বৃষ্টি হয়ে নামো - পর্ব ০২ - ইলমা বেহরোজ - ধারাবাহিক গল্প


"বউ পালিয়েছে!"
বিভোরের স্বাভাবিক কন্ঠ। যেনো এটাই হবার ছিলো। বিভোরের কথা শুনে ডাইনিং রুমে ধারার জন্য অপেক্ষা করা উপস্থিত চারজন ফ্যামিলি মেম্বার আৎকে উঠলো। বিভোর চেয়ার টেনে বসে। সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন চোখ গরম করে বলেন,
"কি বলিস? বউ পালাইছে মানে?"

সৈয়দা লায়লা স্বামীর সাথে তাল মেলান। ছেলেকে ঝাড়ি মেরে বলেন,
"তোর বিয়াতে মত ছিলো না, জানি! তাই বলে আমাদের সাথে মশকরা করবি? বলছি, বউমা কই? আর তুই বলে ফেললি, পালাইছে। যা বউরে নিয়া আয়।"

বিভোর প্লেটে স্ন্যাক্স ভেজিটেবল প্যাটিস নিতে নিতে বললো,
"বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখে আসো।"

বিভোরের কথা শুনে সামিয়া দ্রুত বিভোরের রুমের দিকে যায়। পুরো নাম সামিয়া রহমান। বিভোরের বড় ভাই বাদল মেসবাহর স্ত্রী। দুই বছর হলো বিয়ের। বিভোর আর সামিয়ার সম্পর্ক আপন ভাই-বোনের মতো। বিভোর ভাবি ডাকে না, আপু বলে সম্বোধন করে। সামিয়া বিভোরকে ডাকে 'ছোট ভাই'।

দুই মিনিটের মধ্যে সামিয়ে এসে ঢোক গিলে বললো,
"সত্যি কোথাও নাই।"

বাদল চোখের চশমা ঠিক করে বিভোর কে বললো,
"সমস্যা কি হয়েছিলো? বউ পালালো কেনো?"

বিভোর খাবার খাওয়া বন্ধ করে ভাইয়ের দিকে তাকায়।বলে,
"তাঁর সাথে কোনো সমস্যা হয়নি আমার।"

বাদল গলা খাঁকারি দেয়। তারপর বিভোরের পাশ ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বললো,
"তোর পুরুষত্বে সমস্যা-টমস্যা আছে নাকি?"

বিভোর কান দু'টো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। তীক্ষ্ণ চোখে বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়। বাদল দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। বিভোর রাগ নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে বাদলকে দেয়। বাদল খানিকটা অবাক হয়। চিঠির ভাঁজ খুলে। লায়লা বলেন,
"কি লিখা জোরে পড়।"

বাদল জোরে পড়া শুরু করলো,
"মুহতাব সাহেব আমি চলে যাচ্ছি। কোনো পুরুষের সাথে এতদিন থাকাটা রিস্ক। এই রিস্ক আমি নিতে চাই না। তার উপর অচেনা বাড়িতে আমার ঘুম আসছিলো না। বিয়েটাও জোর করে দেওয়া হয়েছে। বাবাইয়ের বাড়ি থেকে অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। বাবাই বডিগার্ড রেখেছিলো। আজ সেই সুযোগ পেয়েছি। তাই পালালাম। আপনি তো জানেনই আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। আর এটাও বলেছি আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুব ভালবাসি। তো কোনো পুরুষের সাথে এক বছর থাকাটা ইম্পসিবল। আমাকে খুঁজে লাভ নেই। বাবাইয়ের বাড়ি পাবেন না। ভালো থাকবেন।" 

দেলোয়ার হোসেন রাগে গমগম করে উঠে বললো,
"ছিঃ ছিঃ সমাজে মুখ দেখাবো কীভাবে? বিয়ের পরদিনই বাড়ির বউ পালিয়েছে! আবার বয়ফ্রেন্ডের জন্য।"

বাদল সামিয়ার দিকে তাকায়। সামিয়া ভয়ার্ত চোখে তাকায় বাদলের দিকে। এমন ঘটনা তাঁদের বংশে প্রথম। রাজশাহীর এই অঞ্চল সহ আশে-পাশের অনেক অঞ্চলের মানুষের কাছে একজন সম্মানিত মানুষ সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন। আর উনার ছেলের সাথেই এমন ঘটনা? তিনি রাগী চোখে স্ত্রী লায়লার দিকে তাকান। লায়লা দুই-তিনবার ঢোক গিলেন। তিনিই তো মেয়ে পছন্দ করে, একদম বিয়ে ঠিক করে এসেছিলেন। স্বামীকে রাজি করিয়েছেন। আর সেই মেয়ে নাকি পালালো? এতো বড় বাঁশটা দিতে পারলো?

দেলোয়ার হোসেন, বাদল সহ আরো আত্মীয় দুই-তিন জন মিলে সেদিন ধারাদের বাড়ি যায়।

——————————
এক বছর পর.........
——————————

বিভোরকে সারারাত কল করেও পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে বিভোরের ফ্ল্যাটে আসে সায়ন। তিনবার কলিং বেল চাপার পর দরজা খুললো বিভোর। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বিভোর বললো,
"কিরে শালা, সকাল সকাল কি চাই?"

সায়ন বিভোরকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে। বিভোর দরজা লাগিয়ে দুলে দুলে রুমে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। সায়ন বিভোরের পিঠের উপর উঠে বসে। ঘুম কাতুরে বিভোর বললো,
"গে হইয়া গেছস? বউয়ের মতো এমন করতাছস কেন? সর!"

বিভোর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সায়নকে। সায়ন মুখ খুলে,
"তোর ফোন কই?"

"আছে কোনো জাগায়। খুঁইজা দেখ।"

"তোরে মনে হয় এক কোটিটা কল দিছি। ধরস নাই ক্যান?"

বিভোর ভারী অবাক হয়ে উঠে বসে। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে দেখে সায়ানের ৩৫ টা মিসড কল। ইনোসেন্ট মুখ করে সায়ানের দিকে তাকায়। বলে,
"৩৫ টা মাত্র। এক কোটি কই?"

"তুই নেশা করছস?"

বিভোর শুয়ে বললো,
"মাথা ব্যাথা ছিলো খুব। ঘুমের ট্যাবলেট খাইছিলাম তিনটা। এইজন্য ঘুম এমন কামড় মাইরা ধইরা রাখছে। বাদ দে, কি দরকার? ক জলদি।"

"ইম্পোর্টেন্ট কথা। ফ্রেশ হইয়া আয়। তারপর বলমু নে।"

বিভোর অলসতা ভেঙে উঠে ওয়াশরুম যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আসে। একদম ঝকঝকে।
"বল কি বলবি?"

"আমার গার্লফ্রেন্ড। ও বায়না করেছে দার্জিলিং ঘুরবে। তুইও সাথে চল।"

বিভোর সাফ নাকচ করে,
"না,না। কাবাব মে হাড্ডি হবো না। যা তোরা। এনজয় কর।"

"আরে শালা দিশারিরেও নিয়া নিবি। ওর তো অনেকদিনের শখ দার্জিলিং যাবে। নিয়ে নে। তোরা ঘুরবি। আর আমরা আমাদের মতো।"

"তো আমারে দিয়া তোর কাম কিতা?"

"তুই তো দুইবার ঘুরে এসেছিস। সবই চিনিস। আবার পর্বতারোহী তুই। আমিতো সারাজীবন কোথাও ঘুরিনি। একটু ডর-ভয় আছে না?"

"শালা গবেট। বউরে নিয়া নতুন কোথাও হানিমুনে গেলেও কি আমারে নিবিনি?"

"তা নিবো না। কিন্তু এখনতো চল। প্লীজ।"

বিভোর উঠে দাঁড়ায়। রান্নাঘরে এগোয়। সায়ন পিছন পিছন আসে। রিকুয়েষ্ট করে,
"প্লীজ দোস্ত তুইও আয়। তুই, আমি, ঊর্মি, দিশারি
চারজনে মিলে দার্জিলিং ট্যুর! জোস হবে আয় প্লীজ।"

"সায়ন জোর করিস না। অফিসে ছুটি নিতে হবে। গত মাসেই দুইদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলাম। এখন আবার... কি ভাববে?"

"তুই বললে ছুটি দিবে। প্রমোশন পেয়েছিস। একটা দাম আছে না? প্লীজজ দোস্ত?"

বিভোর কিছুক্ষণ কিছু ভাবে। তারপর কোনোমতে বললো,
"আচ্ছা যা যাবো। দিশারিরে বলছস?"

সায়ন প্রফুল্ল মুখ করে বললো,
"রাতেই বলছি। ও রাজি। আগামী রবিবার আমরা যাত্রা শুরু করবো।"

বিভোর পেয়াজ কাটতে কাটতে ছোট করে বললো,
"হুম।"

সায়ন রাজশাহীর ছেলে। বিভোর, সায়ন একই স্কুলে, কলেজে পড়েছে। ভার্সিটি বয়সে এসে আলাদা হয়ে যায়। সায়ন ঢাকা গুলশানে চলে আসে। অনলাইনে, ফোনে যোগাযোগ ছিলো দুজনের। মাঝে মাঝে দেখাও হতো। এগারো মাস পূর্বে বিভোর ঢাকায় চাকরির ইন্টারভিউ দেয় শখে। কিন্তু চাকরিটা হয়ে যায়। মোটা অংকের বেতনের চাকরি কে ত্যাগ করতে চায়? বিভোর ঢাকা চলে আসে। গুলশানে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। সায়ন ভালো ফ্রেন্ড থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠে। কলেজের বান্ধবি দিশারিকেও পেয়ে যায় রাস্তায়। কাজে মন দেয়। প্রমোশন পেয়ে গত মাসে ফ্ল্যাট কিনে।

"একটু আগে যে কইলি আমি পর্বতরোহী। কোন আন্দাজে কইলি?"

সায়ন হেসে বললো,
"সবসময় পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াস। ভিডিও করে ফেসবুকে দেস। সবাই তো তোরে তাই বলে।"

"এইগুলা তো শখের বসে। ভালো লাগে পর্বত। পর্বতকে নিজের আপন মনে হয়।"

"সারাজীবন পর্বত আর অফিস লইয়াই থাকবা নি মামা?  বিয়া-শাদী, প্রেম-পিরিতি করবা না?"

বিভোর ডিম ভাজতে ভাজতে বললো,
"প্রেমটা বউয়ের জন্য রাখছিলাম। কিন্তু বউও বিয়ার রাতে ছ্যাঁকা দিয়ে বেঁকা করে ফাঁকি মাইরা উড়াল দিছে। আর প্রেম নাই মনে!"

সায়ন ফ্রিজ খুলে আপেল নেয়। ড্রয়িংয়ে যেতে যেতে কথা ছুঁড়ে দেয়,
"প্রেম যখন আসবে তখন আটকাইতে পারবানা মিয়া।"

বিভোর দুর্বোধ্য হাসলো। এক বছর আগের সেই রাতটার কথা মাঝে-মধ্যেই মনে হয়। তবে ধারার মুখটা ঠিক মনে নেই। নামটাই শুধু মনে আছে। কখনো খোঁজ নিতেও ইচ্ছে হয় না বিভোরের। রাগও নেই ধারার উপর। মেয়েটার তো দোষ নেই। ভালোবেসে পালিয়েছে। ভালোবাসা দোষের নয়। ডিভোর্স নিতে একদিন হয়তো আসবে।

"এইটা কার ছবি আঁকছস? কোন মাইয়ার?"

বিভোর রান্নাঘর থেকেই বুঝতে পেরেছে সায়ন কোন ছবির কথা বলছে। সে রান্নাঘর থেকে উত্তর দেয়,
"জানি না। কল্পনা থেকে আঁকছি।"

বিভোর ছুটির দিনে এটা-সেটা আঁকে। দুই মাস আগে একটা মেয়ের ছবি আঁকে। মেয়েটা প্রাইভেট কারে বসে আছে। গালের অর্ধেক, ঠোঁট, নাক দুই হাত দিয়ে ঘুরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হাসছে। মেয়েটা হাসলে চোখ দুটিও হাসে। চিকচিক করে চোখের মণি। চুল উড়ছে বাতাসে। কল্পনা থেকে ছবিটা আঁকা। কেনো জানি ছবিটা বেশ ভালো লাগে তাঁর! খুব....বেশি। বিভোরের কাছে তাঁর আঁকা বেস্ট ছবি এটা।

——————————

বিকেলে বিভোর বের হয় বাইক নিয়ে। মিরপুর এসে জ্যামে আটকায়। পনেরো মিনিট পার হয়ে গেছে জ্যামে। গরম নেই ভাগ্যিস। সকাল থেকেই বাতাস হচ্ছে হালকা। রাতে বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা প্রবল। আকাশটা ঘোলাটে। সন্ধ্যা হওয়ার উপক্রম তখন। বিভোর সামনের চুল খাড়া করতে করতে করতে আশে-পাশে তাকায়। চোখে আটকে যায় রাস্তার পাশে ফুটপাতে। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেডি শার্ট-জিন্স পরা। কানে সাদা হেডফোন। কারো সাথে কথা বলছে।দু'গালের অর্ধেক, ঠোঁট, নাক ঘুরে হাসছে। যেনো চোখ দুটিও হাসছে। আশ্চর্য? সামনের সিল্কি চুল মৃদু বাতাসে মৃদু উড়ছে। কল্পনায় আঁকা কারো অবয়ব বাস্তবে যখন দেখা দেয়, তখন কেমন রিয়েকশন নিতে হয়? বিভোরের জানা নেই।

"ও মিয়া বাইক টানো?"
বিভোর পিছনে তাকায়। একজন রিক্সা ড্রাইভার তাকেই বলছে। জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। বিভোর আরেকবার তাকায় ফুটপাতে। মেয়েটা নেই! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দেয়। ছবির মেয়েটাকে সে ভালোবাসে না। শুধু ভালো লাগে দেখতে। তাই আর এটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ঠোঁট হাসলে চোখ হাসে, এমন মেয়ে হাজারটা আছে বাংলাদেশে!
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp