প্রেমান্বেষা - পর্ব ৩৭ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


এ মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ থমথমে৷ মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে ডাইনিং এ। মিলি বেগম, নওরীন,সাজিদ,সাদ ও রাফা স্মরণের সাহসী পদক্ষেপে বিস্ময়ে অভিভূত। ওদিকে ইমাদ সাহেব থম মেরে দাঁড়িয়ে আছেন। স্মরণ ও নীলিমার মাঝে কখন এসব ঘটে গেলো টেরই পেলেন না তিনি! কি আশ্চর্য! 

ওদিকে বাহাদুর শেখ শুয়ে শুয়ে সবটা শুনছেন। প্রথমত ইমাদ সাহেব ও নাজমা বেগমের কথাবার্তায় তিনি ভীষণ কষ্ট পান। ভাবলেন মৃ' ত্যু' র আগে শেষ ইচ্ছেটা বোধহয় পূরণ হবে না। আসমানী বেগম দুজনের এহেন ঝগড়া দেখে উঠে গিয়ে কিছু শোনাতে চাইলেন। কিন্তু বাহাদুর শেখের জোরাজোরিতে তিনি উঠতে পারেননি। বাহাদুর শেখ তখন মনে ভীষণ কষ্ট নিয়ে বলেছিলেন,
" তুমি যাইয়ো না। ওগোর মাইয়া,পোলা, ওরাই সিদ্ধান্ত নিক। আমি আর কে!"
এই বলতে বলতে চোখের কোনে নোনাজল জমলো তার। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে থেকে স্মরণের তেজিয়ান কণ্ঠস্বর শুনলেন। স্মরণের স্পষ্টবাদী আচরণ, নীলিমাকে সবার সামনে মেনে নেয়া, নিজের মনের কথা বলায় অবাক হলেন বাহাদুর শেখসহ আসমানী বেগম ও লিলি বেগম। তিনজনের কেউই কল্পনা করেননি স্মরণ ও নীলিমা একে অপরকে পছন্দ করে। বাহাদুর শেখ এ শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। খুশিতে আসমানী বেগমের দিকে চেয়ে বললেন,
" শুনতেছো দিল! তোমার নাতি আমার নাতনিরে ভালোবাসে!"

আসমানী বেগমও এক গাল হেসে বললেন,
" শুনতেছি শুনতেছি। আমার নাতি খুব সাহসী, শুনতেছো তো? আমার নাতি তোমার নাতনিরে বিয়া করলে সারাজীবন সুখে থাকবে।"

লিলি বেগম মৃদু হাসলেন বাবা মায়ের এহেন কথোপকথনে। স্মরণ, নীলিমা তাদের দুজনেরই নাতি-নাতনি। কিন্তু এমনভাবে বলছেন যেনো নীলিমার সাথে তার নানীর ও স্মরণের সাথে তার দাদার কোনো সম্পর্কই নেই।

এদিকে ডাইনিং এর অবস্থা থমথমে। ইমাদ সাহেব এগিয়ে এলেন নীলিমার দিকে। আহত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
" তুই আর স্মরণ একে অপরকে ভালোবাসিস নীলু?"

নীলিমার দৃষ্টিজোড়া অশ্রুে সিক্ত। বাবার কণ্ঠস্বরের পিছনের কষ্ট সে আঁচ করতে পেরেছে। সে জানে তার বাবা কখনো কল্পনাও করেনি যে সে স্মরণকে ভালোবাসবে। নীলিমা মনের ভেতর সাহস জোগালো। যেখানে স্মরণ সবার সামনে তার হাত ধরে সবটা বলার সৎ সাহস রাখে সেখানে সে কেনো নিশ্চুপ থাকবে। আজ তাকেও কথা বলতে হবে। যে যা-ই ভাবুক না কেনো। 
নীলিমা দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো,
" হ্যাঁ আব্বু। আমি স্মরণ ভাইকে ভালোবাসি। "

নীলিমার এহেন জবাবে স্মরণ বিজয়ের হাসি হাসলো। কিন্তু ইমাদ সাহেব বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে এলেন৷ ভেবেছিলেন মেয়ের কাছ থেকে নেতিবাচক জবাব পাবেন। অথচ.........

ইমাদ সাহেব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। রুমে চলে গেলেন৷ এদিকে নাজমা বেগম বিস্ময় ও রাগের মাঝেও কিঞ্চিৎ খুশি হলেন। নীলিমাকে ছোট থেকে দেখে আসছেন তিনি। মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। কিন্তু মেয়েটার বাবাকে দেখতে পারেন না, এই হলো কথা। 

আনিস সাহেব এগিয়ে এসে স্মরণকে জিজ্ঞেস করলেন,
" এসব কবে থেকে চলছে স্মরণ? আমাদের কিছু জানাসনি কেনো?"

স্মরণ এবার নীলিমার হাত ছাড়লো। আনিস সাহেবকে বললো,
" আমি এবার এসেই এ নিয়ে বলতে চেয়েছিলাম বাবা। কিন্তু এর আগেই দাদা....."

" এসে কেনো বলবি? আগে থেকে বলিসনি কেনো?"

" আমার প্রমোশনের অপেক্ষায় ছিলাম বাবা। বেতন বাড়লে যেনো মাথা উঁচু করে নীলিমার হাত চাইতে পারি। ফুপা যেনো অমত করার সুযোগই না পায়। "

আনিস সাহেব মৃদু তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো,
" তোর বেতনে কোনো যায় আসে নারে স্মরণ। তোর ফুপা আগে থেকেই না করে বসে আছে। আর এদিকে তোর মা। "
বলেই তিনি নাজমা বেগমের দিকে হতাশা ও তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকালেন। নাজমা বেগম তখন লজ্জায় দৃষ্টি নত করলেন। আনিস সাহেব আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন নিজের রুমে। পিছু পিছু গেলেন নাজমা বেগমও। মাসুদা বেগম ও আনোয়ার সাহেবও চলে গেলেন। মাহবুব তখন এসে স্মরণের সামনে দাঁড়ালো। আর রাফা দাঁড়ালো নীলিমার সামনে। 
স্মরণ হুট করেই কেমন যেনো অসহায় বোধ করলো। মনে হয়েছিলো এই বুঝি সব পেয়ে গেলো। কিন্তু এই সময়ে এসে মনে হচ্ছে সবকিছুই যেনো বালুকণার ন্যায় হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে। মাহবুবকে অসহায় গলায় শুধালো, 
" মাহবুব? সব ঠিক হবে তো? আমি আশা হারিয়ে ফেলছি একদম। "

মাহবুব স্মরণের কাঁধে হাত রাখলো৷ আস্থার সুরে বললো,
" চিন্তা করিস না। সব ঠিক হবে স্মরণ। বাড়ির সবাই তোদের বিয়ের পক্ষে। থাকলো চাচি আর ফুপা, তাদেরকে ঠিকই রাজি করানো যাবো। হয়তো একটু সময় লাগবে। "

নীলিমাও বিচলিত নয়নে তাকালো। স্মরণের অসহায় কণ্ঠস্বরে তার উৎকণ্ঠা বাড়লো। সত্যি কি কিছু ঠিক হবে না?

নাজমা বেগম বিছানায় বসে ছিলেন। আনিস সাহেব হাত মুখ ধুয়ে এসে তাঁর পাশে বসলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুচ্চ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
" এসব সিন ক্রিয়েট না করলে হতো না নাজমা?"

নাজমা বেগম নিজের দোষ স্বীকার করলেন না। কিন্তু উল্টো বড় গলায় বললেন,
" সিন ক্রিয়েট আমি করেছি? নাকি তোমার বোন জামাই করেছে? ইমাদ যদি ওসব কথা না বলতো তাহলে....."

আনিস সাহেবের কণ্ঠস্বরের তেজ বৃদ্ধি পেলো। উষ্ণ গলায় বললেন,
" তুমিও চুপ থাকোনি নাজমা। তুমি চুপ থাকলে আজ এতদূর এগোতো না। ইমাদকে হয়তো সামাল দেয়া যেতো। কিন্তু ওর সাথে তোমাকেও কিভাবে সামাল দিবো! 
আচ্ছা, একটা কথা বলো, নীলুকে কি তোমার ভালো লাগে না? "

নাজমা বেগম ক্ষণেই ব্যতিব্যস্ত গলায় বললেন,
" এ কি বলছো স্মরণের বাবা! নীলুকে পছন্দ করবো না কেনো? ওকে খুব ভালোবাসি। আমার বাকি ভাগ্নে ভাগ্নি যেমন নীলুও আমার কাছে তেমন। শুধু ওর বাবা..."
বলতে বলতে ঈষৎ মিইয়ে গেলেন তিনি। আনিস সাহেব এবার উঠে দাঁড়ালেন। শক্ত গলায় বললেন,
" ইমাদের অজুহাত দিও না নাজমা। যদি আব্বার জন্য তোমার মনে এক বিন্দুও সম্মান থেকে থাকে তাহলে স্মরণ ও নীলুর বিয়েতে বাধা দিও না। "
বলেই চলে গেলেন তিনি। এদিকে নাজমা বেগম পড়লেন বিপদে। তাঁর সবকিছু একদিকে, কিন্তু ইমাদ সাহেবের সাথে ঝগড়া একদিকে। এ মুহূর্তে তীব্র অহংবোধ তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। এ বিয়েতে রাজি হলে যে তাঁর মধ্যকার 'ইগো' নামক শব্দটা ভীষণভাবে আহত হবে! তাহলে উপায়?

-------------------

রাত পেরিয়ে সকাল হলো। বাড়ির অবস্থা এখনও থমথমে। বাহাদুর শেখের শারীরিক অবস্থারও তেমন উন্নতি নেই। স্মরণ নীলিমার বিয়ে দিতে না পারার কষ্টে তাঁর বেঁচে থাকার স্পৃহাটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। আসমানী বেগম ও মেয়েরা কালেমা পড়ছে, কোরআন শরীফ পড়ছে। নাজমা বেগম শ্বশুরের এহেন অবস্থা দেখে রাজি না হতে গিয়েও রাজি হয়ে গেলেন। বাকি রইলেন ইমাদ সাহেব। এ নিয়ে মিলি বেগমের সাথে তাঁর মনোমালিন্য চলছে। আসমানী বেগম বড় জামাইয়ের হেন আচরণে এক বাক্য কথাও বলেননি। ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন তিনি। 
বাবার এ দুরবস্থা দেখে মিলি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বের হলেন। রুমে গিয়ে ইমাদ সাহেবকে উচ্চস্বরে বললেন,
" আরে মানুষের মনে পাথর থাকলেও তো এমন আচরণ করে না যেমনটা তুমি করছো! এতোটা পাষাণ কি করে হতে পারো তুমি? আব্বাকে দেখে মনে বিন্দুমাত্র মায়া জন্মায় না? এই বুড়ো বয়সে এসে কি মাথায় সমস্যা ধরা দিয়েছে? যত্তসব অযাচিত বিষয়কে মাথায় নিয়ে আব্বার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে আসছো!"
বলেই তিনি পরনের ওড়নায় চোখ মুছলেন। সিক্ত গলায় ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন,
" আজ আমার আব্বা যদি মনে কষ্ট নিয়ে মা' রা যায়, তোমাকে জীবনেও মাফ করবো না ইমাদ, জীবনেও না। মনে রেখো। তোমার জিদের বশে নেয়া এই সিদ্ধান্ত আমার আব্বার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকুও কেঁড়ে নিচ্ছে ধীরেধীরে। আজ যদি স্মরণ ও নীলিমার বিয়ে দেখে যেতে পারতো তাহলে বেঁচে থাকার ইচ্ছা বাড়তো। কিন্তু সেটাও তুমি কেড়ে নিচ্ছো ইমাদ। এখন তো ভাবীও রাজি হয়ে গিয়েছে। তোমার এতো কিসের ইগো? কি ভেবে পাথরের মতো বসে আছো তুমি? মনে রেখো ইমাদ, আমার আব্বার কিছু হলে সব দায় তোমার, তোমার হবে ইমাদ। "
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp