মন কেমনের দিন - পর্ব ০২ - ঈশানুর তাসমিয়া মীরা - ধারাবাহিক গল্প


সাদিফ ভাইয়ের জ্বর কমছে না। লোকটা শীতে কাঁপছেন। মানুষীর হাত জড়িয়ে ধরে রেখেছেন বুকের সঙ্গে। বিছানার মাথার কাছেই খোলা জানালা। মনের সুখে দখিনা বাতাস সুরসুরিয়ে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তপ্ত শরীর, মন। সাদিফ যেন আরেকটু কেঁপে উঠলো। বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখা মানুষীর হাত টেনে আচমকাই ঠোঁট ছোঁয়ালো আলতো স্পর্শে। দূর্বল কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে উঠল, ‘মানুষী! আমার মানুষী!’

শক্ত হয়ে বসে থাকা মানুষীর হৃদয়ে তখন কঠিন পাথরের ভীড়। কোত্থেকে বেলী ফুলের তীব্র সুবাস নাকে ঠেকছে। আকাশে টিমটিম করা তারারা ফ্যাকাশে খুব। নজরে আসছে না। কুয়াশায় ঢাকা আম গাছের সরু ডালে মানুষী আধো আধো দেখতে পেল, দুটো অচিন পাখি একে অন্যের কাছ ঘেষে বসে আছে। প্রেম আরাধনায় মত্ত তারা। প্রেমের সুধা পানে ব্যস্ত। যেন এই জগত সংসারের কঠিন দূ:খ তাদের কখনো ছুঁয়ে দেখেনি। তাদের কাছে প্রেম বিষই সকল বিষের নাশক, মাধ্যম। সত্যিই কি তা-ই? মানুষীর জানা নেই। কেউ তাকে কখনো বলেনি। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে সাদিফ থেকে রয়েসয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো সে। এ ঘরে ডিম লাইট নেই। মোমবাতির আলো ফিঁকে হয়ে এসেছে। আরেকটু অন্ধকারে ডুবে গেছে আশপাশ। মানুষী সাবধানে পা ফেলে আলমারির কাছে দাঁড়ালো। কম্বল খুঁজতে গিয়ে কাথা পেল দুটো। সাদিফের গায়ে তা জড়িয়ে দিতেই আরামে কপালের ভাঁজগুলো ধূলিসাৎ হলো লোকটার। তন্দ্রাঘোর বোধহয় হালকা হলো। পিটপিট করে আঁখি মেলে মানুষীর অন্ধকারাচ্ছন্ন চেহারা অল্প সল্প দেখলো সাদিফ। দেখেই রইলো। কণ্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে শুধাল, ‘তুই সত্যিই আমার মানুষী?’

মানুষী ভেবেছিল সে চলে যাবে। কি মনে করে আবার সাদিফের মাথার কাছে বসলো। নাকচ করে বলল, ‘আমি কারো মানুষী নই, সাদিফ ভাই।’

সাদিফ মানতে চাইলো না। ফের একই সুরে বলল, ‘কিন্তু আমি যে দেখতে পাচ্ছি বড় বড় চোখের, ঠোঁটে তিল নিয়ে ঘুরিয়ে বেড়ানো আমার মানুষী আমার কাছে বসে আছে। এসব কি আমার কল্পনা? তুই কি এখন আমার কল্পনাও দখল করে নিচ্ছিস, মানুষী?’

‘আপনি প্রচন্ড জ্বরে ভুগছেন সাদিফ ভাই। ভুলভাল বকছেন, দেখছেন। এখন ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুমিয়ে পড়ুন।’

‘সত্যি ঘুমিয়ে যাবো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুই আমাকে রেখে চলে যাবি নাতো?’

মানুষী মিথ্যে বলল, ‘নাহ্।’

‘তুই কিন্তু কথা ভঙ্গ করতে পারবি না, মানুষী। করলে.. আমি কিন্তু খুব রেগে যাবো। তোকে মারবো।’

‘আচ্ছা।’

‘তুই সত্যি যাবি না?’

মানুষী দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘যাবো না। আপনি ঘুমান।’

তারপর এক মিনিটের মাথায় সাদিফ ঘুমিয়ে গেল। জ্বরে তার সিগারেটে পোড়া বেগুনী ঠোঁট তখনো কাঁপছিল। কপালে গুটি কয়েক ভাঁজের প্রলেপ। গালে লালচে ভাব। সুদর্শন এই পুরুষটাকে মাঝে মাঝে চিনতে পারে না মানুষী। এখনো পারছে না। এই লোক এক্ষুণি ভালো তো এক্ষুণি খারাপ। সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে কখনো মানুষীর সাথে দু'দন্ড ভালো ব্যবহার করতে দেখা যায় নি। ধমক আর চড়ের উপরেই রেখেছে সদা। তবুও কিভাবে যেন এই রুষ্ট মানুষের মনের খবর মানুষী জেনে ফেলেছে। সাদিফের অজান্তেই কঠিন শক্তপোক্ত আবরণ ঠেলে নরম সত্যকে সে বুঝে নিয়েছে। লোকটা হয়তো জানেই না সে গোপন খবর।

ধীরস্থির মানুষী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরও কিছুক্ষণ লোকটাকে চেয়ে চেয়ে দেখে হঠাৎই উঠে দাঁড়ালো। জানালা লাগিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে গেল ঘর ছেড়ে। সাদিফকে একা রেখে। জ্বরের ঘোরে করা সাদিফের ব্যকুল অনুরোধটুকু গুরুত্বই দিলো না!

••••••••••••••••

শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরের যত্নে ছেঁয়ে আছে পুরো গ্রামবাংলা। ডিসেম্বর মাস তো! রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া বিরাট বড় জানালা গলিয়ে কিসের যেন বড় বড় সবুজ পাতা জোড় করে ঢুকবার চেষ্টা চালাচ্ছে। পাতার গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশিরের মায়া। একটু দূরেই কামিনী গাছ। কাকের ডাক শোনা গেল কি? দুটো কাক একাধারের ডেকে যাচ্ছে, কা কা! কা কা! শায়লা খাতুন চিতই পিঠার প্লেট-টা এগিয়ে দিয়ে মানুষীকে বললেন, ‘পিঠাগুলো টেবিলে রেখে আয়, মানুষী। খেতে বসে যাস। কত সকালে উঠেছিস!’

‘তোমরা খাবে না, মা?’

মেয়ের সহজ সরল প্রশ্নে হাসলেন শায়লা খাতুন। মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কতজন মানুষ ঘরে। আমরা খেতে বসে গেলে হবে? আমি, তোর বড় আর মেজো চাচি পরে খেয়ে নেব। তুই চিন্তা করিস না।’

বড় চাচি সালমা সুলতানা চা বানাচ্ছিলেন। ফুটন্ত পানিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। মানুষীর মুখপানে। অনুরোধের সুরে বললেন, ‘সাদিফ ছেলেটা কি করছে একটু দেখিস মা। ছেলেটাকে যে কোন ভূতে পেয়েছিল! এত লম্বা পথ এই ঠান্ডার মাঝে বাইকে করে এসেছে! এই জ্বর কি দু'তিন দিনের আগে যাবে?’

টেবিলে চিতই পিঠাগুলো রাখতে রাখতে মানুষী দেখলো, সাদিফ দিব্বি নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছে। চিতই পিঠার এপিঠ-ওপিঠ ভর্তায় ডুবিয়ে মুখে নিচ্ছে অনায়াসে। খেতে খেতে অল্প সল্প মুখ কুঁচকে ফেলছে লোকটা। জ্বর মুখে খাবার তেঁতো ঠেকছে বোধহয়। একমাত্র মায়ের জোড়াজুড়িতেই সে অনিচ্ছাকৃত গলাধঃকরণ করছে একের পর এক।

মানুষী চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলো। মুখোমুখি বসে থাকা সাদিফ তার দিকে তাকালো না। কারো সঙ্গে কথাও বললো না। সকালে একবার সবার অগোচরে সাদিফের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মানুষীর। 'কিছুই হয়নি' ভাবখানা এমন করে লোকটা পাশ কাঁটিয়ে চলে গেছে। মানুষী জানতো এমনই হবে। এ জীবনে সে সাদিফের মতো অকৃতজ্ঞ ইতর প্রজাতির প্রাণী দুটো দেখেনি।

দাদাভাই এ বাড়িটা বড্ড সখ করে বানিয়েছিলেন। বাড়ির প্রতিটা আসবাবে প্রাচীন মোগলদের সুস্পষ্ট ছাপ। পুরোনো হলেও এখনো প্রতিটা আনাচে কানাচে মজবুত। আভিজাত্য যেন চোখে বিঁধে। খাবার টেবিলটাও তাই। বিরাট এই টেবিলে পনেরো - ষোল জনের বসার চেয়ার আছে। সে তুলনায় খাবার শুধুমাত্র চিতই পিঠা। তিনটে কাঁচের জগে পানি পুরানো। গুটিকয়েক কাঁচের সাদা প্লেট আর গ্লাস। মানুষীর ডানপাশের চেয়ারে একাধারে মিতা, প্রান্ত, রঞ্জন, ধুতরা আর কৃষ্ণ দা বসেছেন। মিতা আর প্রান্ত মেজো চাচার ছেলে মেয়ে। মানুষী আর ধুতরা আপন দু'বোন। মিতা মানুষীর সমবয়সী হলেও প্রান্ত আর ধুতরা সবার ছোট। রঞ্জন আর সাদিফ বড় চাচার ছেলে। তার কোনো মেয়ে নেই। এ পরিবারে এ দুজনই ভাইবোনদের মধ্যে সবার প্রধান। রঞ্জন ভাই সাদিফ থেকে তিন বছরের বড়। অন্যদিকে কৃষ্ণ দা তাদের রক্তের কেউ না। এককালে মানুষীদের বাড়ির মালির ছেলে ছিল সে। কৃষ্ণ যখন দশ বছরের তখন হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে তার বাবা মারা যান। মা বিয়ে করে নেন অন্যত্র। কৃষ্ণর দায়িত্ব নিতে চাননি। অনাদরে পরে থাকা প্রায় অনাথ শিশুটিকে মানুষীর বাবা তখন রেখে দেন নিজেদেরই একজন করে।

সালমা সুলতানা চায়ের কাপের ট্রে-টা সাদিফের পাশে রাখলেন। যত্ন করে হাতের এপিঠ-ওপিঠ তপ্ত কপালে ছুঁয়ে মলিন কণ্ঠে শুধালেন, ‘রাতে তোর এত জ্বর এসেছে, অথচ একটাবার মাকে ডাকলি না কেন? তোর জ্বর সহ্য হয়? সকালে দেখলাম জলপট্টি টেবিলে পরে আছে। নিজে নিজে এত কষ্ট করতে গেলি কেন বাপ?’

নিমিষেই সাদিফ খুকখুক করে কেশে উঠলো। সালমা সুলতানা তাড়াতাড়ি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। পানি পান করতে করতে মানুষীর দিকে একবার আড়নয়নে তাকালো সাদিফ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। এরপর আবারও চুপচাপ খেতে শুধু করেছে লোকটা।

মিতা পাশ হতে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কালকে সাদিফ ভাইকে ভাত দিস নি, তাই না?’

মানুষীর মন অন্যদিকে। উদাসীন, বিবর্ণ। হঠাৎ করেই তার ভীষণ শীত লাগছে। গায়ের চাদরটা আরেকটু আষ্টেপৃষ্টে নিয়ে বলল, ‘মনে নেই। আমি কালকে রাতে কিসব যে করেছি!’

মিতা আশ্চর্য হলো। মুখ ফিরিয়ে প্রান্তর কানে কানে বলল, ‘মানুষী মনে হয় পাগল হয়ে গেছেরে। ও রাতে কি করেছে মনে করতে পারছে না।’

প্রান্ত বলল, ‘ওটাকে পাগল বলে না গাঁধী।’

‘তো কি বলে? তুই যখন এত জানিস তুই-ই বল।’

প্রান্ত বিরক্ত হলো। বড় হয়েও তার এই আপাটা এত মূর্খ!

‘কি বলে জানি না। কিন্তু পাগল বলে না। তোর কি কমনসেন্সের অভাব আপা?’

তাদের কথা শুনে রঞ্জন এবার হাসতে হাসতে বলল, ‘তোদের দু'জনেরই কমনসেন্স নেই। মাথায় গোবর নিয়ে ঢেং ঢেং করে ঘুরে বেরাস। গর্দভ কতগুলো!’

শুনে তাদের বড় অভিমান হলো। নাক মুখ ফুলিয়ে অভিমানী চোখে তাকালো রঞ্জনের দিকে। ঝগড়াটা জোড়দার করার জন্য কিছু বলবে, সেসময় হাকিম ভূঁইয়া গলা খাঁকিয়ে উঠলেন। সাদিফকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জ্বরের ঔষধ খেয়েছিস?’

সাদিফের গলা বসে গেছে। পুরুষালী শক্তপোক্ত কণ্ঠস্বরটা কেমন অন্যরকম শোনাল, ‘নাহ্। এখানে আমি জ্বরের ঔষধ কোথায় পাবো?’

‘তো? কারো কাছে খুঁজবি না?’ মানুষীর দিকে তাকিয়ে ফের বললেন, ‘মানুষী মা? সাদিফকে একটু জ্বরের ঔষধ দিও তো। কেমন?’

প্রতিউত্তরে মানুষী মাথা নাড়ালো মাত্র। মুখে কিছু বললো। তার খাবার খাওয়া প্রায় শেষ। চেয়ার ছেড়ে সে নি:শব্দে চলে গেল সেখান থেকে।

••••••••••••••••

রাতে গায়ে হলুদের একটা দাওয়াত আছে। সব ভাইবোনেরা তাই ড্রইংরুমের বিশাল জায়গায় পাটি বিছিয়ে অপেক্ষা করছে মানুষীর। উদ্দেশ্যে, প্রান্ত সহ মিতা, ধুতরা আর কৃষ্ণ দা হাতে মেহেদী লাগাবে। রঞ্জন অবশ্য সেসবে নেই। সে নিরবে পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশের এক পুরোনো ক্রিকেট ম্যাচ দেখছে। মানুষী নাপা ঔষধ আর এক গ্লাস পানি নিয়ে ঘুরঘুর করছে সারা বাড়িময়। বলা যায়, সাদিফকে খুঁজছে। লোকটা একটু আগেও নাস্তার টেবিলে বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নাস্তা খাচ্ছিল। এতটুকু সময়ে গেল কই? ঘরেও তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। ব্যাটার দেখা নেই। 

‘আপনি এই শীতে ছাদে কি করছেন? জ্বর না আপনার?’

ছাদের এককোণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেয়াদব সাদিফকে পাওয়া গেল। বেয়াদবের বেয়াদবির প্রমাণ দিয়ে লোকটা মনের সুখে সিগারেট ফুঁকছেন। মানুষী নাক কুঁচকে ফেলল। এগিয়ে গিয়ে আবার বলল, ‘আপনার ঔষধ নিন। ধরুন।’

সাদিফ নিলো না। মানুষীর দিকে তাকালোও না।

‘কি আশ্চর্য! ঔষধ নিচ্ছেন না কেন সাদিফ ভাই? তাড়াতাড়ি করুন। আমার অনেক কাজ আছে।’

‘কি কাজ?’

‘রাতে হলুদের অনুষ্ঠান আছে। ওইযে? বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না? ওর। সবাইকে মেহেদী লাগাতে হবে আমার। নিজেও লাগাবো। এখন ত্যাড়ামো না করে ঔষধ খান, নিন।’

সাদিফ হাতের সিগারেটটার দিকে একপলক তাকালো। পরপরই মানুষীর দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘সিগারেটটা একটু ধর, নে।’

সঙ্গে সঙ্গে বিশ্রী রকম প্রতিক্রিয়া দেখালো মানুষী, ‘আপনার কি আদৌ কোনোদিন লজ্জাশরম হবে না সাদিফ ভাই? এ কেমন অভদ্রতা?’

সাদিফ বড় আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিল, ‘তোর সামনে আবার কিসের লজ্জাশরম, মানুষী? তোকে দেখে এখন আমার লজ্জাও পেতে হবে? দাঁড়া, চেষ্টা করছি।’

বলে মানুষীর দিকে চেয়ে লজ্জা পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল সাদিফ। মিনিট গড়াতেই হাল ছেড়ে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘হচ্ছে না রে। তোকে দেখে আমার মোটেও লজ্জা আসছে না মানুষী।’
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp