"আমার একটা কিডনি বিক্রি করলে কত পাবো? পঁয়ষট্টি আসবে না?"
অনন্যা ঘুমের ঘোরে অস্পষ্ট স্বরে বিরবির করলো। আচমকা ওর চোখে মুখে কারো নিঃশ্বাস পড়তেই নড়েচড়ে উঠলো। কয়েক মূহুর্ত ব্যয় হতেই হঠাৎ একজোড়া শক্তপোক্ত হাত তার অগোছালো চুলের মাঝে সরে এলো। আলতো করে মাথা তুলে কেউ একজন নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলো।
ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি গন্ধ নাসারন্ধ্রে পৌঁছাতেই অনন্যার ঘুম ভেঙে গেল। তড়াক করে চোখ খুলে তাকাতেই বুঝতে সময় লাগল না মানুষটি কে! অনন্যার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলা করলো।
কৌশিক অনন্যার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। হাতের বাঁধন শক্ত করে রাখলো। অনন্যা ও কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। তার হাত দুটো স্যারের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। নাড়াচাড়া ও করা যাচ্ছে না।
কৌশিক হঠাৎ প্রশ্ন করলো,
"কিডনি কেনো বিক্রি করতে হবে? "
অনন্যা থতমত খেয়ে গেল, অপ্রস্তুত হয়ে কাশতে লাগলো। কৌশিককে দূরে সরানোর চেষ্টা করতেই কৌশিক আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
"হুশ! চুপ করে বসো।"
অনন্যা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
"শীত করছে। "
"উঁহু না, রাগ করেছো।"
"না। ছাড়ুন।"
কৌশিক আকস্মিকতার সাথে অনন্যার গলায় ঠোঁটের স্পর্শ বসিয়ে দিলো। অনন্যা হতবাক হয়ে গেল। সারা শরীর কেঁপে উঠল শিহরণে।
কৌশিক ধীরস্থির গলায় বলল,
"ছেড়ে দিলাম। মুখটা ঠিকমতো ধুয়ে আসো, প্রিন্সেস। নাহলে সবাই বলবে, আমার বউ এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলো।"
অনন্যা মুখ ফুলিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কৌশিক বললো,
"তোমার মা বললেন, তুমি তাদের লাকি চার্ম। যতদিন তুমি ছিলে, সব ঠিকঠাক চলছিল। আর তোমাকে রেখে আসার পর থেকেই ওনাদের দুর্দিন শুরু হয়েছে। তুমি কি মনে করো, সত্যিই এটা তোমার কারণে?"
অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কৌশিক ধীরে ধীরে ওকে ছেড়ে দিলো। অনন্যা নিচু গলায় বললো,
"লাকি চার্ম বলে আদৌ কিছু আছে কিনা, জানি না। তবে আমি বিশ্বাস করি না যে, কারও ভাগ্য আরেকজনের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। কেউ কারো জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে, আবার কেউ দূরে থাকলেই দুর্দিন নেমে আসে এটা যদি সত্য হতো, তাহলে জীবন এতটা অনিশ্চিত থাকতো না। সময়ের নিজস্ব একটা ছন্দ আছে। কখনো আলো, কখনো আঁধার। মেঘের পর বৃষ্টি আসে, তারপর আবার আকাশ পরিষ্কার হয়। আমাদের জীবনের ওঠানামাও তেমনই। কেউ চাইলেই কারও সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে না, যেমন কেউ একা কারও দুর্দশার কারণও হতে পারে না। আমরা শুধু নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করতে পারি, বাকিটা সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়।"
কৌশিক মুচকি হেসে বললো,
"কিন্তু আমি বাস্তববাদী নই। তাই তুমি আমার লাকি চার্ম। ওকে?"
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কৌশিক অনন্যার গালে বাম হাত আলতো করে রেখে আবার বললো,
"আজকে তো ছুটি। কয়েক দিন এখানে থেকে মা আর ভাইয়ের সঙ্গে সময় কাটাও। আমি আসছি।"
এই বলে কৌশিক উঠে দাঁড়ালো, তারপর ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোতে লাগলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে অনন্যা দ্রুত বিছানায় হাঁটু গেড়ে ভর দিলো, তারপর এক দৌড়ে এসে কৌশিকের পিঠে লাফ দিয়ে উঠে গেলো। কৌশিকের কাঁধে এক হাতে ভর রেখে আরেক হাত দিয়ে গলা আঁকড়ে ধরলো। অনন্যার পা দুটো পেঁচিয়ে ফেললো কৌশিকের কোমড়।
কৌশিক হঠাৎ ওজনের ধাক্কায় খানিকটা সামনে ঝুঁকে গেলো, তারপর ভারসাম্য সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
অনন্যা বললো,
"আরে জামাইবাবু, যাচ্ছেন কোথায়?"
কৌশিক ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
"আর ইউ ম্যাড?"
"ইয়েস! আপনার সাহস কত বড়! আপনি নিজের বউকে রেখে চলে যাবেন! আপনি ম্যাড। "
"এভাবে কেউ পিঠের উপর উঠে বসে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার!"
অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
"আপনাকে আমি শাস্তি দেবো।"
কৌশিক কিছু বোঝার আগেই অনন্যা ঝুঁকে কৌশিকের ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিলো। কৌশিক চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত স্থির থাকলো, তারপর ধীর গলায় বললো, "অনন্যা! ডোন্ট...!"
অনন্যা বড় কামড় বসিয়ে শান্ত হলো। কৌশিকের ফর্সা হলুদ ঘাড়ে গাঢ় ছাপ বসিয়ে ফেলেছে।
অনন্যা সরে এসে কঠিন স্বরে বললো,
"আপনার সাহস কত! ফোন কেটে দেন! আমার ফোন ধরেন না! কয়েকদিন ধরে আমাকে ইগনোর করছেন! আবার এখন এসে ঢং দেখাচ্ছেন? মা আর ভাইয়ের কাছে আমাকে রেখে যাবেন?"
"তোমার ভালোর জন্যই বলেছিলাম।"
"শাট আপ! আপনার এই ভারী পোশাক দেখে তো মায়ের বুঝে যাওয়া উচিত ছিল যে আপনি মানুষ না। দাঁড়ান, আমি মাকে বলছি।"
কৌশিক তীব্রভাবে শ্বাস ছেড়ে বললো, "একদম না। মাই মাদার ইন ল ইজ ভেরি এডভান্স! ওকে?"
অনন্যা মুচকি হাসল,
"তাই? তো বলবো আপনার মাদার ইন ল কে সব কিছু? হুম?"
কৌশিক কোন উত্তর না দিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। নিজের হাত দিয়ে অনন্যাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে বললো, "বলে দেখো। আই ডোন্ট থিংক তোমার মা এসব কথায় বিশ্বাস করবে। উল্টো তোমাকে পাগল ভাবতে পারে। ইন্জয় ইউর ডে উইথ ইউর ফ্যামিলি।বাই, প্রিন্সেস।"
অনন্যা বিছানায় বসে রাগে কাঁপছে। তার গা রি রি করছে, এই লোকটা কতটা খারাপ! সে ভাবতেই পারছে না।
*****
প্রায় দুই দিন পর কৌশিকের সাথে অনন্যা বাসায় ফিরেছে। এখনও রাগটা মাথায় চড়ে আছে। লোকটা ফেলে চলে এসেছিল, নিতেও আসেনি। অনন্যা রাগ করে ভার্সিটিতে ও একদিন যায়নি। বিকালের দিকে টিউশনি করাতে গিয়েছিল শুধু।
আজ সন্ধ্যার দিকে হুট করেই অনন্যার মামার বাসায় উপস্থিত হয়ে প্রায় জোর করেই অনন্যাকে নিয়ে এসেছে কৌশিক। গাড়িতে বসে, অনন্যা কোনো কথা বলেনি, কৌশিকও বলেনি।
বাসায় প্রবেশ করতেই, বসার ঘরে একটি অপরিচিত কন্ঠের আওয়াজ শোনে অনন্যা। তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো, সন্দেহের সাথে কৌশিকের দিকে তাকালো। কৌশিকও বিস্মিত হয়ে দ্রুত পা ফেলে বসার রুমে চলে গেলো। সোফায় বেগুনি গাউন পরিহিত একজন মেয়ে বসে আছে, মুখে ভারী মেকাপ, লম্বা চুল কোমর পর্যন্ত দুই পাশে ছড়ানো। ব্রাউন রঙের চুলগুলোতে বেশ মানিয়েছে মেয়েটিকে। টানা টানা চোখ দুটোয় আইলাইনার দেওয়া, চোখের পলকে পুরো পরিবেশ যেন নুইয়ে পড়ছে। হাতে এক কাপ লিকার চা, গোলাপী লিপস্টিক পরিহিত ঠোঁট দিয়ে চায়ে সে অল্প চুমুক দিয়েই বিরক্তিকর আওয়াজ করলো।
মেয়েটি জোর গলায় বললো, "লারা! ওয়াট ইজ দিস? এটা চা নাকি পানি? কী বানিয়েছো তুমি?"
লারা ছুটে এসে মাথা নিচু করে বললো, "স্যরি ম্যাডাম! আবার বানিয়ে নিয়ে আসছি।"
মেয়েটি তীব্রভাবে মাথা নেড়ে বললো, "না থাক! আবার একি জিনিস নিয়ে আসবে। জানা আছে আমার। এইগুলো কিয়ান খায় কী করে?"
"সাব তো কফি খায়।"
"ওহ! গুড চয়েস! এসব পানি মার্কা চা খেতেই বমি এসে পড়ে নিশ্চয়ই।"
এমনটা শুনে লারা আর কিছু বলতে পারলো না, মুখে এক হতাশা ছড়িয়ে পড়লো।
কৌশিক এগিয়ে এসে বললো,
"ভেনোরা! এসেই তুমি লারাকে এভাবে অপমান কেনো করছো?"
অনন্যা শ্বাস ফেলে বিরবির করে বললো,
"তাহলে ইনিই সেই তৃতীয় ব্যক্তি, উনাদের বন্ধু।"
লারা কৌশিককে ধন্যবাদ জানিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।
কৌশিককে দেখে ভেনোরার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। বসা থেকে উঠে এগিয়ে আসলো সে। জোর করে কৌশিককে জাপটে ধরলো। কৌশিক বিরক্তের সাথে চাইলো, চোখ আচমকা অনন্যার দিকেও গেলো।
অনন্যা অবাক হয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো। কৌশিক তাকাতেই সে মুখটা নামিয়ে নিলো। মাথাটা এক নিমিষেই গরম হয়ে গেলো।
ভেনোরা কৌশিকের পিঠে চাপড় মেরে বললো,
"বন্ধু, কতদিন পর দেখা!"
নিকও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। বের হয়েছিল বাইরে যাওয়ার জন্য, কিন্তু সেই ইচ্ছায় গুড়ে বালি। ভেনোরাকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে দ্রুত কাছে এসে দুজনকেই জড়িয়ে ধরলো,
"আমাকে ছাড়া তোমরা আলিঙ্গন করছো? দিস ইজ নট ফেয়ার।"
অনন্যা অবাক হয়ে এ দৃশ্য দেখছিল। কৌশিক দুইজনকে ছাড়িয়ে বললো,
"ভেনোরা, আমার ডাকাতেই তুমি এসেছো। নাহলে তোমাকে পাওয়াই মুশকিল।"
"কিয়ান!"
নিক ভেনোরাকে ইশারায় বললো, এই নামে না ডাকতে, কিন্তু ভেনোরা পাত্তা দিলো না। কৌশিকের গালে হাত রেখে মৃদু হাসি দিয়ে বললো,
"ওহ, কিয়ান। তুমি ডেকেছো আর আমি ছুটে এসেছি। বলো কি চাই তোমার! আরো একটা হাগ দেবো?"
ভেনোরার কথা শুনে অনন্যার মাথা আরো গরম হয়ে যাচ্ছে। স্যার ও মেয়েটার কথায় পাত্তা দিচ্ছে। কৌশিক ভেনোরার হাত ছাড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসে বললো,
"ইউ আর ফোর ডেইস লেইট! চার দিন আগে তোমাকে সংকেত পাঠিয়ে ছিলাম।"
অনন্যা দূর থেকেই উচ্চারণ করলো,
"আপনারা কি কথা বলছেন একটু বুঝিয়ে বলুন আমাকে।"
ভেনোরা হঠাৎ ঘুরে মেয়েটাকে এক নজরে দেখে নিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। সাধারণ পোশাকে শ্যামলা মুখশ্রী মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে কৌশিকের দিকে ঘুরে বললো,
"কিয়ান! এই পুতুলের মতো মেয়েটা কে?"
কিয়ান নামটা শোনার পর অনন্যার মাথায় কিছু একটা ঝলকিত হলো। দ্রুত মনের মধ্যে কিছু কথা ঘুরপাক খেতে লাগলো। মনে পড়লো, স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিল তার বিদেশি নাম কিয়ান হার্ট!
অনন্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কৌশিকের দিকে তাকালো। কৌশিক কিছু বলতে যাবে, তার আগেই নিক দ্রুত হাত বাড়িয়ে বললো,
"ইনি হলেন অনন্যা। আমি ডাকি অ্যানা! আমাদের কৌশিক সাহেবের বউ।"
ভেনোরা অবাক হয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বললো,
"হোয়াট! আবার বিয়ে? কিয়ান, তুমি আবার বিয়ে করেছো?"
"বিয়ে? আবার বিয়ে? মানে কি? উনি কয়বার বিয়ে করেছেন?"
অনন্যার কণ্ঠে বিস্ময়ের সঙ্গে সন্দেহ মিশে গেলো। সে কয়েক পা এগিয়ে এলো, চোখেমুখে প্রশ্ন খেলা করছে।
নিক আরেক সোফায় বসলো ধীর পায়ে। নিজের মাথায় কয়েকবার চাপড় মারলো। ভেনোরা এসে সব গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছে। আজ নিশ্চয়ই কৌশিকের অবস্থা কাহিল হবে। হয়তো ফাঁসির দড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে অনন্যা।
কৌশিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মুখে স্থিরতা থাকলেও ভেতরে এক অদ্ভুত চাপা ঝড় বইছে। অনন্যার চোখের দিকে তাকানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে। সে কয়েকবার চোখ তুললো, কিন্তু অনন্যার স্থির দৃষ্টি তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিল বারংবার। বাঙালি মেয়েরা এই ব্যাপারে কতটা স্পর্শকাতর, সে খুব ভালো করেই জানে। অথচ বাস্তবটা এমনই যে, একবার নয়, বারবার ঝামেলার মধ্যে পড়েই তাকে বিয়ে করতে হয়েছে।
কোনো বিয়েতেই তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছার প্রতিফলন ছিল না। প্রতিবারই পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে, ঠেলে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায়, যেখানে বিকল্প ছিল না। অনন্যা কি তা বুঝবে? কৌশিকের দৃষ্টি নেমে এলো। অনন্যার রাগ, বিস্ময়, হতাশা সবকিছু অনুভব করতে পারছে সে, অথচ কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। অনন্যাই এমন একটা মেয়ে যে কৌশিককে তার হৃদয় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। তার যে একটা মন আছে, মনটাও অনুভব করতে পারে এবং সেই মনে যে কারো জায়গা দিতে পারে এই বিষয়টা বুঝিয়েছে অনন্যা। নাহলে কৌশিক অনেক অনেক বছর ধরে এক হিংস্রতার জীবন কাটাচ্ছিলো।
কৌশিক অনুভব করতে পারছে অনন্যার সেই দৃষ্টি তার বুকের মধ্যে তীরের মতো বিঁধছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে নিঃশ্বাস ফেললো সে, গলা স্বাভাবিক রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করলো, তারপর মাথা নিচু করে বললো,
" আ~সলে আমি কয়টা বিয়ে করেছি গোণা হয়নি।"
সেই স্বীকারোক্তি ঘরে বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়লো। নিক চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, ভেনোরা অনন্যার দিকে হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে রইল, আর অনন্যা নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিয়ৎক্ষণ পার হতেই অনন্যা আচমকা নিজের মাথা দু'হাতে চেপে ধরলো। ওর চারপাশটা কেঁপে উঠেছে, সুন্দর পৃথিবীটাই চোখের সামনে উল্টে যেতে দেখছে সে। এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করলো,
"এই লোকটা আরো কয়েকটা বিয়ে করেছে? অথচ আমি ভাবছিলাম, আমি একাই! কী বোকা ছিলাম আমি! উফফ! অনন্যা, তুই কি বলদ!"
কৌশিক ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ালো। অনন্যার সামনে এসে গা ছুঁই ছুঁই করে দাঁড়ালো। শান্ত গলায়, মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে বললো,
"লিসেন, বিয়ে করা মানেই সব হয়ে যাওয়া নয়। তুমি যেটা ভাবছো, ব্যাপারটা তেমন কিছু না।"
অনন্যা এক ঝটকায় কৌশিকের হাত ছাড়িয়ে দিলো। অনন্যার দৃষ্টিতে তীব্র আগুনের মতো ক্রোধ ঝলকে উঠলো। কৌশিকের ও বুক কেঁপে উঠলো ।
অনন্যা বললো,
"চুপ থাকুন! আপনি আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন!"
কৌশিক গভীর শ্বাস নিলো। গলার স্বর খানিকটা নরম হয়ে এলো তার,
"ধোঁকা দেইনি, প্রিন্সেস। আমি শুধু তোমাকেই..."
অনন্যা তীব্র চোখে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
"হ্যাঁ, এখন কী সাফাই গাইবেন? আপনার গোণা নেই কয়টা বিয়ে করেছেন? এর মানে আপনি অনেক বিয়ে করেছেন! ভাবতেই কেমন লাগছে মানে, আমি এতো দিন কার সাথে ছিলাম? ছিঃ!"
কৌশিক মুখ খোলার আগেই ভেনোরা এগিয়ে এসে অনন্যার পাশে দাঁড়ালো। ঠোঁটে খেলা করা রহস্যময় হাসি ধরে রেখেই বললো,
"শোনো, বারবি ডল, কিয়ানকে রুমে নিয়ে যাও। ইচ্ছামতো ধোলাই দাও। কয়েকটা ঘুষি-থাপ্পড়ও মারতে পারো। আমি তোমার সাথে আছি, ওকে?"
অনন্যা নিশ্চুপ। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলো বিদ্রোহ করছে, কিন্তু সে দমিয়ে রাখছে। কৌশিক তার প্রতিটি অভিব্যক্তি বুঝতে পারছে, তবু কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। গলার কাছে শব্দগুলো এসে থেমে যাচ্ছে।
ভেনোরা হাসির ছলে অনন্যার গাল টেনে ধরতে গেলো। কিন্তু আচমকা একটা শক খেলো! হাতটা দ্রুত সরিয়ে নিলো, কিছুক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো বিস্ময়ে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি! শরীরের ভেতর দিয়ে হালকা বিদ্যুৎ বয়ে গেলো।
ভ্রু কুঁচকে অনন্যার দিকে তাকালো সে। মনে সন্দেহ দানা বাঁধছে। আরেকবার হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলো অনন্যাকে, কিন্তু তার আগেই অনন্যা দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।
ভেনোরা তাকিয়ে রইলো অনন্যার যাওয়ার পথে।
কৌশিক ও সেদিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ সময় পরে হালকা স্বরে বললো,
"দুজনেই রুমে এসো। কথা আছে।"
******
ভেনোরা নিকের রুমে বসে, তার মুখাবয়বে চিন্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চুলগুলো এক পাশে রেখেছে চিন্তিত হয়ে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে। মুখ তুলে কৌশিক আর নিকের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু শব্দগুলো আটকে যাচ্ছে।
নিক বিরক্তির সাথে বললো,
"মিস ঈগল! অ্যানার সামনে এসব না বললেই পারতে। এখন কৌশিক ব্রোয়ের কি হাল হবে, তা নিয়ে চিন্তিত আমি।"
কৌশিক দুদিকে মাথা নাড়িয়ে, শান্তভাবে বললো,
"ইটস ওকে, নিক। একদিন না একদিন অনন্যা জানতোই। তো আজ কেনো নয়?"
ভেনোরা ফুস করে শ্বাস ছাড়লো। চিন্তিত গলায় বললো, "অনন্যা মেয়েটাকে আমার অন্যরকম লেগেছে।"
নিকের চোখে সন্দেহজনক আলো জ্বলে উঠলো, "মানে?"
কৌশিক কঠোর গলায় বললো,
"অনন্যাকে নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। আগে আমাদের দিকে তাকাও তুমি।"
ভেনোরা মুখ তুললো, তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সজাগ হয়ে উঠলো। কৌশিক আর নিকের দিকে একে একে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরখ করলো দুজনকে। তারপর সোজা উঠে দাঁড়িয়ে, হাত ভাঁজ করে দুজনকে আরো ভালোভাবে পরখ করতে লাগলো।
ভেনোরা তার ঈগল চক্ষু দিয়ে দুজনকে সজাগভাবে দেখতে থাকলো। তার চেহারা থেকে পুরো পরিবেশের উত্তেজনা সরে গেলো।
হঠাৎ একটানা শ্বাস ফেলে, বললো,
"তোমরা নিশ্চয়ই ভুল পথে হাঁটছো!"
কৌশিক ভেনোরার দিকে তাকিয়ে ছিল। ভেনোরা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসলো। শীতল দৃষ্টিতে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইল, স্থির হয়ে কৌশিকের চোখ দুটো দেখলো। অতঃপর নিজের হাত উঁচিয়ে কৌশিকের বুকের ডান পাশে রাখলো, মাথা ঠান্ডা করলো সে। নিজের সমস্ত চিন্তা দূর করে দিলো। কৌশিকের দিকে মনোযোগ দিলো। ভেনোরার হাতের আঙুলের মাঝে স্পন্দিত হলো অদ্ভুত এক শক্তি, সেখান থেকেই কিছু অজানা সবুজ তাপ প্রবাহিত হচ্ছিল। আস্তে আস্তে হাতটি দিয়ে কৌশিকের বুকের স্থানে চাপ দিলো। আচমকা কৌশিকের শরীরে কিছু সঞ্চালিত হতে শুরু করল। চোখ বন্ধ করে ভেনোরা কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু হঠাৎ, এক অপ্রত্যাশিত শক্তি, অমিত শক্তিতে ভেনোরার হাতটি সজোরে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেললো তাকে। ভেনোরা ছিটকে ফ্লোরে পড়ে গেলো, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ক্ষণিকের জন্য অচেতন হয়ে গেলো। চোখ তুলে ভেনোরা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
"কিয়ান! তোমার শরীরে তাপ উৎপন্ন হয়েছে। কি করেছো তুমি নিজের শরীরের?"
কৌশিক কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা সামনে এগিয়ে এল। ধীরে ধীরে নিজের উপরের পোশাক খুলতে শুরু করলো। তার পোশাকের অনেকগুলো ধাপ ছিল। খুলতে খুলতে কৌশিক অস্থিরভাবে শ্বাস নিতে লাগলো। সর্বশেষে একটি পাতলা টি শার্ট খুলে ফেলতেই সমগ্র ঘরজুড়ে নীল রঙের আলো ছড়িয়ে পড়লো। পিঠের অর্ধেকাংশে শিরা উপশিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে, নীল আলোতে সেগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছিল। বাম হাত আর পিঠের অর্ধেকাংশের প্রতিটি কোণে অদ্ভুত এক শক্তির আধিক্য চোখ জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তার ত্বক থেকে জ্বলন্ত আগুনের শিখার মতো নীল শিখা বের হয়ে আসছিল।
ভেনোরা অবাক হয়ে ফ্লোরে বসে রইলো, তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। নিকও স্তব্ধ হয়ে কৌশিকের শরীরের সেই অগ্নিঝরা নীল দেখছিলো।
অনেকক্ষণ পর ভেনোরা মুখ খুললো। তার কাঁপানো হাত দিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে বললো,
"ওহ মাই মাই! ইউ আর বিকামিং আ ফুল মনস্টার!"
.
.
.
চলবে.........................................................................