হয়নি আপনার। যদিও দেওয়ার কথা ছিল আমার দলের, দিয়েছে আমার স্বামীর দল। কথাতো একই হলো বলুন। সে কী আমার পর?'

এবার সামান্য কৌতুক খেলল হুসাইন আলীর চোখেও। বলল, ' না। দুবছর একসঙ্গে সংসার যখন করেছো, পরতো না।' বলতে বলতে ড্রয়ার খুলল হুসাইন আলী। একটা ফাইল টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, 'কিন্তু বন্ডে সইটা আসলে ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোল করেছে। সোলার সিস্টেম না। সুতরাং মালগুলো আমার ঐ দুই দলের থেকেই বুঝে নেওয়ার কথা। অন্যকোথাও থেকে আমি কী পাচ্ছি না পাচ্ছি সেটা দেখার বিষয় নয়।'

প্রিয়তার মপ্রতিক্রিয়ায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই। যেন এমনটাই আশা করছিল সে। নির্বিকারভাবেই বলল, ' যদি বলি দেখতে হবে। এবার আপনাকে কোন মাল দিতে পারবনা আমরা। বরং আপনি মাল দেবেন আমাদের। সঙ্গে টাকা। আপনাকে রুদ্র যা দিয়েছে সেটা দিয়ে যতটা সম্ভব ক্লাইন্ট কভার করব আমরা। বাকিটা টাকা দিয়ে। সাময়িক ক্ষতিটা পুষিয়ে ওঠা প্রয়োজন। সোলার সিস্টেমের মতো সর্বশান্ত হওয়া আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে আমাদের।'

' যদি না দেই?'

' আপনি জানেন কী হবে।'

মুখ বিকৃত হয়ে উঠল হুসাইন আলীর। থু করে চিবুনো পান ফেলল একটা পাত্রে। থমথমে গলায় বলল, 'এই ফাইলটাতে কিন্তু তোমাদের সই আছে রাণী। আমার ভাইয়ের কিছু হলে ফাইলটা সোজা চলে যাবে পুলিশের কাছে। চুক্তির প্রমাণ। আর এটা খুব ভালো করেই জানো। আমাদের মতো খুচরো অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কখনও সঠিক পরিচয়ে, সঠিক ইনফরমেশন দিয়ে, কোন প্রমাণ রেখে ব্যবসা করেনা। এখানে তোমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকলেও, আমার বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রমাণ নেই। বড়জোর এমন পাকাপোক্ত ঘাঁটি গুটিয়ে নতুন নাম, নতুন পরিচয়ে কাজ শুরু করতে হবে। এতে চরম লসে পড়ব তা ঠিক। কিন্তু নিজের ভাইকে হারানোর প্রতিশোধে এইটুকূ মূল্য খুব বেশি কী?'

প্রিয়তার ঠোঁটের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। আকর্ষণীয় চোখজোড়ার তীক্ষ্ম দৃষ্টি পড়ল মদের বোতলটার ওপর। পেছনে দাঁড়ানো তনুজা নড়েচড়ে উঠল। পেছনে থাকা পিস্তলের ওপর হাত রেখে প্রস্তুত হল। এই দৃষ্টি ও চেনে। কিছু একটা ঘটবে এখন!
 হঠাৎই এক ধাক্কায় বোতলটা টেবিলের ওপর ফেলে দিল প্রিয়তা। চমকে উঠল ঘরে উপস্থিত সকলে। মদের বোতল থেকে সবটুকু তরল ছড়িয়ে পড়ল গোটা টেবিলে। হুসাইন আলী নড়ল না, কেবল সুক্ষ্ম চোখে চেয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা প্লেটের ওপরে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিল। হুসাইন আলীর চোখে চোখ রেখে চেপে ধরল ঠোঁটের মাঝে। নিচে না তাকিয়েই লাইটার তুলে জ্বালাল সেটা। সিগারেট ধরানোর সময়টাতেও হুসাইন আলীর থেকে চোখ সরালোনা প্রিয়তা। হুসাইন আলীও একইভাবে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে, কী করবে এই মেয়ে। ভাবা শেষ হলোনা, তার আগেই জ্বলন্ত লাইটারটা টেবিলের ওপর ছুড়ে মারল প্রিয়তা। 
সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল টেবিলটা। চমকে উঠে দাঁড়াল হুসাইন আলী। পিছিয়ে গেল কয়েক পা। তনুজা সহ ঘরের বাকিরাও থমকে দাঁড়িয়ে রইল। হুসাইন আলী হতভম্ব চোখে তাকিয়ে দেখল, টেবিলটার সঙ্গে তার ওপর রাখা ফাইলটাও জ্বলছে। প্রিয়তা তখনও চেয়ারেই বসে। টেবিলে জ্বলতে থাকা আগুনের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে ওর চোখে দুটোতে। যেন টেবিলে নয় ঐ দুটো চোখেই আগুন জ্বলছে। নিজের হতভম্ব দৃষ্টি টেবিল থেকে সরিয়ে প্রিয়তার দিকে ফেলল হুসাইন আলী। প্রিয়তা উঁঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের মাঝ থেকে সিগারেটটা আঙ্গুলের মাঝে নিল। হালকা করে ধোঁয়া ছাড়ল। হুসাইন আলী কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রিয়তা বলল, ' আ_ বাংলা সিনেমার কমন ডায়লগ ঝেড়ে এটা বলবেন না যে "এটার একশটা ফটোকপি আছে আমার কাছে।" ' একটু থেমে পুনরায় সেই তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলল হুসাইন আলীর দিকে। গম্ভীর গলায় বলল, ' একশ কেন? হাজারটা কপি থাকলেও কিছু যায় আসেনা আমার। এটা দেখিয়ে আপনি আমায় থ্রেট করেছেন, যা আমার পছন্দ হয়নি। আর যা আমার পছন্দ হয়না, তা জ্বলে যেতে হয়। এবার আসল কথায় আসি। আপনার পেটে লাথি মেরে আমার আহামরি কোন লাভ নেই। যাই নিচ্ছি ধার হিসেবে নিচ্ছি। সবটা ঠিক হলে আপনার জিনিস আপনাকে ফিরিয়ে দেব। আন্ডারওয়ার্ল্ডে টাকার চেয়েও বেশি কাজ করে স্ট্রং ইমেজ। একবার সেটা নষ্ট হলে ফিরে পাওয়া মুশকিল। সোলার সিস্টেমকে দেখে তা আপনার জানা উচিত। যাই হোক, কথা হয়ে গেল, সন্ধ্যার মধ্যে টাকা আর মাল এসে নিয়ে যাবে আমাদের লোক। কীভাবে, কোথায় সব জানানো হবে। আসছি।'

উল্টো ঘুরতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল প্রিয়তা। পেছন ঘুরে বলল, ' আপনার সঙ্গে হওয়া আমার এই মিটিংটার বিষয়ে রুদ্র আমের যাতে কিছু জানতে না পারে। আপনি ওর সঙ্গে কখন, কী কথা বলবেন; সবটাই কানে আসবে আমার। আশা করছি কথাটা মনে থাকবে আপনার।'

হুসাইন আলী তখনও সুক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে রেখেছে দুর্ধর্ষ এই মেয়েটার দিকে। গম্ভীর কন্ঠে সে বলল, ' আমি রুদ্রকে কিছুই বলব না।'

প্রিয়তা দু'পা এগোতেই সামনে সেই ছেলেটাকে দেখল। গতদিন যার উড়ুতে গু*লি করেছিল ও। চোখে চোখ পড়তেই থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল ছেলেটা। শত চেষ্টা করেও চেহারায় ফুঁটে ওঠা ভীতি লুকোতে পারল না। প্রিয়তা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তখনই হুসাইন আলী বলে উঠল, ' এটাই শেষ সুযোগ কিন্তু রাণী! আমি আগেও বলেছি, আমি লাভের পেছনে দৌড়-ই। পরেরবার যদি একই ঘটনা ঘটে_' একটু থামল হুসাইন আলী। অতঃপর খুবই নিষ্ঠুরভাবে বলল, ' আমার ভাইয়ের প্রাণ আমার এতোটাও প্রিয় নয় যে আমি এতোটা ক্ষতি এফোর্ড করতে পারব।'

দু সেকেন্ড ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। কিছু বলল না। পেছন ফিরে তাকালোও না। নিজের সেই দৃঢ় কদমে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল রাণী মীর্জা। পেছনে তনুজা।

•••••••••••••

হুসাইন আলীর ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বাইকের কাছে এসে দাঁড়াল প্রিয়তা। প্যান্টের পেছন থেকে ফোনটা বের করে কল করল শওকত মীর্জাকে। কল রিসিভ করতেই বলল, ' সন্ধ্যায় লোক পাঠিয়ে দিও। টাকা আর মাল দুটোই পেয়ে যাবে।'

' রাজি হয়ে গেছে!' অবাক হয়ে বলল শওকত মীর্জা।

' শেষবারের মতো। এরপর কোনকিছুতেই কোন লাভ হবেনা। কাল নেক্সট ডেলিভারির মিটিং থাকবে। সকাল এগারোটায়। বাড়িতেই হবে। সময়মতো বাকিদের চলে আসতে বলবে।'

নিজের কথাটুকু বলেই কল কেটে দিল প্রিয়তা। বাইকে উঠে বসল। হ্যান্ডেলে ঝোলানো কালো জ্যামাটটা জড়িয়ে নিল গায়ে। মাথায় কালো হেলমেট চড়িয়ে তনুজাকে বলল, ' তুমি চলে যাও। আমের ভিলায় ফিরব আমি।'

তনুজা মাথা নুইয়ে বলল, ' জি ম্যাডাম।'

বাইকটা স্টার্ট দিল প্রিয়তা। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেল তনুজার। তনুজা অপলক তাকিয়ে রইল প্রিয়তার যাওয়ার দিকে। আজকাল নিজের ম্যাডামকে ভীষণ অস্থির লাগে ওর। যেন কোনকিছু সারাক্ষণ মারাত্মক যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। কারণটা বোধহয় রুদ্র আমের। তবে কী রাণী মীর্জার ভেতর কোথাও একটা সত্যিই প্রিয়তা আছে? যে সত্যিই ভালোবেসেছিল রুদ্র আমেরকে। এও সম্ভব? রাণী মীর্জার মতো পিশাচিনীও কাউকে ভালোবেসে প্রিয়তা হয়ে উঠতে পারে!

••••••••••••

আমের ফাউন্ডেশনে অনেকদিন পর আবার মিটিংয়ে বসেছে। রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর এবং দলের বাকি কিছু লোক। চা, হালকা কিছু জলখাবার আর সিগারেটের সঙ্গে টুকটাক আলোচনা করছে ওরা। কতজন বিজনেসম্যান টাকা দিয়েছে, কত দিয়েছে। আমের ফাউন্ডেশনে কত টাকা জমা হয়েছে। লাস্ট ছিনিয়ে নেওয়া মালগুলো সব জায়গায় ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে কি-না। সবার পেমেন্ট ক্লিয়ার কিনা। এসব নিয়েই আলোচনা হলো আজ। উচ্ছ্বাস বলল, 'আমাদের নিয়ে আসা মালগুলো সব সাপ্লাই দেওয়া শেষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্লাইন্টের কাছে পৌঁছনো বাকি ছিল। আজ পৌঁছে গেছে।'

জাফর বলল, ' কিন্তু এখনো যা আছে তা বিদেশি ক্লাইন্টদের পাওনা শোধ করার জন্যে যথেষ্ট না।'

উচ্ছ্বাস কপাল কুঁচকে বলল, ' রাখোতো চাচা! নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।' তারপর রুদ্রর দিকে ফিরে বলল, 'কিন্তু কথা হলো তুই এখনো চাইছিস আমের ফ্যাক্টরিগুলো বেঁচে দিতে? টাকার ব্যবস্থাতো হচ্ছে।'

রুদ্র চুপচাপ বসে সিগারেট টানছিল। রুদ্রর মাঝে আজকাল কেমন একটা রাশেদ আমের, রাশেদ আমের গন্ধ পাওয়া যায়। সেই গাম্ভীর্য, সেই ভঙ্গি, সেই বচন। যেন সাক্ষাৎ জোয়ান রাশেদ আমের এসে বসেছে চেয়ারটাতে। রুদ্র বলল, ' হ্যাঁ দিচ্ছি।'

জাফর অস্থির হয়ে বলল, ' কিন্তু কেন? আরেকটু অপেক্ষা...'

মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে রুদ্র বলল, ' অতোটা সময় নেই আমাদের হাতে। আর তোমার কী মনে হয়? সোলার সিস্টেম এখনো আছে? হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া একজনও আর মনেপ্রাণে সোলার সিস্টেমের নেই। একটা সুযোগ পাওয়া মাত্র সব কেটে পড়বে। ইতিমধ্যে অনেকেই ভেগেছে। যখন দেখবে আর কোন আশা নেই তখন বাকিরাও ভাগবে। নিজেদের গড়ার জন্যে আগে ওদের ভাঙা জরুরি! আর এই তিনটে ডেলিভারিতে যদি ওদের আটকানো যায় অনেক বড় লসের সম্মুখীন হতে হবে ওরা। সেই লস কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে যাবে। ঠিক যেমন আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছিল।'

উচ্ছ্বাস গাল চুলকে বলল, ' পয়েন্ট! এই তিনটে ডেলিভারি ওদের জন্যে ট্রামকার্ড। তিনটেই যদি বাঞ্চাল করে দেওয়া যায় ওদের ভাঙাটা সহজ হবে। সামনে নির্বাচন। এইসময় খুচরো অস্ত্রের ক্রেতার সংখ্যা আরও বাড়বে। এসময়ে সাপ্লাইয়ে তালমিল হওয়া মানে শুধু টাকার ধাক্কা না। অনেক পলিটিক্যাল দলসহ খুচরা সেলারেরও তোপের মুখে পড়তে হবে।'

রুদ্র হালকা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, 'ওদের নেক্সট ডেলিভারি খুব শীঘ্রই আসবে। তার আগেই টাকা লাগবে আমার। তারপর প্রপার প্ল্যান রেডি করতে হবে। কোন ক্লাইন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?'

জাফর নিষ্প্রাণ গলায় বলল, ' হয়েছে। এখানকার ফ্যাক্টরি দুটো সুবর্ণা গ্রুপ কিনতে চাইছে।'

' সেল করে দাও। কথা বলে পেপার রেডি করো। আমি সই করে দেব।'

' তা না হয় করলাম। টাকার ব্যবস্থা না হয় হলো। কিন্তু লোক? ওইপন?'

' প্রথমবার যেভাবে এরেঞ্জ হয়েছে, সেভাবেই হবে।'

 ' আর লোকেশন? কোথায় ডেলিভারি হবে, কীভাবে হবে, যদি আমাদের মতো কোন পাসকোড ব্যবহার করে থাকে সেই পাসকোড। এসব কীভাবে জানব?'

 ' একই উত্তর। প্রথমবারের মতোই হবে।'

উচ্ছ্বাস নিজেও একটা সিগারেট ধরালো। খানিকটা হেসে বলল, 'প্রথমবার কী হয়েছে সেটাইতো এখনো জানা হলোনা।'

লম্বা এক টান দিয়ে সিগারেটে সুখটান দিল রুদ্র। নির্বিকারভাবে বলল, ' জানার আপাতত কোন প্রয়োজন নেই।'

জাফর আর উচ্ছ্বাস একে অপরের দিকে তাকাল। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে রেজিস্ট্রার খাতাদুটো গুটিয়ে নিল উচ্ছ্বাস। ব্যপারটা দেখেও না দেখার ভান করল রুদ্র। কারো প্রতি আবেগ দেখানোর মতো সময় বা পরিস্থিতি কোনটাই এখন ওর নেই। উচ্ছ্বাস বগলের নিচে রেজিস্ট্রার খাতাদুটো নিয়ে উঠে দাঁড়াল উচ্ছ্বাস। পুনরায় ঠোঁটের মাঝে সিগারেট গুঁজে নিয়ে বলল, ' তাহলে আজকের মতো আলোচনা এখানেই শেষ?'

রুদ্র সিগারেট অ‍্যাশট্রেতে গুঁজে রেখে বলল, ' আপাতত।'

উঠে দাঁড়াল জাফরও। নিরস গলায় বলল, ' আমি তাহলে ক্লাইন্টের সঙ্গে কথা বলে ফ্যাক্টরিদুটো সেল করার ব্যবস্থা করছি।'

বলে বেরিয়ে গেল জাফর। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত বাকি কিছু লোকজনও বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রেজিস্ট্রার খাতাগুলো জায়গামতো রেখে উচ্ছ্বাস বলল, ' আমিও যাচ্ছি তাহলে।'

রুদ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ' কোথায় যাবি?'

উচ্ছ্বাস দাঁত কেলিয়ে বলল, ' চুরি করতে। অনেকদিন করিনা। সেই কবে ছোটবেলায় করেছি। সোলার সিস্টেমতো থাকবেনা। ফিউচার প্লানতো করা লাগবে নাকি। তাই একটু প্রাকটিজ করব। ব্যাকআপ প্লান আরকি।'

টেবিলে থাকা ছোট্ট বোর্ডটা উচ্ছ্বাসের দিকে ছুড়ে মারল রুদ্র। মাথা সরিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল উচ্ছ্বাস। হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল কান অবধি। সকৌতুকে বলল, ' আমায় বাগে পাওয়া অতো সহজ না চান্দু।'

রুদ্র তেড়ে উঠতে নিচ্ছিল। হু হা করে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে দৌড়ে পালালো উচ্ছ্বাস। রুদ্র বসে পড়ল নিজের জায়গায়। সবাই চলে গেছে। ঘরটাতে ও একা। টেবিল থেকে ফোনটা তুলে ধীরেসুস্থে কল করল রঞ্জুকে। ওকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাছে পাঠিয়েছে রুদ্র। সেকাজ কতদূর এগোলো তার খবর নিতে হবে।
সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে। কিন্তু ভেতরটা অদ্ভুত অস্থিরতায় ছটফট করছে। ওর মন বলছে আজ রাতে কিছু একটা হবে। খুব নীরব কিছু। কিন্তু রুদ্র জাননা। আজ রাতে যাই হোক, তা এই জটিল গল্পকে তার অন্তিম পরণতির দিকে আছড়ে ফেলবে। খুব নিষ্ঠুরভাবে!

•••••••••••

দিনটা ছিল ১৪ ই এপ্রিল। রুদ্র আমেরের জন্মদিন। এপ্রিলের তেরো তারিখে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক ডেলিভারির কাজ ছিল রুদ্রর। সেকাজ সেড়ে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো ওর। চৈত্রের শেষ দিন। ভ্যাঁপসা গরম। তারওপর সারাদিনের দৌড়ঝাঁপে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল রুদ্র। নিজ ঘরে ঢুকতেই একটু অবাক হয় সে। ঘরটা অন্ধকার। কিন্তু এমন হওয়ার কথা নয়। রুদ্র ফেরার আগে প্রিয়তা ঘুমোয় না। ও কোন মিশনে থাকলেতো একেবারেই না। মেয়েটা কী অসুস্থ? রুদ্র আলতো আওয়াজে ডাকে, ' প্রিয়? জেগে আছো?'

তখনই প্রিয়তার মিষ্টি আওয়াজ কানে আসে রুদ্রর, 'লাইট জ্বালাবেন না প্লিজ। টেবিলে শরবত রাখা আছে। ওটা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।'

রুদ্র ভ্রুকুটি করে বলে, ' কিন্তু তুমি কোথায়?'

' আছি আমি। আপনি যানতো।'

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্র। মেয়েটা এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড প্রায়ই করে। তাই অবাক না হয়ে টি-টেবিল থেকে শরবতটা খেয়ে নেয়। তীব্র গরমে ঠান্ডা টক-মিষ্টি শরবতে শরীর জুড়িয়ে যায় রুদ্রর। মৃদু হেসে চলে যায় ওয়াশরুমে। একেবারে শাওয়ার নিয়েই বের হবে।
কিন্তু বেরিয়ে যে এভাবে চমকাবে সেটা জানা ছিলোনা রুদ্রর। সারাঘরময় ক্যান্ডেল জ্বলছে। সুগন্ধি মোমের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে ঘরটা। বিভিন্ন রঙের মোমের ফলে চারপাশে কী মোহনীয় আলো। ভ্রুদয় কুঁচকে আসে রুদ্রর। গলা থেকে তোয়ালেটা নামিয়ে অবাক চোখে আরও একবার দেখে নেয় চারপাশটা। সুগন্ধি মোমবাতি প্রিয়তার অনেক পছন্দের। সেটা জানে রুদ্র। ওকে স্পেশাল ফিল করাতে চাইলে সবসময় এটার ব্যবহার করে রুদ্র। কিন্তু প্রিয়তা কেন করেছে এসব? রুদ্র বলল, ' প্রিয়? কী করছো বলোতো? কোথায় আছো? বের হও!'

কিন্তু প্রিয়তা আসেনা সামনে। রুদ্র এবার বিরক্ত হয়। প্রিয়তা খোঁজার জন্যে দু'কদম এগোতেই রুদ্রর কানে ভেসে আসে একটা ভয়েজ মেসেজ,

 ' ১৪ ই এপ্রিল! এই দিনটাতে কারো অস্তিত্বের অংশ এসেছিল এই বিচিত্র পৃথিবীতে। আমের সম্রাজ্যের ছোট্ট রাজা। আলোয় ঝলমল করে উঠেছিল তটিনী নামক মহিয়সী এক নারীর কোল। প্রশান্তিতে তৃপ্ত হয়েছিল রাশেদ আমের নামক এক পিতার বুক। এইদিনটাকে কেউ পেয়েছিল বটবৃক্ষের মতো একজন ভাই, কিংবা ছায়ার মতো একজন বন্ধু। আবার কারো কারো জীবনের দুঃস্বপ্ন, ধ্বংস, দুর্ভাগ্য নামক রুদ্র আমেরেরও জন্ম হয়েছিল আজকের দিনটাতেই। কিন্তু যদি প্রিয়তা নামক এই অস্তিত্বহীন মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করেন। তবে সে বলবে, আজকের দিনটাতে তার অস্তিত্বের জন্ম হয়েছিল। তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম অধ্যায়। আপনি আমার জীবনে না আসলে বোধহয় কখনও নিজেকে ফিরে পেতাম না আমি। কখনও আবার ভালোবাসতে পারতামনা। জানাই হতোনা, কারো বুকে মাথা রেখে এতোটাও শান্তি পাওয়া যায়। জানা হতোনা, কারো নরম আদরগুলোতে এভাবে সব যন্ত্রণা ভুলে থাকা যায়। কারো প্রেমে নিজেকে এভাবে হারিয়ে ফেলা যায় আমি সত্যিই জানতাম না। তাই আজকের এই দিনটা আমার জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দিন। সহধর্মিনীর পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আমার শ্যামপুরুষ।'

রুদ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিজ স্থানে। প্রিয়তা বারান্দার দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। হাতে মোমবাতি। সাদা রঙের একটা শাড়ি পড়েছে প্রিয়তা। রুদ্র সাদা রঙে দেখতে পছন্দ করে ওকে। স্নিগ্ধ মুখটাতে মোহনীয় হাসি লেপ্টে আছে মেয়েটার। শুধু কাজলটানা সাজগোজহীন মুখটা মোমের আলোয় ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। রুদ্র অপলক তাকিয়ে দেখল সবচেয়ে প্রিয় নারীটিকে। প্রতি কদমে ওর দিকে এগিয়ে আসছে সে।
প্রিয়তা ধীরপায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল রুদ্রর সামনে। হাতে ধরা মোমবাতিটা নিজেদের বুক বরাবর ঠিক মাঝামাঝি ধরল। মৃদু হেসে বলল, ' শুভ জন্মদিন প্রিয় স্বামী।'

রুদ্র জন্মদিন পালন পছন্দ করেনা। কেউ ওর জন্মদিন পালন করলেও ভীষণ রাগ করে। যার ফলে কেউ ওর জন্মদিন পালন করেনা আর। তবে এই নিষেধাজ্ঞা ও মানাতে পারেনি জ্যোতিকে। রাগ, ধমক যাই খেতে হোক। ১৪ ই এপ্রিল সকালে একবাটি পায়েশ নিয়ে এসে শুভ জন্মদিন সে বলবেই। কিন্তু প্রিয়তার ওপর চেষ্টা করেও বিন্দুমাত্র রাগ করতে পারল না রুদ্র। ঐ স্নিগ্ধ মুখ আর গভীর হরিণী চোখ দেখে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। তাও যথা সম্ভব গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ' এসব কী? তোমাকে কেউ বলেনি আমি এসব পছন্দ করিনা।'

প্রিয়তা মোমবাতিটা সাইডে রাখল। আলতো হাতে রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ' বলেছে। তাতে কী? সেতো আপনি প্রেম-ভালোবাসাও পছন্দ করতেন না। দুটোইতো করেছেন নাকি?'

রুদ্র প্রিয়তার কোমর জড়িয়ে বলল, ' খুব কথা শিখেছো? আজ করেছো করছো। ভবিষ্যতে এসব আর করবেনা।'

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল, ' বললেই হলো? যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিনতো করবোই।'

প্রিয়তার ঘাড় ধরে নিজের দিকে টেনে নিল রুদ্র। বলল, ' মরে দেখাও দেখি। দেখি কার এতো বুকের পাটা যে আমার প্রিয়কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়।'

প্রিয়তা রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, ' দেখা গেল কবে যেন নিজের হাতেই মেরে ফেললেন।'

রুদ্র গম্ভীর হল। থমথমে গলায় বলল, ' এটা কেমন কথা?'

ফিক করে হেসে ফেলল প্রিয়তা। রুদ্র বুকে হালকা একটা কিল বসিয়ে বলল, ' মজা করছিলাম। জানেন ওরা সবাই কথ ভয় পাচ্ছিল আপনার জন্মদিন পালন করব শুনে? আমিতো সবাইকে নিয়েই করব ভেবেছিলাম। কিন্তু কেউ সাহসই করেনি আসার।'

রুদ্র ভ্রু তুলে বলল, ' তুমি একটু বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলেছো না?'

প্রিয়তা সগর্বে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ' বউটা কার?' 

বলে টি-টেবিল থেকে একটা প্লেট তুলে নিল। রুদ্র বলল, 'এখন এটা কী?'

' পুডিং বানিয়েছি। খালি মুখে উইশ করে নাকি?'

বলেছি একটুকরো চামচে নিয়ে এগিয়ে দিল রুদ্রর মুখের দিকে। রুদ্র মুখে নিল। প্রিয়তা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে। রুদ্রও মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশংসা করল খাবারের। আরেকটা টুকরো তুলে খাইয়ে দিল প্রিয়তাকে।
হঠাৎই কিছু মনে পড়ল প্রিয়তার। পুডিং মুখে চিবুতে চিবুতেই বলল, ' উমম। চোখ বন্ধ করুন।'

রুদ্র বিরক্তি নিয়ে বলল, ' আবার কী প্রিয়? আজ একটার পর একটা পাগলামি করছো।'

' করুনতো!'

রুদ্র হতাশ হয়ে চোখ বন্ধ করল। একটু পরেই অনুভব করল ওর একটা হাত হাতে তুলে নিচ্ছে প্রিয়তা। তারপরেই ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেল সেখানে। রুদ্র চোখ খুলে দেখল চমৎকার একটা ব্রেসলেট। রুদ্র অবাক হয়ে বলল, ' এটা কী?'

' জন্মদিনের উপহার আমার প্রিয় স্বামী।'

' এটার কী দরকার ছিল?'

' ছিলো বলেইতো দিলাম। স্যাম্বল অব মাই লাভ।'

বলতে বলতেই রুদ্রর হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল প্রিয়তা। উদাস চোখে চাইল খোলা আকাশের দিকে। রুদ্র পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। কাঁধে থুতনি রেখে বলল, ' কী দেখো?'

' আজ ধুমকেতু দেখা গেলে কত ভালো হতো তাইনা?'

' হতো। কিন্তু ওটাতো নিজের সময়মতোই আসবে।'

' অতোটা সময় কী আছে আমার হাতে?'

প্রিয়তার কাঁধে গভীর প্রনয়স্পর্শ দিল রুদ্র। আবেশে চোখ বুজে ফেলল মেয়েটা। রুদ্র বলল, ' আমি তোমাকে কোথায় যেতে দেবনা প্রিয়। আর যদি আমরা নাও থাকি। আমরা ধুমকেতুতে ফিরে আসব। আকাশের বদলানো প্রতিটা রূপে ফির আসব। ঐ চাঁদ, তারা, মেঘ সবকিছুতে ফিরে আসব। আমরা শেষ হতে পারি। কিন্তু আমাদের কাহিনী কোনদিন শেষ হবেনা প্রিয়। কোনদিনও না।'

•••••••••••••

শরীর কাঁপানো শীতল হাওয়া গায়ে পড়তেই চমকে ওঠে প্রিয়তা। মধুর সেই স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত বর্তমানে। আজ রাতে বনানীর এই ফ্ল্যাটটাতে এসেছে ও। রাতটা এখানে থাকবে বলেই ঠিক করেছে। এই ফ্ল্যাটটা প্রিয়তার ভীষণ প্রিয়। জীবনের অসম্ভব সুন্দর পঁচিশটা দিন কাটিয়েছিল ও এই ফ্ল্যাটে। অথচ সেই সুন্দর স্মৃতিগুলো আজ বিষাক্ত তীরের মতো আঘাত করছে ওর বুকে। বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে প্রিয়তার। দমবন্ধ হয়ে আসছে। আজকাল রাণী মীর্জা হয়ে থাকতে চায়না ও। প্রিয়তাকে ও ভালোবেসে ফেলেছে। ওর প্রিয়তা সত্তার ওপর রাণী মীর্জা রীতিমতো অত্যাচার করে চলেছে। সেই নিষ্ঠুর অত্যাচারে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে প্রিয়তা। কিন্তু বের হওয়ার কোন উপায় দেখছে না। রাণী মীর্জা নামক ভয়ানক কৃষ্ণগহ্বরে আটকে গেছে প্রিয়তা। চিরকালের মতো।
প্রিয়তা বিভ্রান্ত চোখে তাকাল খোলা আকাশের দিকে। চাঁদ নেই। চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রিয়তা অন্ধকারকে ভয় পায়না বহুবছর হল। কিন্তু হঠাৎ আজ ভয় করছে প্রিয়তার। অন্ধকারকে আবার ভয় পাচ্ছে ও। আজকের এই আঁধার রাতকে ভীষণই অশুভ মনে হচ্ছে। সেই আশঙ্কায় শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। একটা শেষ চেষ্টার যে প্রদীপ ও জ্বালাতে চাইছে। মনে হচ্ছে এই দমকা হাওয়া, ঘন অন্ধকার সেই আলোটুকু নিভিয়ে দেবে। নিঃশ্বেষ করে দেবে।

হঠাৎই প্রিয়তার সজাগ কান উপলব্ধি করে শুধু ও একা না। আরও একজন এসে উপস্থিত হয়েছে এই ফ্ল্যাটে। সেই উপস্থিতি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে প্রিয়তার সজাগ ইন্দ্রিয়। অবচেতনভাবেই প্রিয়তার হাতটা হোলস্টারে রাখা নিজের প্রিয় বেরেটার ওপর চলে গেল। দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়াল ব্যালকনির ফ্লোর থেকে। সতর্কতার সঙ্গে উঁকি দিল ভেতরের রুমে। গোটা ফ্ল্যাটটাই অন্ধকার। তবে ফ্ল্যাটে যেই থাক, এখনো এই রুমে আসেনি সে বিষয়ে নিশ্চত প্রিয়তা।
 লাইট জ্বালালে গুপ্ত আগন্তুক সতর্ক হয়ে যাবে। তাই সেটা করল না প্রিয়তা। হোলস্টার থেকে বেরেটা বের করে প্রস্তুত হল। সতর্কভাবে ধীরপায়ে রুম পেরিয়ে দরজার দিকে এগুতে শুরু করল। কানদুটো খাড়া রেখেছে। প্রতিটা শব্দের প্রতি গভীর মনোযোগ আছে ওর। বুঝতে পারছে, রুম পাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগন্তুকের মুখোমুখি হবে ও। সেভাবেই প্রস্তুত হয় এগোচ্ছে ভয়হীন, জড়তাহীন, আত্মবিশ্বাসী কিন্তু একই সাথে চরম সতর্ক ভঙ্গিতে।

দরজার কাছে পৌঁছতেই থেমে গেল প্রিয়তার পা। ঠিক দরজার ওপাশে, ওর মতো করেই কেউ লুকিয়ে আছে। না দেখেও টের পেল সেটা। চোখ বুজে শ্রবণেন্দ্রিয় আরও দৃঢ় করল প্রিয়তা। মনে মনে উল্টো গুনে এগোতে শুরু করল। তিন, দুই, এক! সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করল প্রিয়তা। কিন্তু কারও চিৎকারের আওয়াজ নয়। বরং বাটের সঙ্গে বাটের সংঘর্ষের আওয়াজ পাওয়া গেল কেবল। অর্থাৎ অপরপক্ষ একইসময়, একইদিকে, একইগতিতে আঘাত করেছে পিস্তলের বাট দিয়ে। প্রিয়তা দ্বিতীয়বার সেই দিক লক্ষ করে পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করল। খুব জোরেই লাগল বোধ হয়। সেইদিকের তৃতীয়বার আঘাত করতে গেল প্রিয়তা। কিন্তু খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলল প্রতিপক্ষের সুঠাম শক্ত হাত। একটা প্রচন্ড ঘুষি ছুটে এলো প্রিয়তার ঠোঁটের কোণ ঘেষে। জায়গাটা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো প্রিয়তার। ওর হাতটা মুচড়ে ধরে ওর উল্টো ঘোরালো আগন্তুক। হাঁটু দিয়ে আঘাত করল মেরুদন্ডের হাড়ে। উপুড় হয়ে ফ্লোরে পড়ল প্রিয়তা। বেরেটাও হাত ফসকে পড়ে গেল কোথায় যেন। ব্যথায় দমবন্ধ হয়ে এলো প্রিয়তার। কিন্তু দমে গেল না। পা দিয়ে সজোরে আঘাত করল প্রতিপক্ষের পায়ে। সে টাল হারিয়ে পড়ল ঠিক প্রিয়তার ওপরেই। প্রিয়তা অন্ধকারের গলা খামচে ধরল লোকটার। লোকটাও কম গেল না। সে গায়ের জোরে প্রিয়তার একটা হাত সরিয়ে ফ্লোরে চেপে ধরল। ওপর হাত দিয়ে টিপে ধরল ওর গলা। দম আটকে এলো প্রিয়তার। যন্ত্রণায় কাতরালেও সমানতালে খামচে ধরে রাখল অপরপক্ষের গলা। যখন টের পেল দম আটকে মারা যাচ্ছে ও। গলা ফেঁটে রক্ত উঠে আসতে চাইছে। তখন বহুকষ্টে পা দুটো তুলে সজোরে ওপরে থাকা ব্যক্তির পেটে লাথি মারল ও। ছিটকে দূরে সরে পড়ল সে। প্রিয়তা সঙ্গে সঙ্গে বিভ্রান্তের মতো উঠে বসল। উন্মাদের মতো হাতরে খুঁজে নিল নিজের বেরেটা। হাতে আসতেই সেইফটি ক্যাচ অফ করতে করতে উঠে দাঁড়াল ও। বাইরে থেকে আসা আলোয় যতটুকুই প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে সে অনুযায়ী তাক করল পিস্তলটা। ঠিক একই সময় আরেকটা সেইফটি ক্যাচ অফ হওয়া শব্দ পাওয়া গেল। ট্রিগার চাপতেই যাবে এমন সময় জ্বলে উঠল রুমের লাইট। উজ্জ্বল আলোয় আগন্তুককে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল প্রিয়তা। রুদ্র! রুদ্রও ঠিক একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সুইচের পাশে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু। রুদ্রর দেওয়া কাজ সেড়ে, ওর কথামতোই এখানেই দেখা করতে এসেছিল ও। এসে অমন ভয়ংকর ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে। কোনকিছু না ভেবেই দ্রুত গিয়ে লাইটটা জ্বালায়। ভাগ্যিস জ্বালিয়েছে।
রুদ্র আর প্রিয়তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রঞ্জু। একে অপরের বুক বরাবর বন্দুক তাক করে তাকিয়ে আছে দুজন। দুজনের শরীরেই আঘাতের চিহ্ন। দুজনেই চোখভর্তি বিস্ময়, অবিশ্বাস আর বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। যেন না চাইতেও একেঅপরকে জীবনের সমাপ্তি টানার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে আছে, অটল-জেদি দুই নারী-পুরুষ!
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp