কাছে আসার মৌসুম - পর্ব ০৬ - নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি - ধারাবাহিক গল্প


তুশি ব্যথায় মোচড়াচ্ছিল। ছিটকে এসে পড়ায়,পিঠের হাড় টনটনিয়ে উঠেছে। এর মধ্যে এসে হাত বাড়াল আগন্তুক! মাথা তুলে 
চাইল ও। ব্যথায় কুঁচকে রাখা চোখমুখ টানটান হলো অমনি। ফরসা,সুতনু পুরুষ। মুখের গড়ন দীর্ঘ। স্পষ্ট, চওড়া চোয়াল। চোখদুটোর রং আলাদা। কী রং এটা? রোদের আলোয় জ্বলছে। ভ্রু দুটো জোড়া। গালের ভাঁজে ভেসে থাকা গভীর হাড়ের গঠন,প্রকাশ করছে পুরুষটির ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তার। তুশি ঠোঁট কামড়ে ভাবল, 
“ এ মালটা আবার কে?” 

অয়ন তাগিদ দিলো,
“ কী হলো? উঠুন। সারাদিন এভাবে পড়ে থাকার ইচ্ছে আছে নাকি!”

তুশি হাত ধরবে না ভেবেছিল। 
পুরুষে ওর এলার্জি। কিন্তু কোমরের হাড়ে যে দুম করে লেগেছে,একা ওঠা কষ্টের। আবার লোকটা এভাবে সাহায্য করতে এলো! দোনামনা করে ডান হাতটা বাড়াল তাই। আচমকা এসে দাঁড়াল ইয়াসির। তার মারের তোড়ে ছেলেগুলো নিরুদ্দেশ। ঝুঁকে থাকা অয়নের ঠিক পেছনে সটান দেহের মানুষটাকে দেখেই তুশির কেন যেন শ্বাস আটকে গেল। মনে হলো ইয়াসির এক্ষুনি তেড়ে আসবে। 
খপাৎ করে ওর টূটী চেপে বলবে, 
“ তুই আমার কিচ্ছু ছিড়তে পারবি না।” 
যেমন করেছিল রুহানের সাথে। 
কল্পনার প্যাঁচে বাড়ানো হাত ঝট করে নামাল তুশি। 
অমনি পিচের রাস্তায় ঠুকে গেল কনুইটা। আরেকদফা ব্যথায় লাফিয়ে উঠল তরুণী। কনুই চেপে বিড়বিড় করল,
“ শালার কুফা পুলিশ! মুখ দেখলেই ব্যথা পাই।” 

ইয়াসির সরু চোখে চেয়ে। 
তুশির কাণ্ডকারখানা দেখল কিছুক্ষণ। এতেই যেন মেয়েটার সব গুলিয়ে যায়। এমন করে তাকাচ্ছে কেন? ইয়াসির খ্যাক করে বলল, 
“ তুমি সেই চোর না? এখানে কী চাই?” 

অয়ন ঘুরে তাকাল। কণ্ঠে বিভ্রম,
“ চোর?” 

তুশি ঠোঁট উলটে রাখে। ও চোর না। চোর আর পকেটমার আলাদা। কিন্তু ভুলটা শুধরে দেয়ার সাহস হলো না। 
মোড়ামুড়ি করে দাঁড়াল কোনোরকম। ইয়াসির দ্বিতীয় প্রশ্ন করল, 
“ আবারও পকেট মারতে বেরিয়েছ?” 

তুশি নিষ্পাপ চোখে বলল,
“ নো সার। নো নো।” 

কিন্তু ঝটকা খেল অয়ন। অবাক হয়ে বলল,
“ পকেটমার! মেয়ে পকেটমার?” 
তুশি হাত ডলছে। 
ছিলে গেছে জায়গাটা।
 ইয়াসির হয়ত এসব নিয়ে কথা বলতে চাইল না। প্রসঙ্গ পাল্টাল অয়নকে দিয়ে,
“ তোর না দেরি হচ্ছে? চল।” 

অয়ন তুশির দিকে চাইল আবার। ও তাজ্জব তখনো। বেশভূষা ছেলেদের মতো। কিন্তু তাই বলে পকেট কাটে? কী আজব ব্যাপার-স্যাপার। 
কিন্তু ডাক্তারি সত্তাটাকে তো বিসর্জন দেয়া যায় না। মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে! তাই বলল,
“ বাসায় গিয়ে একটু স্যাভলন লাগিয়ে নেবেন। কমে যাবে।বেশি ব্যথা করলে একটা পেইন কিলার। ওকে?” 

তুশি চুপ। ইয়াসির হেলমেট পরছিল। অয়ন ওর দিকে পুরো ঘুরে বলল,
“ এরপরের রাস্তা দুটো তো দুদিকে ভাইয়া। আমি একটা সি এন জি ডেকে নেই?” 

“ এখান থেকে সি এন জি পাওয়া টাফ। তুই উবার ডাক। সাত/আট মিনিটে চলে আসবে।” 
অয়ন মাথা ঝাঁকাল। পকেটে হাত দিল ফোন নিতে,মনে হলো খালি খালি। যেন কিছু একটা নেই। 
ত্রস্ত হাতানোর গতি বাড়াল সে। নেই, মানিব্যাগ নেই। অয়ন হতভম্ব আওড়ায়,
“ এই যা, আমার ওয়ালেট!” 
বিভ্রান্ত নয়নে ইয়াসিরের মুখ দেখল সে। মানুষটার কপালে গুচ্ছ ভাঁজ। চট করে অয়নের পেছনে চাইল,যেখানে দাঁড়িয়েছিল তুশি। 
কিন্তু কই সে? ওর দেখাদেখি অয়নও ঘুরে যায়। না,
তুশি কোথাও নেই। মেয়ের টিকিও দেখা যাচ্ছে না। ও হাঁ করে বলল,
“ কোথায় গেল মেয়েটা? এইতো ছিল। এর মধ্যে গায়েব? কী অদ্ভুত জায়গা! এমন কেন? ওয়ালেট নেই,মানুষ নেই আশ্চর্য!” 

ইয়াসির ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
“ তোর ওয়ালেট ওই নিয়েছে। 
অয়নের কণ্ঠ শৃঙ্গে,
“ হ্যাঁ? কী চালাক চোর। কখন নিলো? আমিতো কিছু টের পাইনি।” 
“ চোররা এরকমই। তোকে টের পাইয়ে চুরি করবে না।” 
বলতে বলতে চারপাশে দেখল ইয়াসির। এখন কোথায় খুঁজবে এই মেয়েকে! যেই একটু হেলমেট পরায় ব্যস্ত ছিল হাতসাফাই করে ফেলেছে। আরেকবার পাক এটাকে! মজা বোঝাবে।  

অয়ন বলল,
“ কী আর করার! নিয়েছে যখন ফেরত তো আর পাব না। তবে সমস্যা নেই। টাকা গেলে যাক, আইডি কার্ড-টার্ড ছিল না।” 

“ বোস। একবারে তোকে নামিয়ে দিয়ে আসি।” 
“ তোমার দেরি হবে না?” 
 “ না।” 
অয়ন হাঁপ ছাড়ল। সুবিধেই হলো ওর। পেছনে বসতে বসতে বলল,
“ মেয়ে পকেটমার আমি জীবনে প্রথম দেখলাম। তাও তোমার মতো পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে নিয়ে গেল? বলতেই হচ্ছে পাকা হাত!” 

ইয়াসির চুপ। এতক্ষণে মনে পড়ল তুশি নামটা সে কোথায় শুনেছে!
এই চোর মেয়ের নাম তুশি। আবার ওর সাথে যে মেয়ের বিয়ে ঠিক হচ্ছে তার নামও তুশি। শেষমেশ ইয়াসির আবরারের বউয়ের নাম হবে একটা চোরের নামে? ছিঃ

******

 ক্যালেন্ডারের তারিখ এগিয়েছে । এখন ফেব্রুয়ারী মাস। প্রকৃতিতে শীত ডিঙিয়ে গরম পড়ার মতোই, তপ্ত সারাদেশ। 
রুহানের কেস নিয়ে উত্তাল জনগণ। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রত্যেকটা রিফ্রেশে তার মেয়ে কিডন্যাপিংয়ের ভিডিও। কয়েকটি টিভি চ্যানেল অবধি সরব এ নিয়ে। বিভিন্ন ভ্লগার থেকে শুরু করে,জনসাধারণের প্রত্যেকে প্রায় রুহানের শাস্তির দাবি তুলছে। ইয়াসিরকে দেয়া মেয়েটির সাক্ষ্য,তার কান্না,হাহুতাস নাড়িয়ে দিয়েছে মানুষদের। ভিক্টিমের ভার্সিটি চত্বরে মিছিল বসিয়েছে শিক্ষার্থীরা। 
মেয়েরা যদি চেনা কলেজ প্রাঙ্গণেও নিরাপদ না থাকে,তবে কোথায় নিরাপদ? 
স্বপ্নটেলিভিশন সবার এক কাঠি ওপরে। এমনিতেও এই চ্যানেলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে রুস্তমের সম্পর্ক ভালো নয়। তারওপর পেয়েছে এমন খবর‍! কাছা খুলে উচ্ছেদের পাল্লায় নেমেছে যেন। 
সব মিলিয়ে সরকার এবার নড়েচড়ে বসেছে। ওপরমহল থেকে চাপে পড়ছে রুস্তমের ওপর। সকাল-বিকেল ফোন আসছে। বকাঝকা করছেন বড়ো বড়ো মাথারা।

রুস্তমের দশা দিশেহারা। টিভি চ্যানেল মানাতে পারলেও,সোশ্যাল মিডিয়া তো আর হাতে নেই। আজ সকালেও মন্ত্রী রূপক এ নিয়ে ফোন করে গালিগালাজ করলেন। কমিশনার অবধি সুযোগ বুঝে সুর পালটে ফেলেছে। 
রুস্তমের আপাতত ঘোরার উপায় নেই। আপিল করা জামিনও না মঞ্জুর করেছে আদালত। সবশেষে রুহানের আজ সাজা ঘোষণার দিন। আদালতে মোটামুটি মানুষের উপস্থিতি এখন। একপাশে বাদী পক্ষ,অন্য পাশে বিবাদী। রুস্তম বারবার অদূরের ইয়াসিরকে দেখছেন। টানটান দেহে,বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো একটা ফরসা ছেলে। চোখেমুখে অন্যরকম দর্প। এই দর্প কীসের? রুস্তমকে হারিয়ে দিয়ে রুহানকে শাস্তি পেতে দেখার‍! বসে বসে দাঁত পিষলেন ভদ্রলোক। আজ যদি রুহানের সাজা হয়,এই শক্ত দেহটাকে আস্ত রাখবেন না তিনি। একমাত্র ছেলে তার! এখন অবধি ফুলের টোকা পড়তে দেননি। সেখানে ইয়াসিরের মতো অফিসার এসে… 
হঠাৎ কানে এলো বিচারকের স্বর। ভিক্টিমকে দ্বিতীয় দফায় সাক্ষি পেশ করতে ডাকা হচ্ছে। মাথা নুইয়ে গিয়ে দাঁড়াল ফারিন। তার হাবভাবে ইয়াসিরের চিন্তা বাড়ল কিছু। মেয়েটা পারবে তো সব বলতে! বিবাদী পক্ষের উকিলের প্রশ্ন কেমন হয় আন্দাজ আছে ওর। তোড়ে ফারিন ভড়কে না যায়! 
কিন্তু না,এমন কিছু হলো না। ফারিন চোখ নামিয়ে রাখলেও,তার কণ্ঠ পাথুরে। যেন অধিক হিমে তুষার জমে গিয়েছে। উকিলের একেকটি নির্লজ্জ প্রশ্নেও সেই তুষার গলেনি। বিব্রত হওয়ার ছাপ বসেনি মুখে। তার অনর্গল,অকপট জবাবে গোটা থানা থমকে গেল। বুক ভরে স্বস্তির শ্বাস ফেলল ইয়াসির। আড়চোখে রুস্তমের দিকে চাইল এক পল। চোখাচোখি হলো। ভদ্রলোকের উষ্ণ আঁখির অঙ্গার,ইয়াসিরের নেত্রদ্বয়ের নীরব যুদ্ধ বার্তায় সুবিধে করতে পারে না। বরং নিটোল ঠোঁট চূড়ায় তুলে হাসল ইয়াসির। শব্দহীন,একপেশে হাসি। রুস্তমের গা জ্বলে গেল তাতে। 
বিস্ফোরিত চোখ দিয়ে ইয়াসিরকে ভস্ম করল কয়েকবার। 

রুহানের বিচার কার্য শেষ। সমস্ত প্রমাণ,সাক্ষি বিপক্ষে থাকায় ধারা ৩৭৬ কার্যকর হয়েছে। দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সাথে ভিক্টিমকে জরিমানা প্রদানের রায় দিয়েছে কোর্ট। রুহান আর্তনাদ করে উঠল
“ ড্যাড” বলে। রুস্তম হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালেন। পাশে নিয়াজ,অসহায় হয়ে বসে। তার এখানে বলার কিছু নেই। 

কিন্তু বিচার নিয়ে ফারিন খুশি হতে পারল না। যদি রুহানকে ফাঁসিতে দিত, হয়ত একটু শান্তি মিলতো ওর। 
যাক, তবুও কিছু তো হয়েছে। কত ধর্ষিতার নসিবে যে এটুকুও জোটে না। আজও কত ধর্ষক একটা মেয়েকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দুনিয়ের বুকে সদর্পে ঘুরে বেড়ায়। সেখানে রুহান জেলে যাচ্ছে এই ঢেড়। 
আর এই সব হয়েছে একজনের জন্যে। ইয়াসির! ফারিনের চোখদুটো কৃতজ্ঞতায় ছলছল করে উঠল। হঠাৎ নজর পড়ল রুহানের ওপর। পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে তাকে। 
কিন্তু যেতে যেতে তপ্ত চোখ ফারিনেই আটকে। যার প্রতি পরতে অগ্নিশিখা। একেকটি হিংস্র শিখা ছুড়ে তাকে ঝলসে দেওয়ার ইচ্ছে। 
আচমকা সামনে দাঁড়াল ইয়াসির। কনস্টেবল থামলেন। পথরোধের ছোট্ট বাধায় চোখ সরিয়ে সামনে ফেলল রুহান। মুখের কাছে ইয়াসিরকে দেখেই বাড়ানো পা-টা চলে এলো পেছনে।  
ইয়াসির বলল,
“ ওকে এত দেখে লাভ নেই। আপাতত তুই নিজেকে নিয়ে ভাব। বলেছিলাম না? তোর বাপ আমার কিচ্ছু ছিড়তে পারবে না! কথা মিলল?” 
রুহান কটমটিয়ে কিছু বলতে গেলেই,পুঁটি মাছের মত ঘাড়টা ধরে ধাক্কা মারল ইয়াসির। 
“ নিয়ে যাও।” 
কনস্টেবল মাঠে গোরু চড়ানোর মতো ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলেন ওকে।  
ইয়াসির নজর ফেরাতেই দেখল,সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ফারিন। সেকেন্ড দুয়েকেই চট করে পা ছুঁয়ে সালাম করল মেয়েটা। ইয়াসির ত্রস্ত পিছিয়ে গেল। কণ্ঠে বিব্রতভাব,
“ মিস ফারিন, কী করছেন?” 
ফারিন মাথা তুলল। চোখে এক প্রস্থ জল। 
“ আপনি ছিলেন বলেই আজ বিচার পেলাম, স্যার। 
নিজের জীবনের পরোয়া না করে একটা রেপড মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এমন ফেরেশতার মতো মানুষকে একটু সম্মান দেয়া তো দোষের নয়।” 

ইয়াসির সহজ হতে পারল না। অস্বস্তি তার চোখেমুখে। 
“ আমি আমার ডিউটি করেছি। আপনার জায়গায় যে কোনো মেয়ে হলে এই একই কাজ করব। প্লিজ উঠুন!” 

ফারিন উঠে দাঁড়াল। চোখের জলটা তার গালে নেমে এসেছে। ইয়াসিরের মায়া হলো! ছোটো করে বলল,
“ কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। আপনার নিরাপত্তায় পুলিশ সব সময় সচেষ্ট থাকবে।” 

******

বাইরে তখন রোদের ত্রাস। বড়ো শিমুল গাছটা কোর্টের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। ওতে একটা ফুলও নেই। খাখা মরুর মতো শূন্য ডালের চূড়া। 
 ইয়াসির ব্যস্ত প্রাঙ্গণ ছেড়ে বের হতেই মা ফোন করলেন। এবারেও হ্যালো শোনার সময় নিলেন না। ব্যস্ত ভাবে মুখ ছোটালেন,
“ হ্যাঁ রে,তোকে যে বললাম মেয়েটাকে ফোন করতে,করেছিলি?” 
ইয়াসির ক্লান্ত শ্বাস টানল। ও মরছে এক জ্বালায়,তারওপর মায়ের আরেক জ্বালা। 

“ সময় পাইনি।” 
তনিমা রেগে রেগে বললেন,
“ বাহ,খুব ভালো কথা। কিন্তু এসব নতুন কী? শোন সার্থ,তোর এই সময় কোনোদিন আসবে না। এজন্য বিয়েটাও কত পিছিয়ে গেল। এবারেও যদি বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে মোড় দিয়েছিস আমি
 কিন্তু তোর সাথে কোনোদিন কথা বলব না।” 
“ জেদটা বাচ্চাদের মতো হয়ে যাচ্ছে না?” 
“ হলে হচ্ছে। আমার এই এক কথা। তুই এক্ষুনি তুশিকে ফোন কর। ঢাকাতেই তো থাকে। ফ্রিও আছে। দেখা কর আজ। আংটিবদল তাহলে এই সোমবারে করব। তোর বাবা তো বলল…” 
“ অন্য কিছু বলো।” 
ছেলের কড়া কণ্ঠের দৃঢ়তায় একটু থমকালেন তনিমা। বাবার নাম শুনতেই প্রসঙ্গ পাল্টানোর তাগিদটুকু বুঝলেন স্পষ্ট! 
জ্বিভে ঠোঁট ভেজালেন তিনি। বললেন,
“ না মানে তোর দাদুন , বাড়ির সবাই চাচ্ছিল এংগেজমেন্টটা ঐদিন হয়ে যাক। তুই আজ একটু দেখা কর না বাবা।” 

হার মানল ইয়াসির। 
বলল, “ আচ্ছা।” 
লাইন কাটতেই শরিফ হাজির হলো। ইয়াসিরের কথা শেষ করার অপেক্ষাতেই ছিল এতক্ষণ। হইহই করে বলল,
“ স্যার ,আপনি তো কামাল করে দিলেন! রুস্তমের ছেলেকে কারাবাদ! মাই গুডনেস! প্রথম হয়ত কোনো বড়ো মাপের এমপির ছেলেকে সাজা পেতে দেখলাম। তাও আবার রেইপড কেস।” 
 
ইয়াসির সব কথা এড়িয়ে, পালটা প্রশ্ন ছুড়ল,
“ এতক্ষণ কোথায় ছিলে?” 
শরিফের আলগা হাসি মুছে গেল । থতমতও খেল কিছুটা। বিচারকার্য কালীন ও কোর্টের ভেতরে ইচ্ছে করে যায়নি। রুস্তমের চোখে একবার পড়ে গেলে বিপদ! 
তাই চট করে উত্তর দিতে না পারলেও, ইয়াসির বুঝে নেয়। ঝট করে প্রশ্ন ছোড়ে,
“ তুমি সিগারেট খাও?” 
শরিফ ঝটকা খেল। চোখে,মনে সবজায়গায়। ঘাবড়ে বলল,
“ ককেন বলুন তো, স্যার? হঠাৎ এই কথা!” 
ইয়াসিরের স্বর পুরূ,
“ খাও কী না!” 
অবোধ বালকের মতো দুপাশে মাথা নাড়ল শরিফ। 

“ মিথ্যে বলছো। আমি তোমাকে সেদিন খেতে দেখেছি।” 
লোকটার মুখখানা ছোটো হয়ে যায়। ধরা পড়ে আমতাআমতা করল,
“ না মানে..ঐ মাঝে সাঝে দু একটা।” 

ইয়াসির হঠাৎ কাঁধে হাত রাখল। প্রস্তাব ছুড়ল রাখ-ঢাকহীন।
“ এসো,চা খাই।” দ্বিতীয় বার হোচট খেল শরিফ। কাঁধ প্যাঁচানো ইয়াসিরের হাতটাকে দেখল বিহ্বল বনে। 
এত মাস হলো এই থানায় এসেছে ইয়াসির, কখনো এভাবে মেশেনি। বিভ্রম নিয়েই মাথা নাড়ল শরিফ। 

টং-এ এসে বেঞ্চে বসল ইয়াসির। পাশের জায়গা দেখিয়ে বলল,
“ বোসো।” 
শরিফ দোনামনা করে বসলেও,চোখমুখে নির্বাধ জিজ্ঞাসা৷ 
ইয়াসির হঠাৎ এত আন্তরিকতা দেখাচ্ছে কেন? ওকেও কোনোভাবে কিছুতে ফাঁসিয়ে দেবে না তো! যা বুদ্ধি এর! ভাবতেই শরিফের ঘাম ছোটে। 
ইয়াসির কেন যেন হাসল। আলগোছের,অল্প একটু হাসি। তেমন হুট করেই বলল,

“ শরিফ,আমি জানি তুমি একজন চেইন স্মোকার। মাঝেমধ্যে নয়, বরং সিগারেট ছাড়া তোমার দিন চলে না। তাও আমাকে মিথ্যে বলেছ,ভেবেছ চাকরিসূত্রে আমি তোমার সিনিয়র। স্বীকার করলে অভদ্রতা হবে। কিন্তু কী জানো? অন্যের জন্যে নিজের সত্তাকে গুটিয়ে রাখার নাম ভদ্রতা নয়। এটা ভয়। আর এই শব্দ তোমার ইউনিফর্মের সাথে যাচ্ছে না। মরতে তো একদিন হবেই। তোমাকে,আমাকে কিংবা তোমার রুস্তমকে। তাহলে যদি কারো জন্যে ভালো কিছু করতে গিয়ে একটু আগে মরতে হয়,তাতে ক্ষতি কীসের? ভয় পেলে তাকে পেতে শেখো,যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তা না করে, তারই আরেক সৃষ্টি, তোমারই মতো আরেক তুচ্ছ মানুষকে ভয় করছো?
এটা আল্লাহর সাথে বেইমানি। সাথে বেইমানি তোমার পোশাকের সাথে। 
একটা কথা মনে রাখবে,
 নিজেকে শুদ্ধ রাখার মধ্যে যে গর্ব,সেই গর্ব কোনো কিচ্ছুতে নেই।” 

পুরো কথা শরিফ মুগ্ধ হয়ে শুনল। ইয়াসির সচারাচর এত কথা বলেনি তার সাথে। কাজের বাইরে তো একটা শব্দও নয়। গভীর স্বরের প্রতিটি বাক্য এখনো কানে বাজছে তার । ইয়াসির চা শেষ করল ততক্ষণে। উঠে দাঁড়িয়ে বিল মেটাল। শরিফ দিতে চাইলেও লাভ হলো না। 
ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, 
“ আমি একটু শাহবাগ যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হলে সামলে নিও।”  
“ আমি আসব স্যার?” 
“ নো,ইটস এবাউট পার্সনাল।” 
“ জি।” 
ইয়াসির বাইক নিয়ে চলে যায়। 
 শরিফ হেঁটে এলো মেইন গেটে। থানা থেকে আনা জিপটা এখানেই রাখা। হঠাৎ চোখ পড়ল, রুস্তম বের হচ্ছেন। সাথে আরো কজন আছে। ফোনে কথা বলছেন তিনি। শরিফ তটস্থ হয়ে কান খাড়া করল। স্পষ্ট শুনল,রুস্তম কোনো এক গাড়ির নেমপ্লেট বলছে কাউকে। কিন্তু চট করে ওর মাথায় এলো না,এটা কার গাড়ি হবে! 

ইয়াসিরের বাইক চালানোর হাত ভালো। একেবারে পাকাপোক্ত যাকে বলে! কলেজ থেকেই চালায় কী না! বাবার গাড়ি আছে,কিন্তু ইয়াসির কখনোই ব্যবহার করেনি। কলেজে ওঠার পর অনেক জোরাজোরি করে সাইফুল ইসলাম একটা বাইক কিনে দিলেন। চাচার প্রতি তো আর ক্ষোভ নেই,তাই নিলো ইয়াসির।  
এরপর সোজা পাল্টাল নিজের পয়সায় কিনে। এক হাতে থ্রটল ধরে রেখে,অন্য হাতে নম্বর ডায়াল করে ফোনটা কানে গুঁজল ইয়াসির। রিং হচ্ছে কোনো অচেনা নম্বরে। না অচেনা নয়,আনসেভ। তুশির নম্বর এটা। যার সাথে বিয়ে হবে তার। 
তবে ইয়াসির বিধ্বস্ত সংকোচে। গলা অবধি বসে আছে অস্বস্তির জল।
ওপাশ থেকে রিসিভ হলো কিছু সময় পর। রিনরিনে নারী কণ্ঠ শুধাল,
“ হ্যালো,কে বলছেন?” 

ইয়াসির অপ্রতিভ ছিল। অথচ শব্দবাক্যে আঁচটা বিন্দুমাত্র নেই। স্বভাবসুলভ স্থূল তার স্বর,
“ ইয়াসির আবরার সার্থ!” 
মেয়েটির চটপটে কণ্ঠে ভাটা পড়ল এবার,
“ ওহ আপনি? আন্টি বলেছিল ফোন করবেন। এক্ষুনি করবেন তা জানতাম না। তাই আর কী!” 
ইয়াসির জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। তার অস্বস্তি বাড়ছে বৈ কমেনি। মেয়েটা নিজেই বলল,
“ আসলে সবাই বলছিল আমাদের একবার দেখা করা উচিত। আমি তো শাহবাগের এখানেই থাকি। আপনি কি আসবেন একবার? আমি তাহলে বের হোতাম।”

“ জি আসুন, সমস্যা নেই।” 
“ আপনি কোথায় জানলে সুবিধে হোতো।” 
ইয়াসির জায়গার নাম বলল। টিএসসি পেরিয়ে আসছে সে। 
মেয়েটা বলল,
“ আচ্ছা বেশ,আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি।” 
ইয়াসির হু-হা না করেই খট করে লাইন কেটে দিলো। মেয়েটা ভ্রু গোছায় তাতে। 
চোখনাক কুঁচকে ভাবে, 
“ আশ্চর্য লোক! এমন কেন? ভদ্রতার খাতিরে একটা বাই পর্যন্ত বলল না?” 

ইয়াসির দুই গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। বাইক তখনো চলছে। ফোনটা কোনোরকম পকেটে ভরতেই, এক ভয়ানক কাণ্ড ঘটল সহসা। কোত্থেকে ভারি লোহার রড উড়ে এসেই ঠিক কপালে গিয়ে লাগে। প্রখর চোটের তোড়ে বাইকে রাখা হাতটা হড়কে গেল ওর। চাকার টাল হারিয়ে বাইক কাত হয়ে ছিটকে পড়ল ইয়াসির।  
কপাল কেটে রক্ত বেরিয়েছে। হাতের কনুই ছিলে একশা। একহাতে মাথাটা চেপে কোনোরকম উঠে বসল ও। বাইক পড়ে আছে ধুলোয়। ইয়াসির উঠে দাঁড়াল কোনোরকম। এক পল চারপাশে চাইল। অদূরে দু একটা দোকান দেখা গেলেও,ঝাপ্সা চোখে ও মানুষ বুঝতে পারছে না। মাথা দু একবার ঝাঁকি দিয়ে ইয়াসির বাইক তুলতে ঝুঁকল। অমনি পিঠ বরাবর এসে শক্ত কিছু দিয়ে বাড়ি মারল কেউ একজন। অপ্রস্তুতি ইয়াসির থুবড়ে পড়তে নিয়েও,সামলাল নিজেকে। ঘুরে চাইল ত্রস্ত। আক্রমণকারী এক দুজন নয়,গুণে গুণে চারজন সামনে দাঁড়িয়ে তার। প্রত্যেকের হাতে ছুড়ি,রডের লাঠি। ইয়াসির বুঝে নিলো এসব কার কাজ! রুস্তম এট্যাক করবে আন্দাজ ছিল,কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে বোঝেনি। 
ওকে বেশিদূর ভাবার সময় দেয়া হলো না। রড হাতের লোকটা তেড়ে এলো মাথায় আঘাত করতে। কৌশলে হাতটা ধরে ফেলল ইয়াসির। বুট পরা পা তুলে পোক্ত এক লাথি মারল বুকে। লোকটা ছিটকে গেল দূরে। তারপর দুজন আসে। কিন্তু প্রহারে ব্যর্থ হয়। ইয়াসির জুডো চ্যাম্পিয়ন। তার সাথে মারপিটে সুবিধে করা মুশকিলই বটে। খোলা রাস্তার নিচে মুহুর্তে ধস্তাধস্তি লেগে যায় ওদের। পথচারি কজন দেখলেও,এগিয়ে আসার সাহসে কূলোয় না। ইয়াসির একা হাতে যেটাকে পারছে মারছে। কখনো পা,কখনো হাত! আত্মরক্ষার্থে রডটা নিয়েও পেটাল ওদের। শেষে 
একটাকে ঘুষি দিতে দিতে মাটিয়ে শুইয়ে ফেলল। বুকের ওপর হাঁটুর ভর রেখে পটাপট প্রহার করল মুখে। লোকটার নাক থেতলে যাওয়ার দশা হয়। 
চতুর্থ লোকটা বুকে হাত চেপে উঠলেন কোনওমতে। দুপাশে দুজন মাটিতে শুয়ে কঁকাচ্ছে ব্যথায়। লোকটার মাথায় হযবরল লেগে গেল কী করবেন, কীভাবে করবেন তা নিয়ে! 
কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। যে করেই হোক,একে লাশ বানিয়ে ফিরতে হবে আজ। চকচকে ধারালো ছুড়িটা তুলেই ফের তেড়ে গেলেন তিনি। 
ইয়াসিরের খেয়াল অন্যদিকে। দ্বিতীয় লোককে বেধরম মারছিল। 
চতুর্থ জন তার পেছনে দৃঢ় এক কোপ বসাতে গেল, কোত্থেকে ঝড়ের মতো এসেই ছুড়িটা ধরে ফেলল কেউ একজন। বিঘ্ন পেয়ে ভড়কাল সে । তাকাল স্পষ্ট চোখে। আগন্তুক মেয়ে! কিন্তু পোশাক-আশাকে ছেলেদের ভাব।
ধারালো ছুড়ির ডগা হাতের মুঠোয় বন্দি তার। লোকটা ছুড়ি ধরে মোচড় দিল। কিন্তু ছাড়ানো গেল না। আরো শক্ত করে চেপে রাখল মেয়েটি। তোপে কোমল,সফেদ তালুর চামড়া ছিন্ন হলো কেটে। গলগলিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত কব্জি ছুঁয়ে টুপটুপ করে নিচে গড়িয়ে পড়ল। ঘাড়ের ওপর উষ্ণ কিছুর স্পর্শে মুখ তুলে চাইল ইয়াসির। 
পিলে সুদ্ধ চমকাল অমনি। তার দিকে তাক করা ছুড়িটা ধরে দাঁড়িয়ে তুশি।ঘাতক লোকটির সাথে জবরদস্তি চলছে। 
ইয়াসির কিছুক্ষণের জন্যে বোকা বনে যায়। এক পল তুশিকে দেখে,পরপর ঘাতককে দেখল। লোকটা যত ছুড়ি মোচড়াচ্ছেন,তুশি তত জোরে ধরছে। শেষে সজোরে লাথি মারল,এক হাত দূরে ঠিকড়ে গেলেন তিনি। ত্রস্ত
দ্বিতীয় লোকটির বুক হতে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ইয়াসির। 
লোকটি খুকখুক করে কাশছেন। চেহারায় রক্ত,ধুলো মেখে একাকার। একটু ছাড়া পেতেই পা ঘষতে ঘষতে ছুটলেন পালাতে। 

বাকিরাও সাথে ছোটে। তুশির হাত কেটে যা তা অবস্থা! রক্তে সাদা কব্জি মেখে গেছে। ইয়াসির তাজ্জব চোখে মেয়েটিকে দেখছে তখনো। কিন্তু তুশির নজর এদিকে নেই। ছুড়ির সেই ঘাতক উঠে পালাচ্ছে। ও দাঁত পিষে পিছু ছুটতে যাবে,
অমনি হাতটা টেনে ধরল ইয়াসির। মেয়েটা থমকায়। থেমে যায় পা জোড়া। 
ইয়াসিরের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা,
“ মাই গুডনেস! এ কী অবস্থা হাতের! এসো।”
হাতে টান পড়তেই তুশি ভয় পেলো। ও যে অয়নের পকেট মেরেছিল সেদিন, মনে পড়ল সেটা। ঢোক গিলে বলল, 
“ ইয়ে,আবার জেলে ভরবেন নাকি?” 

“ কথা কম,এসো।” 
তুশির মুখটা চুপসে গেল। ও এখানে এসেছিল একটু ভালো ইনকামের জন্যে। ইয়াসিরের ওপর হঠাৎ আক্রমণ দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি। মানবতা মরে গেলেও, তুশি বেঁচে আছে! তাইতো ছুটে এলো বাঁচাতে। কিন্তু এখন কী হবে? এসব পুলিশ-টুলিশের কী মায়া-মমতা আছে? ভাইয়ের পকেট কাটার জন্যে যদি আবার জেলে ঢোকায়? সেবার তো বলল, 
কোর্টে চালান করবে। হায় হায়! তুশি নীরব হা-হুতাশ করছে। 
ইয়াসির ডান হাতে চেপে রেখেছে ওকে। বাম হাত তুলে সি এনজি ডাকল। অল্প পথ! রিকশা হলেও চলবে। কিন্তু একটা মেয়ের সাথে এত পাশাপাশি বসাতেই তার আপত্তি। 
তিন চাকার বাহন কাছে এসে দাঁড়াতেই,
ইয়াসির বলল,
“ ওঠো।” 
ভাবুক তুশি শোনেনি। ও কণ্ঠ চড়া করে ডাকল,
“ এই চোর, ওঠো।” 
মেয়েটা নড়ে ওঠে। কণ্ঠে দোনামনা,
“ ইয়ে মানে… 

“ উঠতে বলেছি।” 
কড়া কণ্ঠে শুনে তুশির সাহস শেষ। হতাশ ভঙিতে বসল ভেতরে। ইয়াসির ভেবেছিল ও চালকের পাশে বসবে। কিন্তু না,জায়গা নেই। অনীচ্ছায় তুশির পাশে বসল তাই। কিন্তু সিটের দুই প্রান্তে দুজন।
তুশি ঠোঁট কামড়ে ভাবল, 
“ আমাকে কি পকেট কাটতে দেখে নিয়েছিল? এখন কি কোর্টে নিচ্ছে! ও মাইগড। সুযোগ আছে। লাফ দিই গাড়ি থেকে।” 

সি এন জি চলছে। ইয়াসির শরিফকে ফোন করল। বাইকের অবস্থা শোচনীয়। বলল,
“ লোক পাঠিয়ে গ্যারেজে নিয়ে যেতে।” 
তুশি খেয়াল করল ও ফোনে ব্যস্ত। আস্তে করে ছিটকিনিটা টানতে গেল তাই। যেই হাত ছোঁয়াবে,
 ভেসে এলো সেই গুরুভার স্বর,
“ ডোন্ট মুভ! ভুলেও এসব করতে গিয়ে,কপালে দুঃখ ডেকো না।”  
 
তুশির চোয়াল ঝুলে যায়। হাতটা সরিয়ে আনে দ্রুত! 
“ না না আমিতো ছিটকিনিটা দেখছিলাম। কোনোদিন এত সুন্দর ছিটকিনি দেখিনি তো,তাই আর কী!” 
ইয়াসির কিছু বলল না। শরিফের সাথে কথায় বহাল হলো। ও 
বিড়বিড় করে মনে মনে,
“ কী চালাক মাইরি। হাত নাড়ালেই হাতি বুঝে ফেলছে?” 

ইয়াসির সোজা ওকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। বিশালাকার সাইনবোর্ড দেখে এতক্ষণে দম ফেলল তুশি। এর মানে ওকে জেলে ভরতে নয়,ডাক্তার দেখাতে এনেছে? যাক,তাহলে লোকটার দয়ামায়া কিছু হলেও আছে। 
তুশির ঠোঁটে হাসি ফুটল। গদগদ ভাব করে বলল,
“ সার,আমার কিন্তু কিছু হয়নি। একদম গুড আমি। নো টেনশন টেকিং। এরকম এসমল এসমল কাটিং অনেকবার! ইউ আমাকে ছেড়ে দিন। আই গো মাই কাজ। নু..” 
ইয়াসির তপ্ত চোখে ফিরল। 
ঠোঁটে আঙুল চেপে বোঝাল,
“ শশশ!” 
তুশি ঠোঁট টিপে মাথা কাত করল। ইয়াসির তখনো হাত ছাড়েনি। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এলো সোজা। সেখানকার লোকজন পুলিশ দেখে একটু তৎপর হলেন। তারওপর ইয়াসির এই কদিনের পরিচিত মুখ। রুহানের কেস চলাকালীন তার সাক্ষাৎকার বেশ পরিচিত। 
ওকে দেখেই এগিয়ে এলেন নার্স। 
“ কিছু লাগবে, স্যার?” 
ও তুশিকে দেখাল,
“ হাত কেটেছে। অনেকটা! ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা করুন।” 

“ জি, আসুন আমার সাথে।” 
নার্স ওদের নিয়ে আলাদা চেম্বারে এলেন। ডাক্তার ঢুকলেন কিছু সময় পরে। 
  ইয়াসির তুশিকে চেয়ার দেখাল,
“ বোসো।” 
তুশি ভয়-টয় এখন নেই। তবে হাতটা জ্বলছে! কতখানি কেটেছে রক্তের জন্যে বোঝা মুশকিল। নার্স তুলো দিয়ে সেস পরিষ্কার করলেন। উল্টেপাল্টে ক্ষত দেখে বললেন,
“ স্যার, মনে হচ্ছে অনেক গভীর চোট।” 
চিকিৎসক নিজেও পরোখ করলেন ব্যাপারটা। মাথা নেড়ে বললেন,
“ হ্যাঁ, ব্যান্ডেজ শেষে একটা টিটেনাস দিতে হবে।” 
 তুশি চোখ ঝাপটাল। ভাবল,
“ টি-টেনাস? টি মানে তো চা? চা খেতে দেবে?” 

অমনি স্ফূর্ত হয়ে বলল,
“ হ্যাঁ দিন না। দিলে ভালোই হয়। মন্নিং থেকে খাইনি।” 
ডাক্তার কিছু বললেন না। চলে গেলেন কোথাও। 
তুশি নজর এনে ইয়াসিরে ফেলল। মানুষটা পাশেই দাঁড়িয়ে। ফোনে মনোযোগ। ও সরু চোখে আপাদমস্তক দেখল ওর। ইয়াসির বেশ লম্বা! বসে থাকা তুশির পাশে উঁচু শৃঙ্গ যেন। চমৎকার স্বাস্থ্যে পুলিশের পোশাক কী যে মানিয়েছে! এত হ্যান্ডসাম পুলিশ তুশি আগে দেখেনি। ওর দেখা সব তো পেট মোটা,জলহস্তী সাইজের। সামনের চালকুমড়ার ভুড়ি দেখলেই বোঝা যেত,ঘুষ খায় কী না! 
ইয়াসিরের ইউনিফর্মে ধুলো মাখা। বোধ হয় মারামারির সময় লেগেছে। কব্জিতে একটা ঘড়ি। চুলগুলো সজারুর কাটার মতো পরিপাটি। গালে দাঁড়ি অল্প ছোটো,একটু খোচা খোচা। গোফটা ধারালো খুব। চিবুকের এক পাশে তিল। 

আচমকা ইয়াসির তাকাতেই তুশি থতমত খেলো। গাল চুলকানোর ভান করে চাইল এদিক সেদিক। ডাক্তার এলেন তখনই। নার্স সার্জিক্যাল ট্রে এনে রাখলেন।
সেখান থেকে বড়ো ইঞ্জেকশানটা তুলতেই, তুশির চোখ বেরিয়ে এলো। 
“ এটা দিয়ে কী হবে? হট ডু ইউ?”
চিকিৎসক বললেন,
“ আপনাকে তো বললাম টিটেনাস দেওয়ার কথা।” 

তুশির মাথা চক্কর কাটে। ডাক্তার ওকে ইঞ্জেকশানের কথা বলেছিল? তুশির তো এই জিনিসে ভীষণ ভয়! কবে কোন ছোটোবেলায় বস্তির স্কুলে একবার ইঞ্জেকশান দেয়া শুরু হয়। তুশিকে চেপে ধরে এমন ভাবে দিয়েছিল ব্যাটা,গোটা দু রাত জ্বরে ঘুমোয়নি সে। হাত নাড়ানো অবধি বন্ধ হয়ে গেছিল। জায়গা পেকে সেই বাজে অবস্থাটা ভেবেই, তুশি আর্তনাদ করে বলল,
“ না,আমি দেবো না। নো নো,নট গিভ মি।” 

চিকিৎসক ইয়াসিরের দিক চাইলেন। নীরবে শুধালেন, কী করবেন! তুশির চিৎকার শুনেই ও কান থেকে ফোন নামিয়েছে। পকেটে ভরতে ভরতে বলল,
“ যা দরকার করুন,আমি আছি।” 
তুশি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। 
“ না না সার। আমি দেব না।” 
ইয়াসির বাজখাই ধমক দেয়,
“ চুপ।” 
অমনি তুশি শক্ত হয়ে গেল। পিঠটা সটান গিয়ে ঠেকল চেয়ারের সাথে। 
নার্স শার্টের হাতা গোটাতেই,
দাঁত চেপে চোখ খিচে নিল জোরে। সূচের মাথাটা যেই ত্বক ভেদ করেছে,মেয়েটার মনে হলো আজ সে শেষ। আতঙ্কে কী করবে,কী ধরবে বুঝে উঠল না। পাশে ছিল ইয়াসির, খপ করে ওর হাতটাই চেপে ধরল তুশি। ধরার তোড়ে, খসখসে চামড়ায় নক বিঁধে গেল। ইয়াসির ভ্রু কুঁচকে সেথায় দেখল এক পল। তারপর ফিরল তুশির পানে। ফ্যাকাশে ঠোঁট নড়ছে মেয়ের। দোয়া পড়ছে হয়ত। গা কাঁপছে। ইয়াসির আশ্চর্য হয়। 
ছুরি দিয়ে হাত কাটল,গুণ্ডাদের বুকে লাথি মারল। তাড়া করতেও যাচ্ছিল 
ওদের। এত সাহস যেখানে! সেই মেয়ে এখন একটা সামান্য ইঞ্জেকশান দিতে বসে এমন ঠকঠক করে কাঁপছে?
.
.
.
চলবে…......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp