প্রেমান্বেষা - পর্ব ৩৮ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


ইমাদ সাহেব নীরবে বসে আছেন। রুমের দরজা আটকানো। ফলে মিলি বেগমের কথার প্রত্যুত্তরে স্বান্তনার দেয়ার মতো কেউ নেই। মিলি বেগম চোখ উপচে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। এ পর্যায়ে তিনি খানিক সময়ের বিরতি নিলেন। চোখ মুখে, গলার স্বরে ঈষৎ নমনীয় ভাব আনলেন। অতঃপর বললেন,
" আচ্ছা, এসব কথা বাদ। আমার আব্বার কথা, আমার কথা, কারোর কথাই চিন্তা করতে হবে না। শুধু তোমার আদরের মেয়ের কথা চিন্তা করো। কাল দেখোনি ওকে আর স্মরণকে? এরপরও কি তোমার মনে হয়েছে শুধুমাত্র জিদের বশে মেয়েকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দেয়া উচিত?"

ইমাদ সাহেব এবার দৃষ্টি তুলে চাইলেন। তাঁর চাহনিতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। মিলি বেগম ফের বললেন,
" গতকাল তো মেয়ের বিয়ে ভেঙে রাতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলে। কখন যে নীলু এসে কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে গিয়েছে সেসবের কিছুই জানো না তাই না?"

বিস্ময়ে ইমাদ সাহেবের চক্ষুজোড়া বড় হয়ে এলো। অবাক কণ্ঠে বললেন,
" কি বলছো মিলি! আমার নীলু কাঁদছিলো?"

মিলি বেগম মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। বললেন,
" এটুকুও টের পাওনি তুমি! অথচ ওর সামান্য ফুঁপানোর আওয়াজেই আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি ওকে থামাইনি। চাচ্ছিলাম ওর কান্না শুনে হলেও যেনো তোমার মন গলে। ওর কথা ভেবে হলেও আব্বার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। কিন্তু তোমার ঘুমই ভাঙেনি। "

ইমাদ সাহেবের চোখেমুখে তীব্র অনুশোচনাবোধের দেখা মিললো। মিলি বেগম পুনরায় বললেন,
" তুমি যখন ঢাকায় ছিলে না তখনই স্মরণ ও নীলিমার ব্যাপারে জানতে পারি আমি। সেদিন ওদের দুজনের চোখে একে অপরের জন্য যে ভালোবাসা ও সম্মান দেখেছি তা বোধহয় গতকাল তোমার চোখে পড়েনি। "
বলেই মিলি বেগম এবার হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন। ইমাদ সাহেবের দু হাত চেপে কান্নায় ভেঙে বললেন,
" দোহাই লাগে ইমাদ। ভাবীর প্রতি শত্রুতা, ঘৃণা থেকে আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করো না। হ্যাঁ, মানছি তুমি আর ভাবী একে অপরকে দেখতে পারো না। কিন্তু তাই বলে নীলিমার বিয়ে দিবে না, এমন সিদ্ধান্ত নিও না। তুমি নিজেও দেখেছো স্মরণ কত ভালো ছেলে। ওর কাছে আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিলে সারাজীবন সুখে থাকতে পারবে, সারাজীবন। "
বলেই মিলি বেগম ইমাদ সাহেবের হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। ইমাদ সাহেব তাঁকে থামালেন না। বরং কিছুক্ষণ নীরব রইলেন তিনি। এবার আর চিন্তাভাবনার জন্য নিজেকে সুযোগ দিলেন না। মিলি বেগমের কথার স্রোতেই সিদ্ধান্ত নিলেন। সবকিছুর আগে তাঁর মেয়ের সুখ। আর কিছু না। কিসের শত্রুতা, কিসের অহংবোধ। মেয়ের সুখের কাছে এসব কিছুই না। 

ইমাদ সাহেব বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
" আমি বিয়ের বন্দোবস্ত করছি। তুমি আব্বার কাছে যাও।"

মিলি বেগম চট করে মাথা তুললেন। অশ্রুসিক্ত নয়নেও হাসলেন তিনি। সুখ ও স্বস্তিতে তার চক্ষুজোড়া চকচক করে উঠলো। মিলি বেগম আর কথা বাড়ালেন না। দৌড়ে চলে গেলেন বাহাদুর শেখের কাছে। ইমাদ সাহেবও তাঁর পিছু পিছু চলে এলো। রুমে বাহাদুর শেখের ছেলেমেয়ে ও পুত্রবধূ ব্যতিত কেউই উপস্থিত নেই। ইমাদ সাহেব এলেন। বাহাদুর শেখের দুর্বল হাতজোড়া আগলে নিয়ে অনুশোচনাপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
" আমাকে ক্ষমা করে দিন আব্বা। গতকাল আমি যে ব্যবহার করেছি তাতে প্রচন্ড অনুতপ্ত। আপনার কথা মতোই স্মরণ আর নীলিমার বিয়ে হবে। "

ইমাদ সাহেবের কথায় ভারী গমগমে পরিবেশটুকু মুহূর্তেই হালকা হলো। আনন্দে পূর্ণ হলো সকলের মুখশ্রী। বাহাদুর শেখে দুর্বল চিত্তে হাসলেন। স্বস্তি নেমে আসলো তার বুকে। এতক্ষণ ভীষণ কষ্টে বুকে যন্ত্রণা হচ্ছিলো। জিয়নকাঠির প্রদীপও যেনো নিভু নিভু করছিলো। ভেবেছিলেন মৃ' ত্যু' র আগে শেষ ইচ্ছেটুকু বোধহয় অপূর্ণই রয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সে ইচ্ছে পূরণ করেছেন তবে। 

বাহাদুর শেখের অনুমতিতে ইমাদ সাহেব ও আনিস সাহেব মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে আজ বাদ জোহরেই কাজি ডেকে স্মরণ ও নীলিমার বিয়ে পড়ানো হবে। প্রথমে অনুষ্ঠানে কেউ রাজি না হলেও বাহাদুর শেখের জোরাজুরিতে ঈদের পরেরদিন হলুদ ও তার পরেরদিন রিসেপশনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। যেহেতু স্মরণ ও নীলিমা সেসময় বিবাহিত যুগল হিসেবে পরিপূর্ণতা পাবে তাই হলুদের অনুষ্ঠানসহ যাবতীয় সেসব অনুষ্টান যেসবে ছেলেমেয়ের আলাদা আয়োজন হয় সেসব অনুষ্টান একত্রেই সম্পন্ন হবে। 

শেখ বাড়িতে আজ খুশির আমেজ। সকালেই যেখানে দুঃখের স্রোত বইছিলো দুপুর হতেই সেখানে আনন্দের ঢল নেমেছে। নীলিমাকে যখন জানানো হলো স্মরণ ও তার বিয়েতে ইমাদ সাহেব মত দিয়েছেন তখন মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসেছিলো সে। অতঃপর বোধ হতেই সে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। খুশির চোটে সশব্দে কেঁদেও উঠেছিলো সে। ইমাদ সাহেব মেয়ের এ খুশি দেখে নিজেও কেঁদে ফেলেছিলেন৷ 

 আজ শুক্রবার। বিয়ের জন্য উত্তম একটা দিন। বাড়ির পুরুষরা গিয়েছে জুম্মার নামাজ পড়তে। আর মহিলাগণ বিয়ের পূর্বপ্রস্তুতি নিচ্ছে। জুম্মার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকেই কাজি সাহেবকে আনা হবে বাড়িতে। বিয়ে পড়ানোর পর হবে দুপুরের খাওয়াদাওয়া। 

মিলি বেগম তো অস্থির হয়ে পড়েছেন। এভাবে হুট করে যে আজই বিয়ে হয়ে যাবে এটা ভাবেননি তিনি। এখন বিয়ের শাড়ি কোথায় পাবে, কি গহনা পরিয়ে দিবে এ নিয়েই দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত তার। মিলি বেগমের এহেন দুশ্চিন্তা দেখে নাজমা বেগম ও মাসুদা বেগম এগিয়ে এলেন। দুজনেরই বিয়ের শাড়ি ও গহনা বাড়িতে আছে বলে নীলিমার বিয়ে এ দিয়েই দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো৷ নাজমা বেগম নিজের শাড়ি ও বিয়ের ওড়না দিতে চাইলেন। কিন্তু বাঁধ সাধলো নওরীন, রাফা ও মানতাসা। নীলিমার বিয়ের কথা ও দাদার শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা শুনে মানতাসা তার স্বামীসহ বাড়িতে চলে এসেছে। 

নওরীন এমন লাল টুকটকে শাড়ি দিতে বাধা দিয়ে বললো,
" বড় মামী, আমরা নীলিমার বিয়ে দিবো সাদা শাড়ি পরিয়ে। "

নওরীনের মা, খালাসহ মামিরা চরম বিস্মিত হলো। নাজমা বেগম হায় হায় করতে করতে বললেন,
" ওসব কি বলিস নওরীন! সাদা শাড়ি পরিয়ে বিয়ে দেয় কেউ? ওসব তো বিধবার লক্ষণ। বিয়ের আগেই আমার ছেলেকে মে' রে ফেলবি নাকি তোরা!"

নাজমা বেগমের কথায় হাসলো নওরীন ও রাফা। নওরীন বললো,
" ওসব কুসংস্কার এখনও মানেন মামী! সাদা শাড়ি শুভ্রতা ও শান্তির প্রতীক। বিধবার প্রতীক কে বলেছে আপনাকে! ওসবে বিশ্বাস করবেন না। পাপ হবে পাপ।"

মিলি বেগমও এবার নাক সিঁটকালেন। বললেন,
" পাপের কথা বাদ দে। বিয়ে কখনও সাদা শাড়িতে হয় দেখেছিস?"

"অনেক দেখেছি আম্মু। আজকাল সেলেব্রিটিরা এমন হালকা রঙের শাড়ি পরেই বিয়ে করে। ট্রেন্ড এসব। "

মুখ বাঁকালেন মিলি বেগম। বললেন,
" ওরে আমার সেলিব্রিটিরে....তোরা কি সেলিব্রিটি নাকি যে ওদের মতো বিয়ে পুষতে চাস!"

লিলি বেগম ও মাসুদা বেগমও সায় দিলো এতে। নাজমা বেগম বললেন,
" তোমার মেয়েদের যে কি ইচ্ছা! এমন সাদা শাড়ি পরিয়ে বলে কেউ বিয়ে দেয়!"

নওরীন, রাফা ও মানতাসা হতাশ হলো। ইশ, মা-খালাদের হালের ট্রেন্ড সম্পর্কে জানানো বা রাজি করানো বেশ দুষ্কর কাজ। মানতাসা এবার বললো,
" এসব ট্রেন্ডে আছে ফুপি। বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে যে কাবিন করা হয় বা বিয়ে পরিয়ে রাখা হয় তাতে মেয়েরা এমনই সাদা শাড়ি পরে। "

রাফা যোগ করলো, 
" আর লাল ওড়না। সাদা শাড়ির ওপর লাল ওড়না। বিশ্বাস করো খালামনি, নীলুকে অনেক সুন্দর দেখাবে। একদম স্নিগ্ধ একটা পুতুল। "

এত কিছু বলার পরও কেউ রাজি হলো না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে নওরীন ফেসবুকে কয়েকটা কাবিনের ছবি দেখালো। ছবি দেখানোর পর রাজি হলেন তারা। বাড়ির সব আলমারি খুঁজে মাসুদা বেগমের আলমারি থেকে সোনালি পাড়ের সাদা একটা জামদানি বের করা হলো। নীলিমাকে এই জামদানী ও লাল ওড়না পরানো হবে। আর গহনাগাঁটি বলতে সবার গহনা থেকেই টুকটাক গহনা নিয়ে পরানো হবে। 

স্বল্প সময়ে মেহেদির ব্যবস্থা করতে না পারায় আলতা পরানো হলো নীলিমার হাতে। এ কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলো রাফা ও মানতাসা। আলতা পরানো শেষে নীলিমা জানালার ধারে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। আর ওদিকে তারা তিনজন সবকিছু গোছগাছ করছে। এখন নীলিমাকে শাড়ি পরানোর পালা। 
শাড়ি পরানোর জন্য নওরীন নীলিমাকে ডাক দিলো নীলিমা উঠে আসলো। নওরীন দেখলো নীলিমার চাহনিতে তীব্র উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা। এ দেখে নওরীন নীলিমার গালে হাত রেখে উদ্বেগ নিয়ে শুধালো,
" কি হয়েছে রে নীলু?টেনশনে আছিস?"

নীলিমার বুকে কেমন যেনো শূন্য অনুভূতি হচ্ছে। ভীষণ অস্থির লাগছে। বললো,
" হুম আপু। অদ্ভুত লাগছে। জানো? মাথার ভেতরটা কেমন করছে। পেটে কেমন যেনো সুড়সুড়ি লাগছে। তোমাদেরও কি এমন হয়েছিলো?"

নীলিমার এহেন কথায় হেসে উঠলো তারা। নওরীন বললো,
" স্বাভাবিক এটা। বিয়ের সময় এমনই হয়। "

নীলিমা আলতো হাসার চেষ্টা করে বললো,
" জানো আপু? স্মরণ ভাইয়ের কথা চিন্তা করেই এতো লজ্জা লাগছে! কখনও ভাবিনি এভাবে হুটহাট বিয়ে করতে হবে। ভেবেছিলাম সময় নিয়ে নিজেকে নতুন সম্পর্কের ব্যাপারে সামলে নিবো। কিন্তু এভাবে বিয়ে হবে কে জানতো! "
বলেই সে আলতা রাঙা হাত দুটো এগিয়ে দিলো সম্মুখে। বললো,
" দেখো, ভয়ে আমার হাতদুটো কেমন কাঁপছে!"

নওরীন ও রাফা নীলিমার হাত ধরে দেখলো সত্যিই নীলিমার হাত কাঁপছে,মৃদু তালে। নীলিমা আরোও বললো,
" বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হার্টবিট যে কত বেড়েছে কে জানে! কেমন যেনো অস্থির লাগছে আবার আনন্দও হচ্ছে। এই তীব্র আনন্দের চোটে আমি আবার অজ্ঞান না হয়ে যাই......"
এই বলতে বলতেই আচমকা অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে পড়লো নীলিমা। নওরীন ও রাফা মুহূর্তেই নীলিমাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। নীলিমার হঠাৎ জ্ঞান হারানোয় তিনজনের মাঝেই আতঙ্কের জন্ম হলো। মানতাসা তীব্র ভয় ও আতঙ্কে কম্পিত গলায় চিৎকার করে মিলি বেগমকে ডাকলো,
" ফুপি, ফুপি, তাড়াতাড়ি এদিকে এসো। নীলিমা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। "
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp