আকাশে তখন দুপুরের লালিমা মুচকি হাসছে। ছন্নছাড়া শীত ক্লান্তির অযুহাত দিয়ে অবসরের পায়তারা খুঁজছে এইতো দুদিন হলো। গ্রীষ্মের অল্পসল্প তাপ এখন থেকেই বহমান, বাতাসে উষ্ণ উষ্ণ ঘ্রাণ। মানুষী গোসল সেড়ে বিছানায় বসল। চুলে আজ শ্যাম্পু করেছে সে। বোধকরি সেজন্যই আয়নায় সদা রুক্ষসূক্ষ হয়ে থাকা চুলগুলো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। স্নিগ্ধ হয়ে আছে তার মলিন মুখটাও। গামছা দিয়ে বার কয়েক ভেঁজা চুলের অগ্রভাগ মুছতে মুছতে ঘড়ির দিকে তাকাল মানুষী। কাঁটায় কাঁটায় একটা বেজে চৌত্রিশ। একটু পরেই ভাতের ডাক পরবে। অথচ পেটে ক্ষুধার তাড়া নেই। ক্ষুধাটা সেই রাত্রি থেকেই উধাও। নাস্তার টেবিলে সাদিফের অনুপস্থিতি তা আরও জোড়াল করেছে। মানুষী ভেবে পায় না, ইতর লোকটা থেকে সে দূরে থাকতে চায়। অথচ তাকে দেখতে না পেলেই মনের বিচ্ছিরি হাহাকারগুলো এত অসহনীয় তান্ডব শুরু করে! কেন? তার মন এমন কেন? তার মনের এ কেমন অবরুদ্ধ অবসাদ?
ফ্যানের নিচে চুল শুকাতে শুকাতে মানুষী ঝিমিয়ে উঠলো। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। চোখ তাই বিশ্রাম খুঁজছে, একটু ঘুমাতে চাচ্ছে। মানুষী কি একটু ঘুমিয়ে নেবে? পিঠ অব্দি চুলগুলো হাতে পেঁচালো সে। কৌশলে খোপা বাঁধলো। ঘরের দরজা ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই কোত্থেকে ভেড়াদের দল হঠাৎ হুমড়ে পরলো সেখানে। সাদিফ আর বাদল ছাড়া ধুতরা, প্রান্ত, মিতা, রঞ্জন, কৃষ্ণ! কেউ বাদ নেই। সহসা মানুষীর ভ্রু কুঁচকে যায়। শুধায়, "তোরা এসময় এখানে কি করছিস?"
ধুতরা হাতের কালো জামদানি শাড়িটা সযত্নে বুকে চেপে ধরলো। ক'দিন আগেই অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে আনিয়েছে সে। গাঢ় কালো শাড়ির সারা গায়ে চিকচিকে সোনালী রঙের লম্বালম্বা দাগ। সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শাড়িটা ভালোভাবে মেলে ধরে ধুতরা হাসি হাসি মুখ করে বলল, "আজকে ভাবছি রাজীব চাচার মেয়ের বিয়েতে এই শাড়িটা পরবো, আপা। আমাকে সুন্দর লাগবে না, বলো?"
মানুষী ছোট্ট উত্তর দেয়, "হু, লাগবে।"
এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষই চালচুলোহীন। ছোট ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য উপাধি 'নিখুঁত বেয়াদব'। কোনোকালেই এদের কাছে অন্য মানুষের প্রাইভেসি নামক নূন্যতম স্বাধীনতা নেই। কখনো ছিল না। বলতে মানা, মানুষীও ইতিউতি করে ওই একই রাস্তার অদৃশ্য পথিক। বংশপরম্পরায় পেয়েছে কি-না! কিন্তু এই মুহুর্তে তার মনটা খারাপ। ঘুমে শরীর ক্লান্ত। সেজন্যই ভাইবোনদের এহেন অসভ্যের মতো তার বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার ব্যাপারটা ক্ষীণ বিরক্ত করলো ওকে। তেঁতে ওঠা কণ্ঠে বলল, "তোরা এক্ষুণি আমার রুম থেকে বেড়িয়ে যাবি। আমি ঘুমাবো।"
মিতা মুখ ফুলালো ক্ষণেই। নিষ্পাপ স্বরে বলল, "এমন করছিস কেন মানুষী? এখনো তো দুপুরের ভাত খাওয়া বাকি! এ অসময় ঘুমাবি?" এরপর একটু থেমে আবার বলল, "আমাকে তোর থেকে একটা শাড়ি দেনারে... নীল রঙের দিস।"
মানুষী সবে সবে ড্রেসিংটেবিলের তিন পায়ের ছোট্ট চেয়ারে বসেছিল। মিতার কথায় 'আচ্ছা' বলে উঠে দাঁড়াল। আলমিরার কাছে গেল। তার ঘরের আলমিরাটা বড় পুরোনো ধাঁচের। দাদাজানের পছন্দের অভিজাত আলমিরা। খুলতে-লাগাতে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হয়। বাবা বহুবার মানুষীকে বলেছেন এটা ফেলে দিতে। তিনি সেগুন কাঠের বড়সড়, নতুন দেখে একটা বানিয়ে দেবেন। মানুষী রাজি হয়নি। দাদাজানের মতো এই আধভাঙ্গা আলমিরা তারও ভীষণ প্রিয়। মনে হয়, দাদা-দাদির হাতের তীব্র স্পর্শ এখনো স্পষ্ট লেগে আছে ওতে।
দু'পাশের দরজা খুলে মানুষী কিছুক্ষণ হেঙ্গারে সারিবদ্ধ শাড়িরগুলোর দিকে চেয়ে রইলো। শেষের সাড়িতে সাদাসিধে নীল ঝুম শাড়ি পেয়ে যেতেই হাত বাড়িয়ে নিল ওটা। মিতাকে দেখিয়ে বলল, "আমার কাছে নীল শাড়ি তেমন নেই। একটাই আছে। হবে এটা?"
মিতা দৌঁড়ে এসে শাড়িটা নিলো। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। তার বেশ পছন্দ হয়েছে। পরক্ষণেই আলমিরার ভেতরে একবার উঁকি দিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো, "তুই কি পরবি রে?"
মানুষী উত্তর দিতে সময় নিল। সে এখনো এ বিষয়ে ভেবে দেখেনি। আলমিরায় আরেকদফা চোখ বুলিয়ে শাড়ি খুঁজতে লাগলো। লাল রঙের একটা সুতী শাড়ি লহমায় চোখে বিঁধলো খুব। মিতাকে জিজ্ঞেস করল, "এ শাড়িটা কেমন হবে?"
"বিয়েবাড়িতে তুই সুতীর শাড়ি পরবি?"
ধুতরা, প্রান্ত দু'জনেই দু'দিক দিয়ে রঞ্জনকে ঘিরে ধরেছে। পেটুক রঞ্জন 'ফ্রি-ফায়ার' নামক আজীব খেলার ওস্তাদ। ওরে ধর! এইরে আমি মইরা যাইতেছি! দিছি মাইরা!— এমন অদ্ভুত অদ্ভুত চিৎকারে দু'হাতের বুড়ো আগুলের চাপে মোবাইলে সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে সে। মনোযোগ এদিকে নেই। অতি আগ্রহে ব্যাকুল ধুতরা আর প্রান্তরও সেই একই অবস্থা। তবে কৃষ্ণর আপাতত এইসব গেম-টেম ভালো লাগছে না। সে শুয়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে রঞ্জনের উরুর কাছে মাথা রাখলো। হামি ছেড়ে বলল, "কি শাড়ি, দেহি।"
মিতা হাত দিয়ে ইশারায় বলল, "লাল শাড়িটা। সুতীর।"
কৃষ্ণ মাথা এদিক ওদিক করে দেখার চেষ্টা করল। চোখ সরু করল। নাহ্! দেখা যাচ্ছে না। আলমিরার বাম কোণের দরজাটা বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খেঁকিয়ে বলল, "ওমনে দেহন যায়? তুই এদিকে আয়, দেহা যায় কি-না দেখ!"
"তো? এখন আমি কি করবো?"
"মাথামোটা নাকি? শাড়ি আমার কাছে ফেক্কা মার।"
'মাথামোটা' বলায় মিতা বোধহয় একটু রাগই করলো। চোখ মুখ কুঁচকে অতি অবহেলায় কৃষ্ণের মুখের ওপর লাল রঙা শাড়িটা ছুঁড়ে মারলো সে। কৃষ্ণ অবশ্য সেসব গায়ে মাখেনি। উল্টেপালটে শাড়ি পরখ করার মাঝে আস্তে করে বলল, "লাল পরতেছিস কেন, মানুষী? লাল তো তোর বিয়ার সময় পরবি। সাদিফ ভাই আর তোর বিয়ার সময়।"
রঞ্জন বাদে তা আর কেউ শুনলো না, বুঝলো না। উরুতে থাকা কৃষ্ণের ভারী মাথায় শক্ত একটা টোকা মেরে রঞ্জন ফিসফিসিয়ে বলল, "গোবেচারা নাকি? এখনো কিছু ফাইনাল হয়েছে?"
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কৃষ্ণের উদাসীন নিশ্বাস, "হতে কতক্ষণ? বুঝি না বাপু! ভালোবাসলে বিয়া করতে কি পেঁচাল? চাচাগুলাও তো পক্ষেই আছে।"
"তুমি ওসব বুঝবা না। খালি নামেই কৃষ্ণ হইছো। কৃষ্ণের কোনো গুণ তো আজ পর্যন্ত তোমার মধ্যে পাইলাম না।"
কৃষ্ণ রেগে মেগে রঞ্জনের উরু থেকে সরে অন্যপাশের বালিশে মাথা রাখল। অভিমানের টইটম্বুর জেদ দেখালো নির্দোষ শাড়ির ওপর। বিছানার একপাশে যাচ্ছেতাই ভাবে ছুঁড়ে ফেলে বলল, "এইডা কোনো শাড়ি হইল? এই শাড়ি বাতিল। ক্যান্সেল!"
•••••••••••••••
সময়টা বিকাল বিকাল। সকালের রোদ্দুরের মিছেমিছি তাপ হঠাৎই চতুরতা দেখিয়ে ধোঁকার খেলায় মেতেছে। শীত এসেছে মুঠোয় ভরে শীতলতা নিয়ে। ঘরের বিশাল জানালাটা বরাবরই খুলে রাখা। মেঘলা মেঘলা ঠেকছে আকাশ। গর্জন দিচ্ছে। এই শীতে বৃষ্টি? ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকলো মানুষীর। এমন আগে কখনো হয়নি। এসময় বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। সে একবার জহুরি চোখে অশেষ আকাশের রহস্যে তাকাল। মেঘের আন্দোলন দেখল একটু সময় নিয়েই। বাড়িতে আপাতত সে আর শায়লা খাতুন ছাড়া কেউ নেই। তারা সবাই বিশিষ্ট মুদির দোকানদার রাজীবের ছোট মেয়ের বিয়ে খেতে গেছেন। মানুষীর যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহুর্তে সে যায়নি সাদিফের জন্য। লোকটা চূড়ান্ত রকমের নির্দয়, পাষাণ। কালরাতে এতকিছু হওয়ার পর হঠাৎই উধাও হয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। নাস্তার টেবিলে তাকে পাওয়া যায়নি। সিগারেটের অযুহাতে ছাদেও তার পদার্পণ ঘটেনি। আর না দুপুরে ভাত খেতে এসেছিল। অথচ... অথচ বিকেল হতে না হতেই মহাশয় কোত্থেকে রকঢক করে হাজির হয়েছিলেন বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার জন্য। সে কি নায়ক নায়ক ভাব তার! সে কি মাধুর্যতা যত্নহীন মুখখানায়!
মানুষী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে। বিছানায় অনাদরে পরে থাকা সুতীর লাল শাড়িটায় চোখ যেতেই তা গায়ে জড়ানোর বড্ড লোভ জাগে তার। শাড়িটা হাতে নেয়, আস্তে আস্তে গায়ে জড়ায়, পরে। অনেকদিন বাদে নিজে নিজে শাড়ি পরায় আঁচলটা বড় দিয়ে ফেলেছে। মেঝে ছুঁইছুঁই লাল কাপড়। মানুষী আঁচলটা কাঁধে তুলে নিল। খোপা বাঁধা চুলগুলো খুলে দেওয়ার মাঝেই মেঘের ভারিক্কি গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠল খুব। নিশ্বাস সামলে সামনে তাকাতেই ফের কাঁপল! সাদিফ দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর নয়নে চেয়ে দেখছে তাকেই। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, লোকটার নিশ্বাস ভারী, অস্থির কিংবা মাত্রাতিরিক্ত স্থবির। চওড়া বুক অল্পসল্প উঠা-নামা করছে। মানুষী আশ্চর্য হয়ে কয়েক মুহুর্ত কথা বলতে পারলো না। বিমূঢ়তায় আষ্টেপৃষ্টে থাকা ঢোকটা গিলে কোনোমতে কাঁধের আঁচল নিচে নামালো। দৃশ্যমান ফর্সা পেট ঢাকলো কি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে! পরপরই অতি গম্ভীর গলায় শুধাল, "আপনি এখানে কি করছেন, সাদিফ ভাই?"
সাদিফ জবাব দেয় না। কথা কয় না। সে এক অদ্ভুত আচরণের বেড়াজালে আটকে গেছে। যার শুরু জানা থাকলেও শেষের পথটা নড়বড়ে। হারিয়ে যাওয়ার একটা বিশ্রী সম্ভাবনাও আছে। সেই হারানো পথকে খুঁজতেই সাদিফ ব্যগ্র পায়ে মানুষীর কাছে এগিয়ে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে মানুষীকে। হাতের বাঁধন দৃঢ়। লুকিয়ে রাখা নিশ্বাসটা তীব্রতা পেয়েছে হঠাৎ। বুকের বা'পাশে পিষে থাকা মানুষী হাঁসফাঁস করলো। দমবন্ধ অনুভূতিতে কাঁতরে উঠলো। কিন্তু বাঁধা দিলো না। কানের কাছে সাদিফের ধুকপুক হৃদযন্ত্রের আওয়াজ শুনতে পারছে সে। অনুভব করতে পারছে অশান্ত ইতরটাকে।
দৈবাৎ, উঠান থেকে বাইকের তীব্র হর্ণের শব্দ এলো। একবার, দু'বার, পরপর তিনবার! অনুভূতির সাগরে শক্ত হয়ে থাকা মানুষীকে আচমকাই সরিয়ে দিলো সাদিফ। চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই। মেয়েটাকে বউ বউ রুপে দেখে সাদিফের পৌরুষ মনে যে অবাঞ্ছিত অনুভূতির জোয়ার এসেছে, তা প্রকাশ করার মনোবল নেই। বরং তৎক্ষণাৎ সে বেরিয়ে গেল মানুষীকে একা ফেলে। পথিমধ্যে শায়লা খাতুনের সাথে দেখা হতেই তিনি যারপরনাই অবাক হলেন, "কি ব্যাপার সাদিফ, তুই এখানে কি করছিস? বিয়েতে যাসনি?"
সাদিফ শুধু উত্তর দেয়, "চলে যাচ্ছি চাচি। আম্মাকে বলে দিয়েন, আর ফিরবো না।"
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষী একটু একটু করে নিশ্বাস ফেলে। বুক চিড়ে, খুব আস্তে। জানালা গলিয়ে হুরহুর করে বাতাস ঢুকছে। মেঝে ছুঁইছুঁই আঁচল দুলছে। দুলছে মানুষীর চুলগুলোও। চোখ-মুখ ঢেকে দিয়ে চোখের টলটলে অশ্রু ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টায় মেতেছে ওরা। মানুষী অবশ্য কাঁদে না। আকাশের কালো মেঘগুলো যেমন বৃষ্টি আসবে বলে হুট করে উড়ে গেছে, মানুষীর অশ্রুরাও অভিমানে মিইয়ে যায়। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ছুটে দিকবেদিক শূন্য হয়ে। কানে বাজে ‘কণ্ঠ’ সিনেমার দুটো বিখ্যাত ডাইলগ — শুধু কথা বলা হয়নি বলে কত সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। শুধু কথা বলা হয়নি বলে কত মানুষ আমাদের থেকে দূরে চলে গেছে।
.
.
.
চলবে......................................................................