মাহিন শব্দ করে হেসে ডেকে বলে,
‘অ্যাই-যে ফায়াজ-ফাইজার বাবা, ভালো আছেন? মন মেজাজ ভালো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
তন্ময় ঘুরিয়ে কেবলই সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরেছে। অন্যদিকে রিয়ান হকচকিয়ে ওঠে। প্রশ্ন করে,
‘ও ভাই, কী মিস করলাম? ফায়াজ-ফাইজা কে?’
মাহিন হাসতে হাসতে বলে, ‘কে আবার? তন্ময়!’
সৈয়দ আশ্চর্য হয়ে পড়ে। আপদমস্তক নির্বিকার তন্ময়কে দেখে বলে,
‘এতো ফাস্ট? এইতো বাসরটুকুও করতে চাইছিলি না। বিড়ালের মতন লেজ আকাশে তুলে মাছের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলি। আমরাই তো জোরপূর্বক মাছ সামনে সার্ভ করে খেতে বাধ্য করলাম। আমরাই তো সবকিছুর বন্দবস্ত করে দিলাম। অথচ এখন দেখি তলে তলে আনবর্ণ বাচ্চাদের নামধামও ডিসাইড করে আছিস। তাও আবার দুটোর! আশ্চর্যজনক।’
ইব্রাহিমের হাতে জুসের গ্লাস। সে গ্লাসে মুখ দিতে ভয় পাচ্ছে। দেখা যাবে খেতে নিচ্ছে এসময় এমন কিছু বলে বসল যে তার মাথায় জুস উঠে গেছে। কাশতে কাশতে জীবন যাবে পরে। এমন অভিজ্ঞতা হাজার খানেক হয়েছে তার ইতোমধ্যে। তাই আর রিস্ক নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এই অসভ্যদের মধ্যে শান্তভাবে খাওয়াও বিলাসিতা। বিড়বিড় করে এযাত্রায় বলে,
‘এখনো জানিস না দেখছি? শালার লাক না যেন খোদাই করা স্বর্ণ! অরুর আলট্রাসনোগ্রাফিতে জমজ বাচ্চা ধরা পড়েছে। এক ঝটকায় প্রেগন্যান্ট করিয়ে তো ফেলেছেই তাও আবার দুটো বাচ্চার!’
তন্ময় থমথমে চোখে ইব্রাহিমের দিকে চাইতেই ইব্রাহিম মুখ ঘুরিয়ে চুপসে যায়। রেস্টুরেন্টের ছাঁদে তখন বেশ শোরগোল, মানুষজন। বন্ধুরা তারা বসেছে পূর্বদিকে চার টেবিল জুড়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ভরা মজলিসের মধ্যেই হৈহৈ করে ওঠে সবগুলো। উচ্চ শব্দ শুনে আড়চোখে সবাই চাইছে এদিকটায়। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুধায়,
‘তোরা বাসায় যাবি না?’
ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে বারোটা চল্লিশে। চল্লিশ মিনিট ধরে এই বাঁদরগুলো তাকে আঁটকে রেখেছে। নেহাতি বন্ধুবান্ধবদের আকুতি-মিনতি রক্ষার্থে এসে হাজির হয়েছিল। রিয়ান তখনো কৌতুহলী হয়ে আছে জানতে,
‘তা নাহয় বুঝলাম, তবে এই নাম রেখেছে? ভবিষ্যৎ দেখেছিলি নাকি যে দুটো হবে?’
মাহিন ফের খিলখিল করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
‘আমাদের অরু রানি রেখেছে। ছেলে হলে ফায়াজ, মেয়ে হলে ফাইজা। এখন ছেলে, মেয়ে দুটোই হচ্ছে। তাই নামও ওলরেডি ফিক্সড।’
শুহানি তন্ময়ের ফোনটা নিয়ে অরুর ছবি দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মেয়েটার মুখ ফুলে গেছে। শরীরও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। এক অদ্ভুত সৌন্দর্য এসে ছুঁয়েছে সম্পূর্ণ ওকে জুড়েই।
সৈয়দ আবদার ধরে এবেলায়, ‘বাসায় একদিন দাওয়াত দে না, দোস্ত! অরুকে একটু দেখি। ছবিতে কী মিষ্টি লাগছে, একদম নাদুসনুদুস।’
তন্ময়ের প্রত্যুত্তরটুকু কাটকাট, কঠিন শোনায়,
‘না। কখনো না।’
রিয়ান ঠোঁট ফোলায়, ‘আমার ডার্লিংকে একটু দেখতে দিবি ন….’
তন্ময়ের কালো মুখ দেখে কথাটুকুর পূর্ণতা করার সাহস রিয়ান আর পায় না। আলগোছে মুখ বন্ধ করে ফেলে। একটু ডার্লিং ডাকলে কী এমন হয়েছে? তন্ময়টা না যাচ্ছেতাই!
———
ভোরের মিঠে-মিঠে রোদ্দুর এসে ছুঁয়েছে বেলকনির ফ্লোর। দুটো পাখি এসে ঘুরছে এদিক-ওদিক জুড়ে। বেলকনির রেলিঙে ঝুলানো ফুল গাছগুলোতে কিছুক্ষণ আগেই জবেদা বেগম পানি দিয়ে গিয়েছেন। পানির সংস্পর্শে এসে ভেজাটে ফুলগুলো দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে। ফুলের পাপড়ি থেকে টুপটুপ করে এখনো পানি ঝরছে। তন্ময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে সবেমাত্র। এসেই দাঁড়িয়েছে বেলকনিতে। গলায় রাখা তোয়ালে দিয়ে বেশ অবহেলিত ভঙ্গিতেই মাথার চুলগুলো মুছে নিচ্ছে। দৃষ্টি গিয়ে থামে বাগানের দক্ষিণ দিকটায়।
সেখানটায় এই সাতসকাল বেলায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহজাহান বাড়ির বেশ কিছু সদস্য। তাদের সবার দৃষ্টি — গর্ভধারিণী অরুর ওপর। অরুর ছয় মাস চলছে। মাসের তুলনায় পেট অস্বাভাবিক বড়ো। কিছুদিন আগেই তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে জমজ বাচ্চা ধরা পড়েছে। একটি ছেলে আর ওপরটি মেয়ে। এরপর থেকেই বাড়ির ভেতরে এক থমথমে পরিস্থিতি। আনন্দের মধ্যেও সবাই চিন্তায় অশান্ত হয়ে আছে। অরুর বয়স কম, অল্পবয়সী প্রেগ্ন্যাসির মধ্যেই আবার জমজ বাচ্চা! ও যে তাদের হাতের ননির পুতুল। এই পুতুল জমজ বাচ্চার মাতৃত্বের স্বাদ আদতেও নিতে পারবে তো?
তন্ময় নিজেও দুঃশ্চিন্তায় আজকাল ঘুমোতে পারছে না। আজ ক'টা দিন ধরেই সে বড্ড বিচলিত। এতো অশান্তি লাগছে ভেতরে। বাবার হওয়ার আনন্দটুকুও সে উপভোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জমজ বাচ্চার ডেলিভারি প্রসেস আতঙ্কজনক। ডিফিকাল্টিস বেশ হাই। তন্ময় ডাক্তার থেকে নিপুণভাবে শুনেছে, জেনেছে।
অসহায় লাগছে তার।
বাড়ির বুজুর্গদের অবস্থাও তন্ময়ের মতনই—কাছাকাছি। জবেদা বেগম আর সুমিতা বেগম অরুর পেছনেই লেগে থাকেন চব্বিশঘণ্টা। ওর প্রতিটা পদক্ষেপ যেন তাদের ইশারায় ফেলতে হবে। এতে অরু মহা বিরক্ত! চঞ্চল সে গৃহবন্দী হয়ে তো আছেই, সাথে একেকটা কদমও তাকে গুনে-গুনে ফেলতে হয়। গতকাল রাতেও সে তন্ময়ের কাছে আহ্লাদী স্বরে নালিশ জানিয়েছে। তন্ময় শুনেছে বেশ মনোযোগ সহকারে। তবে শোনা পর্যন্তই। নালিশ কানে তোলেনি। সেই ব্যপারটি ধরে অরু এখনো মুখ ফুলিয়ে আছে। কথাবার্তা বলছে না। অল্পতেই মুখ ভার করছে, কাঁদছে…অভিমান করছে। ডাক্তার বলেছেন এসময়টায় ওর অনুভূতির ঘুর্ণিঝড় বয়ে যাবে। আর তা তার ওপরেই। শাহজাহান তন্ময়ের ওপর!
মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে চেয়ে আছেন শূন্যে। যেন জগৎ সংসারের ওপর তিনি অতিষ্ঠ। খুব শীঘ্রই বেরিয়ে পড়বেন অজানার উদ্দ্যেশ্যে। হাতে তার চায়ের কাপ। গরম চা থেকে এখনো ধোঁয়া উড়ছে। সুমিতা বেগম মাত্রই দিয়ে গিয়েছেন। তন্ময় এসে বসেছে ভদ্রলোকের পাশেই। সে কফি নিয়ে এসেছে এক মগ। হাতের ল্যাপটপটা রেখেছে টেবিলের ওপর। পায়ের ওপর পা তুলে চায় অদূরেই। অরু ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। পাশেই রুবি দাঁড়িয়ে আছে। দীপ্ত প্রজাপতি ধরতে ব্যাকুল। তন্ময় ওদিকে চেয়েই কফির মগে চুমুক বসায়। মৃদু বাতাস বইছে। পাখি ডাকছে। দারুণ এই সময়টা তন্ময় উপভোগ করতে পারে না। পূর্বেই বাবা নামক দুঃসম্পর্কিত শ্বশুর ক্যাটক্যাটে কণ্ঠে বলে ওঠেন,
‘খুব আমোদেই কফি খাচ্ছো দেখছি।’
তন্ময় জানে তার পিতা মহাশয় কী নিয়ে তার ওপর বিরক্ত! দুটো বাচ্চা তো তন্ময়ের কাণ্ডে আসেনি। আল্লাহ্ এর ইচ্ছেতেই এসেছে। তাই নয় কী? কিন্তু এই ভদ্রলোক সেই বিষয় নিয়ে তন্ময়ের ওপর চটে আছে। আশ্চর্য!
‘কেঁদে কেঁদে খাব?’
তন্ময়ের সরল প্রশ্নের বিপরীতে মোস্তফা সাহেব তীক্ষ্ণ ভাবে চোখ রাঙান। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন,
‘না কেঁদে কেঁদে কেনো খাবা? হেসে হেসে খাও।’
তন্ময় ফের মগে চুমুক বসায়। নির্বিকার কণ্ঠে বলে,
‘হাসতে ইচ্ছে করছে না আপাতত। তোমার হাসি আসলে আমায় ধার দিও, বাবা। তোমার জন্য নাহয় একটু হেসে হেসেই কফি খাব।’
মোস্তফা সাহেবের থমথমে মুখখানা আরও থমথমে হয়ে এলো। নাক ফোলালেন। বিরক্তিতে মুখ ভোঁতা করে বাঁকাচোখে ছেলেকে দেখলেন। তন্ময় যেন বাবার ওই ধারালো দৃষ্টি দেখেও দেখল না। ভদ্রলোককে সুযোগ দিলেই তাকে পেয়ে বসবে। মোস্তফা সাহেব মিনমিনে গলায় আওড়ালেন,
‘দামড়া ছেলে তুমি কিচ্ছুটি কী বুঝো নাই? গাফলতির দ্যাখো কী পরিণাম দাঁড়িয়েছে।’
তন্ময় যেন শুনেও শোনে না। তবে প্রত্যুত্তর করবে না করবে না করেও, করে বসে শেষমেশ,
‘তুমি দাদা হচ্ছো।’
মোস্তফা সাহেবের কথাটুকু বুঝতে সময় লাগে। গুরুগম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ ছেলের উদাস মুখপানে চেয়ে রন। অবশেষে তিনি হনহনিয়ে উঠে চলে গেলেন। পিতা নামক দুঃসম্পর্কিত শ্বশুরকে বিরক্ত করে তন্ময়ের মন ভালো হয়ে আসে অনেকাংশে। সে বেশ আরাম করে কফিতে চুমুক বসাতে বসাতে অরুকে দেখে। মেয়েটা ম রে যাওয়া ফুল নিয়ে হাহুতাশ করছে। রুবি স্বান্তনার বুলি আওড়াচ্ছে। এযাত্রায় ফিরে চায়। তন্ময়ের চোখে চোখ পড়তেই মুখ ভেঙায়। মাথা ঘুরিয়ে ফের ফুল দেখতে ব্যস্ত হয়। ও কী জানে ওভাবে মুখ ভেঙালে তন্ময়ের ভেতর কিছু একটা হয়? তছনছ হয় ভেতরটা? জানে? জানে না। জানার কথাও না।
———
অরুর জন্য সিঁড়ি ঘরের রুম ফাঁকা করা হয়েছে। ক'মাস ধরে এই রুমেই সে থাকে। তন্ময়কেও ঘুরেফিরে এই রুমেই পাওয়া যায়। আজও ব্যতিক্রম নয়। অরু বিছানার অন্যপাশে গিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে৷ রাতের খাবার খায়নি এখন অবধি। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে ন'টায়। তন্ময় হাত ঘড়ি খুলে রাখতে নিয়েই ডাকে,
‘অরু? খেতে আয়।’
অরু আরও ঘুরে বসে। পিঠ দেখিয়ে আওড়ায়,
‘খাব না।’
তন্ময় ওর দিকে এগুতে নিয়ে শুধায়,
‘কেনো খাবি না?’
অরুর প্রত্যুত্তর বাঁকা, ‘আপনার জানা লাগবে না।’
তন্ময় এসে দাঁড়ায় অরুর সামনে। গাল দুটো রক্তিম হয়ে আছে। ফুলো ফুলো গাল দুটোকে আবার কেমন ফুলিয়ে রেখেছে টমেটোর মতন। চুলে তেল দিয়ে দুটো বিনুনি গেঁথে দিয়েছে জবেদা বেগম। দেখতে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। আর এই বাচ্চার পেটেই তার নাকি দুটো বাচ্চা! ভাবতেই তন্ময়ের মেরুদণ্ড বেয়ে শিহরণ ছুটে যায়। সেই অনুভূতি বড্ড অদ্ভুত। তার পুরো পৃথিবীটাই যেন শুধু ওর সামনে এসে থমকে গেছে। সে পকেট হাতড়ে পায়েলের বক্সটা বের করে। কিনেছিল গতকাল রাতে, ফেরার পথে। মেয়েটা অভিমান করে কাছেও আসেনি, দেবার সুযোগও হয়নি। এবারে এসে তন্ময় বসে অরুর পাশেই। বক্স থেকে পায়েলটা বের করে আলতোভাবে অরুর পা’টা বিছানায় রাখে। পায়েলটা পরিয়ে দেয় খুব যত্নের সাথে। অরু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। চোখে কতশত প্রশ্নের বাণ। সেই প্রশ্নের বাণ এড়িয়ে তন্ময় ফের উঠে দাঁড়ায়। আর একটা কথাও বলে না। হঠাৎ করেই কোমর বেঁকিয়ে অরুকে পাজাকোলে তুলে নেয়। অরু হকচকিয়ে ওঠে। অস্পষ্ট আর্তনাদ করে। দ্রুত জাপ্টে ধরে তন্ময়ের গলা। সে কী ভারী! এই তাকে মানুষটা কীভাবে তুলতে পারে? তন্ময় ইতোমধ্যে এগুতে শুরু করেছে দরজার দিক। অরু প্রথমে আশ্চর্য হয়। রুম থেকে বেরুতে দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে,
‘কই নিচ্ছেন? নামান, নামান। বাইরে সব্বাই আছে তো।’
তন্ময় কী শুনলো? বোধহয় না। খুব ধীরস্থির কদমে এগুতে থাকল নিজের মতোই। অরু চোখমুখ আতঙ্কে, লজ্জায় বুজে নিয়েছে। শক্ত করে ধরেছে তন্ময়ের গলা। লিভিংরুমে উপস্থিত সকলের মুখ তখন হা হয়ে আছে। মোস্তফা সাহেবের হাত থেকে বাদাম পড়ে গিয়েছে। আনোয়ার সাহেব থতমত চেহারায় চেয়ে আছেন। তন্ময় কোথাও চায় না। সোজা ডাইনিং এসে চেয়ারে বসিয়ে দেয় অরুকে। জবেদা বেগম বেয়াকুবের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন এহেন দৃশ্যে। তন্ময় বলে,
‘ওকে খেতে দাও।’
যেন হুঁশ আসে জবেদা বেগমের। তিনি আমতাআমতা করেন,
‘ওহ, হ্যাঁ। দিচ্ছি, দিচ্ছি। তুইও বোস।’
অরু মাথা নত করে রেখেছে। রীতিমতো লজ্জায় মেয়েটা এইটুকুন হয়ে আছে। তন্ময় পাশের চেয়ার টেনে বেশ সাবলীল ভাবেই বসে খেতে। আগ বাড়িয়ে অরু প্লেট উল্টে দেয়। অথচ পেছনে অনেক গুলো চোখ বড়ো বড়ো চোখে তাদের দুজনকেই দেখছে।
.
.
.
চলবে.......................................................................