অনন্যার এতো দেরি হচ্ছে কেন? নোহারা ধীরে ধীরে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। হাঁটতে হাঁটতে রিসেপশনের সামনে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো।
আসলে, আরণ্যক ভাইয়ার জন্য এখানে আসার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু অনন্যার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ছেলেটার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছে নোহারা। তাছাড়া সারাটা দিন নানা রকম আয়োজনের মধ্যে কেটে গেছে। আজ অনন্যাকে প্রপোজ করার পর কেক কাটার পরিকল্পনা ছিল আরণ্যক ভাইয়ার, নোহারাকে সাথে করে অনন্যার জন্য বিশেষ একটা উপহারও কিনেছিল। এসব ক্ষেত্রে সাহায্য করতে গিয়ে আজ ক্লাস করতে পারেনি নোহারা।
কিন্তু সবকিছু কি পরিকল্পনামতো হয়? হঠাৎ করেই অনন্যা বলে উঠেছিল, সে বিবাহিত।
নোহারা অবাক হয়েছিল। নিশ্চয়ই মিথ্যে বলেছে! কেন এমন একটা কথা বললো, বুঝতে পারছিল না কেউই। শুধুমাত্র ছেলেটাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য?
আরণ্যক অনন্যাকে পাওয়ার জন্য কতটা চেষ্টা করেছে, সেটা সে নিজ চোখে দেখেছে। যদিও একসময় অবহেলা করেছিল, কিন্তু আজ ভাইয়ার মুখে যা শুনলো, তাতে মনে হলো, হয়তো সবটাই কোনো অদৃশ্য বাধ্যবাধকতার কারণে হয়ে গিয়েছিল।
নোহারার ঘুমঘুম লাগছিল। রাত যে কতদূর গড়িয়েছে টেরই পায়নি। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ওপরে পেরিয়ে গেছে। পেটটা ধীরে ধীরে বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। কিছু একটা খেতে হবে। নোহারা সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের আড়মোড়া ভাঙলো। মুখে হাই তুলে চোখ দুটো পাশে ফেরাতেই আঁখি বড় হয়ে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিছুক্ষণের জন্য শরীরের সব অনুভূতি তালগোল পাকিয়ে স্থির হয়ে গেলো। প্রায় চিৎকার করেই ফেলেছিল নোহারা, কিন্তু নির্জন হাসপাতালের রাতের নিস্তব্ধতা মনে করিয়ে দিল, তার একটুখানি অসতর্কতা কারো হৃদযন্ত্রের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাড়াতাড়ি নিজের মুখ চেপে ধরলো সে।
নিজেকে সামলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সামনে বসে থাকা লোকটার দিকে। প্রথম সারির বাঁ পাশের চার নম্বর সিটে বসে আছে নিকোলাই ভেস্পার। চোখ সরু করে সামনের রিসেপশনে বসে থাকা এক তরুণীকে পরখ করছে। মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত পর চোখ তুলে তাকাতেই নিক হালকা হাত নেড়ে অভিবাদন জানালো।
নোহারার মুখে উত্তপ্ত বাতাস জমতে শুরু করলো। কী নির্লজ্জ এই লোক! প্রতিদিন এই লোকটার কথা ভেবে ভেবে নোহারার মাথা খারাপ হওয়ার দশা, নিক ঠিক আছে কিনা, সেদিনের পর আর দেখাও হয়নি, কেনো আরো একবার সেই গলিতে আসলো না, কেনো নোহারার পিছু করলো না এসব ভাবতে ভাবতে নোহারার জান যায় যায় অবস্থা আর সে কি না এখনো মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত! চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে মাথায় আগুন ধরে গেলো। রাগে শরীর কাঁপছিল। নোহারা একটুও সময় নষ্ট না করে বড় বড় পা ফেলে নিকের সামনে গিয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো।
কিন্তু নোহারার দিকে নিকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বামে মাথা হেলিয়ে মেয়েটাকে দেখতে ব্যস্ত। নোহারা তো আরো ক্ষেপে গেলো। দাঁতে দাঁত পিষে নিকের নাকে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো।
নিক আকস্মিক ঘুষিতে সামলে উঠতে না পেরে পিছিয়ে পড়লো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে গেলো, তারপর চোখ বড় করে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো নোহারাকে।
"লিটিল গার্ল?
বিস্ময়ে কপাল কুঁচকালো সে।
নিকের নাক বেয়ে ধীর গতিতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। নিক হাত দিয়ে চেপে ধরলো ক্ষতস্থান, মুখ বিকৃত হয়ে গেলো তার।
"আআআ! ব্যথা পেয়েছি।"
কাতর স্বরে বললো নিক।
নোহারার রাগে হাত কাঁপছিল। দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর কণ্ঠে বললো, "লজ্জাশরম বলতে কিছু নেই আপনার?"
রিসেপশনের মেয়েটা হকচকিয়ে উঠে ছুটে এলো। চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো, "ম্যাম, শুধু শুধু ওনাকে মারলেন কেন?
রিসেপশনের মেয়েটা কাছে এগিয়ে নিককে দেখতে আসছিলো, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে নোহারা এক ঝটকায় মেয়েটাকে সরিয়ে দিলো। হাই হিল পরা মেয়েটি ভারসাম্য হারিয়ে নিচে ছিটকে পড়লো।
নোহারা গভীর শ্বাস টেনে কঠিন স্বরে বললো, "কেনো মেরেছি, সেটা আমি দেখবো। আমাদের মাঝে আসার দরকার নেই আপনার।
মেয়েটি নিচে বসেই সিকিউরিটি! সিকিউরিটি! বলে চিৎকার করতে লাগলো। মেয়েটির কণ্ঠে আতঙ্ক মেশানো এমন চিৎকার শুনে দুই সিকিউরিটি গার্ড ছুটে এলো।
"এই মেয়েটি আমার উপরে হামলা করেছে! একজনকে ঘুষি মে/রেছে। হসপিটালে এসে অভদ্রতা দেখিয়েছে, প্লিজ বাইরে নিয়ে যান ওকে।
মেয়েটা উত্তেজিত কণ্ঠে অভিযোগ করলো। কঠোর মুখে সিকিউরিটি গার্ডরা নোহারার দিকে এগিয়ে গেলো। শক্ত হাতে নোহারার বাহু চেপে ধরলো তারা।
কঠোর গলায় বললো,
"আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে!
নোহারা ধাক্কা দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। "কেনো যাবো? ছাড়ুন বলছি! আমি কোনো অন্যায় করিনি!
কিন্তু তারা শোনার পক্ষপাতী নয়। দুই জনে মিলে সোজা টেনে নিয়ে যেতে লাগলো তাকে। নোহারার শরীর দপদপ করে উঠছিল, রাগে তার শিরা টানটান হয়ে আছে।
ঠিক তখনই নিক এগিয়ে এলো। রিসেপশনের মেয়েটার দেওয়া টিস্যু নাকে চেপে ধরে ঠান্ডা গলায় বললো, "ওকে ছাড়ুন। মেয়েটি আমার... বন্ধু!
'বন্ধু' শব্দটা শিলার মতো আছড়ে পড়লো নোহারার মনে।
গার্ডরা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলো, তারপর ধীরে ধীরে নোহারার হাত ছেড়ে দিলো।
নোহারা দাঁড়িয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে একে একে গার্ডদের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। চোখের ভাষায় বিদ্ধ করে দিতে চাইলো তাদের। আশেপাশের সবাই ও নিশ্চুপ হয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা উপভোগ করছিল।
নিক আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
"বাইরে চলো। এটা হসপিটাল, তোমার ঝগড়া করার স্থান নয়।
নোহারা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। নিকের সাথে হসপিটালের বাইরে বেরিয়ে আসলো। হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নিকের দিকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে এক ঝটকায় চুল সরিয়ে নিলো কপাল থেকে। নিকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"ফ্লার্টিং করছিলেন? আপনার মতো অমানুষদের থেকে এর বেশি কিছু আশা করাও বোকামি।"
নিক থেমে গেলো। তারপর রক্তে ভিজে যাওয়া টিস্যুটার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
"তুমি জানো, আমার শরীরের এক ফোঁটা রক্তও কতটা দামি?"
নোহারা একচুলও পিছু হটলো না। ভ্রু কুঁচকে ফোঁস করে বললো,
"ওয়াটেভার।"
নিক চোখ সরু করলো, ঠান্ডা স্বরে বললো,
"তোমার এই রাগে আমি গলে যাবো না। বরং এই রক্তের কারণে তোমাকে মে/রে ফেলতেও পারি।"
নোহারা সামান্য ঝুঁকে এগিয়ে এলো, কণ্ঠে উপহাস টেনে বললো,
"আপনার থেকে আর কিইবা আশা করা যায়?"
নিক গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তার চোখের ভেতরে ঠান্ডা ঝড় বইছে। তারপর মাথা উঁচু করে বললো,
"আশা করতে কে বলেছে? আমি তোমার সামনে আসিনি। তুমি এসেছো।"
নোহারা হতবাক হলো না। বরং রাগ চেপে বললো,
"আপনি এতদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও মেয়েদের কাছ থেকে সরে আসতে পারেননি? অথচ বলেন আমাকে কিস করতে চান? আমার ঠোঁট কী এতই সস্তা?"
"এতদিন আগের কথা কেনো টেনে আনছো? তাছাড়া আমি কি কখনো বলেছিলাম ঠোঁটে কিস করবো?"
নোহারা থ বনে গেলো। সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। আসলেই তো সন্ধ্যা ব্রো এমন কিছু তো বলেনি। তারপরও নোহারা মুখ কঠোর রেখেই এক পা এগিয়ে এল, নিকের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে,
"না বলেননি। কিন্তু আপনাদের মতো বিদেশিরা প্রথম ঠোঁটেই নজর দেয়।
আর ওই বিষয়টা নিয়েই আমাদের ঝগড়া হয়েছিল। তাই বলতেই হবে।"
নিক মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো, তারপর চোখ তুলে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
"তোমার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট চলে গেছে। তাই সরে যাও। বেশি করলে নিজের শেষ সময় দেখতে পাবে।"
নোহারা থমকে গেলো। এক পলক তাকিয়ে থাকলো নিকের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিয়ে শক্ত কণ্ঠে বললো,
"আমিও দেখতে চাই, আসলেই আপনি কতদূর যেতে পারেন।"
নিক ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে নোহারার দিক থেকে সরে গেলো। উল্টো হাঁটতে হাঁটতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
"আমার কথা শেষ হয়ে গেছে। নাউ গো!"
নোহারা হতভম্ব হয়ে গেলো। নিকের এমন উদাসীনতা তাকে ক্ষুব্ধ করে তুললো। চিৎকার করে বললো,
"আমার কথা এখনো শেষ হয়নি!"
নিক থামলো না, একবারও ফিরে তাকালো না। রাগে গলা ধরে এলো নোহারার। নিচু হয়ে মাটির একটা ছোট পাথর তুলে নিয়ে বললো,
"আমি কিন্তু আপনাকে পাথর ছুঁড়ে মারবো!"
নিক তবু অচঞ্চল, হাঁটার গতি একটুও কমলো না। জোর গলায় বললো,
"নিজের পথে হাঁটো, লিটিল গার্ল। আমি খুব ব্যস্ত। বিরক্ত করো না আমাকে।"
নোহারার হাত শিথিল হয়ে এলো, পাথরটা মাটিতে পড়ে গেলো ঠক করে। হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো নিকের দিকে। ভেবেছিল কি আর হচ্ছে কি! ভেবেছিল দেখা হলে সরি বলবে কিন্তু মেরে ফেললো ঘুষি? তার মধ্যে সে বলছে নোহারার উপর থেকে ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছে? এতো তাড়াতাড়ি কি করে বদলে গেলো?
আসলেই একটা প্লেবয়!
রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো নোহারা। নিজের উপরেই বিরক্তি ছড়িয়ে পড়লো তার মুখে।
••••••••••••
"অনন্যা! তোর জামাই কি কোনো মাফিয়া ডনদের মধ্যে পড়ে?"
অনন্যা মুচকি হেসে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
"না, তেমন কিছু না।"
"লোকটার মারামারির স্টাইলটা ভালো লেগেছে আমার। লোকটা আসলে কে?"
"আমার হাসব্যান্ড!"
অনন্যা মিটিমিটি হেসে বললো।
"ওয়! স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দেখছি একে অপরের প্রতি... বাহ! যাই হোক, অনন্যা, আমার কথা চিন্তা করিস না। আমি আমার মতো ভালো থাকবো।"
অনন্যা একটু মাথা নিচু করে বললো,
"সেদিন যদি তোমাকে জানাতাম বিয়ের কথা, তাহলে...!"
"না, অনন্যা। সেদিন জানালেও আমি তোকে বিয়ে করতে পারতাম না। তোর বয়ফ্রেন্ড ছিল ভীতু, যে পরিবারের সিদ্ধান্ত ছাড়াই হুট করে বিয়ে করতে পারতো না। কিন্তু এখন যদি তুই বিবাহিত না হতিস, তাহলে অন্য কথা ছিল। আমি ফ্যামিলিকে জানিয়ে কিছুটা সময় নিতাম। কিন্তু হুট করে ওইভাবে বিয়ে করতে পারতাম না, অতটা সাহস ছিল না তখন। কিন্তু জানিস! আজকে আমি সাহস অর্জন করেছিলাম। নিজের পরিবার, ফ্রেন্ডস আর ক্যারিয়ারের কথা ভুলে তোর সাথে বিয়ে করার চিন্তা করেছিলাম। তুই আমাকে অল্প হলেও সাহসী বানিয়ে দিয়েছিস। এটাই আগের আর এখনকার আরণ্যকের মধ্যে পার্থক্য।"
আরণ্যক একটানে কথাগুলো বলে শ্বাস ফেললো। পরক্ষণেই অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"অনন্যা! আমি তোকে আমার জীবনের প্রিয় অসম্পূর্ণ উইশ হিসেবে রেখে দিলাম।"
অনন্যা হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণা একবার চিকচিক করলো, তারপর ধীরে গড়িয়ে পড়লো।
আরণ্যক গভীর শ্বাস নিয়ে বললো,
"আমি সত্যিই তোকে অন্য কারও সঙ্গে সহ্য করতে পারবো না, অনু। কিন্তু তোর হাসবেন্ডের মতো শক্ত হাতে তোকে রক্ষা করার ক্ষমতাও আমার নেই। আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, অতটা স্ট্রং নই আমি। লোকটা কে, জানি না। কিন্তু মনে হলো, সে বিশেষ কেউ। ঠিক সিনেমার সেই হিরোদের মতো, যাদের কাছে অভাবনীয় শক্তি থাকে। যারা গুন্ডাদের এক হাতেই উড়িয়ে দেয়।"
আরণ্যক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর আবারো শ্বাস ফেলে বললো,
"লোকটার মুখের বাচনভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস, তোকে নিজের বলে দাবি করা, তোকে স্পর্শ করেছি বলে রেগে গিয়ে আমাকে মারতে আসা! সবটাই ছিল অকল্পনীয়। যদিও এটা কোনো সিনেমা নয়, আর না এখানে প্রতি মুহূর্তে কিছু খারাপ ঘটবে যে তোকে রক্ষা করার জন্য একজন হিরো লাগবে। তবুও লোকটার চোখে এমন কিছু দেখেছি, যা স্পষ্ট বলছে। তুই ওর কাছ থেকে পালাতে পারবি না। সে তোকে ছাড়বে না, ছায়ার মতো তোর আশেপাশে ঘুরবে। আমি যদি তোকে রাখতেও চাই, শান্তিতে থাকতে পারবো না। আর দ্বিতীয় কথা, তুই আমার সাথে থাকতে চাইবি না।"
গলা একটু কেঁপে উঠলো আরণ্যকের।
"তাই ছেড়ে দিলাম তোকে। তোর স্বামীকে আরেকটু বদনাম করতেই পাঠিয়ে দিলাম।"
অনন্যা মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললো,
"ধন্যবাদ। আমি অজান্তেই তোমার মনকে আঘাত করেছিলাম আর তারপর খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন হয়তো তুমি আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছো?"
"আমার জন্য কষ্ট পেতে হবে না। যা হওয়ার ছিল হয়ে গেছে।"
অনন্যা মাথা নাড়লো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। আরণ্যক আচমকা বলে উঠলো,
"ওই লোকটা তোকে প্রতিদিন ছুঁতে পারে, তোকে আগলে রাখতে পারে, যা আমি চেয়েছিলাম, সে সব করতে পারে। তোদের বিয়ে হয়েছে, করবেই তো! তারপরও কেমন জানি হিংসে হচ্ছে, ইয়ার। বলা উচিত না কিন্তু না বলেও পারছি না বুকটা জ্বলছে আমার।
জানিস, আমি কখনো তোর ঠোঁটে চুমু খাইনি কেন? চেয়েছিলাম, বিয়ের পর সব করবো। সবকিছুর জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম। বিয়ের আগে আমি তোকে শুধু মাঝেমধ্যে জড়িয়ে ধরা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছিলাম। এখন এই সত্যিটা আজ জানার পর সেটাও হবে না। তাই না? অনু, আমি তো পাগল হয়ে যাবো। কীভাবে থাকবো আমি? তোকে না পেয়ে, তোকে না দেখে? আচ্ছা, তুই মাঝেমধ্যে আমাকে একটা গুড মর্নিং ভয়েস মেসেজ পাঠাতে পারবি? শুধু একটু তোর কণ্ঠটা শুনতে চাই, আর কিছু না। তোর ভয়েস না শুনলে মনে হয় বুকের ভেতর বাতাস ঢোকে না আমার। আমি কী করবো বল?"
আরণ্যক বেদনা মিশ্রিত হাসি নিয়ে বললো কথাগুলো। অনন্যা আর শুনতে পারছিল না। বুকের ভেতর কী যেন কুঁকড়ে আসছিল, গলাটা ভারী লাগছিল। পেছন ফিরে নিজের চোখ মুছে নিলো চুপচাপ।
আরণ্যক আবারো বললো,
"আমার না ইচ্ছে করছে অতীতে ফিরে যেতে, সব ঠিক করে দিতে। আচ্ছা, অনন্যা! যদি আমি সত্যিই অতীতে পৌঁছে যাই, যদি সাহসী হয়ে যাই, তুই কি তখন আমাকে ভালোবাসবি?"
আরণ্যকের কথাগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে নীরবতা বিরাজ করলো। অনন্যার মনে হচ্ছিল আরো কিছুক্ষণ থাকলে সে আরণ্যকের কথায় আটকে যাবে।
আরণ্যক হঠাৎ বলে উঠল,
"চিন্তা করিস না। আমি তোকে আটকাবো না। তবে একটা জিনিস চাইবো দিতে পারবি?"
অনন্যা ধীর স্বরে বললো,
"কী?"
"ক্যান আই হাগ ইউ ওয়ান লাস্ট টাইম?
অনন্যার শ্বাস আটকে আসলো। কি সুন্দর আকুতি জানালো ছেলেটা। বুকটা কেমন ভার হয়ে আসছে অনন্যার। প্রচন্ড ব্যথা করছে এই স্থানে। না ভালোবাসার জন্য নয়। আরণ্যকের মনে আঘাত করার জন্য।
অনন্যা কিছু বলতে পারলো না। এই তো কিছু ঘন্টা পূর্বে আরণ্যক ওকে স্পর্শ করেছিল বলে কৌশিক স্যার তাকে রাতের বেলায়ই জোর করে গোসল করার জন্য বাধ্য করলো। আবার ও যদি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে স্যার কি আরো রেগে যাবে না?
অনন্যা চোখ বন্ধ করলো। কপালে স্যারের দেওয়া শেষ আলতো চুম্বন চোখে ভেসে উঠলো। মনে পড়লো, স্যারের যত্ন, উষ্ণতা, তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি। আচমকা কয়দিন হুট করে চলে গিয়ে অনন্যার মনের চিন্তা বাড়িয়ে দেওয়া, তারপর হুট করে এসে বলা, "আই উইল বি ইউর হাসবেন্ড, বি মাই ওয়াইফ",
"হেই শিকদার, আমি ভালোবাসতে জানি না, কিন্তু তোমার হাত ধরতে জানি।"
অনন্যা আবারো চোখ বন্ধ করে কয়দিন আগের কথাগুলোয় আটকে গেলো। কথাগুলো বারবার অনন্যার কানে গুঞ্জরিত হচ্ছিল। এক এক করে সেই মুহূর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।
অনন্যা অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চোখ খুলে বললো,
"স্যরি, ভাইয়া। আমি একজনের প্রতি কমিটেড। আমি চাই না উনি আরো রাগ করুক।"
আরণ্যক হেসে ফেললো। বিছানা ধরে ধীরে ধীরে উঠার চেষ্টা করলো। অনন্যার পেছনে দাঁড়িয়ে কোনো প্রকার স্পর্শ না করেও হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো। গলার কণ্ঠ নরম করে বললো,
"তুই জানিস তুই ওই লোকটাকে ভালোবাসিস? সত্যিই ভাগ্যবান সে।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরণ্যক,
"আমিও তোকে ভালোবাসি, অনন্যা। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি, ঠিক আগের মতোই চেষ্টা করবো পাশে থাকতে। আমরা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড না হই, বন্ধু তো হতে পারি?"
অনন্যা মাথা নাড়লো। শেষ পর্যন্ত মুখে মুচকি হাসি ধরে রাখলো।
••••••••••••
এক বহুতল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক। তার পায়ের কাছেই পড়ে আছে একটা নিথর দেহ। কৌশিকের চোখ দুটো আকাশি মণি থেকে নীলচে রঙে ধারণ করেছে। মুখের ভাঁজে রাগ ফেটে পড়ছে। কৌশিক দেয়ালে কয়বার হাত দিয়ে আঘাত করে নিজের রাগের তোপ সামলানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রাগ কমছে না, উল্টো ধিকিধিকি করে বেড়েই যাচ্ছে।
অনন্যা যদি আজ বাসায় ফিরে না আসে, তবে আরণ্যকের প্রাণটা চলে যাবে। এটা নিশ্চিত সে। কৌশিকের মাথায় এই ভাবনা ঘুরছিল। নিচে পড়ে থাকা লোকটার দিকে তাকালো সে। লোকটা কিছুটা হলেও কৌশিকের আসল রূপ দেখেছে। এমনিই শরীরের রাগ আগুনের মতো জ্বলছিল, তার মধ্যে এক অচেনা লোক তাকে সাধারণ মানুষদের থেকে ভিন্নভাবে দেখে ফেলেছে।
কৌশিক এই বহুতল ভবনটি বেছে নিয়েছিল শুধুমাত্র হাওয়া বাতাস পাওয়ার জন্য, ভিতরটা যাতে কিছুটা শান্ত করতে পারে তার জন্য। গেট বন্ধ ছিল, তাই সিঁড়ি ব্যবহার না করে বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন স্থানে পা রেখে লাফিয়ে উঠতে হয়েছিল, আর এই লোকটা সেটা দেখে ফেলেছিল। বিষয়টা ছিল কৌশিকের জন্য অপ্রত্যাশিত। তাই তো শেষ পর্যন্ত এই পরিণতির স্বীকার হলো লোকটা। কৌশিক চাইলেই লোকটার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারতো কিন্তু তার শক্তিক্ষুধা খুব বেড়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন আগে অনন্যাকে সুস্থ করার পর দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত ল্যুমিস নদী থেকে নিজের শক্তি আবারো পূর্বের মতো ফিরে পেয়েছিল সে। কিন্তু সাথে পেয়েছিলো আরো ভয়ংকর কিছু যা সামনে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে মনুষ্য জাতির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
কৌশিক নিচু হয়ে বসে লোকটার দিকে তাকালো, মৃদু হাসলো। লোকটার শরীর থেকে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ওঠা শুরু হয়েছে। কৌশিক ভাবলো, অনন্যাও যদি বিশেষ কেউ না হতো ওর প্রাণটাও এভাবেই যেতো। শুধু কৌশিকের পছন্দ বলেই মেয়েটা এখন বেঁচে গেছে।
কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রেলিংটি ধরলো। হঠাৎ, এক মুহূর্তে তার ভিতর জমে থাকা রাগ ছুঁড়ে দিয়ে খুব জোরে চিৎকার করলো। শব্দটা পুরো বিল্ডিংকে কাঁপিয়ে দিলো। তারপর অপেক্ষা না করেই কৌশিক বহুতল ভবনের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেভাবেই উঠেছিল, সেভাবেই নেমে আসলো।
.
.
.
চলবে.........................................................................