আশিয়ানা - পর্ব ৮৮ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকরা 'সেহরিশ', 'সেহরিশ' বলে চিৎকার করছে। কনসার্টে গান শুরু করল বিশ্বখ্যাত ইতালির পপ ব্যান্ড বি-এম ক্যাসেল। মঞ্চে উঠে দলের সদস্যরা ভক্তদের সঙ্গে খানিকটা আলাপ করে নেয়। তারপর ওদের পারফর্ম শুরু হয়। গত দুই সপ্তাহ আগে বি-এম ক্যাসেলের আরও একটি অ্যালবাম মুক্তি পেয়েছে। সেটা উদযাপন করতে এই কনসার্ট করেছে বি-এম ক্যাসেল। কনসার্টে অ্যালবামের গান শোনালো ওরা। কনসার্টে অ্যালবামের পাশাপাশি জনপ্রিয় আরও কয়েকটি গান শুনিয়েছে সদস্যরা।

সেহরিশের সাদা শার্ট ঘামে ভিজে চিপচিপে হয়ে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। শার্টের উপর থেকে আরও কয়েকটা বোতাম খুলে জোরে শ্বাস ফেলল সেহরিশ। সাদাফ ওকে লক্ষ্য করে ওর দিকে এগিয়ে এল। একটা পানির বোতল সেহরিশের দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,
  'ঘামছিস! আজ এতো ক্লান্ত হয়ে গেলি কিভাবে?'
সেহরিশ স্টেজে বসে পড়ল। হাঁটুর উপর দুই হাত রেখে তাকাল সাদাফের দিকে। বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করার পরও তার অস্থিরতা কমছে না। বুকের বা পাশে ধড়ফড় করছে। ধুকধুক শব্দ হচ্ছে। 
সেহরিশ তার তর্জনী আঙুল দিয়ে কপালে জমা ঘাম মুছতে লাগল। শুক্ল গলা কাশি দিয়ে পরিস্কার করে বলল, 
  'অস্থির লাগছে! প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছে কোথাও না কোথাও খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।'

সাদাফ আস্তে করে সেহরিশের কাঁধে ওর হাতটা রাখল। কোমল গলায় বলল, 
  'এসব কিছুই না। তুই একটু বেশি চিন্তা করছিস।'
সেহরিশ নিষ্প্রাণ গলায় বলল, 
  'আমাদের শত্রু কে তা এখনো জানতে পারিনি। সে এখনো খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নিচ্ছে। আবার কোন প্ল্যান করছে? জানি না। আমার এই অস্থিরতা কাকে ঘিরে?'
সাদাফ নিশ্চুপ। সেহরিশ নির্লিপ্ত কণ্ঠে আবারও বলল,
  'পারফরম্যান্স শেষ। এখন কিছু ফর্মালিটি আছে। সেগুলো তুই আর তূর্ণ মিলে করে নিস। আমি বাড়ি যাচ্ছি।'

তাত্ক্ষণিক সাদাফ সেহরিশের হাত ধরে ফেলল। সেহরিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকায়। সাদাফ রুক্ষ গলায় বলল, 
  'প্রতিবার তুই এটা ওটা বলে চলে যাস। কিন্তু আজ না। সব শেষে আমরা একসাথে বের হবো।'
তূর্ণ দৌঁড়ে এল। সাদাফ ও সেহরিশের মাঝখানে বসে গেল ও। তারপর প্রফুল্লচিত্তে বলল,
  'কত মাস পর কনসার্ট করছি। ভীষণ ভালো লাগছে। শ্রোতাদের দেখ কত আগ্রহ নিয়ে ওরা আমাদের গান শোনে। আমি ওদের দেখি আর মুগ্ধ হই।'
সেহরিশ চোখ জোড়া বন্ধ করে। নাক দিয়ে গরম গরম শ্বাস বেরুচ্ছে। মস্তিষ্ক যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছে যেন। ছটফট করছে ও।

ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক স্টেজের উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে দাঁড়িয়ে নজর রাখছে চারদিকে। এখন পর্যন্ত সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে চলছে। ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক এর কাছে সেহরিশের ফোন। বার বার ভাইব্রেট হচ্ছে। ফ্রাঙ্ক ব্লেজারের পকেট থেকে সেহরিশের ফোন বের করে। স্কিনে জ্বলজ্বল করছে বাড়ির ইমারজেন্সি নাম্বার। 

ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক এর মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল। উনি কল রিসিভ করে প্রথমে হ্যালো বলে জানতে চাইল, কে? বাড়ির প্রথম সারির স্টাফের হেড নাশরা। 
নাশরার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। কণ্ঠনালি দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। শব্দরা এলোমেলো হয়ে গেছে। ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক একই প্রশ্ন দুবার করলেন একটু উঁচু গলায়।  

নাশরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, 
  'ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক; ম্যাম রোদেলা কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ওনাকে অনেক খুঁজে ছি। ম্যাম, কোথাও নেই।'

ফ্রাঙ্কের চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে গেল। যেনো এখুনি কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। শুঁকনো ঢোক গিলল ফ্রাঙ্ক। এমন ভয়ানক কথা তার জীবনে কখনো শোনেনি বলে মনে হচ্ছে। ফ্রাঙ্ক ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। রোদেলা নেই। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এই খবরটা সেহরিশ কে সে কিভাবে শোনাবে? এই ভয়ানক কথা শোনার পর সেহরিশের রিঅ্যাকশন কেমন হবে? ভাবতেই ফ্রাঙ্কের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। আর দেরি করা চলবে না। ফ্রাঙ্ক ডানেবামে মাথা নাড়লো। যা হবে দেখা যাবে। ঝড় তুফান আসলেও সেহরিশ পর্যন্ত এই খবরটা তাকে পৌঁছাতে হবে। ফ্রাঙ্ক স্টেজে উঠল। নিশ্চল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সেহরিশ ও সাদাফের পাশে এসে দাঁড়াল। 

ফ্রাঙ্কের মুখ ফ্যাকাশে। সাদাফ দেখামাত্র ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলল। সেহরিশ ওর দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
  'কিছু বলবে?'
ফ্রাঙ্ক অস্ফুটস্বরে বলল,
  'জি।'
  'বলো।'
ফ্রাঙ্ক কম্পিত গলায় বলল, 
  'স্যার, আপনার বাড়ি থেকে কল আসছে মাত্র। লেডি নাশরা জানালো, রোদেলা ম্যামকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।'
সেহরিশ সঙ্গে সঙ্গে তাকাল ফ্রাঙ্কের দিকে। স্বচ্ছ সাদা চোখ দুটো আচমকা রক্তিম হয়ে উঠছে। সাদাফ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল, 
  'মানে? কি বলছ?'
ফ্রাঙ্ক উপর নিচ মাথা নাড়লো। ও যা বলছে সেটা সত্য।

সেহরিশ কোনো দিকে তাকাল না। যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই বের হওয়ার পথের দিকে ছুটে গেল। সাদাফ আর তূর্ণ ও তার পিছু নিল। 
রাত সাড়ে দশটা। সেহরিশ বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো মূহুর্তে এক্সিডেন্ট হতে পারে। সাদাফ ও তূর্ণ পেছনের গাড়িতেই আছে। সাদাফ গাড়ির স্পিড আরেকটু বাড়াল। 

সেহরিশের গাড়ির পাশাপাশি সাদাফের গাড়ি। সাদাফ জানালা দিয়ে সেহরিশের দিকে তাকিয়ে উচ্চ গলায় বলল, 
  'সেহের স্লো।'
সেহরিশ আর-ও স্পিড বাড়াল।

সেহরিশ বাড়ি পৌঁছাল। ড্রয়িং রুমে সব স্টাফরা মাথা নিচু করে দাঁড়ানো। সেহরিশ রাগী চোখে তাকিয়ে। সাদাফ আর তূর্ণ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশ সবার উদ্দেশ্য প্রশ্ন করল, 
  'এতো রাতে রোদ একা বাহিরে গেল কিভাবে? তোমরা যেতে দিয়েছ কেন?'
নাশরা আমতা আমতা করে বলল, 
  'স্যার, ম্যামের বাড়িতে ভাল লাগছিল না। তাই উনি বাহিরে যেতে চায়। আমরা নিষেধ করেছিলাম। এ-ও বলেছি আমরা কেউ একজন সাথে যাই। ম্যাম, সরাসরি না করেন। বলেন উনি বেশিদূর যাবেন না। আশেপাশেই থাকবেন। তারপর ডিনারের জন্য টেবিল সাজাতে বলে চলে যায়।'

সেহরিশের রাগ ক্রমশ বাড়ছে। ওর হাত অসম্ভব কাঁপছে। তূর্ণ জিজ্ঞেস করল,
  'তোমাদের ম্যাম কয়টা বাজে বেরিয়েছিল?'
নাশরা একটু ভাবলো। বলল,
  'নয়টা বা সাড়ে নয়টা।'

সাদাফ এগোল। সেহরিশের উদ্দেশ্য লহু কণ্ঠে বলল, 
  'তুই যে ভয় পাচ্ছিস সেটা না-ও হতে পারে। রোদেলা হাঁটতে হাঁটতে হয়তো কিছুটা দূরে চলে গেছে। আশেপাশের সিসি ক্যামেরা চেক করে দেখা যাক।'
সেহরিশ অসহায় চোখে তাকায় সাদাফের দিকে।

ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক অল্প সময়ের মধ্যে আশেপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জোগাড় করে ফেলল। সেহরিশ, তূর্ণ আর সাদাফ আলাদা আলাদা ল্যাপটপে রেকর্ড দেখছে। বেশ খানিকক্ষণ পর একটা ভিডিও ফুটেজে তূর্ণ রোদেলা কে দেখল। চিৎকার করে বলে ওঠল,
  'ওই তো রোদেলা।'

সেহরিশ ও সাদাফ ওদের চেয়ার থেকে উঠে এলো তূর্ণর কাছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল রোদেলা কে। রোদেলা একা নেই। ওর সঙ্গে আছে মিটু আর, আর একটা সাত কিংবা আট বছরের ছেলে। সেহরিশের ভ্রুজোড়া দ্বিগুণ কুঁচকে গেল। বাচ্চাটা রাস্তায় ফুটবল খেলছে। রাত ন'টা বাজে। এই সময় ছেলেটাকে রাস্তায় দেখে রোদেলা তাকে কাছে ডাকলো। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করল,
  'এতো রাতে বাহিরে কি করছো?'
বাচ্চা ছেলেটা বলল,
  'আমার বাবা-মা রোজ ঝগড়া করে। আমআমার এই সময় বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করে না। তাই বেরিয়ে আসছি।'
রোদেলা মৃদু হাসল। বলল,
  'তুমি এখনো ছোটো। এভাবে রাস্তায় হাতটা তোমার জন্য ভালো না। বিপদ হতে পারে। এখুনি বাড়ি চলে যাও।'

মিটু পি করার জন্য একটু ঝোপের আড়ালে গিয়েছিল। বাচ্চা ছেলেটার কথা শুনে সে বেরিয়ে এল। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ছেলেটার চেহারা দেখে মিটু অন্য সুরে ডাকতে শুরু করল। দুই মাস পর পুরোনো বন্ধু কে আবারও দেখার আনন্দ মিটুর। সে দ্রুত ছুটে এল। তারপর বাচ্চা ছেলেটার শরীরের সঙ্গে ঘেঁষতে লাগল। মিটুকে পেয়ে সে-ও মহা খুশি। রোদেলা বুঝতে পারল মিটুর আসল মালিক এই বাচ্চা। 

ছেলেটার নাম দিরান। ওর একমাত্র বন্ধু মিটু। বাবা মায়ের ঝগড়ার কারণে মিটুকে নিয়ে বাড়ির বাহিরের যায় দিরান। আর সেদিনই মিটু ওর থেকে হারিয়ে যায়। অনেক খুঁজেও পায়নি। দিরানের চোখ থেকে টলটল করে অশ্রু পড়ছে। দিরান অকপটে অনেক প্রশ্ন করে রোদেলাকে। সে কিভাবে মিটুকে পেয়েছে? এতদিন ওর যত্ন নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানায়। দিরান বলল,
  'আপনি এতদিন ধরে ওকে লালন পালন করেছেন। ওর উপর এখন শুধু আপনার অধিকার। আপনি তো অনেক বড় চাইলে আরও একটা কুকুর আনতে পারবেন। আমার ডেজল কে আমাকে দিয়ে দিন। ও ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু নেই।'
রোদেলা আবারও হাসল। ছেলেটার আবদার করার ধরন ওর মন স্পর্শ করল। সে-ও এক সময় তার মামার কাছে এভাবেই আবদার করতো। রোদেলা হাসিহাসি মুখে উপরনিচ মাথা দুলালো। দিরান মিটু আর ওর ফুটবল নিয়ে বাড়ির দিকে দৌঁড় লাগাল। রোদেলা আরও কিছুক্ষণ একা একা কাঠের বেঞ্চটায় বসে রইল।

প্রকৃতি তার থেকে শুধু নেয়। দেওয়ার নামে শুধু দিয়েছে সেহরিশকে। যে একা পুরো পৃথিবীর সমান। রোদেলা মলিন হাসল। এরপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সে ছাড়া কেউ নেই। এভাবে একা একা এতদূর সে কখনো আসেনি। রাতে হাঁটার অভ্যেস তার সেহরিশের থেকে হয়েছে। প্রায় রাতে দুজন একসাথে হাঁটতে বের হয়। কখনো কখনো সেহরিশ মজার ছলে রোদেলার সঙ্গে দৌঁড় প্রতিযোগিতা করে। তারপর নিজেই ইচ্ছা করে হেরে যায়। 
রোদেলা পুরোনো কথা ভেবে কুটিল হাসল। কিছু স্মৃতি কখনো পুরোনো হয় না। যখনই মনে হয় একগাল হাসি উপহার দিয়ে যায়।

রোদেলার এবার বাড়ি ফিরতে হবে। ঝরঝরে বাতাস তার মনকে অনেকটাই ভালো করে দিয়েছে। বেঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে উঠে হাঁটতে লাগল রোদেলা। হঠাৎ একটা কালো রঙের গাড়ি রোদেলার পাশে থামল। গাড়ি থেকে চারজন লোক নামে। ওরা রোদেলার হাত ধরে জবরদস্তি গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে।

সেহরিশ দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। সাদাফ ওর ম্যানেজার এর উদ্দেশ্য বলল,
  'ট্রাফিক অফিসে কল করো। আর গাড়ির নাম্বারটা দিয়ে বলো, এই গাড়িটা কোন কোন পথে ও কয়টায় দেখা গেছে।'

তূর্ণ হুট করে বলল, 
  'এই কাজ জোহান করে নি তো?'
সাদাফ বলল, 
  'জোহান এসব করতে পারে না। ও শুধু মুখে বকবক করতে পারে। তাছাড়া ওর তো কোনো খবরই নেই। অবাধ চলাফেরার জন্য এক বছর আগে ওর বাবা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। তারপর ওকে আর দেখা যায়নি।'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'জোহান কে আমি যতটা চিনি ও শুধু আমাকে একবার প্রতিযোগিতায় হারাতে চায়। ও এসব নিচু কাজ করতে পারে না।'
তূর্ণ বিচলিত কণ্ঠে বলল,
  'কিন্তু সত্য এটা রোদেলা কিডনেপ হয়েছে।'

সেহরিশ শক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'ফ্রাঙ্ক, আগামী দশ মিনিটের মধ্যে আমি রোদের লোকেশন চাই।'

শহর থেকে দূরে একটা বড় নদী। স্বচ্ছ নীলাভ জল। নদীর তীরে বিশাল বড় পরিত্যক্ত এক গোডাউন। এর মধ্যে পুরোনো ড্রাম ও কাটুন বাক্স রাখা আছে। রোদেলা কয়েকটা কাটুনের পাশে শুয়ে আছে। দীর্ঘ সময় পর তার জ্ঞান ফিরল। পিটপিট করে চারিদিকে তাকাল সে। অন্ধকার। বাক্সের আড়াল দিয়ে অল্প আলো আসছে। রোদেলা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। কাটুকের পাশে দাঁড়িয়ে দেখল কয়েকজন পুরুষ লোক বসে তাস খেলছে। আর বিশ্রী ভাবে হাসছে। রোদেলার শরীর শিউরে ওঠে। তারপর ভাবতে লাগল এখানে কিভাবে আসলো? 

নিঃশব্দে, কোনো শব্দ না করে এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগল রোদেলা। কিছুক্ষণ পর একটা ছোটো জানালা দেখতে পেল। এখান থেকে বের হতে গেলে হাত পা কাঁটার সম্ভাবণা আছে। তবু কোনো কিছুর পরোয়া না করে বের হওয়ার কৌশল চিন্তা করতে লাগল রোদেলা। 
গোডাউনের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। শব্দ শুনে একজন বলে ওঠল,
  'বস আসছে।'
দুজন এগিয়ে গেল গোডাউনের দরজা খোলার জন্য। বসে থাকা লোকদের মধ্যে একজন বলল,
  'বস নিশ্চিত এই মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। এতো সুন্দরী মেয়ে শরীর ভোগ না করে কিভাবে জ্বালিয়ে ফেলবো?'
দ্বিতীয় জন লালসার সুরে বলল, 
  'ঠিক কথাই বলছিস! ওকে দেখলেই শরীর গরম হয়ে যায়। বস অনুমতি দিলে সবাই এক রাত ওকে নিয়ে ফূর্তি করব।'
তৃতীয় জন বলে ওঠল, 
  'বস এই কাজের জন্য কখনো অনুমতি দিবে না।'
প্রথম জনের ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল। সে তৃতীয় জনের কাঁধে হাত রেখে বলল, 
  'জীবিত হোক বা মৃত আমার চাই, চাই। ধর, বস ওকে মেরে চলে গেল। তারপর জ্বালানোর কাজ তো আমাদের করতে হবে। তখন না হয় সবাই এক এক করে ভোগ করলাম।'
রোদেলার শরীর কেঁপে ওঠল।

রোদেলার পা কেটেছে অনেকটা। ফোট ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও অচেনা অজানা রাস্তায় দৌঁড়ে যাচ্ছে ও। অনেক দূর চলে আসছে। হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন শ্বাস টেনেও হাঁপানি কমছে না। বুক ভারী হয়ে আসছে তার। রোদেলার বুকের উপর হাত রেখে জোরে চাপ দিল। তারপর শ্বাস ফেলল। শাড়ির আঁচলের দিকে অনেকটা ছিঁড়ে গেছে। টান দিয়ে অনেকটা ছিঁড়ে ফেলল রোদেলা। পায়ের ক্ষত স্থান কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। তারপর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। চাঁদের শীর্ণ আলোয় রাস্তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রোদেলা আবারও দৌঁড়াতে লাগল।

মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেহরিশের চিন্তা। মানুষটা কোথায় আছে? বাড়ি ফিরে গেছে? ও বাড়িতে নেই। দেখে নিশ্চয়ই রাগ করেছে। এতক্ষণে খুঁজতেও বেরিয়ে পড়েছে। রোদেলা হোটচ খেয়ে উল্টে পড়ল রাস্তায়।

জোহান গোডাউনে প্রবেশ করে। আর প্রথমে জিজ্ঞেস করে রোদেলার কথা। রোদেলাকে যেখানে রাখা হয়েছে ওরা জোহান কে সেখানে নিয়ে গেল। রোদেলা নেই। জোহান ক্ষিপ্ত হয়ে একজনের গলার চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, 'মেয়ে কোথায়?'
লোকটা হাসপাস করে বলল,
  'এইখানেই ছিল বস। জ্ঞান ফিরেছে হয়তো। গোডাউনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়েছে হয়তো। আমাদের একটু সময় দিন তাকে খুঁজে বের করার।'
জোহান হাত সরালো। ওরা এক এক করে আলাদা হয়ে রোদেলাকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ এই সময় গোডাউনের বাহির থেকে গাড়ির শব্দ আসলো। জোহানের কানে আওয়াজ পৌঁছাতে সে একটা গুপ্ত জায়গায় লুকিয়ে পড়ল। এই সময় কে আসবে? এই জায়গার কথা কেউ জানে না। জোহান পলকহীন চোখে দরজার দিকে নজর রাখল। 

একটু পর, সেহরিশ প্রবেশ করল। ওর সঙ্গে তূর্ণ আর সাদাফ আছে। তার পেছনে বেশ কয়েকজন বডিগার্ড। জোহান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এইখানে সেহরিশকে প্রত্যাশা করে নি মোটেও। অন্য দিকে রোদেলা গায়েব। জোহান আড়ালে দাঁড়িয়ে নজর রাখল। সে দেখতে চায় সেহরিশ কি করে?

উপর তলা থেকে লোকগুলো নেমে এল। অপরিচিত মানুষ দেখে ওরা আক্রমণ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাদাফ ও তূর্ণ এগোল ওদের সঙ্গে অস্ত্র ছাড়া লড়াই করতে লাগল। বেশিরভাগ লোককে মেরে আধমরা করে মাটিতে ফেলল সেহরিশ।

সরু চোখে তাকাল জোহান। জিভের ডগাটা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
  'এতোগুলা পাঠাকে একাই মেরে ফেললো। সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী তোমাকে আমি যত হালকা ভাবে নিয়েছি ততোটা সহজ তুমি নও।'

সব-কয়টা মার খেয়ে পড়ে আছে। ওদের মুখ থেকে শেষ গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে। সেহরিশের তীক্ষ্ণ গলার স্বর, সরু চোখের দৃষ্টি। সেহরিশ অতি জোরে ধমক দিয়ে ওদের শাসিয়ে বলল, 
  'মাই ওয়াইফ রোদেলা তোমাদের জিম্মায় আছে। তাকে সম্মানের সাথে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। নাহলে আমি তোমাদের সবাইকে খুন করে ফেলব।'

জোহান চোখ-মুখ কাঠ কাঠ করে ফেলল। সেহরিশের কণ্ঠটা দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো। আরও একবার চমকে উঠল জোহান। তার বিস্ময় বাড়ছে।

সাদাফ জোরে শ্বাস ছাড়ল। সে দেখল দূর থেকে একজন লোক সেহরিশের সোজাসুজি পিস্তলের নিশানা করছে৷ সাদাফ নড়েচড়ে দাঁড়াল। সে বেশ উঁচু গলায় সেহরিশকে হুশিয়ার করার জন্য সাবধানী কণ্ঠে বলল,
  'জেগান! সাবধান। বামে তাকা।'

সেহরিশের তীর্যক চাহনি। সেহরিশ মাথা ঘুরিয়ে বামে তাকাল। পিস্তল হাতের লোকটা গুলি করার আগে তূর্ণ গুলি করল তাকে। তূর্ণ খানিক এগিয়ে গেল সেহরিশের দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'জেগান কে বাঁচানোর জন্য তার দুটো ডান হাত সোঁদা প্রস্তুত।' 

জোহানের চোখে-মুখে আঁধার নেমেছে। কপালে ভাজ ফেলে বিড়বিড় করে বলল, 
  'জেগান? জেগান? সেহরিশ, জেগান! বিশ্বখ্যাত সিঙ্গার আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া জেগান?' 
জোহান বিস্মিত। ওর চারপাশ থেমে গেছে যেনো।

সাদাফ শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
  'রোদেলা কোথায়? তাকে জলদি নিয়ে আসো। মানুষ চেনো না বোকা! মাফিয়া বাপ জেগানের স্ত্রীকে তুলে নিয়ে আসছো। প্রাণের ভয় নেই? জেগান! তোমাদের এক মূহুর্তে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিবে।'

থরথর করে কেঁপে ওঠল ওরা। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
  'আমাদের ক্ষমা করে দাও। আমরা এসব কিছুই জানি না। আমার টাকা দিয়ে বলা হয়েছে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আসার জন্য।'

তূর্ণ বলল, 
  'কে বলেছিল?'

প্রথমজন বলল,
  'আমরা তাকে চিনি না। ও আমাদের একটা নাম্বার থেকে কল করতো আর ওর নাম টাও আমরা জানি না।'

এরিশ এগোল। প্রথম জনের থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ডায়ালে নাম্বার চেক করল। এরিশ চমকাল। ফোনটা এগিয়ে দিল সেহরিশের দিকে। বলল,
  'মার্কাসের নাম্বার।'

সাদাফ গা ছাড়া ভাবে বলল,
  'গোডাউনের বাহিরে যে গাড়িটা ওটাও তো মার্কাসের বলেই মনে হচ্ছে।'

সেহরিশ জোরে শ্বাস টানলো। চিৎকার করে বলল, 
  'গতকাল আমার সঙ্গে দেখা হল আর আজই আমার ওয়াইফকে তুলে এনে ওর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে।'

সেহরিশ আহত লোকেদের দিকে তাকাল। দ্বিতীয় জন ভয়ে আঁতকে উঠল। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল, 
  'আমরা জানি না সে কোথায়? গোডাউনের পেছন দিকে সরু জানালা আছে। সবসময় বন্ধ থাকে। মাত্র দেখে আসলাম খোলা। মনে হয় উনি ওখান দিয়ে পালিয়েছেন।'

ওর কথা শেষ হওয়া মাত্র সেহরিশ গোডাউন থেকে বেরিয়ে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে গোডাউনের পেছনে যাওয়ার রাস্তা খুঁজলো। জানালায় অল্প রক্ত দেখতে পেল সেহরিশ। হুট করে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা শুরু হলো তার। সেহরিশ তাকাল। তিনটা পথ। এর মধ্যে রোদেলা কোনদিকে গেছে? সেহরিশ রাস্তার দিকে তাকাল। যে পথে রক্তের ফোঁটা দেখতে পেল সে ওদিকে দৌঁড়ে গেল। 

সেহরিশ ঘুরে ঘুরে রোদেলাকে খুঁজছে। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
  'রোদ, রোদ! কোথায় তুমি?'

কোনো শব্দ নেই। চারিদিক নিরব, নিস্তব্ধ । সেহরিশ আরও জোরে দৌঁড় দিল। পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠল,
  'রোদ, রোদেলা?'

অপরিচিত রাস্তা অল্প ভয় ও কাজ করছে। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বিস্ময়াভিভূত দাঁড়িয়ে গেল রোদেলা। বাতাস বইছে। গাছের পাতা গুলো নড়ে ঝনঝন শব্দে হলো। রোদেলার বুক কেঁপে ওঠল। এই সামান্য আওয়াজে তার ভয় লাগছে। এই জায়গাটায় এসে পা থেমে গেছে রোদেলার। শ্বাস আটকে গেছে যেন। এ-সময় খুব কাছ থেকে কারো পায়ের ধ্বনি শুনে চমকে উঠল রোদেলা। ওই দুষ্টু লোকগুলো তাকে খুঁজতে খুঁজতে এই পর্যন্ত এসে গেছে। রোদেলা শক্ত হলো। আবারও দৌঁড় শুরু করবে এমন সময় শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাল উৎকণ্ঠিত গলার ডাক। রোদেলার বুকের ভেতর ধাক্কা লাগল। সে ঘুরে তাকাল। যে পথে এসেছিল সে পথে আবার দৌঁড়াতে লাগল। একটু পর পথে দাঁড়িয়ে পড়ল রোদেলা। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল কেবল। হঠাৎ হঠাৎ দূর থেকে নাম না জানা পশু পাখির আওয়াজ ভেসে আসছে। পরোক্ষণেই চারপাশ আবার নিশ্চুপ, শান্ত। দু'টো মানুষ রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। সেহরিশ বলল,
  'রোদ!'

রোদেলা মাথা ঝুঁকালো। সেহরিশের মুখটা দেখে জোরে শ্বাস নিল রোদেলা। এরপর ছুটতে লাগল সেহরিশের দিকে। রোদেলার দু-চোখে জল জমলো। আবছা দেখতে লাগল। রোদেলা সেহরিশের বুকে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। সেহরিশের শরীর কাঁপছে থেমে থেমে। একজন কঠিন ব্যক্তিত্বের পুরুষ মানুষ। যে কখনো কিছু হারানোর ভয় করেনি। প্রিয় মানুষ হারানোর ভয় আজ তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। সেহরিশের দৃষ্টি মাটির দিকে। ক্ষীণ কণ্ঠে আধ ভাঙা স্বরে বলল,
  'ভয় নেই! এই বুকে তুমি সুরক্ষিত।'
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp