আশিয়ানা - পর্ব ৮৫ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


সাদাফ সেহরিশের দিকে চেয়ে আবার তূর্ণর দিকে তাকাল। তূর্ণ সেহরিশের গম্ভীর মুখটুকু দেখে ম্লান কণ্ঠে বলল, 'তুই বাঁচলি কিভাবে?'

সেহরিশির মেরুদণ্ড টানটান করে সোজা হয়ে বসল। সেহরিশ চোখ বড় বড় তূর্ণর দিকে তাকিয়ে বলল, 'তুই কি চাচ্ছিলি আমি মরে যাই?'

তূর্ণ হড়বড়িয়ে বলল, 'নাহ। আমি কখন বললাম এমন কিছু?'

সাদাফ চোখ বড় বড় করে সেহরিশের দিকে তাকিয়ে বলল, 
  'কে অ্যাটাক করেছিল? চিনতে পারছিস?'

সেহরিশের মুখখানায় গাম্ভীর্যের রেখা। নিবিড়ভাবে ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল,
  'না। একপলক দেখেছি, গাড়ির মধ্যে একজন পুরুষ বসেছিল।'

তূর্ণ শুধাল,
  'আগে কখনো দেখেছিস বলে মনে হয়েছে?'

সেহরিশ বলল,
  'না। সম্পূর্ণ নতুন মুখ।'

সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, 
  'গাড়ির নাম্বার?'
  'দেখতে পাইনি।'
  'আর যে ক্যাবে তুই ছিলি সে ড্রাইভারের কি হয়েছে?' জানতে চাইল তূর্ণ। 

সেহরিশ সোফায় হেলান দিয়ে আবার সোজা হয়ে বসল। বলল,
  'গাড়ির সঙ্গে খাদে পড়ে গেছে। গাড়ির দরজা লক করা ছিল না। এজন্য গাড়ির দরজা খুলে সঠিক সময় লাফিয়ে বের হতে পারছি।'

তূর্ণ বলল,
  'আমাদের পেছনে হঠাৎ এতো শত্রু লাগল কেন? ওদের কি ক্ষতি করেছি আমরা?'

সেহরিশ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, 
  'আমাদের না শুধু আমার।' বলে থামল সেহরিশ। সাদাফের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, 'রোদ?'

সাদাফ কোমল গলায় জবাব দিল,
  'ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক বাড়িতেই আছে। ওর সঙ্গে কথা হয়েছে রোদেলা ঠিকই আছে। অনেকবার তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে। ওকে শান্ত করার জন্য বলেছি তুই স্টুডিওতে আছিস। কয়েকদিন স্টুডিওর পাশে ফ্ল্যাটে থাকবি। সামনেই তো আমাদের আরও একটা কনসার্ট আছে। তারই রিহার্সাল চলবে।'
সেহরিশ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। 

তূর্ণ বলল,
  'এই অদৃশ্য শত্রু কে তা দ্রুতই খুঁজে বের করতেই হবে। এভাবে তাকে খোলা রাখা যাবে না। তাছাড়া রাশিয়ান ছেলেটার সম্পর্কে আর কিছু জানা ও যায়নি।'

সেহরিশ দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধের সঙ্গে বলল, 
  'যেদিন তাকে পাবো এমন শান্তি দিবো যে ওর রূহ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। প্রতি মূহুর্তে মৃত্যুর জন্য ভিক্ষা চাইবে।'

সাদাফ পরখ করল সেহরিশের পায়ে, হাতে-পিঠে অনেক আঘাত লেগেছে। পিঠের দিকে চামড়া অনেকটা ছিলে গেছে।

সাদাফ বলল, 
  'কিছুক্ষণ আগে এডউইন এখানে আসছিল। তোর তখন হুঁশশ ছিল না। তোর হাত পা পিঠের ব্যান্ডেজ সেই করে দিয়ে গেছে। আর আমরা ওকে সত্যিটা বলিনি। বলেছি তোর সামান্য এক্সিডেন্ট হয়েছে।'

এক্সিডেন্টের কথা শোনামাত্র বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে হেঁটে দরজার দিকে চলে গেল। সাদাফ উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 
  'এই অবস্থায় কোথায় যাচ্ছিস?'

সেহরিশ পেছনে ঘুরে তাকাল সাদাফের দিকে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, 'সিম্পল এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমার এখানে থাকার প্রায় নেই। এই মূহুর্তে আমার বউয়ের সঙ্গ অধিক প্রয়োজন। বউয়ের কাছে যাচ্ছি।'

——————————

 জোহান সশব্দে হাসতে লাগল। তার আজ আনন্দের শেষ নেই। এখন গভীর রাত তবুও তার পাগলামির জন্য সবাই জেগে আছে। ফাঁকা ঘরের মধ্যে আনন্দে লাফাচ্ছে, চেঁচাচ্ছে। এত বছর সেহরিশ কে শেষ করতে পারল সে। সব অপমানের প্রতিশোধ আজ নিয়েছে। 

মার্কাস মূহুর্তের মধ্যে জোহানের আনন্দ চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে বলল, 'তোমার প্রতিশোধ পূরণ হয়েছে। কিন্তু আমার বদলার কি হবে? সাতটা বছর আমি এই আগুনে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছি। এর শেষ কোথায়? তুমি বলেছিলে যেদিন সেহরিশের শেষ করতে পারবে, সেদিন আমার কাজে সাহায্য করবে। কোথায় সে? কোথায় জেগান?'

জোহান গর্বের সঙ্গে বলল,
  'চিন্তা করবেন না বস। আমার প্রতিশোধ পূরণ হয়েছে এবার আপনার পালা। আমি কথা যেহেতু দিয়েছি সেটা পূরণ ও করব। আমি আপনাকে জেগানের সন্ধ্যা দিতে পারব বস।'

মার্কাস ওর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তাড়াহুড়ো করে কয়েক কদম পা এগিয়ে এল জোহানের দিকে। জোহান উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়ে জোহান গর্বের সঙ্গে বলল, 
  'পুরানো মার্কেটের ভেতর থেকে সরু পথ দিয়ে এগিয়ে গেলে এক নির্জন জায়গা আছে। ওখান থেকে ডান দিকে একটু হেঁটে গেলে একটা কটেজ। আর ওখানে সপ্তাহে দুবার জেগান আজহাল যায়। আমি আপনাকে টাটকা খবর দিচ্ছি বস। নিজের চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করে তারপরই আপনাকে বলছি। আপনি যদি কটেজ হাউজে আক্রমণ করেন তাহলে জেগানকে সহজেই ধরতে পারবেন।'

মার্কাস খুব মনোযোগ দিয়ে জোহানের কথাগুলো শুনছিল। এক সময় গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 'উঁহু, এভাবে না। তুমি বলেছ, জেগান ওখানে সপ্তাহে দুদিন থাকে। তাহলে বাকি পাঁচদিন কি করে? কোথায় যায়? তাছাড়া কোনো প্ল্যান ছাড়া হঠাৎ ওখানে আক্রমন করার পর যদি দেখি জেগান সেখানে নাই৷ তখন?'

জোহান কর্কশ গলায় বলল, 
  'আমি জানি জেগান সপ্তাহের কোন কোন দিন ওখানে যায়। সে সময় অ্যাটাক করলে জিত অবশ্যই আপনার হবে।'

মার্কাস শীতল কণ্ঠে বলল,
  'কথাটা মন্দ বলোনি৷ কিন্তু তার আগে এই বিষয়ে আমার আর্থেসের সঙ্গে কথা বলতে হবে।'

মার্কাস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জোহানের ঠোঁটের কোণে দূর্লভ হাসির রেখা ফুটে উঠল। ঘরটা এখন পুরো ফাঁকা। জোহান ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে গেল চেয়ারটার দিকে। পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে জোহান। 

অট্টহাসি দিয়ে উঠল। তারপর বলল,
  'সব কিছু এমন ভাবে প্ল্যান করেছি যে সাপ ও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না। তোকে বস ডাকতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু তাও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ডাকি। কিন্তু চিন্তা করিস না। এই বস ডাকটা বেশিদিন ডাকতে হবে না। আমার পথের একটা কাঁটা শেষ কিন্তু এখনো আরও একটা বাকি আছে। মার্কাস তোকে পথ থেকে সরানোর জন্য আমি কিছুই করব না। যা করার জেগান করবে।' চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জোহান। পিস্তলের উপর হাত বুলাতে লাগল। জোহান ধীর গলায় বলল,
  'তোকে মারবে জেগান। আর তারের তোর সব কিছুর মালিক আমি হবো। শুধু একবার আমার কথা শুনে জেগানের কটেজে পৌঁছে যা তারপর আর ফিরে আসতে পারবি না। জেগান তোদের ওখানেই শেষ করে দিবে। হাহাহা। জেগানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সমস্যা নাই। তবুও দূরে দূরে থাকতে হবে। বলা তো যায় না। ব্যাটা কখন কী করে ফেলে। যা ডেঞ্জারাস। মার্কাস মরবে জেগানের হাতে তারপরই মার্কাসের বিরাট অট্টালিকা আমার হবে। এই সব আমি সামলাব।'
জোহান ঠোঁট বাঁকা করে হেসে উঠল।

আর্থেস.. মার্কাসের লোকজনের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। যার ছায়াতলে রয়েছে পঞ্চাশ জন লোক। আর্থেসের কথামতো কাজ করে তারা। প্রতিটা কাজ করার পূর্বে আর্থেসের সঙ্গে পরামর্শ করে মার্কাস। মার্কাস চোয়ালদ্বয় শক্ত করে আর্থেসের কক্ষে প্রবেশ করল। তারপর গিয়ে বসল খাটে। আর্থেসের দৃষ্টি মার্কাসের উপর। সচরাচর রাতের এই সময় মার্কাস তার কাছে আসে না। আজ যেহেতু এসেছে নিশ্চয়ই বড় কোনো চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর্থেস থমথমে গলায় প্রশ্ন করল, 'বস, আপনাকে অস্থির লাগছে?'

মার্কাস কিঞ্চিৎ মাথা নাড়িয়ে বলল,
  'জোহানের সঙ্গে দেখা করে এলাম। সে আগে থেকে জেগানের খোঁজ জানতো। অথচ আমাদের বলেনি। অপেক্ষা করেছে সেহরিশের মরার।'

আর্থেস স্বাভাবিক গলায় বলল, 
  'আমি এমন কিছু আগেই আন্দাজ করেছিলাম বস। তাকে আমার একটুও বিশ্বাস হয় না। শুধু আপনার জন্য সহ্য করছি। তা এখন তো ওর কাছ থেকে এলেন, কি বলল সে?'

মার্কাস ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। জেগানের খবর জানালো আর্থেস কে। প্রচন্ড বুদ্ধিমান মানুষেরা মাঝেমধ্যে মারাত্মক ভুল করে বসে। তারপর আফসোস করেও কুল পায় না। জোহানের বুদ্ধি খারাপ লাগল না আর্থেসের। আর্থেস বলল, 'একবার জেগান কে উপরে পাঠাই তারপর জোহানকে এমন মৃত্যু দিবো সবাই মনে রাখবে।' 

মার্কাসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর্থেসের উপর। কপাল কুঁচকে বললেন মার্কাস,
  'আমার পছন্দের একজন গায়ক ছিল। ওর গান শুনলে মনটা চাঙ্গা হয়ে যেত। ওই বান** এর জন্য তাকেও হারাতে হল। কি আর করার অকালে মারা গেল বেচারা। ওর একটা গান চালিয়ে দাও। মনটা হাল্কা হোক।'

আর্থেস মার্কাসের কথায় হকচকিয়ে গেল। সে বলল,
  'আপনি কখনো গান শোনেন না বস।'

মার্কাস সশব্দে হেসে উঠল। বলল,
  'সে তো মারা গেছে। ওর মৃত্যুর খবর এখনো কেউ জানে না। এটাই তো সময় শোক পালন করার। ওর গান শুনেই সে শোক পালন করতে চাই।'

আর্থেস ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। স্বাভাবিক গলায় বলল,  
  'বস, আগামী সপ্তাহে জেগান তার কটেজে আবারও যাবে। আমি কী এই সপ্তাহে অ্যাটাক করার প্ল্যান করব?'

মার্কাসের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে বলল,
  'যা আমার ছিল তা দ্রুতই আবার আমার হোক সে ব্যবস্থাই করো।'
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp