মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৪৩ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"মিস্টার বড় ইঁদুর! এরকম বেশভূষার তাৎপর্য কী জানতে পারি?"
কথাটা বলে অনন্যা ঠোঁট উল্টে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল।

কৌশিক নিশ্চুপ রইলো। অনন্যার কাঁধে ধীর হাত চালিয়ে পোশাক ঠিক করে দিচ্ছে কৌশিক। অনন্যার পরনে ফিটিংস অ্যাথলেটিক টপ। পায়ে স্লিম ট্রাউজার। হাতে গ্লাভস। কোমরে টাইট ফিটিং বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে কৌশিককে কিছুটা নিচুতে ঝুঁকতে হলো। অনন্যা দ্রুত পিছু হটলো। কৌশিক মৃদু হেসে বললো,
" প্রতিটি কাজে পোশাক, নিজের আউটফিট ঠিক করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।"

"হু?"

কৌশিক অনন্যার পিঠে কুইভারটা শক্ত করে বেঁধে দিলো, নড়াচড়া করলেও যাতে ঠিক জায়গায় থাকে। এরপর অনন্যার পায়ের দিকে বুটজোড়া এগিয়ে দিলো। অনন্যা চুপচাপ নিজের পায়ে জুতো গলিয়ে নিলো, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কৌশিক এক ধাপ পিছিয়ে ভালো করে দেখে নিলো তাকে। তার দৃষ্টিতে তৃপ্তি খেলা করছে, মাথা হালকা ঝাঁকিয়ে বললো,

"ওয়াও! লুকিং লাইক আ স্লিম কাউ!"

অনন্যা চোখ কুঁচকে তাকালো, ঠোঁট বাঁকিয়ে বিরক্তিকর আওয়াজ বের করলো, "হুঁঃ!" 
তারপর কৌশিককে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে বললো,
"গরু?! আমি গরু? আপনি কি যা খুশি তাই বলবেন?"

কৌশিক ভারসাম্য সামলে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে হাসলো। অনন্যা হাত পা নেড়ে নিজের সব বিরক্তি ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও পারলো না। নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকালো, 
"আর এটাই বা কী ধরনের ড্রেস? শরীরের রক্ত সব চেপে বেরিয়ে যাবে মনে হচ্ছে!"

কৌশিক মুচকি হেসে কাছে এগোলো। সে ধীর পায়ে পেছনে গিয়ে অনন্যার চুলগুলো একত্র করে লম্বা ঝুঁটি করে বেঁধে দিলো কালো এক ফিতা দিয়ে। কৌশিকের গরম শ্বাস এসে লাগছিল অনন্যার ঘাড়ের কাছে।

তারপর হঠাৎ কৌশিকের দুটো হাত অনন্যার গলার চারপাশে আলতোভাবে জড়িয়ে এলো। ঠোঁট অনন্যার কানের কাছাকাছি এসে থামলো, গলা কাঁপানো ফিসফিস আওয়াজে সে বললো,
"প্রিন্সেস, খুলে দেবো সব?"

অনন্যার বুকে ধ্বক আওয়াজ হলো। তার গলায় একগাদা ঢোক জমে গেলো। সে দ্রুত কনুই দিয়ে কৌশিকের পেটে এক আঘাত বসিয়ে দিলো। কৌশিক সামান্য কেশে উঠলো, কিন্তু হাসি বন্ধ হলো না।

অনন্যা ভুরু কুঁচকে বললো,
"ইদানিং বেশ অভদ্র আচরণ করছেন আপনি। আগে তো এমন ছিলেন না।"

কৌশিক কথাটাকে একদম পাত্তা দিলো না। বরং উল্টো, অনন্যার উন্মুক্ত গলার কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। অনন্যা ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

কৌশিক অনন্যার গলার কাছে শ্বাস ফেলে বললো, "ছিলাম। কিন্তু তুমি জানতে না।উমম.. দুই দিন পার হয়েছে তাও তোমার ক্ষতগুলো এখনো সারেনি। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে আরো ক্ষত তৈরি করতে। তুমি কি সহ্য করতে পারবে?"

অনন্যা কৌশিকের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে গেলো। নাক ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কৌশিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।

ছাদে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। বেশি সময় হয়নি যে ভোর হয়েছে। আকাশটায় রাতের আবহ রয়ে গেছে। পূর্ব দিগন্তে হালকা কমলা আভা ছড়িয়ে পড়ছে।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তাকালেই চোখে পড়ে বিশাল খোলা ছাদ। একদম ফাঁকা, কোনো রেলিং নেই। সাদা টাইলসে ছড়িয়ে থাকা শিশিরের চিকচিকে আভা হালকা আলোয় ঝলসে উঠছে। বাতাসে এখনো রাতের ঠান্ডা ছোঁয়া লেগে আছে। আকাশের সীমাহীন দৃষ্টিতে তাকালে মনে হয় রাত আর ভোরের মাঝামাঝি এক অলিখিত সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছে তারা।

কৌশিক তার প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে বললো,
"খুব অস্বস্তিকর লাগছে জানি! বাট এভ্রি ডিফারেন্ট টাস্কস নিড ডিফারেন্ট এটায়রস! সঠিক পোশাক তোমার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এন্ড তোমার এনার্জিকে বুস্ট করবে। মেয়েরা সাজগোজ করে কীসের জন্য জানো? অন্যদের দেখানোর জন্য নয়! আমম.. আমার চিন্তাধারা থেকে ভিন্ন মানুষ থাকতেই পারে। কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েরা সাজগোজ করে নিজের জন্য! নিজের কাছে সুন্দর দেখতে লাগলেই সবার কাছে সে কমফোর্ট নিয়ে দাঁড়াতে পারবে, মিষ্টি হেসে কথা বলতে পারবে। 

জব ইন্টারভিউ এর জন্য আলাদা পোশাক পরিধান করে যেতে হয়। কিন্তু কেনো? কারণ, ওই পোশাকটাই তোমাকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইন্টারভিউয়ারদের সামনে বসতে সাহায্য করবে। তুমি হেরে গেলেও, তোমার পোশাক তোমাকে জেতাতে পারবে। কারণ আত্মবিশ্বাসী মানুষ কখনো পুরোপুরি হারে না। দ্যাটস হুয়াই, ড্রেস ইজ ইম্পরট্যান্ট।

তোমাকে এই ড্রেস পড়ানোর কারণ নরমালি তোমার শেখার উপর কনসেনট্রেশন বজায় রাখার জন্য। নাহলে তুমি লস্ট ফিল করবে‌। একটু পরে আর ভালো লাগবে না।"

অনন্যা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কৌশিক একটু এগিয়ে গিয়ে চোখের ইশারায় সামনে ইঙ্গিত করলো। অনন্যা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো সামনের দিকে।

বাড়ির সামনে পুরোনো একটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তার গাঢ় বাদামি রুক্ষ গুঁড়ি সূর্যের ম্লান আলোয় নিখুঁত ভাবে দেখা যাচ্ছে। গুঁড়ির একপাশে ছোট্ট একটা লাল চিহ্ন! মনে হয় কারও নিখুঁত হাতে আঁকা গোল দাগ।

"ওটাই তোমার টার্গেট।" 
কৌশিক আঙুল দিয়ে বোঝালো।

কৌশিক ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিলো। মুখে হাসি টেনে বললো,
"আমার দিকে ঠিকমতো তাকাও। কীভাবে কি করি খেয়াল রাখো!"

কৌশিক সামনে ফিরলো। কোমর সোজা রেখে মাটিতে পা শক্ত করে রাখলো, শরীরের ওজন সামঞ্জস্য করলো। তারপর, ধীরে হাতে তীর তুলে নিলো, ধনুকের ছিলা শক্ত করে টেনে ধরলো। কৌশিকের কাঁধ ও বাহু নিখুঁত সমন্বয়ে স্থির হয়ে রইলো, চক্ষু দ্বয় সেই লক্ষ্যবস্তুতে আটকে ফেললো। নিশ্বাস আটকে রেখে, কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করলো। তারপর শ্বাস ছেড়ে তীর ছুড়ে দিলো!

তীর বাতাস চিরে ছুটে গেলো, সাঁই করে গাছের গুঁড়িতে থাকা লাল চিহ্নের মাঝে গভীর হয়ে গেঁথে গেলো। তীক্ষ্ণ শব্দে কেঁপে উঠলো চারপাশ। কৌশিক মুচকি হেসে তাকালো অনন্যার দিকে। অনন্যা ঠোঁট অল্প খুলে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সেখানে।

কৌশিক ধীরগতিতে ধনুক আর তীর এগিয়ে দিলো অনন্যার দিকে। অনন্যা নিতে গিয়েও দ্বিধা করলো, কিন্তু কৌশিক ওকে ঠিকমতো পড়িয়ে অনন্যার আঙুলগুলো ঠিক করে বসিয়ে দিলো ধনুকের ছিলায়। কাঁধের ওপর হালকা চাপ দিয়ে বললো,

"এভাবে ধরো। লক্ষ্য স্থির থাকবে ওই গাছটিতে। লাল চিহ্নতে প্রথমে চোখ রাখবে না। প্রথমে গাছটিকে ভালোভাবে চোখ দিয়ে স্ক্যান করে নাও। তারপর ধীরে ধীরে লাল চিহ্নে চোখ আনবে। প্রথমে ওই লাল অংশে তীর লাগবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন খারাপ করবে না। আস্তে আস্তে হয়ে যাবে।"

অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নাড়লো। কৌশিক অনন্যার মাথায় হাত দিয়ে মুখের অবস্থান ঠিক করে দিলো। বললো,

"আমি ফ্রান্সে থাকতে একটা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম আর্চেরিতে।"

অনন্যা চোখ ছোট করে তাকালো, ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
"আহা! আরও কত কিছু যে শুনতে হবে! জীবনে আপনার এই মহান নাম কোথাও শুনলাম না। আর এই বয়সে এসে জানতে পারছি আপনি কতো বিখ্যাত!"

কৌশিক এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। একপাশে দাঁড়িয়ে হাত গুটিয়ে বললো,
"শুনবে তো আরও অনেক কিছুই! তবে তার আগে তীর ছুঁড়তে শেখো!"

কৌশিকের ব্যঙ্গ করা কথা অনন্যার বিশেষ পছন্দ হলো না, সে চুপ করে থাকলো। অনন্যা চোখ সরু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গাছের লাল চিহ্ন লক্ষ্য করলো। নিঃশ্বাস ধীরে টেনে নিলো বুকের ভেতর, আঙুল শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ধনুকের ছিলা। চারপাশ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে মনে হলো। এক ঘন্টা পূর্বে ভোর হয়েছে তাও নিশ্চুপ পরিবেশের কারণে মনে হচ্ছে রাতের রেশ এখনো কাটেনি।

অনন্যা এক মিনিট ধরে নিখুঁত সময় মেপে তীর ছুঁড়লো।
তীর ছুটে গিয়ে সটান বিঁধলো লক্ষ্যবিন্দুতে। শুধু তাই নয়, কৌশিকের তীরকে মাঝখান থেকে বিভক্ত করে গেঁথে গেলো গাছের গুঁড়ির সেই লাল চিহ্নে।

অনন্যা হতভম্ব হয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো। এরপর চোখ বড় বড় করে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো,

"আমি করেছিইই!"

কৌশিক বিস্ময়ে স্থির হয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো। অনন্যার নিখুঁত নিশানা তার ভেতরে একধরনের সন্দেহ জাগিয়ে তুললো। তবে মুখে প্রকাশ না করে ঠান্ডা গলায় বললো,
"এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আন্দাজে লেগে গেছে হয়তো!

তারপর চোখ সরু করে আরো দূরের এক গাছের দিকে আঙুল তুললো,

"ওইখানে লাল চিহ্ন আছে, মেরে দেখাও।"

অনন্যা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
"হুম! জ্বলছেন আপনি, সেটা বলেন।"

অনন্যা মুখ ফিরিয়ে ধনুক উঠিয়ে তীর নিয়ে এবারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করলো। নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে ভেতরে টেনে নিলো, ধনুকের ছিলা টানলো আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে তীর ছুঁড়লো। তীর নিখুঁত গতিতে ছুটে গিয়ে আবারও লাল চিহ্নে গেঁথে গেলো।

কৌশিক এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে সময় ব্যয় না করে নতুন নতুন লক্ষ্যের নির্দেশ দিতে লাগলো। একবার ডান পাশে, একবার বাঁ পাশে, কখনো নড়বড়ে গাছের পাতার ফাঁকে, পাতার মধ্যিখানে।

আর অনন্যা? প্রতিবার নিখুঁত নিশানায় তীর ছুঁড়ে যাচ্ছিল। কৌশিক এবার আর চুপ থাকতে পারলো না। ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো। তারপর অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"তুমি আগেও আর্চেরি শিখেছিলে?

অনন্যা হেসে তীর টেনে ধনুক কৌশিকের দিকে নিয়ে বললো,
"মিস্টার বড় ইঁদুর, লাইফের ফার্স্ট টাইম এটা হাতে নিলাম।"

কৌশিক গভীর শ্বাস নিলো, তারপর অনন্যার হাত থেকে ধনুক আর তীর ছিনিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাক করলো। সেকেন্ড সময় পর তীর ছুটে গেল। বাতাস চিরে এক ঝলক আলোর মতো তীর ছুটে গিয়ে তিনটি পাখিকে একসঙ্গে ভেদ করলো। একটা ধাক্কা খেয়ে পাখিগুলো নিস্তেজ হয়ে আকাশ থেকে ধপধপ করে মাটিতে পড়ে গেলো।

চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্কিত পাখিদের করুণ চিৎকার। গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলো ভয়ার্ত ডানায় আকাশ কাঁপিয়ে উঠে গেলো। অনন্যা ভয়ে শ্বাস বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের পাতা কাঁপলো হঠাৎ, দৃষ্টি ঘুরে গেলো স্যারের দিকে।

“কি করলেন? পাখিদের মারলেন কেনো?”

কৌশিক ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। স্যারের চোখে কোনো অনুতাপ নেই বরং চ্যালেঞ্জিং দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
কৌশিক বললো,
“এখন তুমিও মারবে!”

কথাটা বলেই ধনুকটা অনন্যার দিকে এগিয়ে দিলো।

অনন্যা শিউরে উঠলো। তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো। গলার কাছে কি যেনো একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। আকাশে সেই পাখিদের চিৎকার তার কানে এখনো বাজছে, শরীরের রক্ত ছলকে উঠছে।

অনন্যা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
"না! পাখিরা অবুঝ হয়। অবুঝ প্রাণীদের আমি বা আপনি কেউ মারতে পারি না। ইহা ঘোরতর অপরাধ!"

কৌশিক ধনুকটা মাটিতে ফেলে দিলো। চোখে তার জ্বলছে শীতল আগুন, চিন্তিত কণ্ঠে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আহ! এই কথা আমি আগেও শুনেছি।

অনন্যা ভ্রু কুঁচকে, "কী?"

কৌশিক এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবারো বললো, 
"তুমিই কি বলেছিলে আমাকে?"

"কোন কথা?

"অবুঝ প্রাণীদের আমি বা তুমি কেউ মারতে পারি না। ইহা ঘোরতর অপরাধ।"

"না! আমি তো আজই প্রথম বললাম।"

কৌশিক এক হাত মাথায় চেপে ধরলো, কিছু মনে করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কপালের শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠেছে তার। চোখ কুঁচকে ফিসফিস করে বললো,
"তাহলে কে বলেছিল?"

অনন্যা চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইল। কৌশিক গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,

"সে যাই হোক! আমি যেমন তিনটা পাখি মেরেছি, ঠিক তেমনই তুমিও করবে।"

"কিন্তু....!

অনন্যা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কৌশিক তার কথার জন্য অপেক্ষা করলো না। দ্রুত পদে নিচে নেমে গেলো। জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে পড়ে থাকা তিনটি পাখির সামনে এসে দাঁড়ালো কৌশিক। তাদের নিথর ছোট হালকা দেহ গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো বাক্য না বলে, সে হাঁটু গেড়ে বসে ধীরে ধীরে পাখিগুলোর শরীর থেকে তীর টেনে বের করলো। কৌশিকের হাত পড়লো একেকটা পাখির শরীরে, এক নীল শক্তি নির্গত হলো তার হাতের মুঠো থেকে, চক্ষু দ্বয় স্থির রয়েছে সবে ভোর হয়ে যাওয়া আকাশের দিকে, নীল মণিদ্বয় ধক ধক করে জ্বলছে। কিছু মুহূর্তের মধ্যে পাখিগুলোর শরীরে প্রাণ ফিরে এলো! পাখিগুলো হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে সজাগ হলো, তারপর একে একে ডানা মেলে আকাশে উড়তে লাগলো। তাদের আওয়াজ আগেকার মতো ছিল না, ভয়ংকর আওয়াজ করছিল তিনটে পাখি। কানের ভেতরে প্রবেশ করে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো অশুভ শক্তি পাখিদের উপর ভর করেছে। 

উপরে ছাদ থেকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল অনন্যা। পুরো ঘটনাটা সে নিজের চোখে দেখেছে। ধীরে ধীরে সে সামনে এগিয়ে এলো। উপর আকাশের দিকে তাকালো। পাখিদের আওয়াজ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাচ্ছে।

কৌশিক এবার গম্ভীর স্বরে বললো, 
"এই তিনজনকে মেরে দেখাও। তোমার শত্রু মনে করো। আর মেরে ফেলো। কিন্তু মনে রাখবে, এক তীরেই কাজ শেষ করতে হবে।"

"আমি এই কৌশল জানি না!"

কৌশিক ঠান্ডা গলায় হাসলো, "লেটস সি! ট্রাই করো।"

কৌশিক অনন্যার দিকে অব্যক্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। অনন্যা গভীর শ্বাস নিয়ে নিচ থেকে ধনুক হাতে নিয়ে নিলো। কৌশিক বাঁকা হেসে তাকিয়ে রইল। অনন্যার হাত কাঁপছে। সে সময় নিয়ে তীর ছুঁড়লো কিন্তু লাগলো না পাখিদের শরীরে আর না এক তীর থেকে তিনটে তীর বের হলো। অগোছালো ভাবে একটা তীর পাখির পাশ দিয়ে নিচে পড়ে গেলো। তিনটে পাখি কর্কশ আওয়াজ করে সারা আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কৌশিক মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বললো,
"থ্যাংকস, প্রিন্সেস!"

কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। নিজের প্যান্ট ঠিক করে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেলো। বাড়ির দরজা খানা খুলতে গিয়ে হঠাৎ ধপ ধপ আওয়াজ শুনতে পেলো। একটার পর একটা ভারী শব্দ বাতাস কাঁপিয়ে উঠল। পাখিদের কর্কশ আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো। আকস্মিক এই আওয়াজে কৌশিকের মনের শঙ্কা বেড়ে গেলো। পেছন ফিরে তাকাতেই তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। মাটিতে তিনটি পাখি নিথর হয়ে পড়ে আছে। তাদের নড়াচড়া নেই, নিঃশ্বাস নেই! শুধু নিখুঁতভাবে গাঁথা তিনটি তীর তাদের দেহ ভেদ করে আছে। সে তড়িঘড়ি ভেতরে ছুটে গেল। সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে ছাদে পৌঁছাতেই দেখতে পেল অনন্যা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।

কৌশিকের কণ্ঠে সন্দেহ ফুটে উঠল, 
"এটা! এটা কি তুমি করেছো?"

অনন্যা জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। কৌশিকের দিকে ফিরে ভীত দৃষ্টিতে তাকালো, চোখে পানি টলমল করছে, ঠোঁট কাঁপছে। কাঁপা গলায় বললো,
"আমি.. আমি এটা করতে চাইনি! কিন্তু কীভাবে যেন হয়ে গেলো..!"

আর কিছু বলার আগেই সে দুলে উঠল। ছাদের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল অনন্যা। কৌশিক নিস্তব্ধ হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। হাঁটু মুড়ে বসে অনন্যার গালে হাত রাখলো। ভয়ে মেয়েটার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। কৌশিক চোখ তুলে অনন্যার ছোঁড়া প্রতিটি তীরের দিকে তাকালো। তারপর তিনটে পাখির দিকে। প্রতিটি তীরকে দেখে তার মনে চিন্তা ভর করতে লাগলো। যদি অনন্যা কখনো না শিখেই থাকে তাহলে এতো দারুণভাবে তীরন্দাজি কীভাবে করতে পারে?

********

কৌশিক নিজের রুমে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আছে স্মাইলি বল। চোখের কোণে কঠোরতা দেখা যাচ্ছে। ভোর সকালের কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। 
মুখের মাংসপেশী টনটন করছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে সে। অনেক চিন্তার পর কঠোর স্বরে বললো,
"অনন্যা শিকদার! তোমার সম্পর্কে কী আমি সব জানি?"

হঠাৎ ফোনের রিংটোন কর্কশ শব্দে কানে এসে লাগল অনন্যার, মনে হলো কোথাও যুদ্ধের দামামা বাজছে। অনন্যা ঘুমের ঘোরে চমকে উঠে বসল। বুক ধকধক করছে।হাত বাড়িয়ে ফোনটা খুঁজে নিল। স্ক্রিনের আলোয় চোখ কিছুক্ষণ ঝলসে উঠল। নোহারা কল দিচ্ছে।

অনন্যা গভীর শ্বাস নিয়ে কল রিসিভ করল, ফোনটা কানে রাখতেই, এক চিৎকার শোনা গেলো!
"অনন্যাআআ!!"

তীব্র চিৎকার শুনে অনন্যা দ্রুত ফোনটা কানে থেকে সরিয়ে নিল। বুক চেপে ধরেছে সে, কানে বাজ ফেটে পড়ল মনে হলো!
কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল সে। এই নোহারার মাথা মাঝেমধ্যে খারাপ হয়ে গেলো এমন চিল্লাচিল্লি করে। অনন্যা ত্রিশ পর্যন্ত গুনে ফোন কানে চেপে বললো,
"কি হয়েছে, নোহা বেবি? এমন চিৎকার চেঁচামেচি কেনো করছো, বাবু?"

"তোর বাবু তোর কাছে রাখ, অনন্যার বাচ্চা! তোর জন্য আমার মেজাজটা প্রচুর খারাপ। তোর গলাটা চেপে না ধরলে শান্তি হচ্ছে না।"

"এভাবে মেরে ফেলবি আমাকে?"

"কাঁচ্চা চাবামু! অসভ্য মহিলা। দুই দিন ধইরা বলতাছি দেখা কর। ইম্পরট্যান্ট কথা বলার আছে। আর তুই ছাগলি বাসায় বসে ঘাস খাস!"

"আস্তে চিল্লা বইন।"

"চুপ থাক, শালীইই! শোন গেইট খোলা রাখ! আমি তোর বাসায় আসতাছি।‌ রিকশা নিছি।"

অনন্যার মাথায় যেন বাজ পড়লো। সে বিছানা থেকে পাগলের মতো হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো বিধক কন্ঠে বলে উঠলো, 
" প্লিজ প্লিজ তুই বাসায় যাস না! আমি বের হতে পারবো না। টিউশনিতেও ছুটি নিয়েছি। আমার মুখে অনেকগুলা মশা কামড়িয়েছে। এই অবস্থায় আমি বাইরে বের হতে পারতেছি না। আর তুই আসলে কেমনে হবে?তোকে এই মুখ দেখাবো কি করে?"

"কিইই! মশা কি কোনো পুরুষ যে কামড়ালে তুই মুখ দেখাতে পারবি না? আমি আসতাছি মানে আসতাছি।"

অনন্যা মাথা চেপে ধরে বললো,
"আচ্ছা, শোন! আমি আসতেছি। কোথায় আছিস বল! আমি আসতেছি। তোর আসার দরকার নেই।"

নোহারা জোরেশোরে বলে উঠলো,
"রিকশাওয়ালা মামা! তুমি আমার দিকে তাকায় হাসো কেন? জোরে রিকশা চালাও! রিকশা থামাইবানা! তুমি অনন্যার বাসার সামনে গিয়ে দেখবা দরজা খোলা আছে নাকি না। খোলা না থাকলে রিক্সা নিয়াই ঘরে ঢুকবা তারপরেও আমি ওর বাসায় যাব মানে যাবো। যে যা মন চায় বলুক গিয়ে ওকে!"

নোহারা কথাটা বলে কল কেটে দিলো। রিকশাওয়ালা মামা দাঁত কেলিয়ে হেসে সামনের পথে মনোযোগ দিলো।

অনন্যার মাথার ভেতর এলোমেলো ভাবনার ঝড় বইছে। কি করবে, কিভাবে সামলাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আয়নার সামনে পড়তেই বুকের ভেতর ধাক্কা খেলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আয়নায় তৈরিকৃত নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে।

সাদা ফ্রকের পাতলা কাপড় শরীরের সাথে মিশে আছে। ফ্রকের স্লিভলেস কাট তার কাঁধ দুটোকে দৃশ্যমান করে তুলেছে, আর হাঁটুর ঠিক নিচে এসে শেষ হওয়া পোশাকটি তার উন্মুক্ত উজ্জ্বল শ্যামলা পা সুন্দর মতো ফুটিয়ে তুলেছে। অনন্যার শ্বাস আটকে এলো। তার মনেই পড়লো না, এটা সে কখন পরলো?

পায়ের নিচের মেঝেটা আচমকা দুলে উঠলো। হাত দুটো গুটিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো নিজেকে। এই পোশাকে নিজেকে দেখে অদ্ভুত অস্বস্তি হতে লাগলো।

নাক ফুলিয়ে উচ্চারণ করলো,
"প্রিন্স!

কিয়ৎক্ষণ পর দরজার সামনে থেকে একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেলো,
"ডেকেছো আমায়?"
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp