ফাঁকা লিভিংরুম। দেয়াল ঘড়িটা নীরবতা চিড়ে শব্দ করছে। তন্ময়ের গভীর দৃষ্টির সামনে অরু ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। কাঁপছে ঠোঁট জোড়া। কিছুক্ষণের জন্য আশ্চর্য হলেও, পরপরই নিজেকে বেশ চমৎকার ভাবে মানিয়ে নিয়েছে —যেন এমন সংবাদ তার প্রত্যাশার মধ্যেই। নিভু-নিভু চোখে চেয়ে— চোরের মতন অস্বাভাবিক ভাবে তোতলাতে শুরু করে,
‘ত..তন্ময় ভা..ভভাই…আমি–’
তন্ময় এই বোকা, সহজ-সরল– উজ্জ্বল চোখ দুটোর ভাষা পড়তে পারে। বুঝতে পারে এই শীর্ণ মেয়েলি দেহের একেকটি ভাবভঙ্গি। সে ঠিকই ধরেছে, এই মেয়ে ইচ্ছে করে পিল গুলো খায়নি। তন্ময়েরও দোষ আছে। দাঁড়িয়ে থেকে চোখের সামনে বসিয়ে খাওয়াতে হতো। ওর ভীষণ কাছে যাবার আগেই তন্ময় খুব করে ভেবেছে এইসব বিষয়ে। তার অরুটা ছোটো। পড়াশোনা চলছে। কেবলই অনার্স! তন্ময়ের ইচ্ছে আছে ও অনেকদূর পড়াশোনা করবে। অগত্যা এমন বয়সে ভুলবশতও গর্ভধারিণী হওয়া যাবে না। এরজন্য সে বারংবার নিজেকে বুঝিয়েছে। অরুর কাছে যেতে দ্বিধা করেছে। ধৈর্য ধরেছে, নিজেকে শক্ত করেছে। অবশেষে যখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ওর কাছে গিয়েছে তখনো বেশ সতর্ক থেকেছে। শরীরে উত্তাল ঝড় বয়ে গেলেও নিজেকে অনড় রেখেছে। কার জন্য? কার জন্য তার এতো চিন্তাভাবনা? কার জন্য সে এতো ভেবেছে? এতোটা ত্যাগ স্বীকার করেছে? অথচ যাকে সে চারিদিক হতে হেফাজতে রাখতে ব্যস্ত, সে নিজেই লাফিয়ে গিয়ে খাদে পড়ে বসে আছে।
এখন তন্ময় রাগ হবে না? তার হওয়া দরকার। কিন্তু সে পারছে না। আসছে না। বাবা হওয়ার এই অসহ্যকর সুখময় অনুভূতি তাকে রাগতে দিচ্ছে না। আর এই সুখ যার মাধ্যমে পেয়েছে তার ওপর রাগ কী আদতেও সম্ভব? তন্ময়ের পক্ষে অন্তত নয়।
অরু গভীর দৃষ্টির সামনে নত হয়ে ফের কুণ্ঠিত স্বরে ডাকে,
‘ততন্ময়ভভভাই….’
এমন ঘটনা ঘটিয়ে, এমন সময়ে, এমন সম্বোধন শুনে তন্ময় আশ্চর্য না হয়ে পারে না। ভ্রু'দ্বয়ের মধ্যিখানে চার-পাঁচেক ভাঁজ পড়ে। এমনিতে ওর এই ডাক তন্ময় পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে। এখন এই কাণ্ড ঘটার পরও, এইমুহূর্তেই আবার কেনো এমন সম্বোধনেই ডাকা লাগবে? তন্ময় কদম বাড়িয়ে অরুর ঘনিষ্ঠ হয়। মাথাটা ঝুকোয় অরুর সমান। কানের খুব কাছে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বেশ চাপা তবে গম্ভীর স্বরে শুধায়,
‘পেটে আমার বাচ্চা নিয়ে তুই আমায় ভাই ডাকছিস?’
অরু সতর্ক হয়। দিশেহারা হয় ওর দৃষ্টি। ঠোঁটে ভিজিয়ে বোকা ভাবে একবার তাকিয়ে নেয় তন্ময়ের গম্ভীর মুখে। অনিশ্চিত, ভীতু, ধীর স্বরে পালটা শুধায়,
‘তাইলে কী ডাকব? ফাফায়াজ- ফাইজার বাবা?’
তন্ময় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়। নড়েচড়ে ওঠে তার অভিনীত চোয়াল। মুখটা হা হয়ে আসে সামান্য। পরমুহূর্তেই মুখ বন্ধ করে নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে হতবিহ্বল কণ্ঠে জিজ্ঞাসাবাদ করে,
‘ফায়াজ-ফাইজা? কে?’
অরু আরও ঘাবড়ে ওঠে। সতর্ক ভঙ্গিতে মিনমিনে গলায় বলে,
‘আমাদের মেয়ে হলে ফাইজা আর ছেলে হলে ফায়াজ। আম– আমি ভেবে রেরেখেছিলাম আর কি—।’
শেষের দিকের কথাগুলো অরুর জড়িয়ে আসে। ভয়ে বেচারি চুপসে যাচ্ছে। চোরাচাহনিতে ঘনঘন চাইছে তন্ময়ের মুখের দিকে। তন্ময়ের সুগভীর দৃষ্টির সামনে নুইয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। তন্ময়ের প্রত্যুত্তর না পেয়ে ফের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নেয়। সামনেই হাপিত্যেশ করা এই বোকা মেয়েটাকে তন্ময়ের এখন আর বোকা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ছেলে-মেয়ের নামও ভেবে রেখেছিস?’
অরু মিইয়ে যায়। আহত চোখে চায়। হয়তো-বা মাত্র বুঝতে পেরেছে সে নিজের জালে নিজেই ফেঁসেছে। লজ্জায় আর মাথা তুলে তাকানোর সাহস করে না। নিজেকে বাঁচাতে নিচে চেয়েই বলে ওঠে তড়িঘড়ি করে,
‘আমি না তো।’
তন্ময় বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলো। বুকে বাঁধল হাত দুটো। ভ্রু তুলে বেশ আগ্রহ হয়ে জানতে চাইল,
‘ওহ, তাহলে? কে রেখেছে?’
অরু চোরের মতন একপলক দেখে নিলো তন্ময়ের মুখ– পরিস্থিতি বুঝে নিতে। তন্ময়ের হাবভাব স্বাভাবিক দেখে সাহস পেলো সামান্য।
চোখ খুলে মুহূর্তেই মিথ্যে বলতে থাকল,
‘অজ্ঞান হলাম না? তখন স্বপ্নে দেখলাম দুটো বাচ্চা এসে অনুনয় করে বলছে, তাদের নাম যেন ফায়াজ, ফাইজা রাখি। সত্যিই! আ-আমি এসব নিয়ে আগে ভাবিনি।’
কথাটুকু বলে অরু ফের তাকায় তন্ময়ের মুখে। তন্ময় তখন হাসি চেপে মুখ গুরুগম্ভীর করে রেখেছে। একচিত্তে শুধুই চেয়ে আছে অরুর সুশ্রী মুখে। অরু হাঁসফাঁস করছে প্রত্যুত্তর না পেয়ে। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠোঁটে ছুটে এসে লেপ্টে যায় আটকে রাখা হাসিটুকু। নরম চোখে চেয়ে গভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘আমার বাচ্চার মা হওয়ার এতো সখ তোর?’
অরু লজ্জায় নেতিয়ে যায় ফুলের মতন। এলোমেলো চুল কানে গুঁজে মিনমিন করে বলে,
‘আপনার বুঝি সখ নেই আমার বাচ্চার বাবা হবার!’
তন্ময় নিঃশব্দে হেসে ফেলে। আড়চোখে দেখে দুয়ারে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারা কিছু মাথা। হেসে অরুর গাল টেনে ধরে সুর টেনে বলে,
‘খুউউব সখ।’
অরুর মুখখানি ঝলমলে রোদের মতো উজ্জ্বল হয়। রাতের আকাশের তারা ভাসে চোখে। এলোমেলো ভঙ্গিতে জাপ্টে ধরতে চায় তন্ময়ের পুরুষালি কোমর। পূর্বেই তন্ময় আলগোছে ডান হাতের আঙুল অরুর কপালে ঠেসে ওকে কাছে আসতে দেয় না। অরু আশ্চর্য হয় এতে। ফ্যালফ্যাল চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। ওসময়ে কিছু হাঁচি-কাশির শব্দ এসে কানে লাগে। অরু হকচকিয়ে ওঠে। সরে আসে তন্ময়ের কাছ থেকে। তিন শাহজাহান এসে ঢুকেছে ভেতরে। আনোয়ার সাহেব হাতের ইশারায় মেয়েকে কাছে ডাকেন। অরু ওমনি ছুটে যায় বাবার দিকে। আনোয়ার সাহেব একটুখানি মেয়েটাকে বুকে আগলে নেন। তার চোখজোড়া তখনো রক্তিম। চোখের কোণ ভেজা। এসময়ে জবেদা বেগম এসেছেন কয়েক গ্লাস জুস ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে। তন্ময় অ্যাপল জুসটা পছন্দ করে। তিনি এসে ছেলের হাতে অ্যাপল জুসটাই তুলে দিয়ে বলেন,
‘ভাত দিচ্ছি, খাবি আয়। জুসটা খেয়ে গোসল নিয়ে চটজলদি নাম।’
তন্ময় মাথা দোলায়। জুসের গ্লাসটা নিয়ে বসে সোফায়। মোস্তফা সাহেব কোমলার জুস নিয়ে ছেলের পাশেই এসে বসেছেন। আনোয়ার সাহেব তখনো মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতেও জুসের গ্লাস। অরু দু'হাতে নিজেরটা ধরে রেখেছে। আনোয়ার সাহেব বাম হাতে মেয়ের মাথার চুল গুছিয়ে দিতে নিয়ে বলেন,
‘আম্মু, এবার কি একটু চঞ্চলতা কমানো যায়?’
অরু বুঝদার হবার মতন মাথা দোলায়। মুখেও বলে,
‘আর করব না।’
সুমিতা বেগম আঁচলে হাত মুছতে নিয়ে এসে দাঁড়ান স্বামীর পাশে,
‘এসব শুকনো কথার ভত নেই। এখন থেকে আর ওপরে থাকা হবে না আপনার। নিচে থাকবেন। রুম খালি করাচ্ছি। ঠিক বলেছি তো ভাইজান?’
মোস্তফা সাহেব সহমত প্রকাশ করেন, ‘ঠিক বলেছো। নিচের রুম আগামীকালই খালি করাতে হবে। তোমার ভাবিকে নিয়ে কী করবে না করবে গুছিয়ে নাও!’
ভদ্রলোক থেমে ফের ছোটো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হ্যাঁ রে আনোয়ার, হাসপাতাল যেতে হবে না সকাল সকাল?’
আনোয়ার সাহেব মেয়েকে সাথে নিয়েই ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। প্রত্যুত্তরে বলেন,
‘জি, ভাই। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব।’
অরু বাপ-চাচার মধ্যিখানে বসে জুস খাচ্ছে। তার সচেতন আড়চোখের দৃষ্টি তন্ময়কে দেখার চেষ্টায় মগ্ন। তন্ময় সামনে তাকিয়েও সেই দৃষ্টি অনুভব করতে পারছে। পরমুহূর্তেই একটি দ্বন্দ্ব লেগে যায় হাসপাতাল কে কে যাবে সেই বিষয় নিয়ে! মুখের ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে সবাই যেতে যায়। এখন গোটা শাহজাহান পরিবার নিয়ে তো আর হাসপাতাল যাওয়া যাচ্ছে না৷ কেমন দেখাবে? তন্ময় ভেবেই মুচকি হাসে। এইমুহূর্তে, এইক্ষণে তার মনে হচ্ছে জীবন সুন্দর। ভীষণ সুন্দর। এরচেয়ে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না।
———
শাহজাহান বাড়িতে অন্যরকম এক পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনটুকু তন্ময় উপলব্ধি করতে পারছে পরিবারের সবার মধ্যে। পূর্বে তাদের বিয়েটা নিয়ে সকলের মধ্যে চাপা এক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল— যা খুব সন্তর্পণে তারা গোপন করে রেখেছিল। আজকাল আর তা গোপনে নেই। সকলে উৎসাহের সহিত নিজেদের ভাবনা গুলো অকপটে ব্যক্ত করছে। আজকের ব্যাপারটাই বলা যাক, তন্ময় অফিস ব্যাগ সহ নেমেছে ব্রেকফাস্ট করতে। খেয়েদেয়ে বেরুবে অফিসের উদ্দেশ্যে। ডাইনিংয়ে এসে চেয়ার টেনে বসেছিল ঠিক অরুর পাশেই। অরুর পাশের চেয়ারটা আজকাল সবসময় ফাঁকা থাকে। এই বাড়ির অনেক বড়ো এক রুলস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ফাঁকা চেয়ারটা। এটাতে তন্ময়ই বসবে এবং অরুর পাশেই বসবে! অন্যদিকে অরু ঘনঘন তাকেই আড়চোখে দেখে যাচ্ছে। তন্ময় সেই দৃষ্টি সবসময়ের মতো উপেক্ষা করে। মুফতি বেগম ডাইনিং ভরতি সবার সামনেই গদগদ গলায় হঠাৎ করে বলে বসলেন,
‘তন্ময় আর অরুকে পাশাপাশি কী ভালো দেখতে লাগে! আমারই তো নজর লেগে যাবে।’
রুবি বেশ উৎসাহিত গলায় মায়ের সুরে সুর মেলায়, ‘বছরের মাথায় দু'জনের মধ্যে ফুটফুটে বাচ্চাও থাকবে। কিইইই কিউট!’
দীপ্ত চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘আমাদের বাবুর সোনার আমি কী হব? মামা নাকি চাচ্চু?’
মোস্তফা সাহেব শব্দ করে হেসে ওঠেন। পালাক্রমে হাসেন বাকিরাও। অরু লজ্জায় কাত হয়ে গেলেও– তন্ময় বেশ নির্বিকার। সে নিজের মতো হাত বাড়িয়ে দুধের গ্লাসটা অরুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। পানির কাচের জগটা থেকে গ্লাসে পানি ভরে ওর হাতের কাছেই রেখেছে। দুটো টিস্যু খুব নিপুণভাবে অরুর হাতে গুঁজে দিয়েছে। এসব বাড়ির লোকজন নিত্যদিন দেখেও অভ্যস্ত হননি। প্রতিদিনের মতন মুগ্ধ হোন। সুমিতা বেগম পরম মমতায় ধরা চোখে চান তন্ময়ের দিকে। স্বেচ্ছায় তাকে রুটি, ভাজি বেড়ে দিতে নিয়ে বলেন,
‘তুই খা বাবা! এই ধিঙি মেয়েটাকে এতো মাথায় তুলিস না।’
তন্ময় প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে হাসে। অরু মায়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টি ফেলে। সুমিতা বেগম অগ্রাহ্য করে সেই তন্ময়ের খাবারের পেছনেই লেগে থাকলেন। মোস্তফা সাহেব খেয়ে উঠেছেন। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে নিয়ে হেসে অরুকে শুধান,
‘কী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, মামণি? কী নিয়ে আসব?’
অরু গদগদ গলায় বলে, ‘চাচ্চু আমি স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম খাব।’
তন্ময় কাটকাট গলায় বাঁধ সাধে, ‘ঠান্ডা খাওয়া যাবে না।’
মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে তন্ময়ের মতামত সচরাচর মেলে না। দুজন কথা কাটাকাটি করতেই ব্যস্ত থাকে। তবে এই ব্যাপারে মিলে গেল। মোস্তফা সাহেব ছেলের সঙ্গে একমত হয়ে বলেন,
‘মামণি, ঠান্ডা খাওয়া যাবে না। অন্যকিছু বলো?’
অরু হাপুস নয়নে চেয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ‘চাচ্চু, ট্রিপল ডিম দিয়ে মগলাই খাব৷ ঝাল ঝাল।’
বলতে বলতে অরু জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে রয়। জবেদা বেগম রান্নাঘর ছেড়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে বলেন,
‘এসব আবার হোটেল থেকে আনতে হবে কেন? আমি এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি। বাড়িতে সবই আছে। কতক্ষণ লাগবে আর? উল্টো আমার হাতেরটা ওই হোটেলের থেকেও মজার হবে দেখিস।’
আকাশ রুটি চিবুতে চিবুতে বুকের পাটা টানটান করে বলে, ‘আমাকে গতকাল রাতে বলেছে মমো খেতে চায় আমি রাতে ফেরার পথে তাই নিয়ে আসব।’
তন্ময় উদাস ভঙ্গিতে বাড়ির সবার কীর্তিকলাপ দেখে গেল। স্বামী হিসেবে স্ত্রী কী খেতে চায় এনে দেবার দায়িত্ব ছিল তার! কিন্তু এই বাড়িতে সেই অধিকার থেকে সে বঞ্চিত। সবাই লাইন ধরে আছে কে কী আনবে! আনোয়ার সাহেব তো একফাঁকে মেয়েকে চাপাস্বরে বলে গেছেন,
‘আম্মু আমাকে ফোন করে জানিও কী খাবে, হুঁ? বাবা ফেরার পথে নিয়ে ফিরব।’
অরু বাধ্য মেয়ের মতো হেসে মাথা দুলিয়ে বলেছে, ‘বিকেলেই বলে দেব।’
আনোয়ার সাহেব হাসিমুখে ভাইদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। তন্ময় ডাইনিং ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ব্যাগ হাতে। অরু উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। তন্ময় জানে কেন এই উৎসুক হাবভাব! সবাই জিজ্ঞেস করুক এতে মন ভরবে না। তন্ময়কেও জিজ্ঞেস করতে হবে, মহারানি কী খবেন! অবশেষে কাছে এসে অরুর মাথায় হাত ছুঁয়ে নরম কণ্ঠে শুধোয়,
‘কী খেতে ইচ্ছে হয়? কী আনব?’
অরু হাপুস নয়নে চেয়ে বলে, ‘খেতে না, ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে।’
তন্ময় হাত ঘড়িতে নজর বোলায়। আজ তার চারটা মিটিং আছে। দ্রুত ফিরতে হলে দুটো ক্যান্সেল করতে হবে।
‘বিকেলে তৈরি থাকিস।’
অরু খুশিতে আত্মহারা। দু'হাতে সংকোচ নিয়ে জড়িয়ে ধরে তন্ময়ের বাম হাত। তন্ময় আড়চোখে শুধু চায়, কিছু বলে না বলেই সাহস করে অরু সেভাবেই দুয়ারের দিক এগুতে শুরু করে। পেছন থেকে দু’জনকে দেখে আঁচলে মুখ গুঁজে হাসেন বাড়ির তিন গিন্নি। তিনজনই রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে আছেন।
— — —
ফেব্রুয়ারি মাস। শুক্রবার, আজ চৌদ্দ তারিখ। ভালোবাসা দিবস। তন্ময় বসে আছে বাগানে। সকালের মিঠা ঝলমলে রোদ্দুর এসে ছুঁয়েছে বাগানের ফুলগুলো। প্রজাপতি উড়ছে, মিহি বাতাস বইছে। পাখিরা ডাকছে। সহনীয় রোদ এসে পড়েছে তন্ময়ের মুখেও। কোলে ল্যাপটপ। হাতে চায়ের কাপ। মাত্রই জবেদা বেগম দিয়ে গিয়েছেন তার আর অয়নের জন্য। পাশেই অয়ন বসে চা খাচ্ছে আমোদে। আজ অয়ন-শাবিহা বেড়াতে এসেছে সকাল সকাল। মোস্তফা সাহেব ভাইদের নিয়ে বাজারে গিয়েছেন। মেয়ে জামাই এসেছে যেহেতু রান্নাবান্নার একটা তোরজোর আছে না?
অরুকে নিয়ে শাবিহাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল এসময়ে। অরুর হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। অরুর পাঁচ মাস চলছে। পেট দৃশ্যমান রূপে বড়ো। তাকে সিঁড়ি বাইতে দেয়া হয় না। একা কোথাও ছাড়া হয় না। সবার নজর বন্দী একপ্রকার। বিশেষ করে তন্ময়ের। তন্ময় আজকাল অফিসে বেশিক্ষণ থাকে না। চেষ্টা করে বাসায় সবটা কাজ করে ফেলার। এই বছর সে কোনো ব্যবসায়িক কাজে ঢাকার বাইরে যাবে না বলে জানিয়েছে। এতে অবশ্য মোস্তফা সাহেব খুশিই হয়েছেন। তন্ময় মাথা তুলে দেখে হন্তদন্ত কদমে আসতে চাওয়া ছোটোখাটো রমণীকে। অরুর চঞ্চলতা কমেছে বললে ভুল হয়, সে চঞ্চল হতে পারছে না। বাড়ির সকলের তার ওপর হাজার খানেক নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে৷ তন্ময়ের শীতল দৃষ্টি দেখে অরু হাঁটার গতি কমায়৷ কচ্ছপের মতো ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়ার প্রচেষ্টা করে। এতে তন্ময় সন্তুষ্ট হয়। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ফের অয়নের সাথে আলাপে মগ্ন হয়। তবে অন্যমনস্ক ভাবে একাংশ মনোযোগ অরুর ওপর রয়েই গেল। অরু কাছাকাছি এসেই মুগ্ধ গলায় অয়নের উদ্দেশ্যে বলল,
‘অয়ন ভাইয়া আপনি কত রোমান্টিক! কী সুন্দর আপুকে ফ্লাওয়ার বুকে এনে দিয়েছেন।’
অয়ন আড়চোখে তন্ময়ের দিকে চেয়ে ফাঁকা হাসল। প্রত্যুত্তরে তার বলার সাহস নেই যে, ‘অরু তুমি চাইলে আমি কিনে দিতে পারি তোমাকেও একটা।’ নির্ঘাত তন্ময় চোখ দিয়ে তাকে ভস্ম করে দেবে। অগত্যা অয়ন চুপ রইল। শাবিহা হাসছে। অরু আড়চোখে চায় তন্ময়ের প্রতিক্রিয়া দেখতে। কোনো ভাবান্তর না দেখে ঠোঁট ফোলায়। গিয়ে বসে তন্ময়ের পাশেই। তবে হাল ছাড়ে না। ফের বলে,
‘আমাকে দেখাবে ওই ফুলের তোড়াটা? কী ফুল? গোলাপ?’
শাবিহা হাসিটুকু গিলে নেয়। বলে, ‘অনেকগুলো ফুলের মিশেলে বানানো ছিল।’
অরু ফের হাপিত্যেশ করে ওঠে মুগ্ধ গলায়, ‘অয়ন ভাইয়া কতো রোমান্টিক!’
অয়ন ঢোক গিলে। মনে মনে অরুকে আচ্ছারকম বকে। তাকেই কেন ফাঁসাতে হবে? অয়ন তন্ময়ের কঠিন দৃষ্টির সামনে আলগোছে উঠে দাঁড়ায় চায়ের কাপ নিয়ে। অযুহাত ধরে বাড়ির ভেতর চলে যায়। শাবিহাও হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। অরু মুখ ফুলিয়ে তাকায় তন্ময়ের দিকে। তন্ময় চেয়েইছিল বলে মেয়েটা হকচকিয়ে ওঠে সামান্য।
পিটপিট করে করে চোখ দুটো। মিনমিন করে বলে,
‘এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো? মিথ্যে তো বলিনি। সত্যই তো বললাম।’
তন্ময় স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘আমার চেয়ে না।’
অরু ভেঙচি কাটে। তন্ময় ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসিটুকু গিলে ফের বলে, ‘আমার চেয়ে রোমান্টিক না। প্রমাণ তো সামনেই।’
অরু আশ্চর্য হয়ে চতুর্দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে, ‘কই? কীসের প্রমাণ? কিছুই তো দেখি না।’
তন্ময় তাকায় অরুর পেটের কাছটায়। অরুও দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজ পেটে তাকায়। ফুলো পেটে কীসের প্রমাণ? অরু অবুঝের মতো কিছুক্ষণ পলক ফেলে পরমুহূর্তেই আশ্চর্যে দাঁড়িয়ে যায়। তাকায় তন্ময়ের চোখে। তন্ময় তখন ভ্রু তুলে তাকিয়ে আছে।
.
.
.
চলবে..........................................................................