রোদেলা পা ভাঁজ করে বসে আছে। সেহরিশ তার পাশে বসে রোদেলার কপালে হাত রাখল। শরীর গরম। গতকাল রাতে ভয় পেয়েছে। তাই হয়তো জ্বর এসেছে। হালকা নাস্তা খেয়েছে রোদেলা। ওর দিকে জ্বরের ঔষধ এগিয়ে দিল সেহরিশ। রোদেলা ঔষধ খেলো। পানির গ্লাস সেহরিশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
'ওরা কারা ছিল?'
'আমি জানি না।'
'আমাকে তুলে নিয়ে গেছিল কেনো?'
'তুমি আমার দূর্বলতা, তাই।'
রোদেলা মাথা নিচু করল। ঠোঁট কামড়াচ্ছে সে। সেহরিশ তাকাল। প্রশ্ন করল,
'কি হলো?'
রোদেলা মাথা নিচু করে জবাব দিল,
'গতকাল রাতে আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি পালানোর চেষ্টা করি। আর তখন ওদের কথা শুনতে পাই। আমাকে নিয়ে অনেক বাজে কথা বলছিল।'
সেহরিশ নড়েচড়ে বসল। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
'কি বলেছিল?'
রোদেলা মাথা নাড়লো। একটু সময় নিয়ে সে সেহরিশ কে সবটা জানালো। সেহরিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে আছে। রাগ ও ক্ষোভে বাঁ হাতটা কাঁপছে।
সেহরিশ রোদেলার মাথায় হাত রেখে বলল,
'একা কোথাও যাবে না। এটা আমার আদেশ।'
রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলল। সেহরিশ রোদেলার মাথায় ওর হাত রাখে। কণ্ঠস্বর নরম করে কাতর গলায় বলল,
'তোমার জন্য আমার টেনশন হয়, রোদ। তুমি সবসময় আমার চোখের সামনে থাকবে। এটাই আমি চাই। আমি বেঁচে থাকতে তোমার কিছুই হবে না। আমি হতে দেব না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো কিভাবে? তুমি আর কখনো একা বেরোবে না, রোদ। প্লিজ।'
বেশ খানিকক্ষণ পর সেহরিশ রুম থেকে বের হলো। দরজা চাপিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। রাগে তার শরীরের লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। রোদেলার বলা এক একটা বাক্য তার কানে বাজছে। ওর সেখানে পৌঁছাতে দেরি হলে কি হত? রোদেলা। ও যদি ওখান থেকে পালাতে না পারতো বা ধরা পরতো। তাহলে? সেহরিশ মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। শরীর ঘামছে তার।
টেরেসে এসে দাঁড়াল সেহরিশ। একটু সময় নিয়ে কল করল সাদাফকে। সাদাফ আর তূর্ণ রাতে সেখানে ছিল। সাদাফ কল রিসিভ করে। সোফার উপর হেলায় দিয়ে বসে সাদাফ।
সেহরিশ বলল,
'ওদের সঙ্গে কি করেছিস?'
সাদাফ প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
'গোডাউনে আগুন লাগিয়ে ছিলাম। সব কিছু আগুন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।'
সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। লোকগুলোর জন্য আরও কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। সাদাফ ভাবুক কণ্ঠে বলল,
'গতরাতে গোডাউনে পৌঁছানোর পর মার্কাসের গাড়ি দেখে ছিলাম। মনে আছে?'
সেহরিশ দুই আঙুলে কপাল চুলকে বলল,
'হ্যাঁ।'
সাদাফ নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
'গোডাউনের বাহিরে এসে আগুন জ্বালানোর পর সে গাড়ি আর দেখতে পাইনি। বোধহয় আমরা ছাড়াও আরও একজন সেখানে ছিল। সুযোগ বুঝে পালিয়েছে। সে আমাদের দেখেছে।'
সেহরিশ স্বাভাবিক গলায় বলল,
'নতুন কী? আগের রাতেই তো মার্কাস আমাদের দেখেছে।'
সাদাফ বলল,
'ওটা মার্কাস ছিল না। অন্য কেউ হয়তো সে আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু কারণ তার কাছে মার্কাসের জিনিস আছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে সে আমাদের বিরুদ্ধে মার্কাসের জিনিস ব্যবহার করছে।'
সেহরিশ বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলল,
'মার্কাসের জিনিসপত্র তার কাছে থাকবে। আর কে ব্যবহার করবে ও ছাড়া?'
সাদাফ কড়া গলায় বলল,
'মার্কাস ইতিমধ্যে মারা গেছে! গতকাল রাতে তার বাড়ি থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আজ সকালে খবর দেখিসনি?'
সেহরিশ থমকাল। চিন্তায় কপালে চার ভাজ পড়ল তার। অতি সুক্ষ্ম গলায় বলল,
'সে কে?'
••••••••••••••
বিছানার ঠিক মাঝখানে শুয়ে আছে, সোহা। মেয়ের ডানপাশে উবু হয়ে শুয়ে রয়েছে তূর্ণ। সোহার ছোট্ট ছোট্ট আঙুলের মাঝখানে ওর তর্জনী আঙুল। ঘুমানোর সময় বাবার একটা আঙুল ধরে ঘুমিয়েছে সোহা। একজন মেয়ের জন্য এটাই প্রথম বিশস্ত হাত। সোহা ভারী নিঃশ্বাস ফেলেছে। প্রতিটি শ্বাসের শব্দ কান পেতে শুনছে তূর্ণ।
মেয়ের বয়স এক মাস পূর্ণ হয়েছে। এতেই অনেকটা অধৈর্য্য হয়ে গেছে তূর্ণ। জুবিয়া স্নান সেরে রুমে এল। তূর্ণর হাতটা সোহার হাতের মাঝে দেখে সে জিজ্ঞেস করল,
'তুমি এখনো ওর হাত থেকে নিজের হাতটা বের করোনি?'
তূর্ণ হাসল। বলল,
'মনের মধ্যে শান্তি অনুভব হয়। তাই হাত সরাতে ইচ্ছে করে না।'
জুবিয়া ডানে-বামে মাথা নাড়লো। তূর্ণ ফের বলল,
'ও চোখ খুলছে না কেন? ওকে বলো, চোখ খুলতে। এতো কে ঘুমায়? আমি ওকে দেখব। তুমি একটু বলো না আমার সাথে কথা বলার জন্য।'
জুবিয়া সশব্দে হেসে উঠল। এটা তার জন্য নতুন কিছু না। তূর্ণ বাংলাদেশ থেকে আসার পর যখন মেয়েকে প্রথমবার কোলে নিয়েছিল তখন ও ঠিক বাচ্চাদের মতো কান্না করে। তারপর শুরু হয় ওর পাগলামো। সারাক্ষণ মেয়ের পাশে বসে থাকে। চোখ দুটো খুললেই শতশত শব্দের গল্প জুড়ে দেয়। মেয়ে ও ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে উঠে। তূর্ণ রোজ একই কথা জুবিয়াকে বলে। সে তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়। তার মুখে বাবা ডাক শুনতে চায়। ও চায়, মেয়ে না ঘুমিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকুন। ও বোরিং জোকস বলবে আর তা শুনে মেয়ে খিলখিল করে হাসবে।
জুবিয়া বিরক্ত হয় না। সে মুখে হাসি ফুটিয়ে তূর্ণ কে বলে,
'অপেক্ষা করো। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। তোমার মেয়ের এখন ঘুমানোর বয়স। আর কিছু মাস যেতে দাও তখন সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকবে আর তোমার সাথে হাসবে। তারপর হাঁটা শিখবে মুখে বলি ফুটবে। সে অব্ধি অপেক্ষা করো।'
তূর্ণর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও আলতোভাবে মেয়ের কপালে ঠোঁট স্পর্শ করল। অমনি চোখ দুটো খুলে তাকাল সোহা। তূর্ণ একগাল হেসে ফেলল। তূর্ণ জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে ম্লান কণ্ঠে বলল,
'ওকে একটু আমার কোলে তুলে দাও।'
জুবিয়া এল। সোহাকে তূর্ণর কোলে দিয়ে সে পাশেই বসল। মাথা থেকে তোয়ালে খুলে পাশে রাখে তারপর জিজ্ঞেস করল,
'গতকাল রাতে বাড়ি আসোনি কেন? কনসার্ট শেষে কোথায় গিয়েছিলে?'
তূর্ণ সত্য কথাটা বলল। জুবিয়া আঁতকে ওঠে। কর্কশকণ্ঠে বলল, 'এত কিছু হয়ে গেছে অথচ তুমি আমাকে কিছুই বলোনি। আমি যদি এখন জিজ্ঞেস না করতাম তাহলে তো বলতেই না।'
তূর্ণ বলল,
'বিষয়টা অনেক সিরিয়াস।'
জুবিয়া বলল,
'আমি কিছু শুনতে চাই না। বিয়ের এতগুলো বছর হয়ে গেছে অথচ এখনো সব কিছু আমার জিজ্ঞেস করে করে জানতে হয়। নিজে থেকে কিচ্ছু বলো না। তুমি থাকো এখানে চললাম আমি।'
তূর্ণ গলা তুললো,
'আরেহ, বউ কোথায় যাচ্ছো?'
জুবিয়া দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলল,
'জাহান্নামে।'
তূর্ণ ঠাট্টা করে বলল,
'সাবধানে যেও আর শীঘ্রই ফিরে আসবে। সোহা কিন্তু বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারবে না।'
জুবিয়া রুম থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল রোদেলাকে। রোদেলার ফোন বন্ধ। গতকাল রাতে কোনো পড়ে গেছে। জুবিয়া কয়েকবার চেষ্টা করার পর বাড়ির নামের কল করে। একজন স্টাফ রোদেলার কাছে ফোন নিয়ে যায়।
রোদেলা মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। গত রাতের কথা চিন্তা করলেই শরীর কেঁপে উঠছে। জুবিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় নিজেকে যথেষ্ট স্ট্রং রাখার চেষ্টা করে রোদেলা। যেনো গতকাল রাতে কিছুই ঘটেনি। জুবিয়ার চিন্তা কিছুটা কমলো।
রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'সোহা কোথায়? ঘুমচ্ছে কি?'
জুবিয়া মৃদু হাসল। তারপর বলল,
'সে কি আর ঘুমায়? এতো ঘুম পাতলা একটু পরপর উঠে যায়। এখন জেগে আছে। তূর্ণ ওর সঙ্গে কথা বলছে। তুই একটু অপেক্ষা কর আমি ও রুমে যাচ্ছি। সোহাকে দেখ, টুকুর টুকুর করে তাকিয়ে আছে।'
জুবিয়া রুমে এল। সোহা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে। জুবিয়া হাসিহাসি মুখে বলল,
'রোদু তুই ওর নাম ধরে ডাক। দেখবি তোকো খুঁজবে।'
রোদেলা হাসল।
.
.
.
চলবে........................................................................