মন কেমনের দিন - পর্ব ০৬ - ঈশানুর তাসমিয়া মীরা - ধারাবাহিক গল্প


জানালা খোলা। বাহির থেকে মৃদুমন্দ বাতাসের তোরে শীতল রুমটায় আরও শীতলতা ছেঁয়ে আছে। গায়ে সোয়েটার নামক উষ্ণ কাপড়টা নেই মানুষীর। নেই কোনো চাদর। আনমনা হয়ে সে একদৃষ্টে ইট ঢালাই করা কাঁচা রাস্তায় চেয়ে আছে। চড়ুই পাখিরা এইতো, জারুল গাছের মাঝারি ডালে বসে সেই যে কিচিরমিচির শুরু করেছিল! এখনো থামেনি। থামবে না বলে পণ করেছে। মানুষী সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল-নিল। তার মনটা ভালো নেই। সে আজকাল নতুন কিছু রিয়েলাইজেশন করেছে। মানুষ যা আশা করে তা না হলে তাদের মন ভেঙ্গে যায়। হাঁসফাঁস লাগে। জীবনটাকে অনর্থক মনে করার একটা বিশ্রী অনুভূতি অজান্তেই ছেঁয়ে যায় সর্বাঙ্গে। কিছু ভালো লাগে না, করতে ইচ্ছা করে না। এই অনুভূতিটুকুই মানুষীকে এখন ভেতরে ভেতরে চূড়ান্ত ভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সে ভেবেছিল, ছাদের ঘটনার রেশ ধরে মা আর চাচি তুলকালাম কান্ড ঘটাবেন। বাড়িতে নামহীন এক ঝড় বইবে। কিন্তু কই? সব এত নিষ্পাপ শান্ত কেন? টু শব্দটিও কেউ করছে না। রাতে একটা আলোচনা সভা বসেছিল। তাকে আর সাদিফকে নিয়ে। সে বা সাদিফ কেউই ওই আলোচনার অংশ ছিল না। কি কথা হয়েছে তাও জানা নেই। মানুষীর বুক ভারী হয়ে এলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হলো। সাদিফকে মানুষী পছন্দ করে। হয়তো ভালোওবাসে। এ কথা অস্বীকার করার সাহস নেই। কিন্তু জোড় গলায় প্রকাশ করার সামর্থ্যও পায় না ও। ভয় হয়, শঙ্কায় বুক কাঁপে। লোকটার করা ইতরামি থেকেও সেদিন তাকে তুচ্ছভাবে প্রত্যাখ্যান করাটা বুকে গেঁথে গেছে। প্রচন্ড অবহেলা দাগ কেঁটে আছে আজও।

বয়স তখন কতই বা হবে মানুষীর? পনেরো কি ষোল? তার কৈশোর কালের প্রথম প্রেম ছিল সাদিফ। প্রথম ভালো লাগার অনুভূতিও সে। হাকিম ভূঁইয়া আর তালহা ভূঁইয়া শহরে নিজেদের বসবাস স্থায়ী করে নিলেও মাটির টানে মানুষীর বাবা রহমত ভূঁইয়া গ্রামেই রয়ে যান। ভাইয়েরা তাকে দেখতে আসতো প্রায়ই। বছরে বোধকরি পাঁচ ছয়বার। সে সময়গুলো মানুষীর কাছে ইদ ইদ লাগতো। সারাটাক্ষণ ইতর সাদিফের কাছ ঘেঁষে থাকতো সে। এত ভালো লাগতো লোকটাকে তার! এখনো কি লাগে? লাগে বোধহয়। চিনচিনে ব্যথায় মিইয়ে পরা বা'পাশটাই তার প্রমাণ। 

মানুষীর যতোটুকু মনে আছে, সাদিফ ছোটবেলা থেকেই ভয়াবহ রকমের ইতর। স্কুলের গন্ডিতে থাকা অবস্থাতেই ঠোঁটে সিগারেটের প্রথম ছোঁয়া পরেছিল তার। প্রেম আদৌ করেছিল কি-না জানা নেই। তবে তার সুদর্শন চেহারার কারণে গ্রামে এলেই সখীরা ওঁৎ পেতে থাকতো লোকটার একটু দেখা পাবার, একটু কথা বলার! চিঠিও যে কত অহরহ পেয়েছে, হিসাব নেই। ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে সাদিফ দারুণ। নেতা নেতা ভাব নেওয়া লোকটার যেকারো কমরেড হওয়ার যোগ্যতা আছে। গ্রামের ছোট ছেলেপেলেরা তাই সাদিফের জন্য প্রাণ-জান উজাড় করে দেয়। তাদের আইডল মানে। যদিও এসব কখনো মানুষীর বেলায় খাটেনি। কিভাবে কিভাবে এই দারুণ ব্যক্তিত্বের আড়ালের সাদিফকে সে দেখে ফেলেছিল। ইতরামির শেষ পর্যায়ে থাকা খাচ্চর সাদিফকে চিনতে পেরেই সে প্রেমে পরেছিল লোকটার। অথচ লোকটা তখন তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। 

সেবার ইদের পর জমিজমার কাজে ভাইয়েরা সব একত্রিত হয়েছিল। জুলাই মাস। প্রচন্ড গরমে চারিদিক উত্তপ্ত, গুমোট। ঘরে থাকা দায়। সাদিফ তখন খালি গায়ে মনের সুখে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। সবে সবে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে সে। শরীরে মারাত্বক জোশ! যৌবনের দোহাই দিয়ে তাগড়া শরীরের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ বেড়েছে। মুখভর্তি কালো কালো দাঁড়ির সমাবেশ। চুলগুলো লম্বা লম্বা, এলোমেলো। ক্রিকেট খেলার দরুণ হাতের বাহু ফুলে মোটা হয়ে আছে। ষোড়শী কন্যা মানুষী সুপুরুষটাকে দেখেই আঁতকে উঠে। বুকে ধুকপুক হয়। চোখে ম্লান অশ্রু। হাতের মুঠোয় হলদে রঙের খাম। খামটার ভেতরে প্রেমপত্র আছে। নীল রঙের কাগজে কালো কালির শত শত আবেগের আঁচড়। প্রেমপত্রটা মানুষীর নয়। তিন ঘর পরের শর্মিলা আপুর। 

"সাদিফ ভাই!"

সাদিফ চমকালো, ভড়কালো। বাবা থেকে লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল বিধায় অল্পসল্প ভয়ে ভেতরটা কেমন খিঁচে উঠল তার। তটস্থ হলো। পরপরই মানুষীকে দেখে সুবিশাল ধমক দিল, "সমস্যা কি তোর? শাকচুন্নির মতো এভাবে ডাকলি কেন? আমি যদি এখন ভয়ে হার্টএট্যাক করতাম? হু?"

চোখের টলমলে ভাবটা আরেকটু স্নিগ্ধ করে তুললো মানুষী। হাতের প্রেমপত্র এগিয়ে বলল, "এটা আপনার জন্য।"

কপাল কুঁচকে গেল। দু'পলক মানুষীকে দেখে সিগারেটে লম্বা টান দিল সাদিফ। ডান ভ্রু উঁচিয়ে রসিকতার সঙ্গে বলল, "অনেক দিন চড়-থাপ্পড় কপালে জুটছে না। এজন্য পায়তারা খুঁজছিস?"

মানুষীর অভিমানি কণ্ঠস্বর, "এটা আমার না। শর্মিলা আপুর।"

"চামচাগিরি শুরু করেছিস কবে থেকে?"

মানুষী সে কথার উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে রাখল। চোখের পানি ক্রমশ বিরক্ত করছে। মেয়েটাকে শান্তি দিচ্ছে না। বাড়িয়ে রাখা হাতে আরও খানিক জোড় দিয়ে বোঝাতে চাইল, 'খামটা নিন।'

দৈবাৎ, সাদিফ খামটা নেয় না। সিগারেট-টা ছাদে ফেলে পা দিয়ে দু'তিনবার পিষে দেয়। রেলিংএ ভর করে আকাশ পানে চায়। চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। ছোটবড় তারাদের ভিড় চোখ ছেড়ে মস্তিষ্কে দোলা দিচ্ছে। সাদিফ থমথমে গলায় বলে, "খামটা ডাস্টবিনে ফেলে রুমে যা। অনেক রাত হয়েছে। অভদ্রদের মতো আমার কাছে আর আসবি না।"

সহসা মানুষী যায় না, "এ নিয়ে পাঁচবার।"

"কি?"

"আমাকে আপনাকে চিঠি দিতে বলা হয়েছে। তিনটা বড় আপু আর দু'জন আমার ক্লাসমেট।"

"তোর মতো তোর বড় আপু আর ক্লাসমেটরাও অভদ্র, বেয়াদব।"

"আপনি কি প্রেম করেন, সাদিফ ভাই?"

সাদিফ ঠোঁট বাকিয়ে হাসল। তার দিকে চেয়ে থাকা উত্তাল কিশোরীর দিকে তাকালো না। সহজ কণ্ঠে বলল, "তা জেনে তুই কি করবি?"

"অনেক কিছু।"

"অনেক কিছু করা লাগবে না। ঘুমাতে যা, হুর!"

"যাবো না।" মনে দুরন্ত সাহস নিয়ে হঠাৎ সাদিফের দিকে এগিয়ে গেল মানুষী। হাত টেনে নিজের দিকে ঘুরালো, তাকাতে বাধ্য করলো। ঠোঁট কামড়ে থেমে থেমে বলল, "আপনি কারো সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে পারেন না, সাদিফ ভাই। কাউকে ভালোবাসতে পারেন না। এটা অন্যায়।"

চাঁদের ঠুনকো আলোয় মানুষীর কান্নাজড়িত লাল মুখ দেখেও মন গললো না সাদিফের, "ন্যায়-অন্যায় এখন তোর থেকে শিখতে হবে?"

"হ্যাঁ।"

"শিখবো না। এসব ভন্ডামি বাদ দে। বয়স কত তোর? আমি তোর কত বড় জানিস?"

"মাত্র চার বছরে কিচ্ছু যায় আসে না।"

"আমি কিন্তু তোকে থাপড়াবো, মানুষী!"

"আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি বুঝেন না কেন?"

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড! গালটা অস্পষ্টভাবে জ্বলে উঠলো মানুষীর। অথচ তেমন একটা ব্যথা পেল না। এমন চড়-থাপ্পড় সে কত খেয়েছে সাদিফের কাছ থেকে! এসব সে গায়ে মাখেনা। কিন্তু এইযে, সাদিফের হাত কাঁপছে, শরীর মৃদু দুলছে। মুখশ্রীর সে কেমন অচেনা ভাব! গম্ভীরতা! তা রাগে কিনা অন্য কিছুতে বোঝা গেল না। কিন্তু সাদিফের চোখের অচেনা অথচ গভীর দৃষ্টিটাকে মানুষী রাগ ধরেই স্তব্ধ হয়ে গেল। টলটল করতে থাকা অশ্রু অবশেষে গাল বেয়ে গড়ালো খুব হিংস্র ভাবে। প্রত্যাখ্যানটা মানুষী মেনে নিতে পারেনি। এখনো পারেনা। তার কিশোরী বয়সের ভালোবাসাটা কাঁচের মতো সচ্ছ হলেও ইস্পাতের মতো দৃঢ়তাও ওতে ছিল। 

মানুষী যদিও এখন বুঝতে পারে, বয়সের সল্পতার দোহাই দিয়েই তাকে সেদিন দূরে ঠেলে দিয়েছিল সাদিফ। তাতে কি? যে গাঢ় দাগটা তার মনে এঁটে আছে তা মিটানো এত সহজ? হঠাৎ মনে প্রেম নিয়ে জড়িয়ে ধরার আবদার করা, জ্বরের ঘোরে নিজের সবটুকু অনুভূতি প্রকাশ করলেই মানুষীর অভিমান গলে যাবে? মোটেও না। সাদিফ জানে মানুষী তাকে ভালোবাসে। মানুষীও বোঝে, লোকটা তাকে পছন্দ করে। লোকটা অভিনয়ে কাঁচা। সেরাতে চোখের ভাষা বুঝতে না পারলেও এখন চোখ দেখেই ভেতরের উত্তাল ঢেউয়ের পরিমাপ করতে শিখেছে ও।
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp