বিকেল বেলা।
সুদিনের এ সময় যেন বস্তির জীবন্ত চিত্র হয়ে উঠেছে। দোকানগুলোয় মানুষের ভিড়,ডুবু তেলে পেয়াজু ভাজার গন্ধ! ওলিতে-গলিতে বাচ্চাদের ছোটাছুটি কখনো। একেকটি দোকানে রেডিয়োর ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দে বেজা চলা গানের ছন্দে, নৈসর্গে এ এক মিশ্র অনুভূতি! তুশিকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসার দিন। কথাটা চারপাশ থেকে আপাতত গোপন করে রাখতে বলেছেন রোকেয়ার মা আফিয়া বেগম। কোত্থেকে কে ভাঙচি দেবে, কাউকে বিশ্বাস নেই। হাসনাও তাই বলেননি। আজ সারাটাদিন উনি তুশিকে বাইরে পা-ও রাখতে দিলেন না। নিজে বাজার করেছেন, নিজেই রেধে-বেড়ে গুছিয়েছেন সবটা। তুশিকে মন্ত্রের মতো সকাল থেকে শিখিয়েছেন, পাত্রপক্ষের সামনে কীভাবে বসবে! কীভাবে কথা বলবে! ঢুকতেই যেন সালাম দেয়! একদম মাথা উঁচু করা যাবে না! এমন গমগম করে কথা বলা তো কখনোই নয়। বলতে হবে আস্তে,মেয়েদের মতো। যাতে একবারের জায়গায় কথাটা দশবার বললে শুনতে পায় সবাই! তুশি গোঁ ধরে বসে রইল। দাদির তুষ্টিতে স্বায় না মেলালেও, বিরোধিতা করল না। হাসনা মুরগীর মাংস, পোলাও আর ডাল রেধেছেন। রাতে একবারে ওনাদের খাইয়ে ছাড়ার পরিকল্পনা। আপ্যায়ন যত ভালো হবে, তত প্রসন্ন হবেন তারা। তবেই না নাতনীটার কপাল খুলবে! হাসনার তো আনন্দে চোখে জল চলে আসছে। তুশির একটা ঘর হবে, বর হবে। শার্ট-প্যান্ট পরে লাফিয়ে বেড়ানো মেয়েটা, কোমরে আঁচল গুঁজে উনুনে হাড়ি চড়াবে এক সময়!
ছেলের নাম সবুজ। দেখতে বেটে, বেশ কালো। ঢিলেঢালা প্যান্ট, আর হাফ হাতা চেক শার্ট পরে এসেছে। সাথে সবুজের মা, আর মামি এসেছেন। ঘটক আফিয়া এসেছেন ফ্রিতে। ভদ্রমহিলার মুখের জিরোন নেই। একের পর এক গালে পান গুঁজছেন, প্যাচ প্যাচ করে পিক ফেলছেন পরপর। হাসনা দরজা ছেড়ে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। সরু গলিতে রিকশা ঢোকার জো নেই। তাই সবাইকে হেঁটেই আসতে হলো। কাছাকাছি আসতেই ভীষণ গদগদ হয়ে পড়লেন প্রৌঢ়া। সালাম দিয়ে বললেন,
“ আসেন, আসেন। রাস্তাত কুনো অসুবিদা হয়নাই তো?”
ছেলের মামি বললেন,
“ না। হয়নাই। কিন্তু এই জায়গা এত নোংরা ক্যান? ইস! কী অবস্থা চাইরপাশের।”
হাসনা জবাব দিলেন না। চুপচাপ ওনাদের ভেতরে নিয়ে এলেন। গোটা ঘর দেখেই নাক সিটকালেন ছেলের মা।
“ এত ছোটো ঘর? এইটা ঘর না মুরগীর খোপ?”
ফিক করে হেসে উঠলেন দুজনেই। আফিয়া ভেংচি কাটলেন আড়ালে। নিচ তলার দুটো রুম নিয়ে থাকে, সারাক্ষণ ইদুর আসে যায় তাদের আবার বড়ো বড়ো কথা।
অপমানে হাসনা বানুর মুখখানা ছোটো হয়ে গেল। তিনি যে গরিব, সব তো জেনেশুনেই এসেছে। তাহলে এমন কটুক্তি করছে কেন? বৃদ্ধা চুপ রইলেও পর্দার ওইপাশ হতে উত্তর দিলো কেউ,
“ আজ্ঞে হ্যাঁ, মুরগীর খোপই। আমরা দুই মুরগী এতদিন থাকতাম, এখন আরো তিনখানা মুরগী এসে ঢুকেছে। তা এ মুরগী শুধু কক ককই করে? না ডিম টিমও দেয়?”
হাসিটা থেমে গেল অমনি। ছেলের মা এদিক-ওদিকে চাইলেন।
“ কে বলল?”
আফিয়া চোখ বড়ো করে হাসনাকে দেখলেন। প্রৌঢ়া তিতিবিরক্ত চোখে রান্নাঘরের ওদিকটায় চেয়ে। নির্ঘাত তুশি ওখানেই আছে। ওর গলা তো চেনে আফিয়া। প্রসঙ্গ কাটাতে বললেন,
“ আরে বাদ দেন। বসেন আপনেরা । হাসনা খালা, চেয়ার দাও উনাগো।”
“ হ দিতাছি।”
সবুজের চোখ চারপাশে। দেখতে আসা পাত্রী খুঁজছে সে। আফিয়া বলেছেন মেয়ের গায়ের রং টসটসে ফরসা! সবুজকে আত্নীয় স্বজন কাইল্লা সবুজ ডাকে। তাতে কী? ওর যে একটা সুন্দর বউয়ের খুব শখ। বউ দেখলেই যেন সবাই এক কথায় বলে,
“ কাইল্লা সবুজের বউ চান্দের মতো সুন্দর!”
হাসনা তিনখানা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিলেন। একটা তার। বাকি দুটো আফিয়া দিয়েছেন আজকের জন্যে।
সবুজ, তার মা, মামি বসল। আফিয়া খাটে বসলেন। হাসনা টেবিলটা টেনেটুনে সামনে দিলেন ওনাদের। ছুটেছুটে নাস্তা-শরবত এনে ভরালেন জায়গাটা। সেমাই, বিস্কিট, চানাচুর, আপেল, লেবুর শরবত, ট্যাঙও আছে। আর চা দিয়েছেন খেতে। মামি সেমাই নিলেন আগে। এক চামচ মুখে পুরে শুধালেন,
“ মেয়ে কই? ডাকেন। যে কামে আসছি তা আগে সারি।”
“ এত তাড়া ক্যান? আগে নাস্তা-পানি খান। একটু মিষ্টি মুখে দেন। তারপর এইসব হইব।” (হাসনার কণ্ঠে বিনয়।)
ছেলের মা বললেন,
“ ওসবের জন্যি সময় আছে, খালা। আমরা আরো দু জায়গায় মেয়ে দেকতি যাব। আপনার নাতনিরে পছন্দ হবারও তো একটা ব্যাপার আছে। তা মেয়ের বাবা শুনলাম এক্সিডেন্ট করে মরিছে? কীভাবে হোলো?”
হাসনা জ্বিভে ঠোঁট ভেজালেন।
“ রাস্তা পার হইতে গিয়া।”
“ আর মা? সে কীভাবে মরিল?”
“ অসুকে।”
“ ওহ। ছোটো থেকে আপনার কাছে ছিল?”
“ হ।”
আফিয়ার ভারি মেজাজ গরম হলো। এসব তো তিনি বলেই নিয়েছেন। আবার এখানে এসে শুনছে, মেলানোর জন্যে। এত বুদ্ধি এদের! তপ্ত মেজাজে মুখ ঘুরিয়ে পিক ফেললেন তিনি। ছিটকে গিয়ে সেটুকু জানলার বাইরে পড়ল। ঠোঁটে হাসি টেনে বললেন,
“ আমি তো কইলামই আপনেগো কোনো চিন্তা নাই। মাইয়া সুন্দর আছে। পছন্দ নাহইলে টিয়্যা ফেরত কইছি না?”
একটু নীরবতা তারপর। পাত্রপক্ষ নাস্তা শরবত খেতে ব্যস্ত হওয়ার মাঝে ফিসফিস করলেন আফিয়া,
“ শাড়ি পিন্দাইছো তো, খালা?”
হাসনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
“ না রে। জামা পরতে পাডাইছি। আমার ভালো কুনো কাপুর নাই তো।”
“ আমার তে নিতে পারতা। আচ্ছা হইল, জামাতেও চলব৷ ওর ওই ব্যাটা মাইনষের জামাডি না পিনলেই হইছে।”
“ পরব না। আমি বুঝাইয়া কইছি !’’
ছেলের মা খাওয়ায় বহাল রইলেও, কান সজাগ করে রেখেছেন। কিন্তু এত ধীরে বলছেন দুজনে, কিচ্ছুটি শোনা গেল না।
মামি অধৈর্য হলেন বোধ হয়। বললেন অধীর গলায়,
“ মেয়ে কই? নিয়া আসেন। শুনছি মাইয়া ফরসা। তয় আমরা কিন্তু ভালো মতো পরীক্ষা কইরে নিব। আজকাল কার মাইয়ারা তো বস্তা বস্তা মেকাপ মাইখা পাত্রের সামনে আসে। কিন্তু নেয়ার পর দেখা যায় কালির কালি।”
বলার সময় এক চোট নাক সিটকালেন তিনি। যেন জগতে কালো হওয়া ভীষণ অন্যায়। হাসনার চোখদুটো আপনা-আপনি সবুজের দিকে পড়ল। মা ধরে ফেললেন বোধ হয়। কথাখানা টেনে নিয়ে বললেন,
“ আমাগো পোলা কালা তাতে কী? সন্নের আঙটি ব্যাঁকা হইলেও যে দাম, সোজা হইলেও তাই। পুরুষ মানুষের গায়ের রং একটা হইলেই হয়। তয় বউ দরকার সুন্দর। নাইলে নাতিপুতিও তো কালা হইব।”
হাসনার জিভখানা নিশপিশিয়ে উঠল। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বললেন না। তুশি সুন্দর দেখতে। সাজলে শরতের আকাশের ন্যায় লাগবে। কিন্তু ওর যা চালচলন! এই এক দূর্বলতার কবলে হাসনার গলায় জোর নেই। হেসে বললেন,
“ তুশি আইতাছে। তৈরি হয়।”
মামি বললেন,
“ অত সময় নাই। ডাকেন, এক নজর দেইখা যাই।”
সবুজ চুপচাপ বসে রইল। তার ভেতরটা ধৈর্যহীন বটে। তবে মায়ের ওপর সে রা করে না। আফিয়ার পান চিবানো শেষ। একটা বিস্কিট তুলে মুখে দিলেন এর মাঝেই হাজির হলো তুশি। পায়ের শব্দে একইসাথে ফিরে চাইল সবাই। অমনি মাথায় আকাশ ভাঙল হাসনার। তুশি থ্রি-পিস পরেনি। সেই
শার্ট-প্যান্ট পরনে। জিন্সটাকে গুটিয়ে আবার উঁচুতে তুলেছে। মোমের মতো পায়ের একাংশ দৃশ্যমান। গেঞ্জির ওপরে পরা শার্টের মাথা পেঁচিয়ে পেটের কাছে দড়ির মতো বাঁধা। আফিয়ার খাবার গলায় আটকে পড়ল। ছেলের মা, মামি হতবাক! হতচেতন! প্রকট নেত্রে তুশির আপাদমস্তক দেখলেন দুজনে।
“ এডা কেডা?”
তুশি কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়াল। খুব ভাব নিয়ে বলল,
“ মাই নেম ইস তুশি। দিস বসস্তির ওয়ান এন অনলি সেলবিরিটি।”
সবুজ হাঁ করে চেয়ে। তুশির পা থেকে মাথা মেপে নিয়েছে এক পল। ভারী সুন্দর মেয়ে! মামি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“ তুমিই পাত্রি? জামাকাপড়ের কী ছিরি ওমা! ছ্যা ছ্যা। কিন্তু রোকেয়ার মা, তুমি যে কইছিলা মাইয়া খুব ভদ্র। সব সময় মাথায় কাপড় দিয়া চলাফেরা করে?”
আফিয়ার মুখ চুপসে গেল। একটা সমন্ধ পাকা করতে মানুষ কত কী বলে! তিনিও বলেছিলেন। বিয়েটা হলে তো রোজগার হতো কিছু। কিন্তু তুশি যে ইজ্জতটা এইভাবে খেয়ে ফেলবেন কে জানতো! আমতাআমতা করে বললেন,
“ না মানে, আমিতো ওইটাই হুনছিলাম।”
হাসনা হুশে ফিরেছেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসে ঝুলছিলেন এতক্ষণ! কাল রাত থেকে কাকে তন্ত্রের ন্যায় মুখস্থ করালেন, কী কী করবে! তুশি এইভাবে পল্টি খেলো?
ত্রস্ত এগিয়ে এলেন তিনি। নাতনির বাহুটা টেনে ঘোরালেন নিজের দিকে। কটমট করে বললেন,
“ এডি কি পিনছস তুই? তোরে জামা পিনতে কইছি না? যা, অহন পাল্টাইয়া আয়।”
“ জামা পরেছিলাম তো। কিন্তু পাজামা পরতে গিয়ে দেখি ফিতে নেই। ওসব আমি ঢুকাতে পারি? শুধু জামা পরে তো আর কামিং হয় না দাদি। আবার ওখান থেকে শুনতে পেলাম সবাই আমাকে খুঁজছে। হুয়াই ওয়েটিং? তাই যা ছিল তাই পরে কামিং।”
হাসনা কপাল চাপড়ে বললেন,
“ হায় হায় খোদা! এইডা কী মাইয়া না আর কিছু! পায়জামায় ফিতা নাই, আমারে ডাইকা কইতি। তুই এমনে আইছস! অহন হকলে কী মনে করব?”
তুশি কাঁধ উঁচাল,
“ সে আমি কী জানি! যাদের মন, তাদের চিন্তা। ওমা, ট্যাঙ গুলিয়েছ দাদি! আগে বলবে না?”
তুশি চপল পায়ে টেবিলের কাছে এলো। ছেলের মায়ের সামনে থেকে টেনে নিলো গ্লাসটা। ভদ্রমহিলা হাঁ করে ফেললেন। তুশি ঢকঢক করে চুমুক দিতেই, সবাই তব্দা খেলেন এক চোট। আফিয়ার জ্বিভ দাঁতের ফাঁকে পড়ে এক হাত বেরিয়ে এলো। হাসনা চোখ খিচে নিলেন লজ্জায়। তুশি পুরোটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে থামল। মুখ মুছতেই সবুজ লেবুর শরবত বাড়িয়ে দেয়। হাসি হাসি মুখ করে বলে,
“ এটাও খান। আপনার মনে হয় খুব পিপাসা লেগেছে?”
“ নো, নট নিড! আচ্ছা, আপনিই কি দাদির রিকশাওয়ালা?”
“ হ্যাঁ?”
“ বাংলা বোঝেন না? এসটাডি করেননি? আপনিই পাত্র যার সাথে আমার বিয়ের কথা চলবে?”
সবুজের মাঝে থতমত ভাব। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ঘাড় নাড়ল তাও।
“ জি।”
তুশি কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“ এসটেরেঞ্জ। বিয়ের কথা চলছে দুজনের। কিন্তু আপনি বসে আছেন। আই এসট্যানিং! (standing) কেন? হুয়াই? উঠুন, এখন আমি বসব।”
আফিয়ার ঠোঁট দুইদিকে চলে গেছে। ছেলের মায়ের চোখ কপালে। হাসনা দিশাহারা, দিগভ্রান্ত। নাতনীকে থামাতে চাইছেন, কিন্তু কী বলবেন কী করবেন আমূল হযবরল সবেতে।
সবুজ কিছু ভ্যাবাচ্যাকা খেল। মায়ের দিকে চেয়ে চেয়ে দাঁড়াল তাও। তুশি বসল আরাম করে। উরুর ওপর আরেক পা তুলে হাত ছড়াল হাতলের ওপর। আফিয়ার মনে হলো এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। কপালটা চেপে চোখটা এদিক-সেদিক ঘুরল।শরীরটাও টলল একটু। মামি
হতবাক আওড়ালেন,
“ এ কেমন মাইয়া? ব্যাটা মাইনষের মতো বসছে। আফিয়া ভাবি, আপনে না কইলেন মাইয়া সুশীল? কথা কইলে কাছে বইসাও ট্যার পাওন যায় না? এতো দেখি পুরা উলটা।”
আফিয়া কী বলবেন! চমকের ভার নিজেই নিতে পারছেন না। তুশির এসবে আগ্রহ নেই। চানাচুরের বাটিটা হাতে নিয়ে বাদাম মুখে পুরল। নাক কুঁচকে বলল,
“ ইস, কোন দোকান থেকে এনেছ দাদি? পুরো এই রিকশাওয়ালার মুখের মত নেতিয়ে গেছে।”
সবুজের আদল সংকীর্ণ হয়। আহত চিত্তে চেহারায় হাত বোলায় একবার। মা চটে বললেন,
“ কী? আমার পোলার চেহারা নেতাইন্না বাদামের মতো? কত সাহস এই মাইয়ার! বুঝছি, এই মাইয়া বেয়াদব। কুশিক্ষায় বড়ো হইছে। এরম ব্যাটা মাইনষের মতো মাইয়া দেখোনের দরকার নাই। ভাবি চলেন, আয় সবুজ।”
আফিয়া হতাশ শ্বাস ফেললেন। এসব তো হওয়ারই কথা।
হাসনা উদ্বীগ্ন হয়ে বললেন,
“ না না শোনেন, ও এরম না। আসলে হইছে কী…”
কোনো কথাই কেউ কানে নিলো না। সবুজ সুড়সুড় করে মায়ের পিছু চলল। যেতে যেতে তুশিকে দেখল কয়েকবার। মা, মামি ফুঁসতে ফুঁসতে যেই চৌকাঠে আসে, ভূতের মতো এক লাফে এসে সামনে দাঁড়াল তুশি। দুদিকে দুহাত মেলে বলল,
“ নো নো, চাইলেই তো নট গোয়িং খালারা। এভাবে তো যেতে দেয়া যাবে না। এখনো অনেক কথা বাকি।”
মামি রেগে রেগে বললেন,
“ তুমি আবার কী কইবা? আর কত বেয়াদবির বাকি আছে শুনি? সরো, যাইতে দাও আমাগো।”
তুশি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল
“ ইয়েস, নিশ্চয়ই যাবেন। কিন্তু তার আগে এই যে এতক্ষণ নাস্তাগুলো গিললেন, কিছু আবার নষ্ট করলেন, এসবের যে দাম দিতে হবে।”
অবাক সকলে। এমন কথাতো কোনো পাত্রীর বাড়ি গিয়ে কস্মিনকালেও শোনেননি। কণ্ঠে অনিশ্চয়তা,
“ কী? কী দিতে হইব?”
“ দাম বোঝেন না? টাকা, মানি। সব নাস্তা, খরচাপাতি মিলিয়ে তিন হাজার হয়েছে। নিন, ফটাফট বের করুন এবার।”
আফিয়ার বিষম লাগার দশা। তুশি হাতা গোটাচ্ছে। মেয়েটা তো তার চেনা। কী ঘটবে এখানে কে জানে! না বাবা, বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। তিনি পানের কৌটো বগলদাবা করলেন। আশপাশটা সতর্ক নয়নে দেখে নিয়ে, রান্নাঘরের দোরের দিকে এগোলেন তারপর। পা টিপে টিপে দরজা ছুঁয়েই, বেরিয়ে গেলেন দ্রুত।
ছেলের মা কণ্ঠ শৃঙ্গে নিয়ে বললেন,
“ এইডা কি মগের মুল্লুক নাকি? এট্টুক নাস্তার দাম এত ক্যামনে হয়? আমরা তো তেমন কিছুই খাইলাম না।”
মামি স্বায় মেলালেন,
“ হেইডাই তো।”
তুশি দরজার কাঠে হাত ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। নিরুৎসাহিত বলল,
“ ওসব আমি জানি না।
পাঁচ হাজার না দিলে, যেতে দেব না আজ। আমার দাদি সকালে উঠে বাজার করেছে, সারাদিন খেটেখুটে রান্না করেছে। তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করেছে, আপ্যায়নের সব ব্যবস্থা করেছে, আবার আপনাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এসবের পেছনে হেবি মানি ওয়েসটিং। সেসব তো আপনাদেরই দিতে হবে, তাই না? নিন, ফটাফট বের করুন দেখি।”
মামি বললেন,
“ দিমু না ট্যাকা। কী করবা?”
তুশি কপাল কুঁচকে ঘাড় বাঁকাল। চাউনিতে বিরক্তি। ঝট করে দোরে খিল দেয়া দাসাটা হাতে তুলে বলল,
“ টাকা বের কর। নাহলে একেকটাকে এমন ঘা দেব, একেবারে জিভ উলটে পড়ে থাকবি। মাই নেম ইস তুশি। নট আন্ডাস্টিমেট মি হ্যাঁ? কুস্তি শিখেছি দু বছর। চেপে ধরলেই, এক ছোবলে ছবি বানিয়ে দেবো।”
রমণী দুজন আঁতকে উঠলেন। গোল চোখে বললেন,
“ ওমাগো, কী ডাকাইত মাইয়া! ও সবুজ, তুই কিছু কস না ক্যা?”
তুশি বলল,
“ সবুজ এই লাউয়ের মতো চেহারা নিয়ে কী বলবে? এমন বাড়ি মারব না, একেবারে চার ফুটের সবুজ, দুফুটের হলুদ হয়ে যাবে।”
সবুজ বোধ হয় ঘাবড়ে গেল। প্রথম দফায় পছন্দ হওয়া তুশির এই রূপে সে নিজেও ভড়কে গেছে খুব! ছেলেকে চুপ দেখে দুজন হতাশ হলেন। মামি নিরুপায় অথচ গমগমে স্বরে বললেন,
“ ভাবি, যা চায় দিয়া দেন।”
পাত্রের মা দু হাজার বের করলেন। বাকি এক হাজার মামিকে মিলিয়ে দিতে হলো। তুশি ছো মেরে নিলো পুরোটা। মুখ ঝামটা মেরে প্রথমে মা, এরপর মামি বের হলেন। সবুজ বের হতে নিলো, তুশি দুষ্টুমি করে পা-টা বাড়িয়ে দিলো সামনে। হাঁটতে গিয়ে অমনি হোচট খেল ছেলেটা। টাল খুইয়ে রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। চিল্লিয়ে উঠল ব্যথায়,
“ ও মাগো!”
টিনটিন-বাবলু এসে দাঁড়িয়েছে কেবল, সবুজকে পড়তে দেখে জোরে হেসে ফেলল ওরা। হাত তালি দিয়ে বলল,
“ বোয়াল মাছ ধরছে, বোয়াল মাছ ধরছে।”
সবুজ ব্যথা পেয়েছে। মা আর মামি ছুটে এসে ত্রস্ত তুললেন ওকে।
“ কী করে পড়লি, আব্বা? দেইখা হাঁটোস না?”
সবুজ বোকা চোখে আশপাশ দেখল। কীসে একটায় পা বেধে পড়েছে৷ কিন্তু কিছু তো নেই। তুশির দিক চাইলে দেখল, সে টাকার নোট গুণতে ব্যস্ত। মেয়েদের মতো ঠোঁট উল্টাল সবুজ। তারপর হেসে গড়াগড়ি খাওয়া টিনটিনদের ধমকাল,
“ এই ছোকরা চুপ কর। কেউ পড়লে হাসতে হয়!”
টিনটিনরা থামল না। তারা দুলে দুলে হাসছে। সবুজ চটে বলল,
“ চলো আম্মা, এনে আর এক মুহুর্তও থাকোন যাইব না।”
হাসনা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন খাটে। মুখায়বে হতাশার ছাপ। তুশির বুঝি আর গতি হোলো না। টিনটিন-বাবলুরা ঘরের ভেতর ঢুকল।
“ ওস্তাদ তোমারে বলে দেখতে আইছে?”
তুশি বলল,“ হুঁ। ওইত ছাগলের দল মিলে দেখে গেল।”
বাবলু নির্বোধের ন্যায় বলল ,
“ ক্যামনে দ্যাখল, ওস্তাদ? কী কী দ্যাখল? কুরবানির সময় যে গোরু দেখে মাইনষে, অমনে?”
তুশি ধমক দেয়,
“ চুপ কর ব্যাক্কল।”
তারপর হাসনার কাছে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। পাশে টাকাগুলো রাখল। বলল,
“ এত সেন্টি খাচ্ছো কেন? টাকা যা লোকসান হয়েছিল সব সুদে আসলে উশুল করে এনে দিলাম। ওদের জন্য যা যা রেধেছ সব আমরা খেয়ে শেষ করে দিচ্ছি। কপালে হাত না দিয়ে যাও, খাবার দাও।”
হাসনা যেন গরম তেলের রূপ। তুশির কথায় পানির ছিটে পড়ল। অমনি ছ্যাৎ করে উঠলেন,
“ নাটক মারাস আমার লগে? এত কাহিনী কইররা অহন আমারে সান্ত্বনা দিতে আইছোস?”
তুশি অবোধের মতো বলল,
“ আরে, হট আই ডুয়িং? আমি কী করলাম!”
“ জানোস না কী করছস? তুই ওগো ভাগাইলি ক্যান?”
তুই কাইল আমারে কইছিলি তুই বিয়ায় রাজি। তাইলে আইজ এই সিনিমাডি করলি ক্যা তুশি? রোকেয়ার মার সামনে আমার মান ইজ্জত সব শ্যাষ কইররা দিলি!’’
“ আমি বিয়েতে রাজি, এ কথা কখন বলেছি?”
হাসনা চোখ রাঙিয়ে চাইলেন,
“ কাল কস নাই?”
“ না তো। আমি শুধু বলেছি পাত্রপক্ষের সামনে বসব। সে তো বসলাম। ওই আধ ইঞ্চি কুমড়োটাকে তুলে ওর চেয়ারে তোমার সামনেই বসলাম। তুশি কখনো কথার খেলাপ করে বলোতো! আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি,তাই না?”
হাসনা কিছু বলতে চাইলেন, তুশি আটকাল। বলল ফের,
“ দাদি শোনো, এই তালবেগুনের মতো দেখতে ছেলেপেলে আমি বিয়ে করব না। দুনিয়ার হেনসাম ছেলে এলেও করব না। তুশি জেনাস (জিনিয়াস)। ওকে সামলানোর জন্যে কেউ জন্মায়ইনি। এর চেয়ে বিন্দাস আছি,থাকি। আর তুমি এসব কই খুঁজে পাও বলোতো? এর সাথে আমার যায়? ভাগিয়েছি, বেশ করেছি!”
হাসনা দুম করে উঠে দাঁড়ালেন।
“ বেশ করছোস?”
তুশি মাথা নাড়ল।
“ য়েস।”
“ খাড়া, আইজ তোর এক দিন কী আমার একদিন।”
সাদা আঁচলটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে রান্নাঘরে ছুটে গেলেন প্রৌঢ়া। তুশি কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল সেদিকে।
টিনটিনের কণ্ঠে কৌতূহল
“ কী আনতে গেছে ক তো।”
বাবলুর কথায় উচ্ছ্বাস,
“ খাওন দেবে মনে হয়।”
ছেলেটার কথা ফলল না। উলটে রণচণ্ডীর মতো রূপ নিয়ে ঝাটা হাতে ছুটে এলেন হাসনা। তুশি আঁতকে উঠল। ভো দৌড় লাগিয়ে বলল,
“ বুড়ি ক্ষেপেছে রে, পালা পালা।”
টিনটিন-বাবলু তুশির পেছন পেছন ছুটল। হাসনা হুঙ্কার ছুড়তে ছুড়তে গেলেন কিছু পথ। শরীরটা স্বায় না দেয়ায় দাঁড়ালেন তারপর। তুশি তার দল সমেত হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধা ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
“ যাবি কই পলাইয়া? আইজকা বাড়িত আয়, তুই। তোর হাড্ডি ভাঙমু আমি। কত বড়ো কুস্তিগির হইছস দেখতাছি।”
•••••••••••••••
অন্ধকার রাতের প্রথম প্রহর। সময় প্রায় আটটা পেরিয়েছে।
শাহবাগের ফুটপাত ধরে হাঁটছে তুশি। দুপাশে তার ছায়াসঙ্গী দুজন। সবার মুখ ভার, মনটাও খারাপ। খিদেতে বাবলুর চোখমুখ শুকিয়ে বসেছে। এক ঘন্টার বেশি না খেয়ে ও থাকতে পারে না। সেখানে দুপুরে দুটো ভাতের পর আর কিচ্ছু মুখে তোলেনি। তুশি আর হাঁটবে না। পা ব্যথা করছে। ফুটপাতের আইলে ধপ করে বসে পড়ল তাই। দেখাদেখি বসল ওরাও। বাবলু উশখুশে চিত্তে বেশিক্ষণ রাশ টানতে পারল না। জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
“ ওস্তাদ! আইজ আর পকেট মারবা না?”
তুশির কণ্ঠ ক্লান্ত শোনাল।
“ নাহ। ইচ্ছে করছে না। দাদি মনে হয় কষ্ট পেয়েছে বুঝলি!”
টিনটিন বলল,
“ পাইলে পাউক। তুমি তো সত্যি কথাই কইছো। ওই আলকাতরার ডিব্বারে তোমার লগে মানাইব না।”
তুশি ভ্রু গোছায়।
“ তোরা মানানোর কী বুঝিস?”
ও দাঁত বের করে হাসল।
“ সব বুজি।”
বাবলু দুহাতে পেট চেপে ধরেছে।
কণ্ঠ কাঁদোকাঁদো,
“ ওস্তাদ, খিদায় প্যাট কামড়ায়। কিছু খাওয়াইবা না?”
“ আমারো খিদা লাগছে, ওস্তাদ। তোমার লাগেনাই?”
তুশির কাছে টাকা নেই। পাত্রপক্ষের থেকে যা হাতালো, তাতো দাদির সামনে রেখে এসেছে। এখন এদের খাওয়াতে হলে পকেট কাটা জরুরি। কিন্তু আজকে ভালো লাগছে না। দাদি কে তো তুশি চেনে। নিশ্চয়ই অভিমানে কেঁদে কেটে ভাসাচ্ছে এখন। কিছু বলতে গেলেও, ফোস করে উঠবে। খিদে তুশিরও লেগেছে। দুপুরেও কিছু খায়নি। কী যে করবে!
তুশির হঠাৎ চোখ পড়ল রাস্তার ওইপাড়ে। জমকাল সাজের একটা কম্যিউনিটি সেন্টার। দুষ্টু মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি এলো ওর। উঠে দাঁড়াল তড়াক করে,
“ আমাকে দেখতে কেমন লাগছে রে, টিনটিন?”
ও আপাদমস্তক দেখে বলল,
“ ফেনটাসটিক। ধোয়া জামা পরছো? চকচক করতাছে।”
তুশি দুহাতের বালু ঝাড়ল।
“ তোরা এখানেই দাঁড়া। আমি আসছি।”
বাবলু বলল,
“ কই যাও?”
তুশির তাকানো দেখে টিনটিন বুঝে ফেলল ঘটনা।
“ ওস্তাদ আইজকাও?”
“ হুঁ!”
ওরাও দাঁড়াল এবার। আনন্দ নিয়ে বলল,
“ যাও যাও। আইজকাও পোলাও, মাংস খামু কী মজা!”
বাবলুর আবদার,
“ আমার লইজ্ঞা কিন্তু রোস্ট দুইডা আনবা। আমি গোরু খামুনা। দাঁতে ব্যথা করে।”
তুশির চুলগুলোতে বেনি করা আজ। পাত্রপক্ষ আসবে বলে দাদি করে দিয়েছিলেন। শার্টের যে মাথা গিট বাধা ছিল, সেটাও টেনেটুনে ঠিক করল ও। পায়ে এক জোড়া চটি ছাড়া বাকি সব ঠিকঠাক। তারপর রাস্তা পেরিয়ে সেন্টারের কাছে এলো। ওই পাড় হতে চেয়ে রইল বাবলুরা। তুশি এর আগেও কয়েকটি সেন্টারে ঢুকে ফ্রিতে খেয়ে এসেছে। আবার পলিতে করে খাবার এনে ওদেরও খাইয়েছে। এখন অবধি ধরা-টরা পড়েনি। তাই ওরা নিশ্চিন্ত,আজও ধরা পড়বে না।
তুশি ওৎ পেতে রইল। বোঝার চেষ্টা করল পরিবেশ কেমন! গেটে গার্ড নেই। যে আসছে, সেই ঢুকছে আরামে। তুশির ঝলমলে মুখখানায় সূর্যের কিরণ। বুক চিতিয়ে সুরুৎ করে ঢুকে গেল ভেতরে। স্টেজ ফাঁকা তখনো। বর-বউ কেউ আসেনি। পেছনের সাইনবোর্ডে, প্যাঁচানো ইংরেজিতে কিছু লেখা। মনে হয় বর-বউয়ের নাম। তুশি ওসব পড়তে পারেনি। ও এদিক-ওদিক চেয়ে খাবারের জায়গা খুঁজছে। এখনো কেউ খেতে বসেনি দেখে চ সূচক শব্দ তুলল জিভে।
কিন্তু ফেরত যাওয়া যাবে না। খাবারের দারুণ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নিশ্চিত হাইফাই খাবার হবে। তুশির খিদেটা ক গুণ বেড়ে গেল তাতেই। যেখানে পুরো সেন্টারের সবাই দারুণ সব সাজসজ্জায় মোড়ানো, সেখানে মেয়েটা বড্ড বেমানান। কয়েকজন ওকে দেখল ঘুরেফিরে। কিন্তু তুশির তাতে নার্ভাস লাগছে না। এরকম ফ্রিতে বিয়ে ও কত খেয়েছে!
তুশি অতিথি সাড়িতে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। একটু পর এক মাঝবয়সি ভদ্রমহিলাও এলেন। ফোনে কথা বলতে বলতে চাইলেন ওর দিকে। নজর গিয়ে আটকাল পায়ের চটির ওপর।
কপাল কুঁচকে বললেন,
“ কোন পক্ষ তুমি?”
তুশি পালটা প্রশ্ন করল,
“ আপনি কোন পক্ষের?”
“ মেয়ে পক্ষের। আমার মেয়ের বান্ধুবির বিয়ে।”
“ ওহ, আমিও মেয়েপক্ষের। অনেক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। চিনে কাজ নেই।”
ভদ্রমহিলা একটু অবাক হলেন। কেমন কাঠখোট্টা জবাব! চোখের কোণ তুলে ওকে মাপলেন কয়েক পল। তুশি একটু ঘাবড়ে গেল। আর বসে থাকা বিপদ। উঠে এলো ত্রস্ত।
ঠিক তক্ষুনি ওর পাশ কাটিয়ে ঝড়ের মতো ছুটে গেল কেউ একজন। গতির দ্রুততায় বাহুতে ধাক্কা লাগল তুশির। মেয়েটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে মিশল। ফিরল কটমটিয়ে। কোন রাতকানা রে! দেখল, একটা অল্প বয়সি মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। হাতে ব্যাগ। তুশির রাগটা পালটে গেল কৌতূহলে। মেয়েটা হন্তদন্ত গতিতে গিয়ে পৌঁছাল এক ভদ্রলোকের কাছে। তুশির জিজ্ঞাসু চিত্তে টান পড়ল অমনি। কী ঘটেছে জানা চাই! এগোলো ওদিকে। মেয়েটা, ভদ্রলোককে টেনেটুনে কোনার এক কামরায় গিয়ে ঢুকেছে।
তুশি সন্তর্পণে গিয়ে আড়িপাতল। প্রথমটুকু না শুনলেও, পরের টুকু পৌঁছাল কানে। মেয়েটা অস্থির হয়ে বলছে,
“ এখন কী হবে, মামা? আমার মাথায় তো কিচ্ছু ঢুকছে না। মানুষ জানাজানি হলে তো…”
ভদ্রলোকের মুখ ফ্যাকাশে দেখাল। হাতটা আপনা-আপনি চলে গেল বুকে। ঢলে পড়তে দেখে মেয়েটা আকড়ে ধরে চেয়ারে বসায়। বিচলিত পায়ে ছুটে বেরিয়ে যায় আবার। তুশি দ্রুত লুকিয়ে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে বুঝতে চাইল ঘটনা কী! তারপর ফের কতগুলো পায়ের শব্দ। মেয়েটি একজন পুরুষ আরেকজন ভদ্রমহিলাকে ডেকে এনেছে। মহিলা অসুস্থ লোকটির কাছে ছুটে এলেন। কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে চিন্তায় একশা হলেন নিমিষে। তুশি বুঝল, ইনি এই লোকের স্ত্রী। আর পাশের লোকটি হলেন শ্যালক। দুলাভাই, দুলাভাই বলে ডাকছেন। সবাই মিলে ওনাকে পানি খাওয়ালেন। ফ্যানের বাতাস বাড়ালেন। ভদ্রমহিলা উদ্বীগ্ন হয়ে শুধালেন,
“ হঠাৎ এমন অসুস্থ হয়ে পড়ল কেন? আর, তুমি তো পার্লারে ছিলে! একা ফিরলে যে…”
মেয়েটি মাথা নোয়াল। অসুস্থ ভদ্রলোক কোনোরকম ফ্যাসফ্যাসে শ্বাস তুলে বললেন,
“ তোমার মেয়ে পালিয়েছে।”
চমকে উঠল সবাই। তুশির ভ্রু টানটান হলো। ঘরের ভেতর হাহুতাশ, আর অস্থিরতায় ভরে গেল সহসা। মেয়ের মা কাঁদছেন। তুশি কথাবার্তা সব শুনে যা বুঝল তাতে, মেয়ে পার্লারে সাজতে গিয়ে ভেগেছে। চিঠিতে লিখে গেছে তার প্রেমিক আছে, সে এই ছেলেকে বিয়ে করবে না। আর খবরটা নিয়ে এসছে মেয়ের বান্ধুবি।”
শ্যালক লোকটি চশমা খুলে উদ্ভ্রান্তের মতো পায়চারি করছেন। মেয়ের বাবা বলছেন,
“ ছেলেপক্ষ চলে আসবে একটু পর। এসব জানাজানি হলে কী হবে? আমি মানুষকে মুখ দেখাব কী করে?”
অশান্ত হাতে এক ঢোক পানি খেলেন তিনি। জোরালো শ্বাস টেনেটুনে বললেন,
“ মাজহার, ও বেশিদূর যেতে পারেনি। তুমি কজন লোক পাঠাও। যেভাবেই হোক ওকে ধরে আনো। এটা আমার সম্মানের প্রশ্ন। পালালে আগে পালায়নি কেন? এখন বিয়ের দিন স্টেজে ওঠার সময়!”
একটু থেমে বললেন,
“ কেউ কিছু জানার আগে ওকে ধরে এনে হলেও স্টেজে বসাতে হবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে নাহলে। যত টাকা লাগে দাও, তাও কজন লোক পাঠাও মাজহার।”
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে কাউকে একটা ফোন করলেন। বাস ট্যান্ড, ট্রেন স্টেশন আর এয়ারপোর্ট সবখানে লোক পাঠানোর আদেশ। পেশায় মেয়ের বাবা পাকা ব্যবসায়ী। অর্থের সাথে টুকিটাকি ক্ষমতাও আছে।
কিন্তু এপাশে টাকার কথা শুনেই তুশির মুখ চকচক করে উঠল। এর মানে মালদার পার্টি! অনেক টাকা আছে। অমনি একটা ফন্দি আঁটল সে। আড়াল ছেড়ে এসে, চট করে ঢুকল ঘরে।
“ কিন্তু আমি যে সব লিসেনিং, কাকু। এবার কী হবে?”
আচমকা কথায় চমকাল সকলে। এতগুলো চাউনি একইসাথে বর্তাল তার ওপর। মাজহার অবাক হয়ে বললেন,
“ তুমি কে?”
তুশি সব দাঁত দেখিয়ে হাসল। বাধ্যের ন্যায় জানাল,
“ মাই নেম ইস তুশি। কারওয়ানের বসতিতে থাকি। খেতে এলাম, কথা শুললাম। মেয়ে ভেগে গেছে তাই না? সো স্যাট!(স্যাড)”
প্রত্যেকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। বসে থাকা রমণীর কণ্ঠে বিস্ময়,
“তোমার নাম তুশি?”
মাজহার চটে গেলেন বস্তি শুনে। রেগেমেগে বললেন,
“ এই মেয়ে, এখানে ঢুকলে কী করে! এক্ষুনি ঘাড় ধরে বের করার ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও।”
তুশি সজোরে মাথা নাড়ল।
“ উহু উহু। ওটি করতে যাবেন না। তাহলে বাইরে গিয়ে একেবারে মাইকিং করে জানিয়ে দেবো আপনাদের মেয়ে ভেগেছে। তখন কী হবে হু?”
দ্বিতীয় বার মুখ দেখাদেখি করলেন তারা। মেয়ের বাবা শান্ত ভাবে শুধালেন,
“ কী চাও তুমি?”
“ এইত, ভেরি নাইস। আঙ্কেল এসমাট মানুষ, বুঝা যাচ্ছে।
শুনুন আঙ্কেল, মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে এসব খুব বাজে কথা। আপনি কাউকে জানাতে না চাইলে, আমিও জানাব না। কিন্তু একটা শর্তে। ”
মাজহার অধৈর্য,
“ কী শর্ত হ্যাঁ? শুনিতো!”
তুশির মাঝে ভয়ডর কিচ্ছু নেই। এতগুলো অচেনা মানুষের সামনে কেমন বুক ফুলিয়ে আছে। চটপট বলল,
“ পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। বিকেল থেকে কিছু খাইনি। খাই, দাই তারপর বাড়ি চলে যাই।”
মেয়ের বাবা ঝামেলা চাইছেন না।
বললেন এক কথায়,
“ মাজহার, একে টাকা দিয়ে বিদেয় করো। অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি দেখি ওদিকটা সামলাই।”
ভদ্রলোক আস্তে ধীরে উঠে বেরিয়ে গেলেন। মাজহার ব্যতীত একে একে সবাই তার পিছু পিছু চলল। তুশি বলল,
“ দিন কাকু। শুভ কাজে দেরি করতে নেই। ওহ, ভাংতি দিলে ভালো হয়।”
মাজহার বিরক্ত। দাঁত চেপে পকেটে হাত দিলেন।
এর মাঝেই বাইরে থেকে শোরগোল এলো, বর এসেছে। ভদ্রলোক থমকালেন। চোখেমুখে দুশ্চিন্তা জেঁকে বসল। হঠাৎ চোখ পড়ল তুশির ওপর। সহসা কিছু একটা ঘূর্নির মতো বেজে উঠল মাথায়। প্রশ্ন করলেন,
“ আমার একটা কাজ করে দিবি, মেয়ে?”
তুশি হাত নাড়ল,
“ নাহ, ওসব কাজফাজ আমি করি না। টাকা দিন, চলে যাই।”
“ আহহা! আগে শোন তো। করে দিলে পাক্কা বিশ হাজার দেব।”
তুশির ঠোঁট আলাদা হয়ে গেল। চোখদুটো ঠিকড়ে এলো প্রায়। কণ্ঠ শৃঙ্গে নিয়ে বলল,
“ এ্যাহ! বিশ হাজার? আরিব্বাস, এজন্যেই মনে হয় সকাল থেকে হ্যান্ড চুলকাচ্ছিল।”
“ করবি?”
তুশি লাফিয়ে উঠল।
“ অফকোর্স করব। কী কাজ খালি বলুন!”
মাজহার ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলেন। সে বড়ো চতুরের হাসি। তুশি সেই হাসিতে অহেতুক বোকা বনে যায়। অশনীর একটা দুরুদুরু সংকেত আড়াআড়ি দাগ কাটে মনে।
কেন যেন ঘেমে গেল মেয়েটা। জ্বিভে ঠোঁট চুবিয়ে, হাত তুলে মুছল সেটুকু। এরপর কপালে কী আছে কে জানে!
.
.
.
চলবে….......................................................................