নবোঢ়া - পর্ব ৩৮ - ইলমা বেহরোজ - ধারাবাহিক গল্প


জাওয়াদ কোহিনূর বেগমের হাত ধরল, তারপর আস্তে আস্তে তাকে বিছানায় বসিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বলল, “গুলনূর... ওর মতো নিষ্পাপ, সরল মেয়ে আমি দুটো দেখিনি দাদিজান,” কণ্ঠটা নরম হয়ে আসে, “ও কথা বলতে না পারলেও শুনতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে, অনুভব করতে পারে। আমি যখন কথা বলি, ও শুধু চুপ করে শোনে। কোনো প্রশ্ন করে না, কোনো বিচার-বিশ্লেষণ করে না, শুধু শুনে যায়। ছায়ার মতো আমার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মনোযোগ দিয়ে শোনে।”

কোহিনূর বেগম নীরব রইলেন।

“আমি যখন দমবন্ধ অনুভব করতাম, ওর কাছে গিয়ে ক'টা কথা বললেই সেই অস্বস্তিটা কেটে যেত। মা সেটাকে অন্যভাবে নিয়েছে, বাবাও আমাকে ভুল বুঝে যা নয় তা বলে অপমান করেছেন। এত অপমানের পর আমি ওই বাড়িতে দম নিতে পারতাম না, দাদিজান।”

কোহিনূর বেগম চোখ সরু করে তাকালেন, “বাবার সঙ্গে রাগ হয়েছে তাই বাড়ি ছেড়ে চলে এলি বুঝলাম, সঙ্গে করে ওই মেয়েকে আনতে হলো কেন?”

জাওয়াদের চোখে হতাশা ছড়িয়ে পড়ল। বলল, “বাধ্য হয়ে, দাদিজান। আপনি তো মা’কে আমার থেকেও বেশি চেনেন। আমি যদি রাগের মাথায় একা বেরিয়ে আসতাম, মা কী গুলনূরকে আস্তো রাখতেন? ভালো থাকতে দিতেন? দুনিয়াতে ওই মেয়েটার নিজের বলতে কেউ নেই। বোবা, অবলা একটা মেয়ে, কোথায় যেত ও? আমাকে হারিয়ে মা কী ওর উপর সব রাগ মেটাতেন না?”

কোহিনূর বেগম এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন।

জাওয়াদের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, “মায়ের রাগের তোপে কী এর আগেও...!”

সে থেমে গেল। নিজের মায়ের কুকীর্তির কথা গুলনূরের সামনে বলতে গা শিরশির করে উঠল। শত ভুল থাকুক তবুও তো মা। জন্মদাত্রী মা! 

বলল, “আমি একা চলে এলে শান্তি পেতাম না। সারাক্ষণ মনের ভেতর অশান্তি হতো। গুলনূর না জানি কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে এসব ভেবে ব্যাকুল হয়ে থাকতাম! দাদিজান, আমি শুধু ওর ভালো চাই।”

কোহিনূর বেগম চোখ তুলে তাকালেন গুলনূরের দিকে। মেয়েটা নিঃশব্দে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

তিনি ধীর স্বরে বললেন, “ওর ভালোর জন্য সারাজীবন নিজের সঙ্গে রাখতে পারবি? এ কি সম্ভব?”

জাওয়াদ চুপ করে রইল। জানে, এ সমাজ, এ বাস্তবতা কখনো তাকে গুলনূরকে নিজের পাশে চিরকাল রাখার অনুমতি দেবে না। 

“না, দাদিজান। আমি জানি, এই সমাজে এটা সহজ নয়, বরং অসম্ভব। তবে...” সে একটু থামল, “এখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে একটা পুনর্বাসন কেন্দ্রের খোঁজ পেয়েছি, যেখানে অসহায় মেয়েদের নতুন জীবন শুরু করতে সাহায্য করা হয়। আমি চাই ওর একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ হোক। আমি ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে গুলনূরকে...”

কথাটা শেষ করতে পারল না। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে আসে।

“তুই শুধু একটা অসহায় মেয়ের ভালো চাস? গুলনূরের সঙ্গে এতটুকুই সম্পর্ক ?”

জাওয়াদ মাথা ঝাকাল, “জি, দাদিজান।”

“আর কিছু নয়?”

“না।”

“ওর একটা সুন্দর জীবনই তোর কাম্য?”

“ঠিক তাই।”

“যদি আমি সেই দায়িত্ব নিই?”

জাওয়াদ চোখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল।

কোহিনূর বেগম শান্ত গলায় বললেন, “গুলনূর আমার সঙ্গে থাকবে। আমি ওর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করব। এমন ঘরে বিয়ে দেব, যেখানে ও মেয়ে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে।”

সমাজের কত অনাথ, নিঃসঙ্গ মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন কোহিনূর তার কোনো হিসাব কেউ রাখেনি, তিনিও রাখেননি। 
তবু কথাটা শুনে জাওয়াদের গলা শুকিয়ে এলো। নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করল, “আপনি সত্যিই ওর দায়িত্ব নেবেন?”

কোহিনূর বেগম চোখের দৃষ্টি দিয়ে আশ্বাস দিলেন।

জাওয়াদ এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এতদিন ধরে গুলনূরের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে ছিল, অথচ এখন যখন সবকিছু এত সহজে গুছিয়ে যাচ্ছে, বুকের ভেতর কেমন খালি খালি লাগছে।

সে ঘাড় ফিরিয়ে গুলনূরের দিকে তাকাল। “তুমি দাদিজানের সঙ্গে যেতে চাও?”

গুলনূর চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিল।

জাওয়াদের ভেতরটা দমচাপা অনুভূতিতে ভরে উঠল।

গুলনূর আর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না এই ভেবেই স্বস্তি আসছে, কিন্তু একই সঙ্গে বুকের গভীরে একটা অজানা কষ্ট ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সেই কষ্টের কারণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না।

সে মুখ ফিরিয়ে নিল।

কিছু সম্পর্ক থাকে, যা পথ দেখানোর জন্যই সৃষ্টি হয়, পাশাপাশি থাকার জন্য নয়। গুলনূরের জীবনে সে ঠিক সেই মানুষটাই ছিল।

••••••••••••

রাতের আকাশ তারাদের ঝিলমিলে আলোয় মাখামাখি। একরাশ নৈঃশব্দ্য ভেদ করে শা শা শব্দে বইছে বাতাস। গুলনূর ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ আটকে আছে আকাশের অসংখ্য জ্বলজ্বলে বিন্দুর দিকে। 

জাওয়াদ এসে তার পাশে দাঁড়ায়। গুলনূরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তারার দিকে তাকিয়ে ডাকল, “গুলনূর।”

গুলনূর চমকে পেছন ফিরে তাকায়।

জাওয়াদ তার দিকে মুখ ফেরায়। চোখ দুটো গম্ভীর হলেও গলার স্বর নরম, “দাদিজানের মতো মানুষ হয় না। তুমি উনার কাছে খুব ভালো থাকবে।”

গুলনূর নিশ্চুপ। শুধু বাতাসের সাথে ওড়নার খোলা অংশ উড়ে যায় একপাশে।

জাওয়াদ একটু থেমে আবার বলল,
“উনি উপরে উপরে নিজেকে কঠোর দেখান, কিন্তু আসলে খুব নরম মনের মানুষ। একবার যদি আপন করে নেন, সারা জীবন আগলে রাখবেন।”

বাতাসে হালকা মিষ্টি গন্ধ। পাশের দেয়ালের পাশে রাখা তিনটে টবের দিকে চোখ পড়ে। তুলসি গাছগুলোর পাতায় হালকা দুলুনি, গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। দ্বিতীয় তলায় যে সনাতনী ভাড়াটিয়া থাকেন, এগুলো তারই গাছ।

জাওয়াদ বলল, “তুমি খুব ভালো থেকো, গুলনূর। খুব ভালো। আমি তোমাকে সারাজীবন মনে রাখব।”

গুলনূর এবার সরাসরি চোখের দিকে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হতেই এক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যায় জাওয়াদ। তার দৃষ্টি নেমে আসে গুলনূরের কপালের ডানদিকে, যেখানে একটা দাগ দুঃসহ স্মৃতির চিহ্ন হয়ে লেপ্টে আছে গাঢ় হয়ে। 

আজ কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছে, ওই কালো দাগের ওপর হাত রেখে চিরতরে ম্লান করে দিতে সেই ভয়ংকর স্মৃতি। জাওয়াদ অজান্তেই দুই কদম এগিয়ে আসে।

গুলনূর চমকে পেছনে সরে যায় এক পা। জাওয়াদ থেমে যায়। কী প্রগাঢ় অসহায়ত্ব বুকের সর্বত্রজুড়ে। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। বাতাস তখনও বইছে শা শা শব্দে, তুলসি গাছের পাতাগুলো দুলছে, আর আকাশের তারা তখনও জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

পরদিন। ফেরি থেকে নেমে কোহিনূর ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসলেন। গুলনূরের হাতে ছোট একটা ব্যাগ৷ ভেতরে জামাকাপড় আর কিছু টুকিটাকি স্মৃতি, যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আবেগের ভারে ঝুলে আছে।

একবারও না তাকিয়ে সে উঠে বসে ঘোড়ার গাড়িতে। জাওয়াদ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সারা পথ গুলনূর একবারও ফিরে তাকায়নি, অথচ সে সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিল নিঃশব্দে, স্থির হয়ে। 

কোহিনূর পর্দার ফাঁক দিয়ে একবার তাকালেন নাতির দিকে, কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলেন আপনমনে।

আসাদ লাগাম টানতেই ঘোড়ার গাড়ি সামনের দিকে ঝাঁকি খেল, ধুলো উড়ল বাতাসে। পাথুরে পথে ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। সেই প্রতিধ্বনি শুনে জাওয়াদের হৃদয়ের গহীন কোণে কিছু একটা যেন ছিঁড়ে গেল।

ঠিক তখনই গুলনূর পর্দা সরিয়ে পেছনে তাকায়।

জাওয়াদ সেই দৃষ্টির ভেতরে তলিয়ে গেল, নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। গুলনূরের চোখের গভীরে কিসের যেন অনুরণন, কিসের যেন অব্যক্ত ভাষা!

কিছু মুহূর্ত মাত্র।

ঘোড়ার গাড়িটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সীমানায়। দূর থেকে শুধু ঘোড়ার খুরের ম্লান শব্দ ভেসে আসে।

জাওয়াদ দাঁড়িয়ে রইল নিঃসাড়, একলা, অবাক বিস্ময়ে। এমন বিদায় সে কখনো দেখেনি, কখনো অনুভবও করেনি।

একটা দৃষ্টি ফেলে রেখে কেউ বিদায় নেয়?
একটা শূন্যতা উপহার দিয়ে কেউ চলে যায়?
একটা শব্দহীন আর্তনাদ রেখে কেউ হারিয়ে যায়?

ঘোড়ার গাড়ি ধুলোমাখা পথ বেয়ে ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে।

কোহিনূর বেগম অপলক চেয়ে আছেন গুলনূরের দিকে। মেয়েটি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে আছে। কিন্তু কোহিনূরের দৃষ্টি কেবল বাইরের নিস্তব্ধতা দেখছে না। তিনি দেখছেন তার গভীরে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত আকর্ষণ যা সকল শব্দের ঊর্ধ্বে।

কিন্তু এই আকর্ষণের গভীরতা কতটা? এটি কি কেবল মোহ, না কি হৃদয়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত গাঁথা কোনো অনুভূতির রূপ?

কোহিনূর পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালেন। পথের পাশেই নদী। ঢেউ খেলানো জলরাশি রৌদ্রের আলোয় প্রতিফলিত হয়ে ক্ষণিকের জন্য রূপোর মতো ঝলমল করে উঠছে। কয়েকটি নাও দুলছে নদীর বুকে।

নাওয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি হারিয়ে গেলেন বহু বছর পূর্বে।

সেদিনও এমনই এক নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। মামার বাড়িতে গিয়েছিলেন চাঁদপুরে। কত সুন্দর সেই গ্রাম, কত প্রাণবন্ত! ছোট্ট কুঁড়েঘর, নদীর তীরে বালুকাবেলা, দূর-দূরান্তে ফসলের মাঠ! 

মামার ছিল দুই কন্যা, প্রায় সমবয়সী। তিনজন কিশোরী মিলে গড়ে তুলেছিলেন দুষ্টু দল। মেয়ে হয়ে একা বাইরে যাওয়ার ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা, কিন্তু কে শোনে কার কথা? লুকিয়ে পালিয়ে নদীর ধার ঘেঁষে ঘুরে বেড়াতেন তারা।

তখনই পরিচয় হয় এক তরুণের সঙ্গে। যে একজন সাধারণ কর্মচারীর ছেলে ছিল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটে চলত বুনো বাতাসের মতো। প্রথম পরিচয় কৌতূহল জাগিয়েছিল, পরের কয়েকটি দেখায় সে কৌতূহল রূপ নেয় আকর্ষণে, আর তারপর... ভালোবাসায়।

কিশোরী কোহিনূর বুঝে গিয়েছিলেন, এই প্রেমের কোনো স্থান নেই সমাজের চোখে। কিন্তু আবেগ কি নিয়ম মানে?

মামার বাড়ি ছাড়ার আগে তরুণের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ফিরে আসবেন, এবং তখন আর কারও অনুমতি চাইবেন না।

তারা পালিয়ে যাবে।

কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি।

বাড়ি ফিরে কোহিনূর শুনলেন, তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বাবার সম্মান, পরিবারের মর্যাদার ভার তার কোমল কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হলো।

তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন বিনা প্রশ্নে।

নাইওর যাওয়ার পথে, স্বামীর ঘোড়ার গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলেন সেই তরুণকে।

একদল গ্রামের মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত অবস্থায়।

কিন্তু তার চোখ...

সে চোখে কেবল অভিমান ছিল না, ছিল যন্ত্রণার তীব্রতা, যেন দৃষ্টি দিয়েই বলে দিচ্ছিল, প্রতারক! তুমি প্রতারক কোহিনূর। তোমায় আমি কক্ষনো ক্ষমা করব না।

সেই দৃষ্টি আজও কোহিনূরকে তাড়া করে বেড়ায়। কত রাত ঘুম ভেঙেছে সেই চোখের স্মৃতিতে।

সম্মান রক্ষার জন্য তিনি একদিন নিজের হৃদয় বিসর্জন দিয়েছিলেন।

আজও তাই করবেন।

জমিদার বাড়ির চৌকাঠে পা দিয়েই গমগমে গলায় আসাদকে ডাকলেন।

“আসাদ, আজই তোর বাবা-মাকে চিঠি লিখে জানা, তোর জন্য পাত্রী ঠিক করেছি এবং এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি আমি শুনতে চাই না!”
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp