আশিয়ানা - পর্ব ৯৩ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


রাতের সময় এখন নয়টা, ক্রিস্টিয়ানোর তার গেস্ট হাউজের পার্টিতে উপস্থিত গেস্টদের ওয়েলকাম জানাচ্ছে। সেহরিশ রোদেলা কে নিয়ে একপাশে দাঁড়াল। ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির সবচেয়ে দাপটে লোক ক্রিস্টিয়ানো। তার এক কথায় যে কোনো ফিল্ম বন্ধ হয়ে যায়। সেহরিশের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সেহরিশ কখনো তার লোক দেখানো পার্টিতে আসে না। এবার আসার কারণ হচ্ছে সাদাফ আর উমাইয়া! সন্তান হারানোর বেদনা। ওরা মুখে প্রকাশ না করলেও চোখেমুখে তার ঝলক ঠিকই দেখা যায়। ক্রিস্টিয়ানো তার পার্টি বেশ জাঁকজমক ভাবে করেন। এতো আয়োজন ও উল্লাস দেখে কিছুক্ষণের জন্য ওদের মনটা ভালো হবে। সাদাফকে পাশেপাশে রাখছে সেহরিশ। রোদেলা উমাইয়ার সঙ্গে এদিক ওদিকের কথা বলছে। অনেক গায়িকা, নায়িকা ও মডেল এসেছে। তাদের পোশাক দেখে চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেলল রোদেলা। 

জুবিয়ার খোলা চুল ধরে বারবার টানছে সোহা। বিরক্তিতে চোখ দুটো বড়সড় করে তাকাল ও। সোহা আলগোছে জুবিয়ার কোল থেকে নেমে রোদেলার দিকে এগিয়ে গেল। সোহা হাত বাড়ালো। কোলে উঠবে! সোহা রোদেলার কোলে উঠে বুকের সঙ্গে লেপ্টে রইল। কিছুক্ষণ জুবিয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল রোদেলা। এরপর সোহাকে নিয়ে খাবারের জায়গার দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটার ক্ষুধা লাগছে। আর সে? পার্টিতে আসা মডেলদের দেখে উৎসাহিত হচ্ছে। রোদেলার চোখে ভেসে উঠল পুরোনো সে জুবিয়ার সাদামাটা মুখটা , জোর করে সুন্দর হওয়ার চাহিদা ছিল না। সারাক্ষণ সাধারণ ভাবে থাকতে পছন্দ করতো। অথচ সময় তাকে পরিবর্তন করেছে। ইতালি আসার পরপর আধুনিকতা তাকে ছেয়ে গেছে।

উমাইয়া পাশে বসে রোদেলা কে দেখছে। রোদেলা হঠাৎ উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে হা হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল,
  'ওমন করে কি দেখছিস?'

উমাইয়া মাথা নাড়লো। 
  'মাঝেমধ্যে মনে হয় তুই-ই সোহার মা। তুই ওর কতো যত্ন করিস, ও না বলতেও কত কথা বুঝে যাস।'

রোদেলা মুচকি হাসল। পাল্টা প্রশ্ন করে বলল, 
  'জন্ম দিলেই বুঝি মা হওয়া যায়? জন্ম না দিলে মা হওয়া যায় না?'

উমাইয়া দোটানায় পড়ে গেল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল, 
  'তোর সঙ্গে কথায় আমি পারব না। এমন যুক্তি দাঁড় করাস আর কথাই খুঁজে পাই না।'

রোদেলা হাসল। 
  'যুক্তিতে কোনো ভুল আছে?'

উমাইয়া নিবিড়ভাবে মাথা নাড়লো, 
  'না। তবে জানিস, জন্ম না দিলেও যে মা হওয়া যায় এটা কঠিন সত্য। একটা বাচ্চা কে আপন করার জন্য সুস্থ মন মানসিকতা প্রয়োজন। শুধু নামে মাত্র মা নয় কর্মেও মা হয়ে উঠতে হয়। একজন শিশু বাবা-মাকে দেখে সবকিছু শিখে ও বুঝে তাই তাদের তেমন পরিবেশ প্রয়োজন। যেখানে ওরা সুস্থ ভাবে বাড়তে পারবে। আমার মনে হয় জুবিয়া মা হিসেবে ফেইল হবে। ওর সমাজের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলার ইচ্ছা ওর সন্তানের থেকে ওকে দূরে ঠেলে দিবে।'

রোদেলা নড়েচড়ে বসল। এরপর মুষ্টিবদ্ধ করে উমাইয়ার হাতখানা শক্ত করে ধরে বলল, 
  'উমা, জুবিয়া অনেক ভালো মা হবে এবং ও সেটাই। শুধু একটু বেশি চঞ্চল মন ওর। সোহার লালন-পালন সে-ই করছে। তবেই তো সোহা আমাদের এতো শান্তশিষ্ট, বুদ্ধিমতী হয়েছে।'

উমাইয়া হাসল। মলিন হাসি। রোদেলার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকাল জুবিয়ার দিকে। পার্টিতে আসা বেশ কয়েকজন নারীদের সঙ্গে গল্প করছে জুবিয়া। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হতে ওর খুব ভালো লাগে। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর অনেক কিছু জানতে পারে। জুবিয়া একটু পরপর তাকিয়ে দেখছে সোহাকে। রোদেলার কাছে আছে দেখে স্বস্তি পায় সে।

ক্রিস্টিয়ানোর সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেল সেহরিশ। দু'জন হ্যান্ডশেক করে। সাদাফ ও হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিল। ক্রিস্টিয়ানো দুজনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে তারপর ড্রিংক এর দিকে এগিয়ে গেল। পাশাপাশি তিনটা চেয়ারে ওরা বসল। 

ক্রিস্টিয়ানো হাসি মুখে বলল, 
  'আমার পার্টিতে আজ চাঁদ নেমে আসছে। আমি সত্যি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী আমার পার্টিতে এসেছে।'

সেহরিশ নির্বিকার গলায় বলল,
  'উফফ, তোমার এই ফালতু জোকস বন্ধ করো ক্রিস। আমার এখানে আসার পেছনে কারণ আছে। তোমার সঙ্গে আমার অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার আছে।'

ক্রিস্টিয়ানো তাকাল সেহরিশের দিকে। নরম গলায় বলল,
  'হ্যাঁ, শুনছি! বলো।'

সেহরিশ পূর্বের কণ্ঠে বলল,
  'এখানে নয়। নিরিবিলি জায়গা বা ভেতর রুমে চলো।'

ক্রিস্টিয়ানো ওয়াইনের গ্লাসে হাত দিল। এক ঢোক, দুই ঢোক এরপর অর্ধেকটা গ্লাস খেয়ে ফেলল। একটা নতুন ভরা গ্লাস সেহরিশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
  'কথা তো পরেও হবে। আগে একটু গলা ভিজিয়ে নাও।'

সেহরিশ হাত দিয়ে গ্লাসটা দূরে সরিয়ে দিল। শান্ত গলায় বলল, 
  'আজ না, অন্য সময়। আমার ওয়াইফ তোমার পার্টিতে আসছে। ওর সামনে আমি ড্রিংক করি না।'

ক্রিস্টিয়ানো শব্দ করে হেসে উঠল। বলল,
  'তুমি ব্যক্তিগত ভাবে মানুষ যেমনই হও স্বামী হিসেবে সেরা।'

সেহরিশ সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলল, 
  'তূর্ণ তো এখানে আছে। তুই আমার সঙ্গে আয়।'

ক্রিস্টিয়ানো ওর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় গেল। বসার রুমটা বেশ বড়। আসবাবপত্র সোফা একটা টেবিল আর টিভি। সোফায় হয়ে বসল সেহরিশ। একবার সাদাফের দিকে তাকিয়ে আবার ক্রিস্টিয়ানোর দিকে তাকাল।

ক্রিস্টিয়ানো জিজ্ঞেস করল,
  'মাফিয়া জগতের বাদশাহ এর আজ আমাকে প্রয়োজন। মনে হচ্ছে বড় কোনো ঝামেলা।'

সেহরিশের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সেহরিশ ক্রিস্টিয়ানো এপর্যন্ত ঘটা সব এক এক করে বুঝিয়ে বলল। সব শুনে ক্রিস্টিয়ানো বেশ চমকাল। বেশ খানিকক্ষণ গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে রইল। ক্রিস্টিয়ানো সহজ গলায় বলল,
  'ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিকে ঘুম থেকে তোলা যায়। কিন্তু যে ইচ্ছা কৃত ভাবে ঘুমানোর নাটক করে চোখ বন্ধ রাখে তাকে কিভাবে তুলবে? তুমি যাকে খুঁজছো। সে তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। এজন্য সে সতর্কতা অবলম্বন করে এখনো লুকিয়ে পাড় পেয়ে আছে। তোমার সাথে শত্রুতা করার পর সে সর্বপ্রথম জেনেছে তোমার শক্তি কী? তোমার আক্রমণ করার টেকনিক এবং লাস্ট ওয়ান সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট তোমার দূর্বলতা! তোমার স্ত্রী। সে অল্প অল্প করে নিজেকে তৈরি করেছে তোমার বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর জন্য। তোমাকে প্রথম কথাটা বলার কারণ হচ্ছে এই তুমি যাকে খুঁজছ সে নিজে থেকে ধরা না দেওয়া পর্যন্ত তুমি তাকে খুঁজে পাবে না। কারণ শত্রু আগন্তুক। অপেক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় কথা মন দিয়ে শুনো সেহের, আজ থেকে কয়েক বছর আগে তুমি মন ও বাহির থেকে শক্তিশালী ছিলে। তোমার মৃত্যুর ভয় ছিল না। কিন্তু এখন তুমি দূর্বল কারণ তোমার দূর্বলতা আছে। মানুষ দূর্বলতা খুঁজে বের করে তারপর সেখানেই আঘাত করে। তুমি এখন ভয় পাও, তোমার ওয়াইফকে হারানোর ভয়। তোমাকে প্রায় থামিয়ে দেয়। আমার কথা, নিজের পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করো। এরপর বাহিরের শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার চিন্তা ভাবনা। অপেক্ষা করো সেহের, সময় সঠিক রাস্তা করে দিবে।'

'হুম।' বলে গম্ভীর হয়ে রইল সেহরিশ। দু হাতের মুষ্টিবদ্ধ করল সে। ক্রিস্টিয়ানো গড়গড় করে একনাগাড়ে কথাগুলো বললেও সেহরিশ যেন সেসব শুনতেই পাচ্ছিল না। তার মাথাজুড়ে ততক্ষণে অন্য চিন্তা। এরপর কী হবে? তার শত্রুর পরবর্তী প্ল্যান কী?  

সাদাফ প্রশ্ন করল, 
  'আমরা কি হাতে হাত রেখে বসে থাকব? সে আমাদের আর কোনো ক্ষতি করবে না তার কি গ্যারান্টি?' 

ক্রিস্টিয়ানো সুক্ষ্ম গলায় বলল, 
  'যা হবে তাকে বাধা দিতে পারে কেউ?'

সেহরিশ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। যেমন বসে ছিল, তেমনই বসে রইল। সাদাফ বলল, 'একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকার লোক আমরা নই। ক্রিস্টিয়ানো এটা আপনি খুব ভালো করে জানেন।'

এবার হাসল ক্রিস্টিয়ানো। সামান্য, মৃদু হাসি। সে বলল, 'তোমরা যা ভালো মনে করো, তাই করো।'

সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। নিশ্চুপে রুম থেকে বেরিয়ে এল সে। ক্রিস্টিয়ানোর কথার সঙ্গে একমত সে কোনো ভাবেই হতে পারছে না। সাদাফের মনটা হঠাৎ করে বিষণ্ণ লাগছে। খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো অঘটন ঘটবে। 

ধনুক থেকে তীর ছুটে গেলে তীরকে আটকানো যায় না কিন্তু তীরের সামনে বস্তু সরানো যায়। সাদাফ সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আর কাউকে হারানোর বেদনা সহ্য করার শক্তি তার নেই। সাদাফ চোয়াল শক্ত করে উমাইয়ার কাছে গিয়ে বসল।

উমাইয়া দেখল সাদাফ ঘামছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে সাদাফের মুখ মুছে দিল। এক গ্লাস পানি সাদাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
  'হঠাৎ করে এতো ঘামছ পেসার বাড়ল নাকি?'

সাদাফ পানি পান করে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ভেতর পাথর চাপা পড়ে আছে এমন অস্বস্তি হচ্ছে। সাদাফ বলল,
  'আমার কিছু হয়নি। ঠিক আছি। তুমি খেয়েছ?'

উমাইয়া বলল,
  'না। সবাই এলে একসঙ্গে খাব।'

সাদাফ তাড়া দিয়ে বলল, 
  'তার আর দরকার নেই। তুমি আর রোদেলা খেয়ে নাও। অনেকে খেতে শুরু করেছে। তোমরাও এখন শুরু করো। একটু পর আমরা চলে যাব।'

জুবিয়া অবাক হয়েছে। উঁচু গলায় বলল,
  'এতো তাড়াতাড়ি? এখনো তো পার্টি ঠিকমতো শুরু হয়নি।'

সাদাফ চোখ ছোটছোট করে তাকাল। জুবিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে রোদেলার পাশে বসে গেল। ঠোঁট কামড়াতে চেয়েও সামলে নিল নিজেকে। 

সেহরিশ গম্ভীর। সাদাফ তাকে পাশ কাটিয়ে তূর্ণর দিকে এগিয়ে গেল। তূর্ণ এক কোণায় দাঁড়ানো। সাদাফ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, 
  'খাবার খাবি আয়।'

 তূর্ণ তাকাল না। কিছুদূর একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। তূর্ণ সাদাফের উদ্দেশ্যে বলল, 
  'একটু পরে খাব। পুরো রাত পার্টি হবে। হাতে শুধু সময় আর সময়। খাবারের জন্য এখনই এতো তাড়া দিচ্ছিস কেন?'

সাদাফ একবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আবার তূর্ণর দিকে তাকাল। কিছুটা বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, 
  'তোর এই অভ্যেসটা আজও গেল না। আমরা একটু পরই চলে যাব। এজন্যই তাড়া দিচ্ছি। জলদি চল।'
এই বলে সাদাফ চলে গেল।

তূর্ণ আকীর্ণ হেসে উঠল। তূর্ণ খেয়াল করেনি সাদাফ নেই। ও সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, 
  'ওই যে মেয়েটাকে দেখছিস সাদাফ? ওই যে লাল কালার জামা পরা। দেখ ও আমাকে দেখে কিভাবে হাসছে। আমার হ্যান্ডসাম ফেস দেখে যেকোনো মেয়েই পটে যায়। তুই এখানে একটু ওয়েট কর আমি কথা বলে আসি।'

তূর্ণ হাসিহাসি মুখে ঘুরে তাকাল। সহসা জুবিয়ার রক্তিম মুখখানা দেখে আঁতকে উঠল তূর্ণ। এখানে কিছুক্ষণ আগে সাদাফ ছিল। এখন জুবিয়া। জুবিয়া! কখন এল ও? সে কি তূর্ণর সব কথা শুনে নিয়েছে? তূর্ণ ঢোক গিললো। জিহ্বার মাথা দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিল। এক পা দু পা এগিয়ে এল জুবিয়ার দিকে। হাত বাড়িয়ে জুবিয়ার হাতটা ধরল সে। জুবিয়া এক ঝটকায় তূর্ণর হাত থেকে তার হাতখানা সরিয়ে ফেলল। তটস্থ হয়ে গেল জুবিয়া। বলল, 'এইসব ছিল আপনার মনে? এটাই আপনার বাস্তব চরিত্র।'

তূর্ণ জবাব দিল না। সে ততক্ষণে জুবিয়াকে বোঝার চেষ্টা করল। তূর্ণ বলল, 'তুমি ভুল বুঝছ।'

রাগ ও ক্ষোভে শরীর কাঁপছে জুবিয়ার। সে তূর্ণর পাশ দিয়ে সদরদরজার দিকে এগিয়ে গেল। তূর্ণ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল সেহরিশ ওরা কোথায়। এরপর সে-ও জুবিয়ার পিছনে ছুটে গেল। বউ ভুল বুঝে রাগ করেছে। মান তো ভাঙাতেই হবে। 

জুবিয়া পার্কিং এরিয়ায় আসলো। আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল তূর্ণর ম্যানেজার একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জুবিয়া তার থেকে তূর্ণর গাড়ির চাবি নিয়ে গাড়িতে উঠল। চোখের পলকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল জুবিয়া। তূর্ণ এল। ম্যানেজার তাকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। তূর্ণ তার দিকে তাকাতে সে বলল,
  'জুবিয়া ম্যাম মাত্রই আপনার গাড়ি নিয়ে গেছে স্যার।'

তূর্ণ ভ্রু কুঞ্চিত করল। পরোক্ষণে বলল,
  'তোমার গাড়ির চাবি দাও। জলদি!'

সুনসান রাস্তা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্ট। শু শু করে বাতাস বইছে। জুবিয়া রাগের মাথায় এলোমেলো ভাবে গাড়ি চালাতে লাগল। তূর্ণ ওর পেছনের গাড়িতে। একটু স্পিড বাড়িয়ে জুবিয়ার গাড়ির পাশাপাশি গাড়ি নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল তূর্ণ। জুবিয়ার উদ্দেশ্য বলল,
  'জুবিয়া গাড়ি থামাও প্লিজ। আমার কথা শুনো। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।'

জুবিয়া তূর্ণর দিকে তাকানোর আগ্রহ পেল না। তূর্ণর গাড়ি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য স্পিড বাড়াল সে। তূর্ণ স্পিড বাড়াল। জুবিয়ার গাড়ির সামনে গাড়ি থামাল তূর্ণ। জুবিয়া পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। তূর্ণ ওর গাড়ির স্টিয়ারিং এ সজোড়ে থাপ্পড় মারলো। জুবিয়া রাগী! ওর মাথায় একবার যা চাপে সে তা করেই ছাড়ে।

তূর্ণ গাড়ি পেছনে এনে আবারও সোজা ড্রাইভ করতে লাগল। এইটুকু সময়ে জুবিয়ার গাড়ি অনেকটা দূরেই চলে গেছে। জুবিয়া ভুল পথে যাচ্ছে। তূর্ণ বার দুয়েক হর্ন বাজালো। একহাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে ফোন নিয়ে কল দিল জুবিয়ার নাম্বারে। কল কেটে দিল জুবিয়া। 

এতদিন যাকে শ্রেষ্ঠ স্বামী ভেবে এসছে জুবিয়া। আজ তার স্বামীর মেয়েদের প্রতি আলাদা আগ্রহ দেখে সে কাঁচের মতো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। জুবিয়া এতদিন ভেবেছে, তূর্ণর জীবনে সে প্রথম ও শেষ নারী। তার ভাবনা হঠাৎ ভেঙে গেল। চোখ দুটো অশ্রুতে ছলছল করছে। সামনে সবকিছু অস্পষ্ট দেখছে সে।  

তূর্ণ গাড়ি নিয়ে এল জুবিয়ার গাড়ির বা পাশে। জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে বারবার তাকে গাড়ি থামাতে অনুরোধ করছে। জুবিয়া অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল তূর্ণর দিকে। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল তূর্ণ। জুবিয়ার চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রুজল টপটপ করে পড়ছে।

জুবিয়া তূর্ণর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকাল। সহসা দেখল একটা বড় গাড়ি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। জুবিয়ার চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে গেল। মূহুর্তের মধ্যে গাড়িটার সঙ্গে দু'জনার গাড়ি ধাক্কা লাগল। গাড়িটা উল্টে পড়ল। গ্লাস ভেঙে গেছে। রক্তাক্ত হাতখানা জানালা দিয়ে বাহিরে বের হয়ে এল। নির্জন রাস্তা, সচরাচর এই পথে গাড়ি আসে না। রাস্তার মাঝখানে তিনটা গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে। কিছুক্ষণ পর দুটো গাড়ি এপথে এল। এক্সিডেন্ট হওয়া গাড়ি গুলো দেখে আঁতকে উঠল তারা। প্রথম গাড়ির লোক ভয় পেয়ে যে পথে এসেছিল সে পথেই চলে গেল। এক্সিডেন্ট, পুলিশ আসবে। এত ঝামেলার মধ্যে জড়াবে না বলেই সে চলে গেল। 

দ্বিতীয় গাড়ির লোক প্রথমে পুলিশ স্টেশনে কল করে তারপর অ্যাম্বুলেন্সে। আধ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। দু'জন ঘটনা স্থলে মারা গেছে। আর দুজন গুরুতর আহত। তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। তূর্ণকে দেখে চিনতে পারে অফিসার। সাংবাদিক সাথে আছে। ব্রেকিং নিউজ টিভিতে দেখানো হচ্ছে। পুলিশ অফিসার নিজে সেহরিশ কে কল করে খবর শোনায়। ক্রিস্টিয়ানোর হাউজ থেকে ওরা তাত্ক্ষণিক হাসপাতালে এসে পৌঁছালো। 

সোহা রোদেলার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। সোহাকে কোলে নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদেলা। উমাইয়া, স্ট্রেচারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জুবিয়ার মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড় সরিয়ে মৃদু গলায় তাকে ডাকলো,
  'জুবি, এই জুবি। চোখ খোল! দেখ আমরা কিন্তু ইয়ার্কির মুডে একদম নেই। এভাবে শুয়ে না থেকে উঠে বোস। দেখ, সোহা তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। তুই এখনো চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবি? উঠ না।'
উমাইয়া আলতোভাবে জুবিয়ার গালে হাত রাখল। মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার। উমাইয়ার চোখ থেকে অশ্রু টপটপ করে পড়ছে।
 রোদেলা টলতে টলতে স্ট্রেচারের পাশে এসে দাঁড়াল। জুবিয়ার মুখটা দেখতে ওর ভেতর থেকে কান্না উপচে বেরিয়ে আসে। 

আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেহরিশ। চোখ দুটো স্থির। সাদাফ পায়চারি করছে। সেহরিশ দু-হাতে মাথা চেপে ধরল। চোখের পাতায় ভেসে উঠছে তূর্ণর মুখটা। তূর্ণর বার বার সেহরিশের কাছে ছুটে আসা। ইচ্ছা করে সেহরিশ কে জড়িয়ে ধরতে সে। তূর্ণর সহজসরল হাসি। ক্ষুধা লাগলে সেহরিশের কাছে ছুটে আসতো। আর বলতো আমাকে একটু রান্না করে দিবে?
নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনার পর প্রথমে সেহরিশ কে দেখাতো। সেহরিশ হ্যাঁ বললেই সেটা পরে খুশি হতো তূর্ণ। বাচ্চাদের মতল ছিল তার আচরণ। সেহরিশের মাথা ঝিমঝিম করছে। হৃদপিণ্ডটা ধড়ফড় করছে। ধুকপুকানি বাড়ছে। সাদাফ এগোল। সেহরিশের কাঁধে হাত রেখে ধরা গলায় বলল, 
  'আমাদের তূর্ণর কিছু হবে না, ইন শা আল্লাহ।'

সাদাফের কণ্ঠ থেমে থেমে আসছে। পুরুষ মানুষ বলেই নিজেকে শক্ত করে রাখছে। মেয়ে মানুষ হলে নিশ্চয় হাউমাউ করে কাঁদতো। ভেতর থেকে সে নিজেও তো ভেঙে গেছে। তূর্ণ! ও যে দুই ভাইয়ের ভীষণ আদরের ছিল। সাদাফের চোখ ভিজে উঠল। সেহরিশের আড়ালে পানিটুকু আলগোছে মুছে নিল সে। 

আইসিইউ থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসে। 
সেহরিশ আর সাদাফ উৎসুক দৃষ্টিতে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে। ডাক্তার ইতস্তত করে বললেন,
  'সরি ইয়াংম্যান! আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। এক্সিডেন্ট এ গাড়ি উল্টে যাওয়ায় চারজন মানুষের মাথায় আঘাত লাগছে। তার মধ্যে দু'জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আর মহিলাটা পথেই মারা যায়। আর র‍্যাপার তূর্ণ মাত্রই শেষ নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু সে শেষ সময়ে অস্ফুটস্বরে বার দুয়েক সোহা বলে ছিল।'

সেহরিশ ধপ করে বসে পড়ল। কর্নপাত হলো তূর্ণর কণ্ঠে তার নাম। 'সেহরিশ!' 

চারিদিক ঘুরতে লাগল তার। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করছে। সেহরিশ চোখ বন্ধ করল। সাদাফ হাঁটু গেড়ে বসল। সেহরিশের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল সাদাফ। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, 
  'সেহরিশ! তূর... তূর্ণ!"
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp