প্রেমান্বেষা - পর্ব ৩৩ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


সাদের এহেন কথায় যেনো দুম করে আকাশ থেকে জমিনে পড়লো স্মরণ। বিস্ময়ের চরম সীমায় সে। ছোট ভাই যে হবু বউয়ের সামনে এভাবে ইজ্জত লুণ্ঠন করতে পারে তা কল্পনাও করেনি। আজ সাদ স্মরণকে দেখাচ্ছে বাঁশ কত প্রকার ও কি কি। মেন্যু কার্ডের মতো অপশন দিচ্ছে বোধহয়। চিকন বাঁশ, লম্বা বাঁশ, কচি বাঁশ, বুড়ো বাঁশ, বেঁটো বাঁশ, মোটা বাঁশ, কোনটা খেতে চাও ভাইয়া। 

এদিকে নীলিমা পড়লো ভীষণ লজ্জায়। গা গুলিয়ে এলো তার। ছিঃ এসব কেউ বলে! সাদের মধ্যে নূন্যতম ভালোমানুষি দেখছে না সে। ছেলেটা কত বজ্জাত! হাড়ে হাড়ে যেনো শয়তানি লুকিয়ে আছে। লজ্জায় নীলিমা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

স্মরণ এবার ঠাস করে সাদের মাথায় গাট্টা মারলো। এতে সাদ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় পড়েই যেতে নিলো। কিন্তু এর আগেই নিজেকে সামলে সরু দৃষ্টিতে স্মরণের দিকে তাকালো। স্মরণ ওদিকে ক্রোধান্বিত গলায় বললো,
" আজকাল বহুত মিথ্যা বলতে শিখে গিয়েছিস। আজ বাসায় গিয়ে তোর মুখে সুপার গ্লু এঁটে দিবো। "

সাদ তার কথায় পাত্তা দিলো না। উল্টো নীলিমাকে আরোও বললো,
" ভাবো আপু, বিয়ের পর তুমি সকালে উঠে বাথরুমে ঢুকেছো। ঢুকতেই তীব্র গন্ধ এসে লাগলো তোমার নাকে। তখন ভাবো কি হবে? সকালটাই নষ্ট পুরো। "

নীলিমা এবার সরু চোখে তাকালো। সাদের হাঁটুতে কিল বসালো। কপট ক্রোধ নিয়ে বললো, 
" দিনকে দিন দুষ্টু হচ্ছো। এসব কথা কেউ বলে? ছিহ! "

স্মরণও এদিকে লজ্জায় হতভম্ব। নীলিমার সামনে বেঁচে থাকা মান সম্মানটুকুও ধুলোয় মিশে গেলো। ইশ, বিয়ের পর যদি এসব মনে আসে তবে! স্মরণ এবার সাদের কান চেপে ধরলো। পারে না টুঁটী চেপে ধরতে। কিন্তু একমাত্র ছোট ভাই। মারা-টারা যায় যদি! তাই শক্ত হাতে সাদের কান চেপে ধরলো সে। স্মরণের হাতের চাপে ব্যাথায় গোঙানি দিলো সাদ।

" আহ আহ, ভাইয়া ছাড়ো। কানে লাগছে তো। "

বলতে বলতে সে স্মরণের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। ওদিকে স্মরণ সাদের কান ছাড়ছে না। সাদও ছাড়া পাওয়ার জন্য লাফাচ্ছে।

" ভাইয়া সরি সরি। ভুল হয়ে গিয়েছে। এবারের মতো ক্ষমা চাই। "

স্মরণ দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
" তোর তো আজ ক্ষমা নেই। ব্যাটা আজ সারাটাদিন ধরে জ্বালাচ্ছিস আমাকে! এখন আবার মিথ্যা বলে নীলিমার কান ভরছিস! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! "

এদিকে দু'ভাইয়ের মধ্যে চলা মেকি দ্বন্দ্ব দেখতে লাগলো আশেপাশের মানুষজন। নীলিমা এবার উঠে দাঁড়ালো। স্মরণের হাত চেপে ধরে বললো,
" স্মরণ ভাই ওকে ছাড়ুন। আশেপাশের মানুষ দেখছে। "

স্মরণ তবুও ছাড়লো না। আজ তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। প্রেমিকার সামনে এভাবে অপমানিত হওয়ার কোনো মানে হয়!

সাদকে স্মরণ ছাড়লো না দেখে নীলিমা এবার চোখ রাঙালো। কঠোর চাপা গলায় বললো,
" থামুন স্মরণ ভাই। আশেপাশের মানুষজন দেখছে। ভিডিও শুরু হওয়ার আগেই ছাড়ুন ওকে। "

স্মরণ ক্ষণেই ছেড়ে দিলো সাদকে। সাদ বেচারা 'আহ উহ', শব্দ করতে করতে কান চেপে ধরলো। ইশ, কানটা গরম হয়ে গিয়েছে! হনুমানের পশ্চাৎদেশের মতো লালও হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই! সাদ অভিযোগের সুরে বললো,
" আজ তো কানটা টেনেই নিতে ভাইয়া! ছোট ভাইকে এভাবে মারে কেউ! আমাকে এভাবে মারার অধিকার নেই, বেশ! "

স্মরণও বললো,
" আর বড় ভাইয়ের মান সম্মান নষ্ট করার অধিকার আছে বেশ তাই না? "

ইতোমধ্যে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী এগিয়ে এলেন। স্মরণকে জিজ্ঞেস করলেন,
" কি ভাই? মারছেন কেনো উনাকে? "

সাদ এগিয়ে এলো মুহূর্তে। সে ভয় পেয়ে গিয়েছে। আজকাল তো সাধারণ ঘটনাকেও মানুষ তিল থেকে তাল বানিয়ে দেয়। দেখা গেলো এ ঘটনাকে মানুষ ফেসবুকে পোস্ট করে বেড়ালো। এই লিখে ছেড়ে দিলো, 'গাইস দেখুন, রবীন্দ্র সরোবরে এক প্রেমিকাকে নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে দুই প্রেমিকের। চলছে তাদের তুমুল লড়াই।' এসব খবর ছড়িয়ে পড়লে বাড়ির ঠিকানা ভুলতে হবে সাদকে। বাড়িতে থাকার জন্য হলেও এগিয়ে গেলো সাদ। প্রশ্নকারীর কাঁধে হাত রেখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো সে। বললো,
" ভাইজান, এটা আমার বড় ভাই। একটু মজা-টজা হচ্ছিলো আরকি। চিল করেন আপনি। আমি একদম নিরাপদ। "

লোকটি সন্দেহ নিয়ে তিনজনের দিকেই তাকিয়ে বললো,
" সত্যি তো? অন্য ঘটনা নাই তো আবার? "

" আরে ভাইজান! আপনে এতো প্যারা নিচ্ছেন কেনো। উনি আমার বড় ভাই। আর এই যে উনি হচ্ছেন আমার ভাবী। আমি একদম নিরাপদ। টেনশন নিয়েন না। "

লোকটি ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
" আরে আপনার নিরাপত্তা কে দেখতেছে মিয়া! আমি তো লেকের নিরাপত্তা নিয়া টেনশনে আছি। নিত্যদিন এসব ঝামেলা লাইগাই থাকে। কোথ থেইক্কা যে এসব পাবলিক আসে! আল্লাহ মালুম। "

বলেই লোকটি চলে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেলো সাদ। বোকা বনে গেলো সে। ধ্যাত, কোথায় ভাবছিলো লোকটা হয়তো তাকে নিয়ে চিন্তা করছে। কিন্তু এ কি হলো!

সাদ লোকটির যাবার পানে চেয়ে বিড়বিড় করে বললো,
" ভালোর যুগই নাই আজকাল। কালোর যুগ চলে। কালা দিয়ে ভরা চারপাশ। আর তার মধ্যে এক নাদান ধলা আমি। হাহ। "

এদিকে সাদ ও লোকটির কথোপকথনে হেসে কুটিকুটি হলো নীলিমা ও স্মরণ। স্মরণ বেশ মজা পেয়েছে। 

সাদ এবার নীলিমার সামনে এসে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কণ্ঠে আশ্বস্ত গলায় বললো,
" কিছু মনে করো না নীলুপু। আজ একটু বেশিই মজা করে ফেলেছি। ভাইয়াকে নিয়ে যা যা বলেছি বিশ্বাস করো না কিন্তু! ওসব মজা ছিলো। আমার ভাই আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। এটুকু গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো যে ভাইয়া সারাজীবন সুখে রাখবে তোমাকে। তা তো তুমি জানোই। "

বলেই সে স্মরণকে দেখিয়ে দেখিয়ে মিছেমিছি নীলিমার কানে কানে বললো,
" আর কোনো খারাপ দিক পেলে তোমাকে গোপনে জানাবো। শায়েস্তা করবে ভাইয়াকে। "

স্মরণের রাগ নিভেছে। এবার সে হাসতে হাসতে সাদের পিঠে আলতো কিল বসিয়ে বললো,
" সে সুযোগই দিবো না আমি। এবার যা তুই। ডেটের অর্ধেক সময় তো নষ্টই করে দিলি তুই। "

সাদ এবার মুখ বাঁকালো। বললো , 
" যাচ্ছি যাচ্ছি। অশ্লীল হও তোমরা।"

বলেই সে স্মরণের হাত উঠার আগেই ভোঁ-দৌড় দিলো।
 
নীলিমা এবার হাসতে হাসতে বললো,
" সাদ যে কি দুষ্টু হয়েছে!"

" শুধু দুষ্টু! আস্ত বজ্জাত হচ্ছে দিন দিন। "

নীলিমা এবার স্মরণের দিকে চাইলো। ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় শুধালো,
" শুনুন? সত্যিই তো সাদের কথায় সত্যতা নেই? "

স্মরণ জানে নীলিমাও মজা করছে। তাই সে-ও সুযোগ বুঝে মজা নিয়ে বললো,
" হুম। ও যা বলেছে সব সত্য। বিয়ের পর নাক ডেকে তোমার রাতটা নষ্ট করবো। আর ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে সকালটা নষ্ট করবো। ব্যস, তোমার দিনটাই নষ্ট। মজা না? "

নীলিমাও বুঝলো স্মরণের কথার গতি। সশব্দে হেসে সে স্মরণের বাহুতে কিল বসিয়ে বললো,
" তাহলে বিয়ের পর আপনাকে আলাদা ঘরে ঘুমাতে দিবো, আলাদা বাথরুম ইউজ করতে দিবো। "

বলে সমস্বরে হেসে উঠলো দু'জন। 

--------------

নীলিমা আজ ভার্সিটিতে যায়নি। সকাল থেকে ঘুমাচ্ছিলো। ঘুম থেকে উঠেছে সকাল ১২টায়। এ নিয়েই চেঁচামেচি করছেন মিলি বেগম। নীলিমা ওসব কানে তুললো না। সে এখন গিয়েছে সকালের নাস্তা খুঁজতে। ওদিকে মিলি বেগম ঘরদোর গুছাচ্ছেন। আর চেঁচাচ্ছেন। নীলিমাও ওদিকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" সকালের নাস্তা নেই আম্মু? "

মিলি বেগম নীলিমার বিছানা গুছাতে গুছাতে তেজী গলায় বললেন,
" মহারানী এখন সকালের নাস্তা খুঁজছেন! মাথা খা আমার। আর এসব কি হ্যাঁ? ঘুম থেকে উঠার পর বিছানাটা একটু গুছায় রাখা যায় না? কবে বুদ্ধি হবে তোর? উফ, দু বাপ বেটি মিলে আমার জীবনটা তছনছ করে দিলো। "

নীলিমা হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লো। কেনো যে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলো নাস্তার কথা! এর চেয়ে একটা ডিম পোচ করে খেলেও হতো। এই ভেবে সে ফ্রিজ থেকে ডিম বের করলো৷ কিন্তু যে-ই না চুলো জ্বালাতে যাবে ওমনই মিলি বেগমের গর্জন শোনা গেলো। 
" নীলিমা! এ্যাই নীলিমা? কই তুই? এদিকে আয়। "

নীলিমা দৌড়ে গেলো ভয়ে। নাহ, মা এখন ভয়ানক ক্ষেপে আছে! আজ আর তার নিস্তার নেই। 

নীলিমা ভয়ে ভয়ে রুমে গেলো। রুমে যেতেই মিলি বেগম তার মুখের সামনে ফোন ধরে বললো,
" এসব কি করছিস তুই? "

নীলিমা চমকে ফোনে তাকালো। দেখলো ম্যাসেঞ্জার থেকে স্মরণের ম্যাসেজ এসেছে,
" কি ব্যাপার নীলি? আজ সকালে একটু ফোনও দিলে না? জিজ্ঞেসও করলি না কিছু খেয়ে অফিসে গিয়েছি কি না। "

নীলিমার গলা শুকিয়ে এলো। এতদিন যার ভয়ে ছিলো শেষ সময়ে এসে সেটাই ঘটে গেলো। আর দু সপ্তাহ বাদে কোরবানি ঈদ৷ তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সমস্ত পরিবারকে জানাবে দুজন। অথচ এর আগেই তার মা জেনে গেলো। সেটাও আবার এভাবে!

নীলিমা শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। মিলি বেগমের মুখশ্রীতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একদিকে তিনি যেমন অবাক হয়েছেন, অন্য দিকে তেমন কঠিন রেগে আছেন। 

শক্ত গলায় মিলি বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
" তুই আর স্মরণ প্রেম করছিস নীলু? "

নীলিমার ভয়ে হাত পা অসার হয়ে এলো। সে জবাব দিলো না। মিলি বেগম এ নীরবতা দেখে ধমকে উঠে বললেন,
" বল আমাকে! "

নীলিমা কেঁপে উঠে উপর নিচ মাথা নাড়ালো। মিনমিনে স্বরে বললো,
" হু-হুম। "
চোখের পলকে মিলি বেগমের হাত উঠে গেলো।
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp