বসন্তের এক সন্ধ্যে - তানজিল মীম - অনু গল্প


বসন্তের উৎসবে ভার্সিটি প্রাঙ্গন মুখরিত। বাসন্তী রঙে রাঙানো ভার্সিটির রমণীগণ। আমি বিমুঢ় তাদের পানে চেয়ে। বিরক্তি বোধ করছি খানিকটা। এমন নয় আমি শাড়ি পড়িনি। আমিও পড়েছি। কিন্তু শাড়ি সামলানো কি চারটে খানিক কথা! এই নিয়ে চতুর্থ বারের মতো শাড়ি পড়েছি তবুও এ যেন আমার সামলানো সাধ্যের নয়। আমি বুঝি না— শাড়ি পড়ে হাঁটা, দাঁড়ানো এত কঠিন কেন! মা বার বার বলেন এখনও শাড়ি সামলাতে না শিখলে বিয়ে করলে কি হবে তোর? কিছুই হবে না। বর্তমান সময়ে শাড়ি সামলানো খুবই সহজ। যেমন রেডিমেট শাড়ি। আহা! পড়ো, ধরো, ঘোরাও আর আটকাও, ব্যস হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ভেবে ফেলেছি বাসায় ফিরে বাবার কাছে বায়না ধরতেই হবে আমার চারপাঁচটা রেডিমেট শাড়ি চাই। মাথার উপর রোদ্দুরটা যেন টগবগিয়ে ফুটছে। বসন্তের সময় এত গরম লাগার কোনো মানে হয়। কেউ গরমে ছটফট করছে না। অথচ আমি কিনা বিতৃষ্ণায় জর্জরিত হচ্ছি। ভার্সিটি প্রাঙ্গনের মাথায় বড় স্টেজে একের পর এক নাচগান হচ্ছে। আমিও মন দিয়ে দেখছি। শুনছি। আচমকাই কি হলো গোলাগুলির শব্দ হলো হঠাৎ। পুরো ভার্সিটি প্রাঙ্গনের মানুষ ব্যস্ত হলো ছুটতে, আতঙ্কিত হলো চারপাশ। আমি বিস্ময় চেয়ে। আমার পাশে বসে থাকা আমার বান্ধবী রিনি বলল, “মাধু ওঠ।” আমার পুরো নাম মাধবীলতা। বাবা শখ করে নাম রেখেছেন। বাবা উপন্যাস প্রেমি মানুষ। নামটা সেখান থেকেই নাকি জানা। তবে বেশির ভাগ মানুষ আমাকে মাধবী বলে ডাকে। আমি উঠলাম না। হিতাহিত জ্ঞান বুদ্ধি বোধহয় হারিয়েছি। আমার এক কঠিন ব্যামো হলো আমি অল্পতেই আতঙ্কিত হয়ে যাই। বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়। আর এটা একবার শুরু হলে আমি আমার সকল কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যেমন এখন হারিয়েছি। রিনি হাত ধরে কোনোক্রমে উঠে দাঁড় করালো। আতঙ্কিত কণ্ঠে বার বার শুধাল, “মাধু ছুট।”

ও আমার হাত ধরেই ছুটল। আমিও দৌড়ালাম ওর সাথে। শাড়ির কুঁচিতে কোনোরকম হাত বুলিয়ে ছুটছি। এমন সময় রিনির প্রেমিক আশিক ভাইয়া এসে হাজির। তিনি আতঙ্কিত হয়ে রিনির হাত ধরে বললেন, “ডিপার্টমেন্টের দিকে যাও, ছাত্রলীগের কিছু দল হামলা করেছে।”

রিনির হাত ধরে ছুটলেন আশিক ভাইয়া। আর আমার হাত ধরে রিনি। এক অদ্ভুত ঘটনা। আমি মাঝে মধ্যে আমার এই কঠিন ব্যামোর জন্য বড্ড বিরক্ত হই। আবার খারাপও লাগে। আমার জন্য আমার কাছের মানুষরা সবসময় বিপদে পড়ে। এই যে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে রিনির সঙ্গ নিয়ে ছুটছি। আমি জানি ওর কষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষ যদি বিপদের সময় তার সমস্ত ভার অন্য আরেজন মানুষের হাতে দিয়ে দেয় তখন ভারপ্রাপ্ত মানুষটির খুব কষ্ট হয়। যেমন রিনির হচ্ছে। রিনি বলল, “মাধু দ্রুত ছোট।”

আমি কথা শুনে ছুটছি ঠিকই। তবে তা অনুভব করতে পারছি না। আমার পা সমেত কাঁপছে। যেকোনো সময় আমি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। তবে আজ পণ করেছি এমন কিছু করব না। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেললাম বার কয়েক। আমার জন্য বার বার কাছের মানুষগুলো পীড়া পায় এটা মানতে আমার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু আমি কি করতে পারি এতে, আমার হার্ড দূর্বল, ব্লাড ফোবিয়াও আছে। আপাতত মাথা নিচু করেই আছি। মাঠ প্রাঙ্গণে ইতিমধ্যে মারামারি, চেচামেচি আর আহাজারির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি সবটাই শুনছি তবে অনুভব করতে পারছি না।'

কিছু দূর এগোতেই হঠাৎ রিনির হাতের বাঁধন ছুটে গেল। আমি কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আকস্মিকভাবে সেই মুহূর্তে কে যেন এসে আমার ডানহাতটা শক্ত করে ধরল। বেশ ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল, “এই মেয়ে, এই সময় এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে।”

আমি কিছু বলতে পারলাম না। তার দিকে তাকাল। মাথায় কালো ক্যাপ, মুখে মাস্ক, চোখে কালো চশমা। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। চেহারা চেনার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। আমি তার দিকে তাকিয়েই রইলাম। কিছু যে বলছে শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু ওই যে বললাম অতিরিক্ত আতঙ্কিত হলে আমি আমার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিছুই অনুভব করতে পারছি না। হঠাৎই পিছন থেকে কে যেন তার পিঠে আঘাত করল। আমি দেখলাম। তিনি আমায় দেয়াল করে দাঁড়ালেন। পুনরায় আঘাত দেয়ার আগেই পিছন ঘুরে আঘাত দেয়া মানুষটার হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে নিলেন। তক্ষৎণাৎ আঘাত করলেন না। তবে বললেন, “অহেতুক ঝামেলা না করে বাড়ি যাও।”

এরপর কি হলো মনে রইল না। আমি বোধহয় আমার পণ করা কথাটা ভেঙে দিলাম। লুটিয়ে পড়লাম বোধহয় ভার্সিটির মাঠ প্রাঙ্গণে।'

•••••••••••••••

জানালার কার্ণিশ ছুঁয়ে রোদ্দুরেরা ভাসছে। ভাড়ি ভাড়ি বইয়ের ভিড়ে মেঝেতে বসে আছে মাস্ক পরিধিত একজন যুবক। মাথার কালো ক্যাপটা সে সরিয়ে নিচে রেখেছে। কালো চশমাটাও তার পাশে শুইয়ে। পিঠে খানিকটা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। ছেলেটা মনে হয় তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেরেছে। আরফান জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল। ভার্সিটির লাইব্রেরি রুমে সে বসে আছে। তার পাশেই আছে অপরিচিত এক মেয়ে মানুষ। শুধু যে পাশে বসে আছে– তা বললে ভুল হবে। বেশ খানিকটা সময় ধরে তার বুক লেপ্টে শুয়ে আছে মেয়েটা। আরফান ডাকবে ডাকবে করেও ডাকতে পারল না। বাহিরে গোলাগুলির শব্দ এখনও খানিকটা শোনা যায়। মেয়েটা বোধহয় এসব নিতে পারে না। কেমন যেন অবশ বেশে আশপাশ দেখছিল। বড় অদ্ভুত ঠেকছিল আরফানের। তাই তো ছুটে গিয়ে ধরল মেয়েটাকে। আরফানরা বসে আছে লাইব্রেরির একদম ভিতরের পুরনো বইয়ের ভিড়ে। ধুলো জমেছে চারিপাশে। আশপাশে কেউ নেই। আরফান কি করবে বুঝতে পারছে না! এবার কি ডাকবে মেয়েটাকে!'

বেশ খানিকটা সময় গেল মেয়েটা নড়েচড়ে উঠল। আরফান ছিঁটকে দূরে সরে যাবে ভেবেও গেল না। ধীরে ধীরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটা চোখের পাতা খুলল। আশপাশটা বুঝতে তার খানিকটা সময় লাগল। পুরোপুরি হুশ আসতেই মেয়েটা ছিটকে দূরে সরে গেল। বুকশেলফেও আঘাত লেগে কিছু সংখ্যক বই গুঁড়িয়ে পড়ল নিচে। আরফান বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটার আতঙ্কিত মুখখানা দেখল। কান্ডকারখানা দেখল। হাসি পাচ্ছে খানিকটা। তবুও হাসল না। গম্ভীর এক কণ্ঠে বলল, “এতটা আতঙ্কিত হওয়ার মতোও কোনো ঘটনা ঘটেনি এখানে।”

মাধবী মাথা নিচু করে ফেলল। লজ্জিত মুখ হলো তার। ঠিক কি কি ঘটেছিল সবটা মনে করার চেষ্টা করল। এরপর বলল,
 “আমরা এখানে কতক্ষণ ধরে আছি।”

আরফানের খাপছাড়া উত্তর,
 “সে ঘন্টা দুই।”

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল মাধবী। বিস্ময়ে চোখ ফুলে উঠল। সে সরাসরি আরফানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এতক্ষণ অজ্ঞান হয়েছিলাম।”

আরফান মাথা নাড়িয়ে জানাল, “জি।”
পরমুহূর্তেই মাধবীর কেমন যেন লাগল। সে বলল,
 “আপনি মিথ্যে বলছেন না তো?”

শব্দ করে হেঁসে ফেলল আরফান। মাস্কের ভিড়েও সেই হাসি খুবই চমৎকার শোনাল। মাধবী ক্ষিপ্ত হলো, “আশ্চর্য! এখানে হাসার কি ছিল?”

আরফান তার হাসি থামাল। পাঞ্জাবির বুকে লেপ্টে থাকা ধুলোগুলো ঝেড়ে উত্তর দিল,
 “আপনাকে আমি যেমনটা ভেবেছিলাম আপনি আসলে তেমনটা নন।”
 “মানে?”
 “আপনার মাথা আর আমার ব্রেইন।”

হকচকিয়ে উঠল মাধবী। এই ছেলে বলে কি। আরো কিছু সময় গেল। নির্জনতায় ভরপুর সময়। ধীরে ধীরে বিকেল সরে এলো। মাধবী বলল, “আমাদের বোধহয় যাওয়া উচিত।”

আরফান উঠে দাঁড়াল, “আমারও মনে হয়, চলুন।”
মাধবী উঠে দাঁড়াল। আরফানের পিঠের দিকের সাদা পাঞ্জাবির গায়ে এক বিশাল কালো রেখা দেখা যাচ্ছে। মাধবীর কিছু মনে পড়ল। সে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, “আপনি আঘাত পেয়েছিলেন তখন।”

আরফান দ্বিধাহীন বলল, 
 “ওসব কিছু না ছোটোখাটো ক্ষত। আপনি চলুন।”
 “কি বলেন ছোট খাটো ক্ষত। কোনো ক্ষতই ছোট নয় চলুন ডাক্তারের কাছে যাই। এমনিতেও আপনি আমায় সাহায্য করেছেন তার বিনিময়ে হলেও আমার আপনাকে সাহায্য করা উচিত।”
 “আমি কোনো বিনিময়ের জন্য আপনায় সাহায্য করিনি।”
 “সুযোগ যেহেতু হয়েছে তখন সাহায্যের প্রতিদান দিতে আমি প্রস্তুত।”

আরফান আর মানা করল না। সে পড়ে নিল তার মাথার ক্যাপ আর চোখের কালো সানগ্লাসটা। ধীরে ধীরে তারা ভার্সিটির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো। মাঠপ্রাঙ্গনের বেশ নিরিবিলি পরিবেশ। তবে স্টেজ ভেঙে গেছে। মাধবী প্রশ্ন করল, “আচ্ছা হঠাৎ হামলা হলো কেন?”

আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানি না।”

প্রকৃতিতে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। হসপিটালের বাহিরের দাঁড়িয়ে আছে আরফান আর মাধবী। আরফানের পিঠে সাময়িক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন গুরুতর কোনো বিষয় নয়। ঔষধপত্র নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। আরফান বলল,
 “আপনার জন্য রিকশা ডেকে দেই?”
 “আপনায় ডেকে দিতে হবে না আমি চলে যেতে পারব। আর হ্যাঁ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।”

বিনিময়ে আরফান কিছু বলল না। সে রিকশা ডাকল। মাধবী বলল,
 “রিকশা লাগবে না।”
 “আপনি চুপ করে দাঁড়ান।”

মাধবী দাঁড়াল। ছেলেটার কণ্ঠস্বর খুবই ধারাল। কিছুক্ষণের মাঝেই একটা রিকশা এসে হাজির। আরফান বলল, “উঠুন।”

মাধবী বিনাবাক্যে উঠে পড়ল। বলল,
 “আচ্ছা শুনুন এতটা পথ তো আমরা একসাথে ছিলাম আপনি তো আপনার চেহারা দেখালেন না। পরবর্তীতে দেখা হলে চিনব কি করে?”

উত্তরে আরফান বলল, “আপনাকে চিনতে হবে না, আমি চিনে নিব। ভালো থাকবেন।”

মিষ্টি হাসল মাধবী। বলল, “আপনিও।”
রিকশা চলতে শুরু করল। মাধবী একবার ঘুরে তাকাল। আরফান তার পকেট থেকে ফোনটা বের করে ছোট্ট একটা মেসেজ লিখল। এরই মাঝে মোড়েই মাথা তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা এগিয়ে এলো। আতঙ্কিত স্বরে তার এসিস্ট্যান্ট আরিফ বলল, “আপনি ঠিক আছেন তো স্যার?”

বিনিময়ে আরফান দ্রুত গাড়িতে বসে বলল, “হুম। চলো।”

মাধবীর রিকশাটা তখনও দূর সীমানায় দেখা যায়। আরফান হঠাৎ উপলব্ধি করে এতটা সময় পার করা মেয়েটার নাম জানা হয়নি। বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার ঘটল। আরফান নিরাশ মনে বসে রইল গাড়িতে।”

•••••••••••••••

রাত আটটা। সোফায় বসে টিভি দেখছিল মাধবী। তাদের ভার্সিটির হামলার ঘটনা দেখানো হচ্ছে। মূলত ঘটনাটা ঘটেছিল আলাদা দুই ভার্সিটির ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে সামাজিক এক দ্বন্দ্ব নিয়ে, যা শুরু হয়েছিল ক্যাম্পাসের এক বিতর্কিত পোস্টার ছেঁড়া নিয়ে। শাহজালাল ভার্সিটির বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়, যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়। ইতিমধ্যে কিছু ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়েছে।

হঠাৎই টিভির একটা হেডলাইনে চোখ আটকাল মাধবীর। যেখানে লেখা ছিল—

"শাহজালাল ভার্সিটির ছাত্রলীগ হামলার ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরফান আহমেদ। মূলত শাহজালাল ভার্সিটির বসন্ত উৎসবে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। তবে খুবই গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন তিনি। তাই প্রত্যক্ষ দোষী তাকে চিনতে না পেরে আঘাত করে বসে তার পিঠে। জানা যায়, ভার্সিটিরই কোনো এক মেয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং চিকিৎসা করায়।"

হেডলাইন পড়ে মাধবীর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। এরই মাঝে সাংবাদিকও বলে উঠলেন—

"শাহজালাল ভার্সিটির ছাত্রলীগ হামলার ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরফান আহমেদ। মূলত শাহজালাল ভার্সিটির বসন্ত উৎসবে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। তবে খুবই গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন তিনি। তাই প্রত্যক্ষ দোষী তাকে চিনতে না পেরে আঘাত করে বসে তার পিঠে। জানা যায়, ভার্সিটিরই কোনো এক মেয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং চিকিৎসা করায়। এ ব্যাপারে আমাদের সরাসরি তথ্য দেবে আমাদের সহযোগী রিপোর্টার মতিউর রহমান।"

 এরপরই স্ক্রিনে ঢাকা মেডিকেলের দৃশ্য ভেসে উঠল। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরফান আহমেদ নিজেই বললেন,
 "একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসবে এমন হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি, দ্রুত এই ঘটনার পেছনের কুশীলবদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে।"

  আরফানের চেহারা দেখে পুরোদমে চমকে উঠল মাধবী। আরে ইনি তো…! আরফানের চেহারা না দেখলেও তার চোখদুটো খুব খেয়াল করেছে মাধবী। তাছাড়া, আরফানের চোখের পাশে একটা কাটা দাগ আছে।

মাধবী টিভির একদম কাছে চলে গেল। পুরোপুরি নিশ্চিত হতেই আরেক দফা অবাক হলো। ভাবতেই অবাক লাগছে, আজ সারা বিকেল-সন্ধ্যা সে এক মন্ত্রীর সঙ্গে ছিল! অথচ চিনতেই পারেনি। অবশ্য দেখলেও চিনত না, কারণ বাংলাদেশের মন্ত্রী-মিনিস্টারের খবরাখবর সে রাখে না। তবে আরফান আহমেদের নাম শুনেছে। খুব বেশিদিন হয়নি সে মন্ত্রীর আসনে বসেছে। মূলত তার বাবা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে মন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এইতো কেবল দু'মাস হলো।

মাধবী গালে হাত দিয়ে তখনও টিভির পর্দায় তাকিয়ে। তবে লোকটা একটা কথা ভুল বলেছে— মূলত মাধবী তাকে নয়, সে-ই মাধবীকে সাহায্য করেছে…!

••••••••••••••

রৌদ্রময়ী সকাল। বিছানা লেপ্টে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মাধবী। হঠাৎই তার ফোনটা বেজে উঠল। ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে সে ফোনটা তুলে বলল, “হ্যালো।”

অপরপাশের ব্যক্তিটি সঙ্গে সঙ্গে উদাস গলায় বলল,
 “আমার সুখের ঘুম কেড়ে নিয়ে— আপনি কি করে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন বাসন্তীফুল?”

••••••••••••••

ঘুমের ঘোরে আচমকাই অনাকাঙ্ক্ষিত কারো কণ্ঠে বাসন্তীফুল নামটি শুনে হকচকিয়ে উঠল মাধবী। তাৎক্ষনিক ঘুম উড়ে গেল তার। শোয়া থেকে উঠে বসল দ্রুত। ফোনের স্কিনে আননোন নাম্বার দেখে আরো বিস্মিত হলো। থমথমে কণ্ঠে আওড়াল, “কে বলছেন?”

তক্ষৎণাৎ উত্তর এলো না। কিছুটা সময় গেল। মাধবী কান থেকে ফোন সরিয়ে একপলক দেখল। পুনরায় ফোনটা কানে পেতে আবারও জিজ্ঞেস করল, “কে বলছেন?”

থমথমে এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। অপরপাশের মানুষটা বলল,
 “পরিচয় না দিলে কি– কথা বলা যাবে না?”

চট করেই কণ্ঠটা যেন চিনে ফেলল মাধবী। সে অবাক হলো। ভীষণ অবাক। জানাল,
 “মন্ত্রী মশাই।”

 আরফান যেন অবাক হলো না। তবে ভাবল, মেয়েটা বুঝি তার পরিচয় জেনে গেল। সে বলল,
 “কি করে বুঝলেন?”
 “আপনার কণ্ঠ যে আমি শুনেছি তা ভুলে গেলেন নাকি।”
 “আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই।”
 “জরুরি কিছু?”
 “আমার সাথে অবুঝ হচ্ছেন?”

মাধবী হাসল। খানিকটা শব্দ হলো সেই হাসিতে। আরফান অনুভব করল। সে শান্ত তবুও করুণ স্বরে বলল, “এভাবে হাসবেন না বাসন্তীফুল, ভিতরটা যেন কেমন করে!”

মাধবী হাসি থামাল। কথাগুলোর গুরুত্ব দিল না। উল্টো বলল,
 “আমার সাথে মশকরা করছেন?”
 “আমাকে কি হাস্যরসিক মানুষ বলে মনে হয়?”
 “মন্ত্রী মশাইরাও প্রেমে পড়ে নাকি?”
 “মন্ত্রীদের কি হৃদয় থাকে না?”
 “তাই বলে আমি।”
 “কেন আপনার প্রেমে পড়া বারণ নাকি?”
 “কোথায় মন্ত্রী আর কোথায় মাধবীলতা?”
 “নিজের প্রতি এতটাও উদাসীন হবেন না বাসন্তীফুল, শাড়িতে কিন্তু আপনাকে দারুণই লাগে।”
 “কতজনকে বলেছেন এই কথা?”
 “বিশ্বাস করুন আপনি প্রথম।”
 “বিশ্বাস হচ্ছে না।”

এবার আরফান কি বলবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা তার কথা সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছে না! তার কথায় দেশের কত মানুষ ওঠে বসে অথচ এই মেয়েটা হেঁসে উড়িয়ে দিচ্ছে। কি অদ্ভুত!'

কল কেটে গেল। মাধবী বিস্মিত হলো। থমকাল। ভড়কাল। চমকে বার কয়েক ডায়াল নাম্বারটা দেখল। লোকটা রাগ করল নাকি। অবশ্য রাগ করলেও কিছু করার নেই। এমন সকাল সকাল এক শ্যামবতীকে কল করে যদি সুদর্শন এক মন্ত্রী মশাই বলে, “আমার সুখের ঘুম কেড়ে নিয়ে— আপনি কি করে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন বাসন্তীফুল?” তাহলে অবশ্যই সেটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। মাধবী তার ঘরের আয়নাটার দিকে তাকাল। নিজের শ্যাম বর্ণের মুখখানায় বার কয়েক চোখ বুলাল। কই বিশেষ কিছু তো নজরে আসছে না। অন্তত একজন মন্ত্রী মশাইকে নিজের প্রেমের জ্বালে ফাসানোর মতো রূপবতী নয় মাধবী।'

আচমকাই শব্দ করে হাসল। বোধহয় এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। মাধবী হাই তুলে ফোনের ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকল। মেসেজ অপশনে যেতেই দেখল রিনির গোটা চারেক মেসেজ। কাল রাতেও করেছিল। সে ঠিক আছে কিনা জানার জন্য। বলেছে, 'ঠিক আছে।' রিনি লাইনেই ছিল। মাধবী লাইনে আসতেই মেসেজে লিখেছে,
 “কোথাও ঘুরতে বের হবি মাধু?”
 “কোথায় যাবি?”
 “নদীর পাড়ে চল।”
 “তোদের দুই প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে আমি গিয়ে কি করব?”
 “চল না দোস্ত।”

মাধবী কতক্ষণ ভেবে বলল,
 “কখন যাবি?”
 “বিকেলে।”

•••••••••••••••
 
নদীর পানিতে তখন প্রবল স্রোত। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মাধবী আর রিনি। আশিকের এখনও খবর নেই। আশিক আসলেই তারা ব্রিজের নিচে নামবে। নদীর ঘাটে পা চুবিয়ে বসে থাকবে। এই কাজটা শুধুমাত্র মাধবীই করে। আশিক আর রিনি তো তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে বসে কথা বলে। প্রায় ঘন্টা দেড় কেটে যায় তাদের। মাধবী তো মাঝে মধ্যে ধরতেই পারে না এত কথা কি বলে তারা। মাধবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
 “কখন আসবে আশিক ভাইয়া?”

রিনিও খানিকটা বিরক্তবোধ করছে। সে বলল,
 “দাঁড়া দেখছি।”

মিনিট পাঁচেকের মাঝেই আশিক হাজির। রিনি প্রায় রাগ নিয়ে বলল,
 “এত সময় লাগে তোমার?”
 “সরি।”

অতঃপর দুই প্রেমিক প্রেমিকা সামনে হাঁটতে শুরু করল আর পিছনে মুরগীর অসয়হায় বাচ্চার মতো হাঁটতে লাগল মাধবী। খুবই দুঃখজনক ঘটনা।'

 বরাবরের মতোই নদীর পাড়ে পা চুবিয়ে বসে আছে মাধবী। আর তার থেকে দশ-বার হাত দূরে বসে আছে রিনি আর আশিক। মাধবী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিষয়টা ভালো নয়। তবুও রিনি তার বেস্টফ্রেন্ড বলে কিছু বলতেও পারে না। মাধবী নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে রইল। দূর সীমানায় দু'একটা ট্রলার নৌকা যেতে দেখা যায়। মাধবী নিরাশ মনে বলল, “আমারও বয়ফ্রেন্ড চাই।”

হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠল। মাধবী থমকে উঠল খানিকটা। কল ধরতেই অপরপাশের মানুষটা বলল,
 “বাহ্! বাসন্তীফুল যে পাহারাদারের কাজও করে তা তো জানতাম না।”

মাধবী বিস্মিত হয়ে বলল,
 “মানে?”
 “আপনি লুতুপুতুর প্রেম বিষয়টা পছন্দ করেন?”
 “অর্নাস আর মাস্টার্স পড়ুয়া প্রেমিক প্রেমিকাদের প্রেম কখনো লুতুপুতু হয় শুনেছেন?”
 “তাহলে কাদের প্রেম লুতুপুতু হয় শুনি?”
 “জানি না আমি।”

পরক্ষণেই কি যেন ভাবল মাধবী। সে আশেপাশে তাকাল। অবাক হয়ে বলল,
 “এক সেকেন্ড আপনি কি আমাকে ফলো করছেন?”
 “কি অদ্ভুত কথা বলেন! যাকে বিয়ে করব তাকে ফলো করব না।”

আর একটুর জন্য হাত থেকে ফোনটা ফসকে পড়ে গেল না মাধবীর। সে বিস্ময়কর চাহনি নিয়ে বলল,
 “বিয়ে..! আপনার মাথার ঠিক নেই মন্ত্রী মশাই?”
 “আপনি করেছেন।”
 “পাগল হলেন নাকি?”
 “সত্যি বলছি আপনি করেছেন।”

ফোন কেটে দিল মাধবী। লোকটার মাথাটা কি সত্যি গেল নাকি অন্যকিছু...।'

অন্যদিকে ছদ্মবেশে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আরফান বলল, “আপনার কনফিডেন্স এত ভাঙাচোরা কেন বাসন্তীফুল?”

•••••••••••••••

মাঝপথে কেটে গেল চারদিন। আরফানের আর কল এলো না। মাধবীও ভুলতে বসল সবটা। সে বুঝেছে মন্ত্রী মশাই তার সাথে খানিকটা মশকরা করেছে। মাধবী কিছু মনে করেনি। বিষয়টা সেও উপভোগ করেছে।'

 দুপুর প্রায় বারোটা। আকাশ ছুঁইয়ে রোদ পড়ছে জমিনে। একপ্রকার ক্লান্ত হয়ে ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরছে মাধবী। রিনির বাসা আর মাধবীর বাসা ভার্সিটির ডানে আর বামে। যেই কারণে বাড়ি ফেরার সময় মাধবীকে একাই ফিরতে হয়। মাধবী হাঁটছে। আশেপাশে কোথাও রিকশা নেই। বড়ই বিরক্তির বিষয়। ফস করে শ্বাস ফেলল মেয়েটা। একপ্রকার জোরপূর্বকই হাঁটছে সে। হঠাৎ গা ঘেঁষে একটা গাড়ি থামল। মাধবী ভয় পেল। ছিঁটকে দূরে সরে গেল দ্রুত। গাড়ি থেকে কে যেন নামল। মাধবীর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
 “আপনার সাথে কিছু কথা ছিল ম্যাম।”

মাধবী অবাক হয়ে বলল,
 “আমার সাথে?”
 “জি।”
 “কে বলুন তো আপনি?”
 “আমি আরফান আহমেদের এসিস্ট্যান্ট।”

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল মাধবী। আরিফ বলল, “ভয় পাবেন না ম্যাম। গাড়িতে উঠুন। স্যার আপনার সাথে কথা বলতে চায়।”

মাধবী এইবার গাড়ির দিকে তাকাল। মাস্ক পরিধিত এক যুবক বসে আছে। মাধবী কিছু বলার আগেই আরিফ বলল, “প্লিজ ম্যাম দাঁড়িয়ে থাকবেন না। কেউ দেখে নিলে আমরা বিপদে পড়ব।”

আরিফের কণ্ঠটা অসয়হায় শোনাল। মাধবী বুঝল। সে হেঁটে গেল দ্রুত। জায়গাটা নির্জন। কারোই বিশেষ আগ্রহ নেই। কোন মেয়ে কার গাড়িতে উঠল বলে। মাধবী গাড়িতে উঠতেই আরফান বলল,
 “নির্জন দূরে চলো আরিফ।”
 
আরিফ মৃদু হেঁসে গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিল।
মাধবী বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে সামনের মানুষটাকে দেখছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশে বসে আছে। বিশ্বাস হচ্ছে না। হঠাৎই আরফান বলল, “যতক্ষণ দেখার দেখে নিন, এবং বিশ্বাস করে নিন আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশেই বসে আছেন।”

খানিকটা লজ্জা পেল মাধবী। লোকটা কি করে বুঝল সে এসব নিয়েই ভাবছিল।'

•••••••••••••

নির্জন একটা পরিবেশ। দূরদূরান্তে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই। আরফানের গাড়ি থামল। আরিফ বলল, “স্যার, আমি দূরে গিয়ে চা খেয়ে আসি।”

আরফান মাথা নাড়াল। আরিফ তার গায়ের কালো কোটটা খুলে রেখে গেল ড্রাইভিং সিটে। এবং কানে ব্লুটুথ লাগাতে লাগাতে বলল, “কোনো সমস্যা হলেই ডাকবেন স্যার।”

এবারও মাথা নাড়াল আরফান। আরিফ মুচকি হেসে চলে গেল। মিনিট পনের কোনো কথা হলো না। সব চুপচাপ। সব নির্জীব। আরফান তার মুখের মাস্ক, চোখের কালো সানগ্লাস, ক্যাপ সব খুলে ফেলল। এরপর সরাসরি তাকাল মাধবীর দিকে। মাধবীর বুকটা আচমকাই ধক করে উঠল। এই প্রথম সে আরফানের মুখটা সামনাসামনি দেখছে। আরফানের চাপদাড়ি আছে। চোখের পাশে কালো দাগ। গায়ের রঙ ফর্সা। পরনে ছাইরঙা শার্ট, কালো প্যান্ট। ছেলেটাকে টিভির থেকেও সামনাসামনি ভয়ানক সুন্দর দেখতে। মাধবী কিছুটা দূরে স্বরে গেল। আরফান মৃদু হাসল। জানাল,
 “আপনি আমায় ভয় পাচ্ছেন বাসন্তীফুল?”

কিছুটা তোতলানো স্বরে উত্তর দিল মাধবী,
 “খানিকটা।”

পুনরায় হাসল আরফান। বলল,
 “কি করলে আপনি বিশ্বাস করবেন এই আমার আপনাকে চাই?”

থমকে গেল মাধবী। কথা আঁটকে গেল তার। এভাবে চট করে এমন কথা বলে কেউ! বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। কি সাংঘাতিক যন্ত্রণা। না, যন্ত্রণা নয় সাংঘাতিক এক অনুভূতি হচ্ছে। মাধবী বার কয়েক শ্বাস ফেলল। বলল,
 “আমি আপনার জন্য পারফেক্ট নই।”
 “কে বলেছে?”
 “আমি বলছি।”
 “ভুল বলছেন।”
 “আমার কঠিন একটা অসুখ আছে।”
 “যেমন?”
 “আমি একটুতেই আতঙ্কিত হয়ে যাই।” 
 “আমি জানি।”
 “জানেন?”

অবাক স্বরে বলল মাধবী। আরফান বলল,
 “এতে তো আমি সমস্যা দেখি না।”
 “দেখুন আমি আতঙ্কিত হয়ে গেলে আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আমার জ্ঞানশক্তি লোপ পায়। এটা আপনার জন্য কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।”
 “আমি মানিয়ে নিব বিশ্বাস করুন।”
 “আপনার জীবন জটিলতায় ভরে যাবে বিশ্বাস করুন।”
 “আমার জীবন এমনিতেই জটিল বিশ্বাস করুন।”

সরাসরি আরফানের চোখের দিকে চাইল মাধবী। লোকটার চোখ দুটো খুব গভীরভাবে কিছু একটা বলছে। মাধবী বুঝতে পারছে। হঠাৎই মাধবীর হাত ধরল আরফান। শক্ত করে ধরল। মাধবী থমকে গেল। আরফান করুন কণ্ঠে আওড়ায়, “বসন্তের এক সন্ধ্যে আমার বুক লেপ্টে শুয়ে থাকা আপনাকে আমার লাগবে। বিশ্বাস করুন খুব করে লাগবে। আমার রাতে ঘুম আসে না। আমি নিশ্বাস নিতে পারি না। আমার সাদা পাঞ্জাবির বুকেপকেটের অংশে আপনার ঠোঁটের লিপস্টিকের দাগ আমায় দারুণ পীড়া দেয়। আমি নিতে পারি না। আমার খালি মনে হয় আপনাকে আমার চাই। আমাকে ফেরাবেন না দয়া করে। বিলিভ মি আমার আপনাকে চাই। গোটা আপনিটাকেই চাই। আপনি যেমন তেমনই আমার চাই।”

আরফান নিশ্বাস ফেলল। এতটা অসয়হায় লাগল নিজেকে। মাধবী বিমুঢ় তার পানে চেয়ে। কি করবে বুঝতে পারছে না। এভাবে তো কেউ তাকে চায়নি। মাধবী ভীতু হয়। বলে,
 “আমায় নিয়ে সমস্যায় পড়বেন।”
 “পড়লে পড়েছি তবুও আমার আপনাকে চাই।”
 “এমন কি দেখলেন বলুন তো?”

আরফান মাধবীর চোখের দিকে তাকিয়েই বলল,
 “জানি না।”
 “ভালোবাসেন আমাকে?”
 “বোধহয়।”
 “বোধহয়... তারমানে অনিশ্চিত।”
 “আমি জানি না।”
 “কি জানেন তাহলে?”
 “আপনাকে জড়িয়ে ধরি।”

থমথমে কণ্ঠের করুণ আবদার আরফানের! মাধবী চমকে উঠল। লোকটা বলে কি,
 “বিয়ে হয়নি আমাদের।”
 “চলুন না দ্রুত করে ফেলি।”

হাসল মাধবী। আরফান তাকিয়ে রইল তার দিকে। মাধবী বলল,
 “মন্ত্রীরা এতটা উতলা হয় জানতাম না তো।”
 “বিয়ে করি দেখবেন মন্ত্রীরা আরো অনেক কিছু হয়। অনেকটা বেহায়া, অনেকটা অসভ্য আর ভীষণ ভীষণ পাগলাটে।”

•••••••••••••

সন্ধ্যারাতে বিছানায় শুয়ে ছিল মাধবী। আরফানের কথা ভেবে তার খুব হাসি পাচ্ছে। দীর্ঘ একুশ বছরের জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষ মানুষের কথা ভেবে মাধবী হাসছে। তার সমস্ত শরীর অস্থিরতায় রূপ নিয়েছে। কি সাংঘাতিক অনুভূতি হচ্ছে। ফোন বাজল। মাধবী বুঝল কে দিয়েছে। সে কল তুলেই বলল, 
 “বলুন।”
 “উত্তর তো দিলেন না?”.
 “এত তাড়াহুড়ো কিসের?”
 “আপনাকে পাওয়ার।”
 “পেয়ে গেলে অবহেলা করবেন না তো?”
 “আমি বললে তো আপনি বিশ্বাস করবেন না।”
 “আমার এখনও বিশ্বাস হয় না।”
 “আমারও হচ্ছে না। আমি প্রেমে পড়েছি। বিশ্বাস করুন আমি প্রেমে পড়েছি। আচমকা আসা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিধিত এক শ্যামকন্যার আমি খুব দারুণভাবে প্রেমে পড়েছি।”
 “আমিও পড়েছি।”
 “আমি জানি।”
 “এত জানেন কিভাবে?”
 “বুকলেপ্টে শুয়ে থাকা এক রমণীতে আমি খুব করে পড়েছি।”
 “সেদিন আপনি মিথ্যে বলেছেন আমি দু'ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম না।”

হাসল আরফান। বামপাশের বুকে হাত রাখল। খুব আপসোস নিয়ে বলল,
 “যদি থাকতেন।”
 “কত শখ?”
 
আরফান তার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। মাধবীও কাঁথা জড়িয়ে শুইল। আরফান তার কণ্ঠে গাম্ভীর্যের ছোঁয়ায় এঁটে বলল,
 “আমি চাইব বসন্তের এক সন্ধ্যে আপনি আবারও আমার বুকলেপ্টে থাকুন। অনেকটা সময় থাকুন। অজ্ঞানে নয় স্বজ্ঞানে থাকুন। আমি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকি আর আপনি আমার দিকে। বুঝলেন তো বাসন্তী ফুল।”

মাধবী খুশি হলো। অনুভূতিরা টগবগিয়ে উঠল। সে হাল্কা হেঁসে জানাল,
 “ইস! মন্ত্রী মশাইরাও প্রেমে পড়ে।”

আরফান আবেশে চোখ বন্ধ করে বলল,
 “বিয়ে করবেন তো আমায়?”

মাধবী শীতল কণ্ঠে উত্তর দিল,
 “করব।”
.
.
.
সমাপ্ত.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp