চাচ্চু বাদে বাকিরা যখন আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল ঠিক তখন আদনান বলে উঠলো,
"এই অপরাধে আমাকে রিজেক্ট করে দেবেন না প্লিজ। অনেক খারাপ সময় কাটিয়েছি। সাহায্য করার কেউ ছিল না। নিজের সবকিছু নিজেকেই ম্যানেজ করতে হয়েছে। তখন জানতাম না আমার জীবনে একটা তিন্নি আসবে আর তার পরিবারের সামনে আমাকে দাঁড়াতে হবে। তাহলে হয়তো আমি এমন কাজ করতাম না। আমি তিন্নিকে ভালোবাসি। আমার জীবনে সবকিছুর চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে। কখনো নিজের ফ্যামিলি এবং নিজের পথ চলার কঠিন সময়ের কথাগুলো কাউকে বলিনি। আজকে তিন্নিকে হারানোর ভয়ে কথা না বলা আমি এতকিছু বলে ফেলেছি।"
বাবা কিছু বলতে নিলেন,
"কিন্তু আদনান..."
বাবাকে কথা শেষ করতে দিল না আদনান। সে বলল,
"আংকেল আমি জানি মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য বাবারা যেরকম পাত্র পছন্দ করেন আমি সেরকম নই। একে তো ডিভোর্সি তার উপর আমার ফ্যামিলি নেই। কিন্তু তিন্নিকে পেলে তো আমার একটা ফ্যামিলি হবে। দুজন থেকেই তো ফ্যামিলির শুরু হয় তাই না? শ্বশুর শাশুড়ির ভালোবাসা আমি তাকে দিতে পারব না । কিন্তু নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে সুখী করার চেষ্টা করব।"
আমি বিস্মিত হয়ে আদনানের কথাগুলো শুনছিলাম। সত্যিই এই আদনান কি সেই আদনান? নিজের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য যে কথাগুলো সে আমাকে কখনো বলেনি তাই বলছে আমার বাবাকে। বিমুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম আমাকে পাওয়ার জন্য তার এই আকুলতা। বাবা বললেন,
"আমরা আমাদের মেয়েকে দূরে বিয়ে দিতে চাই না। তোমার পক্ষে কি সম্ভব হবে ঢাকায় শিফট করে যাওয়া?"
আমি অবাক হলাম বাবা আদনানের বিয়ে বিষয়ে কোনো কথাই বললেন না! সম্পূর্ণ অন্য টপিকে চলে গেলেন? এটা কীসের পূর্বাভাস?
আদনান এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে বলল,
"সেক্ষেত্রে আমাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে সবটা গুছিয়ে নেবার জন্য। আমি চলে আসব।"
"আর তোমার বাড়ি?"
"পরিশ্রম করতে পারলে বাড়ি আবার করা যাবে। সেসব নিয়ে ভাবছি না।"
"তোমার ক্যারিয়ার?"
"আমার পড়াশোনা যা আছে, আমার বিশ্বাস একটা ক্যারিয়ার এখানেও তৈরি করে ফেলতে পারব।"
"ঠিকাছে আদনান। আমাদেরকে একটু সময় দাও। আমরা তোমার সাথে কয়েকদিন পরে যোগাযোগ করব। তুমি এখন আসতে পারো।"
আদনান বলল,
"আপনাদের সবার যদি অনুমতি থাকে, আমি কি তিন্নির সাথে ৫ মিনিট একা কথা বলতে পারি?"
আদনানের সাহস দেখে আমি যারপরনাই অবাক হচ্ছি। ভয়ও করছে, আনন্দও লাগছে! আমাদের বাড়িতে যেখানে বাবা থাকেন সেখানে অন্যকেউ সিদ্ধান্ত দেয় না। তাই সবাই চুপ করে রইলেন। বাবা বললেন,
"অনুমতি নেই।"
"ঠিকাছে কোনো সমস্যা নেই। আমি আসছি।"
আদনান উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার আমার দিকে তাকালো। আমি একটু অবাক হলাম। দেখতে আসলেও পাত্র-পাত্রীদের একা কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। অথচ আমাদের কপালে তাও জুটলো না! আরও বেশি অবাক হলাম এটা ভেবে যে আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করা হলো না। কোনোরকম মত প্রদান করতেও দেওয়া হলো না! তাহলে ডাকলো কেন? আমাদের সকলকেই এখানে উপস্থিত রাখা হলো অথচ কথা বললেন বাবা ও আদনান। এ বিষয়ে বাড়ির অন্যদেরও কিছু বলার নেই। কারণ বাবা খুবই বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী। তার সিদ্ধান্তের উপর সকলেই চোখ বুজে ভরসা করেন।
আদনান চলে যাওয়ার পর বাবা তার ঘরে চলে গেলেন। গতকাল কমল ঝামেলা করে যাওয়ার পর বাবা যে আদনানকে আসতে বললেন, তারপর থেকে তিনি আমার সাথে কথা বলেন না। এখনও বললেন না। বাবা চলে যাওয়ার পর দাদাজানও চলে গেলেন। মিন্নি ও চাচ্চু যার যার অবস্থানেই স্থির রইলো। চাচ্চু সম্ভবত আমাকে কিছু বলতে চান। কিন্তু তার আগেই মা এসে আমার গালে একটা চড় মারলেন। বললেন,
"প্রেম করার যোগ্যতাও নাই তোর? একটা বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করলি!"
বলতে চাচ্ছিলাম বিবাহিত না ডিভোর্সি কিন্তু সুযোগ পেলাম না। মা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মিন্নিকে একটা ধমক দিলেন এখনো এখানে বসে থাকার জন্য। চাচ্চু কে বললেন তার ঘরে যেতে। মা রেগে গেলে চাচ্চু একটু সমঝে চলে তাকে। তাই সেও চলে গেলেন। জানি না মা আমাকে আর কিছু বলতে চাইছিল কিনা। আমি নিজের ঘরে এসে দরজা দিলাম। আমাকে অবশ্য ডাকলেন না। আমি আদনানকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম,
"স্পষ্ট করে মানা করার পরেও তুমি তোমার কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের কথাটা বলে দিলে কেন? এই কথাটা কি শুধু তোমার আর আমার মধ্যে থাকলে চলতো না?"
"না তিন্নি। আমার ফ্যামিলি নেই। তাই বোধহয় ফ্যামিলির গুরুত্বটা খুব ভালো ভাবে অনুধাবন করতে পারি। তাই তোমার যখন ফ্যামিলি আছে, তখন সেই ফ্যামিলির কাছে আমি নিজেকে পরিস্কার করাটা জরুরি মনে করি। ডিভোর্সি হয়েও সেটা গোপন রেখে অবিবাহিত সেজে কারও মেয়ে আনতে চাই না আমি।"
"তোমার এই সততার জন্য যদি আমাকে না পাও?"
"না পেলে চাইতে থাকব। একবার ফেরাবে, দুবার ফেরাবে, তিনবার ফেরাবে। এভাবে চলতে থাকবে। একদিন হয়ত আর ফেরাতে পারবে না।"
"যদি সত্যিই প্রতিবার ফেরাতে থাকে? সত্যিই যদি আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়?"
"দূর্ভাগ্য বলে মেনে নেব। এমনিতেও আমার ভাগ্য খুব একটা ভালো না। সেটা আমার জীবন বহুবার প্রমাণ করেছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি তিন্নি, তোমাকে পাওয়ার জন্য যত স্যাকরিফাইস করতে হয় করব। নিজেকে বদলাতে হলে বদলাব কিন্তু অসৎ হতে পারব না, ভান ধরতে পারব না। আমি অসততা ও ভান পছন্দ করি না। অসৎ হলে তার ফল কখনোই ভালো হয় না।"
"তোমার এই অতি ভালোমানুষির জন্য হয়তো আমরা আলাদা হয়ে যাব।"
"আমি অতি ভালো মানুষ নই। কেউই হান্ড্রেট পারসেন্ট ভালো বা হান্ড্রেট পারসেন্ট খারাপ হয় না। ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষ। শুরুতে বোঝা যায় না। একসাথে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে সব সামনে আসে। তবে কিছু নীতি বোধ ছাড়া কেউ কখনো সত্যিকার অর্থে মানুষ হয় না।"
আমি আদনানের সাথে এতসব তর্ক করেছি ঠিকই তবে তার প্রতিটা কথাই আমার ভালো লেগেছে। একসাথে পুরোটা জীবন কাটানোর জন্য পাগল প্রেমিকের চেয়ে একজন ভালো মানুষ খুব বেশি দরকার। কারণ পাগল প্রেমিকের পাগলামি ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু একজন ভালো মানুষ সারাজীবনের জন্যই ভালো। হুট করে কেউ তার স্বভাব বদলাতে পারে না। যাই হোক, হঠাৎ মনে পড়ায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
"আচ্ছা ৫ মিনিট কথা বলতে চাইছিলে কেন? এখন বলো।"
আদনান বলল,
"তোমার গালে পাঁচ আঙু লের দাগ বসে গেছে। কে মেরেছে আংকেল নাকি আন্টি?"
"বাদ দাও। যা বলতে চেয়েছিলে তা বলো।"
কী করে বলি কমল এই কাজ করেছে! লজ্জা রাখার জায়গা থাকবে না যে!
আদনান বলল,
"এটা জানার জন্যই কথা বলতে চেয়েছিলাম।"
"আমার জীবন যাচ্ছে চড় খেতে খেতে। আজকের টা নিয়ে এক হালি পূরণ হলো।"
"আজকের টা মানে আমি ফিরে আসার পর?"
"হুম।"
আদনান নিশ্চুপ। আমিও নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর আদনান বলল,
"তার মানে আংকেল সৌজন্যতার খাতিরে আমার কাছ থেকে সময় নিলেন। আসলে মেনে নেবেন না আমাদের!"
"তুমি কি ভাবলে বাবা মেরেছে? বাবা আমাদেরকে মারেন না। মা মারে।"
আদনান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি বললাম,
"বাবা মানবেন কিনা বুঝতে পারছি না। তবে না মানার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। পজিটিভ হলে আমার সাথে কথা বলতেন। গতকাল সব জানার পর থেকে আমার সাথে কথা বলেন না।"
"আমি তোমাকে অনেক বিপদে ফেললাম তিন্নি!"
"তুমি আর আমি আলাদা তো নই আদনান। এটাকে যদি বিপদ বলো, তো সেটা আমার একার হয়নি। তোমারও হয়েছে।"
"আমার কাছে এটা বিপদ না। একটা পরীক্ষা। তবে পাশ ফেইল কোনোটাই আমার হাতে নেই।"
"আচ্ছা বাবা যে বলল বাংলাদেশে চলে আসতে? তুমি সত্যি আসবে নাকি বাবা যাতে মেনে নেয় তাই বললে আসবে?"
"তোমাকে পেতে যদি চলে আসতে হয় তো আসব।"
"তাহলে তো তোমার সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।"
"করব। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে জীবনযুদ্ধে একা যুদ্ধ করা মানুষ আমি। তুমি সাথে থাকলে এই সব কিছুই পানির মত সহজ হবে তিন্নি।"
আদনানের এই কথাটায় আমার কী যে হলো! এক অদ্ভুত কষ্ট এবং ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। কিন্তু হঠাৎ আরেকটা কল আসার শব্দ হওয়াতে ফোনটা সামনে এনে দেখি কমল ফোন করেছে। হায় আল্লাহ! বিয়ে তো ভেঙে গেছে, তাহলে কমল আবার কেন ফোন করছে! ওপাশে আদনান ডেকে যাচ্ছে,
"হ্যালো তিন্নি...? তিন্নি...?"
.
.
.
চলবে..........................................................................