প্রেমান্বেষা - পর্ব ৩৬ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


শেখ বাড়ির পরিবেশ উষ্ণ। দুঃখ ভারাক্রান্ত মহল মুহূর্তেই সরগরম হয়ে উঠেছে ইমাদ সাহেবের ভয়ংকর সিদ্ধান্তে। উপস্থিত সকলেই হতভম্ব তার এহেন সিদ্ধান্তে। তার এ সিদ্ধান্তটুকু সকলের হজম হবার পূর্বেই নাজমা বেগম ইমাদ সাহেবের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন। এ যেনো চাচাতো দুই ভাই বোনের মধ্যে ছোটবেলার লড়াই চলছে৷ দুজনের শত্রুতা যে ছেলেমেয়ের বিয়ে না করানো অব্দি এসে ঠেকে যাবে তা কেউই কল্পনা করেনি। বাহাদুর শেখের নিকট মাসুদা বেগম ও আসমানী বেগম বাদে সবাই ডাইনিং এ উপস্থিত হয়েছে৷ 
স্মরণ ও নীলিমার অবস্থাও ভয়াবহ। কিছুক্ষণ পূর্বেই তাদের জীবনে ক্ষণিকের জন্য সুখ এসেছিলো। বাহাদুর শেখের সিদ্ধান্তে তারা ভীষণ খুশি হয়েছিলো। এ যেনো মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি পাবার মতো পরিস্থিতি। অথচ মুহূর্তেই তাদের এ সুখের জোয়ারে ভাটা পড়ে। একে একে নীলিমার বাবা ও স্মরণের মায়ের সিদ্ধান্তে সুখের হাওয়া কর্পূরের ন্যায় উবে যায়। নীলিমার মুখশ্রীতে কালো মেঘের ঘনঘটার দেখা দেয়। এই তো সুখ আসি আসি করছিলো। কিন্তু বাবার এমন হটকারি সিদ্ধান্তে সবকিছু বোধহয় শেষ হয়ে যাবে। 

আনিস সাহেব বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে এলেন। নাজমা বেগমের উদ্দেশ্যে গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
" এসব কি বলছো নাজমা? মাথা ঠিক আছে?"

নাজমা বেগম তেতে উঠে বললেন,
" আমাকে বলার আগে তোমার বোন জামাইকে বলো। ও-ই আগে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। "

আনিস সাহেব এবার ইমাদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
" ইমাদ, তুমি তো বুঝদারের মতো কাজ করো। আব্বা মৃ' ত্যু' সয্যায়। এমন অবস্থায় তুমি হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে! আগেপিছে কিছু ভাবার প্রয়োজন বোধ করলে না!"

ইমাদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
" দেখুন ভাইজান, আমি সব জেনে-বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আব্বার অবস্থা ভালো না জানি। কিন্তু তাই বলে কি আব্বার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়ে আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করবো!"

আনিস সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন,
" স্মরণের সাথে নীলুর বিয়েকে তুমি ওর জীবন নষ্ট করার সাথে তুলনা করছো! তুমি একটু বাড়াবাড়ি করছো না ইমাদ? আব্বা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেনে বুঝেই নিয়েছে। ঘরের মেয়েকে ঘরে রাখতে চাচ্ছে সে। আর তুমি!"

" ঘরের মেয়েকে ঘরে রাখা লাগবে না ভাইজান। একজন বাবা হিসেবে আমার চেয়ে ভালো কেউই বুঝবে না নীলুর জন্য কোন ছেলে ভালো, কোন ছেলে খারাপ। এখন সব কথার এক কথা, আমি স্মরণের সাথে এ বিয়ে মানি না। "

নাজমা বেগমও এগিয়ে বললেন,
" আমিও এ বিয়ে মানি না। "
বলেই তিনি ইমাদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললেন,
" আমার স্মরণও তোর মেয়েকে বিয়ে করার জন্য বসে নেই। ওর জন্য আরোও ভালো ভালো মেয়ে আছে। "

ইমাদ সাহেবও কড়া জবাব দিলেন,
" আমার মেয়েও তোর ছেলের চেয়ে ভালো ছেলে পাবে নাজমা। দেখে নিস। "

দুজনের এমন অবাঞ্ছিত ঝগড়া দেখে আনিস সাহেব গর্জে উঠলেন। বললেন,
" কি পেয়েছো তোমরা হুম? লাই দিতে দিতে মাথায় উঠে যাচ্ছো। বয়স তো কম হলো না। এখনও বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করো কোন মুখ নিয়ে? বিয়ে কি ছেলে খেলা? দুজন অকারণে জেদ ধরে বসে আছো বিয়ে দিবে না বলে!"

আনোয়ার সাহেবও এবার এগিয়ে এলেন। তবে তিনি যথাসম্ভব নম্র গলায় ইমাদ সাহেবকে বললেন,
" দ্যাখেন ভাইজান। ছেলেমেয়ে দুজনই আমাদের। ওদের ভালোমন্দ আমাদেরই চিন্তা করতে হবে। আব্বার তো বয়স হয়েছে। আমাদের সবার চেয়ে সে বেশি দিন দুনিয়া নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে৷ সে যা সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা কিন্তু ভুল না৷ আজকাল কিন্তু যুগ অনেক খারাপ ভাইজান। আমাদের নীলু কোন বাড়িতে যাবে, কেমন ছেলের সাথে বিয়ে হবে, তার আচরণ কেমন হবে এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার চেয়ে মেয়েকে ঘরেই বিয়ে দেয়া ভালো না? যেখানে আমাদের সুযোগ আছে! আর এমনও তো নয় যে স্মরণ খারাপ ছেলে।"

ইমাদ সাহেব মুহূর্তেই প্রত্যুত্তর দিলেন, 
" স্মরণ খারাপ না। কিন্তু স্মরণের মা তো খারাপ। নাজমা আমার মেয়েটাকে পেয়ে আমার উপর প্রতিশোধ না তুলে!"

এ কথা শুনে নাজমা বেগম হায় হায় করতে করতে আশ্চর্যান্বিত হলেন৷ গলা উঁচিয়ে বললেন,
" তুই জানিস আমি নীলুকে কত আদর করি ইমাদ! ও তোর মেয়ে হওয়ার আগে মিলির মেয়ে। আমার ভাগ্নি। তোর মতো নিচু চিন্তা ভাবনা নিয়ে চলি না আমি। "

ইমাদ সাহেব কিছু বলতে যাবেন এর পূর্বেই মিলি বেগম এসে ইমাদ সাহেবকে বাধা দিলেন। আজ প্রথমবারের মতো স্বামীর প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা আসছে। অন্য কথায় বলতে গেলে ইমাদ সাহেবের এমন ব্যবহারে ঘৃণা আসছে তাঁর। মিলি বেগম প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন,
" তুমি যে আমার আব্বাকে নূন্যতম সম্মানটুকু করো না তা আজ বুঝলাম ইমাদ। একজন বৃদ্ধ মানুষ, যে কি না মৃত্যুশয্যায়, তার ইচ্ছে পূরণের চেয়ে তোমার খোঁড়া যুক্তি দিয়ে মেয়ের বিয়ে ভাঙাচ্ছো!"

ইমাদ সাহেব কিছু বললেন না। তিনি মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তায় ভীষণ চিন্তিত। নাজমা যদি ভবিষ্যতে কোনোদিন নীলিমাকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করে! যদি নীলিমার সংসার ভাঙার চেষ্টা করে তবে! এসব উল্টাপাল্টা চিন্তায় বিভোর হয়ে আছেন তিনি। 
মিলি বেগম ফের বললেন,
" তুমি কি ভাবছো আমাদের মেয়ে খারাপ থাকবে? আরে স্মরণের সাথে বিয়ে হলে ও সবচেয়ে বেশি সুখে থাকবে। "

ইমাদ সাহেব এবার বললেন,
" এই গ্যারান্টি তোমাকে কে দিয়েছে মিলি? বড়দের সিদ্ধান্ত যে সবসময় ভালো হবে এটারও তো কোনো গ্যারান্টি নেই। আমি আব্বাকে সম্মান করি। কিন্তু তাই বলে যার তার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিবো না আমি। "

নাজমা বেগম ফের ফুঁসে উঠলেন। বললেন,
" যার তার কাছে বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছিস ইমাদ? আমার ছেলেকে এতোটাও সহজলভ্য বানাইনি আমি। ওকে 'যার তার' বলিস কোন সাহসে!"

স্মরণ ত্যক্ত বিরক্ত। প্রচন্ড রাগে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। এতক্ষণ চুপ ছিলো ভদ্রতার খাতিরে। বড়দের মাঝে নাক গলাবে না বলেই নিজেকে নীরব রেখেছিলো। কিন্তু তার মা ও ফুপার অযৌক্তিক আচরণ ও ঝগড়া দেখে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। অনেক হয়েছে চুপ থাকা। এবার কিছু না বললে কাপুরুষের মতো আচরণ করা হবে। আর এই কাপুরুষতার ফল হিসেবে নীলিমাকে সারাজীবনের জন্য হারাতে হবে। স্মরণ গর্জে উঠলো। উচ্চ আওয়াজে বললো,
" ব্যস অনেক হয়েছে তোমাদের ঝগড়া। আমি কারোর যুক্তি মানবো না। আমি দাদার সিদ্ধান্ত অনুসারে নীলিমাকেই বিয়ে করবো। "

স্মরণের এহেন কথায় উপস্থিত সকলে বিস্মিত হলো, শুধুমাত্র তারা বাদে যারা এ নিয়ে পূর্ব হতেই অবগত। স্মরণ এবার আরোও যোগ করলো,
" আর এ সিদ্ধান্ত থেকে আমি পিছপা হবো না। কারণ আমি নীলিমাকে ভালোবাসি। বিয়ে করলে ওকেই করবো। "

শেখ পরিবারে যেনো ছোটখাটো একটা বোম নিক্ষেপ করলো স্মরণ। বাকি সবাই যতোটা না বিস্মিত হয়েছে তার তুলনায় অধিক বিস্মিত হয়েছেন ইমাদ সাহেব ও নাজমা বেগম। দুজনে হতভম্ব দৃষ্টিতে স্মরণের দিকে চেয়ে আছে। ওদিকে নীলিমা দাঁড়িয়ে আছে নত দৃষ্টিতে। সে অপেক্ষা করছিলো কখন স্মরণ কিছু বলবে, কখন এ দুশ্চিন্তার অন্ত হবে। স্মরণের এই সামান্য বলাটুকুই তার হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দিয়েছে। নাজমা বেগম স্তম্ভিত গলায় বললেন,
" এসব কি বলছিস স্মরণ! তুই আর নীলিমা! কিন্তু কীভাবে!"

স্মরণ এবার এগিয়ে এলো নীলিমার কাছে। সকলকে সাক্ষ্য রেখে নীলিমার হাতের মুঠোয় নিজের হাতে ডুবিয়ে দিলো। শক্ত হাতে তার হাত ধরে বললো,
" যেভাবেই হোক মা। আমি নীলিমাকে ছাড়বো না। তোমাদের এই ইউজলেস ঝগড়া, কথা কাটাকাটি আমাদের ওপর কোনো এফেক্ট ফেলবে না। আর আমি এটা বুঝছি না যেখানে দাদা নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে সেখানে তোমরা বাগড়া দিচ্ছো কেনো? দাদা যে আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক এবং সম্মানীয় মানুষ সেটা কি ভুলে বসেছো মা?"

এবার ইমাদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
" আর ফুপা, আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। অন্তত আপনি একটু বুঝদারের মতো আচরণ করতে পারতেন। জানি, আপনি নীলিমাকে অনেক ভালোবাসেন। ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে বিচারবিহীন একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন! আপনি যেমন নীলিমাকে ভালোবাসেন। আমিও ওকে ভালোবাসি। আর এ হাত ধরেছি ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়, সারাজীবন ওকে নিজের করে রাখার জন্য। ওকে আগলে রাখার জন্য।
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp