আশিয়ানা - পর্ব ৮৩ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


রোদ ঝলমলে আকাশ হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হতে শুরু করে। ঘড়ির কাঁটায় তখন তিনটা ছুঁইছুঁই। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে, যেন গভীর রাত নেমেছে। মূহুর্তে দমকা হাওয়ার আর বজ্রপাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ তার কাজকর্ম ফেলে তারাহুরো করে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। সামান্য বৃষ্টি তারপর শুরু হয় ঝড়। গাছের সবচেয়ে নিচু ডালটা টিনের চালে ঘষা খাচ্ছে। অদ্ভুত কটকট শব্দ হচ্ছে। জানালার দ্বার খুলে বাহিরে তাকালেন মাসুদ মিয়া। বহু বছর পর তিনি এমন ঝড় আবারও দেখছেন। বিছানার উপর উবু হয়ে শুয়ে আছে তার ছেলে। বাপ ছেলে দু'জনে অসুস্থ। ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়েছেন। ঔষধ ঠিক মতো খাচ্ছে। এখন মোটামুটি ভালো আছে। মাসুদ মিয়ার বুকে ব্যথাটা বেড়েছে। সে সঙ্গে খুসখুসে কাশি। বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে। দিন আর মাস চোখের পলকে ফুরিয়ে যাচ্ছে যেনো।

পুতুল বেগম শোয়া থেকে উঠে বসলেন। মাসুদ মিয়ার পিঠে হাত রেখে বললেন, 'বেশিক্ষণ বসে থেকো না। শুয়ে পড়ো। যত দিন যাচ্ছে তোমার শরীরটা আরও খারাপ হচ্ছে। কতবার বললাম চলো শহরের কোনো হাসপাতালে যাই। সেখানে ভালো ডাক্তার পাবো।'

মাসুদ মিয়া কাশতে লাগল। বললেন, 
  'আমার পেছনে ফাউ খরচ করার দরকার নাই। এমনিতে আমার সময় শেষ হয়ে গেছে। তোমার আর পোলাটার জন্য জীবনে কিছু করতে পারলাম না। যতটুকু সঞ্চয় আছে। ওগুলো অন্তত আমার জন্য খরচ করিও না। ছেলের ও একটা ভবিষ্যত আছে। আর যদি সেসব টাকা ও শেষ হয়ে যায় তাহলে আমার বন্দের জমি আর গরু বাছুর এক এক করে বিক্রি কইরা দিও।'

পুতুল বেগম কান্না জড়ানো গলায় বললেন,
  'তুমি এইসব কি বলতেছো? তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? তোমার কিছু হইলে আমাদের কি হবে? তুমি এই জেদ রাখো। ঝড় কমলে আমরা কালই শহরে যাব। তুমি না থাকলে টাকা পয়সা দিয়ে কি করব?'
  'যা বলছি তাই শুনো। আর কথা বাড়াইও না। টাকা পয়সা রাখো। কাজে লাগব।' 
  'রোদেলা কে বলি। জামাই বাবা নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবেন।'
  'নাহ। সে আমাদের মেয়ের জামাই। তার থেকে সাহায্য চাওয়া উচিত না। মনের মধ্যে একটাই শান্তি মেয়েটা আমার কাছে আমার বোনের আমানত ছিল। একটা ভালো শক্তপোক্ত হাতে গিয়ে পৌঁছিয়েছে। সে তাকে সারাজীবন আগলে রাখবে। আমার দায়িত্ব এখানেই শেষ। আমার অসুস্থতার কথা ওকে বলবে না৷ মেয়েটা অনেক নরম মনের মানুষ। কোনো কিছুই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না। কান্না করে নিজের অবস্থা খারাপ করে ফেলে।' বলে থামলেন মাসুদ মিয়া।

পুতুল বেগম বললেন, 
  'মেয়েটা দুমাস ধরে তোমাকে দেখতে চাচ্ছে। ওর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছ তুমি। যাও এমনি একটু কথা বলো তাও দুই মিনিটের বেশি না। অনন্য সময় আমাকে মিথ্যা বলতে হয় তুমি বাসায় নাই এটা বলে। আর কত লুকিয়ে রাখব?'

মাসুদ মিয়া অসহায় চোখে তাকায়। বললেন, 
  'মা হারা মেয়ে। ছোটো থেকে আমার কাছেই মানুষ। এখন যদি আমার এই অবস্থা দেখে ওই দূর দেশে ওর কি অবস্থা হবে একবারও ভাবছো? ওর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা না বলারও কারণ রয়েছে, আমাকে দেখলেই মেয়েটা বুঝে যাবে আমার গুরুতর কোনো অসুখ হয়েছে।'
  'আমি আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবা ব্যস। নিজের কথা না ভেবে একবার ছেলের দিকে তাকাও।'

 মাসুদ মিয়া মাথা নিচু করলেন। আর কেউ না জানলেও তিনি জানেন ওনার মরন বেদী রোগ হয়েছে। ডাক্তার বলেছে হাতে বেশি সময় নেই। বেশি না হলেও একমাস। পরিবারের কাছে এই তিক্ত সত্যটা দু বছর ধরে লুকিয়ে রাখেন মাসুদ। একমাস আগে শহরে গিয়েছিল তখন ডাক্তার সরাসরি বলেন ওনার হাতে বেশি সময় নেই। আর মাত্র দুইমাস বাঁচবেন। এর মধ্যে একমাস শেষ। আর আছে এক মাস। পুরুষালী শরীর। সবসময় কাজকর্ম করা লোক হঠাৎ বিছানায় পড়ে গেছেন। আগের শরীর ও নেই। হাড় বেরিয়ে গেছে। দেখে মনে হয় কঙ্কাল। 

মাসুদ মিয়া লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন, 
  'মাথাটা ঘোরাচ্ছে। বিছানা করে দাও। একটু ঘুমাই।'

বিছানার ঝাড়ু দিয়ে বিছানা পরিস্কার করে দিলেন পুতুল। এরপর স্ত্রীর হাত ধরে বিছানায় শুলেন তিনি। বেশ খানিকক্ষণ স্ত্রীর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। এরপর চোখ বন্ধ করে ঘুম দিলেন।

ধীরেধীরে সন্ধ্যা নামছে। মসজিদের মাইকে মাগরিবের আযান পড়েছে। এতো বেলা অব্ধি কখনো ঘুমাননা মাসুদ মিয়া। গরু, ছাগলদের গোয়ালঘর থেকে ফিরে আসতে অনেক সময় লেগে গেল। বৃষ্টির জন্য সব জায়গা ভেজা। গোয়ালে গরুদের থাকতে আজ অনেক অসুবিধা হবে। পানি হেঁচে ফেলে তারপর খেড় দিয়ে জায়গাটা শুঁকনো করে তারপর বাড়ি এলেন পুতুল বেগম। হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে দেখল মাসুদ মিয়া এখনো ঘুমাচ্ছেন। বার কয়েক ডাকার পরও তিনি চোখ খুললো না। পুতুল বেগম এগোল। বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিতেই তিনি গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল। 

চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যার রাতের মতোই অন্ধকার নেমে আসছে পুতুল বেগমের জীবনে। স্বামী হারা স্ত্রী একমাত্র ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্না করছেন। শরীর অবশিষ্ট শক্তিটুকুও আর নাই। অবশ শরীর নিয়ে মাটিতে বসে আছেন পুতুল। চারিদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। খবর শুনে চৌধুরী পরিবার ও এসেছে। মাইমুনা এগিয়ে এসে পুতুল বেগমকে সামলাচ্ছে। সোহান ইতিমধ্যে ইতালি কল করে সেহরিশ কে খবর দিয়েছে।
ওরা আসবে জানিয়ে কল কেটেছে সেহরিশ।

সাদা রঙের কুকুরটার নাম রেখেছে রোদেলা। মিটু। সারাক্ষণ ওর পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায়। রোদেলার এখন একটা সঙ্গী হয়েছে। সেহরিশ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলার পাশে মিটু কে দেখে ও ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। মিটু আসার পর থেকেই জেনো সেহরিশের ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছে। 

রোদেলা সেহরিশের দিকে তাকিয়ে স্মিথ হাসল। সেহরিশ নিশ্চল হেঁটে রোদেলার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মাসুদ মিয়ার মৃত্যুর কথা জানাল তাকে। রোদেলা স্তব্ধ। চারিদিক থেকে হঠাৎ থেমে গেছে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল তার। বসা থেকে পড়ে যাবে এমন সময় সেহরিশ রোদেলাকে ধরে ফেলল। জ্ঞান হারিয়েছে। সেহরিশ রোদেলাকে পাঁজা কোলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। একজন স্টাফের উদ্দেশ্য বলল,
  'দ্রুত ডক্টর এডউইন কে আসতে বলো।'

সময়ের গতিপথ কখনো বদলায় না। শুধু থেমে যায় মানুষের আয়ু। একজন মানুষ চলে যায়। পেছনে রেখে যায় হাজারও গল্প ও স্মৃতি। কিছু মানুষের চলে যাওয়ায় রূহ অব্ধি কেঁপে ওঠে। রোদেলার জ্ঞান ফিরলো একদিন পর। অল্প অল্প করে চোখ খুলে সেহরিশ কে দেখল। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
  'আমার মামা।'

সেহরিশ আলতোভাবে রোদেলার হাতখানা মুঠোয় নিল। তারপর লহু কণ্ঠে বলল, 
  'তুমি রেস্ট করো রোদ। তোমার শরীর এখন অনেক দূর্বল।'

রোদেলার চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। প্রথমে একফোঁটা দুই ফোঁটা তারপর অঝোরে কাঁদতে লাগল সে৷ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলল,
  'আমার মামা। আমার মামা। আমাকে ছোটো থেকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে। কখনো আমার প্রতি অখুশি হয়নি। কতরাত আমার সঙ্গে জেগেছে। যখন আমার পরীক্ষা চলতো মামা আমার পাশে বসে থাকতো। আমার কি লাগবে সব কিছু মামা জোগাড় করে দিতো। সে মামা আমাকে একা ছেড়ে কিভাবে চলে গেল? আমি.. আমি এখন কি করব?'

রোদেলার উন্মাদনা দেখে সেহরিশ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সেহরিশ বলল,
  'রোদ। শান্ত হও। এই পৃথিবী খনিকের জন্য। যারা জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসছে তাদের একটা সময় পর যেতে হবেই। তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না।'
রোদেলা নিথর বসে আছে। ভাঙা গলায় বলল, 
  'আমার মামা। কিভাবে মারা গেল? অসুস্থ ছিল? ওরা আমাকে কিছু জানায়নি কেন? আমি কি তাদের কেউ নই? আমাকে এত দূরে কবে সরিয়ে দিল? নাকি আমি তাদের কখনো আপন ছিলামই না?'

সেহরিশ রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলল,
  'তোমার মামা চায়নি তোমাকে জানানো হোক। উনি জানেন তুমি ওনাকে কত ভালোবাসো। এমন সময় তার অসুস্থতার খবর শুনলে তুমি চিন্তা করতে। তোমার ভালোর জন্যই তোমাকে জানাতে দেয়নি।'

রোদেলা হাঁসপাস করে বলল, 
  'এমন ভালো আমি চাইনি। এমন নিষ্ঠুরতম ভালো তারা কেনো চাইলো আমার?'
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp