জাওয়াদ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। গোধূলির ম্লান আলো ঘরটাকে অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ঢেকে রেখেছে।
জুতো খুলতে খুলতে ধীর পায়ে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। শরীরে অসহনীয় ক্লান্তি। এই ক্লান্তি কোনো দীর্ঘ যাত্রার নয়, কোনো কঠিন পরিশ্রমেরও নয়, এই ক্লান্তি অন্যকিছুর...
বালিশ সরাতেই চোখে পড়ল এক বান্ডিল পুরোনো নোট, অগোছালোভাবে রাখা, যেন তাড়াহুড়ো করে রেখে যাওয়া হয়েছে। পাশে ভাঁজ করা একটা চিঠি। জাওয়াদ কপালে ভাঁজ ফেলে ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলল। কাগজের গায়ে পুরোনো আতরের মৃদু গন্ধ লেগে আছে।
সেখানে লেখা—
জীবন মানুষকে বহুদূর টেনে নিয়ে যায়, কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো গভীর খাদে। কিন্তু মনে রাখিস, যত দূরেই যাস, শেকড় কখনো উপড়ে ফেলা যায় না। শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন গাছ যেমন বাঁচতে পারে না, মানুষও তেমনি নিজের অতীতকে অস্বীকার করে পূর্ণতা পায় না।
তাৎক্ষণিক জাওয়াদের চোখের তারায় ভেসে উঠে গতকাল রাতের স্মৃতি। সে গুলনূরের সঙ্গে কথা বলছিল, তখনই হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনে দুজনই চমকে তাকায়। কোহিনূর এসেছেন। গুলনূর দ্রুত কুর্নিশ করে সেখান থেকে চলে যায়।
জাওয়াদ দ্রুত এগিয়ে এসে চিন্তিত স্বরে বলল, “একা একা উপরে উঠলেন কেন? সিঁড়িগুলো খাড়া, রেলিং নেই। যদি পড়ে যেতেন?”
কোহিনূর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এখনো আমি যথেষ্ট শক্ত-সামর্থ্য। আল্লাহর রহমতে চলাফেরার জন্য কারো সাহায্য লাগে না।”
তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে ছাদটির এক কোণে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর ছাদটি পুরোটা পর্যবেক্ষণ করে কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “চাকরি-বাকরি করা হচ্ছে?”
জাওয়াদ হালকা হাসি দিয়ে বলল, “পেটের জন্য করতেই হতো।”
কোহিনূরের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল। জমিদার পুত্র নাকি পেটের দায়ে অন্যের গোলামি করছে!
তিনি কয়েক পা এগিয়ে ছাদের রেলিংহীন কিনারায় দাঁড়িয়ে দূরে, ভীষণ অস্পষ্ট দৃষ্টিতে আকাশে তাকিয়ে বললেন, “একসময় বাহনপুরের পুরো অঞ্চলটা আমাদের ছিল। আমাদের বংশের নাম শুনলে মানুষ মাথা নিচু করত। সম্মান আর ভয়, দুটোই কাজ করত তাদের মনে। তোর পরদাদা, খান বাহাদুর শামসুদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন ব্রিটিশ আমলের নামকরা জমিদার। তার এক ডাকে পুরো বাহনপুরের মানুষ হাজির হতো। যে শ্যামলগঞ্জে এখন এত বড় স্কুল হয়েছে, একসময় সেটা ছিল আমাদের বংশের হাফেজখানা। তোর দাদাজানদের সময়ও সেই প্রতিপত্তি টিকে ছিল। বড় বড় ব্যবসায়ী, নায়েব-গোমস্তা আমাদের দরবারে এসে কুর্নিশ করত।”
জাওয়াদ চুপচাপ শুনছে।
কোহিনূর ধীরে ধীরে বলছেন, “তারপর সময় বদলাতে শুরু করল। জমিদারির ভিত নড়তে থাকল। তোর বাবা সুফিয়ান যখন দায়িত্ব নিল, তখন চারপাশের পরিবেশ বদলে গেছে। তারপর এলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। তখন আর আগের মতো সব কিছু ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু জমিদারির খেতাব, সম্মান, ঐতিহ্য ঠিকই রয়ে গেছে।”
তিনি জাওয়াদের দিকে দীর্ঘ দৃষ্টি ফেললেন, “দাদুভাই, আমাকে বল তো, রক্তের সঙ্গে কি কখনও বন্ধন ছিঁড়ে ফেলা যায়? আজ তুই যদি ভুলে যাস তোর পূর্বপুরুষ কারা ছিল, তবে একদিন অন্যরাও ভুলে যাবে। আর কে আছে জমিদারি রক্ষা করার জন্য?”
কোহিনূর আরো কিছুটা এগিয়ে এসে বললেন, “জমিদারি মানে শুধু ক্ষমতা নয়, দায়িত্বও। তোর পূর্বপুরুষেরা শুধু শাসক ছিল না, তারা ছিল রক্ষক, তারা ছিল অভিভাবক। যারা তাদের প্রজাদের নিজের সন্তান হিসেবে দেখেছিল। জমিদারি মানে কেবল জমি আর টাকা নয় দাদুভাই। জমিদারি মানে হলো একটা বংশের ইতিহাস বহন করা, ঐতিহ্য বহন করা। সেই ইতিহাস সম্মান, দায়িত্বের। আজ যদি ভূঁইয়া পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়, তবে আমাদের সম্মান, ঐতিহ্য নয়, ওই কান্তারপুরের প্রতিটি মানুষও নিঃস্ব হয়ে যাবে।”
কোহিনূরের কঠোর মুখভঙ্গি এবার বিষাদে ভারাক্রান্ত। তিনি আরও বললেন, “শেকড়কে অস্বীকার করা যায় না, দাদুভাই। যে নিজের মাটি থেকে নিজেকে উপড়ে ফেলে, সে কখনোই শান্তি খুঁজে পায় না। তোর এই দুই বছর নিরুদ্দেশ থাকার কারণ জানতে চাই না, কিন্তু একটা কথা বল, যে শান্তির খোঁজে তুই নিজের ভিটে ছেড়ে গেলি, সেই শান্তির স্পর্শ কি কখনো পেয়েছিস? শেকড় ভুলে ভালো থেকেছিস?”
জাওয়াদ এ কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল। সত্যিই তো...একটা সত্য...একটা স্মৃতি থেকে পালিয়ে বেড়ানোর এই দীর্ঘ পথচলায় সে কখনোই প্রকৃত শান্তির সন্ধান পায়নি। প্রতিটি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যে অশান্তি তাকে তাড়া করেছে, তবে কি সেটা শেকড়ের ডাক ছিল?
কোহিনূর ম্লান হাসলেন, “দেখলাম, সুফিয়ান আর শব্দর নতুন এক যুবককে নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষের জমিদারি চালাচ্ছে। অথচ আমাদের ছিল একজন সিংহ-সন্তান। আমাদের ছিল তুই!”
বলেই তিনি চোখের জল মুছলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাবা-মা কিংবা চাচার প্রতি যত ক্ষোভই থাক, ওই জমিদারি, ওই বাড়ি, কান্তারপুরের মাটি আর মানুষের সঙ্গে তোর কীসের অভিমান দাদুভাই? ওই মাটি থেকে তোকে বিচ্ছিন্ন করার অধিকার কারও নেই, এমনকি তোর বাবামায়েরও না।”
জাওয়াদ রাতের স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে, দৃষ্টি মেলে জানালার ওপারে।
||সেদিন নাভেদের নরম স্বরে উচ্চারিত বন্ধুত্বের আহ্বান জুলফার অন্তরে কাঁপন তোলে দিয়েছিল। নাভেদ আরও বলেছিল, যদি জুলফা বন্ধুত্ব গ্রহণ করে, তবে আগামীকাল ভোরে ছাদে রাখা খাঁচার পাখিটিকে যেন মুক্ত করে দেয়।
জুলফা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নীরবে সরে গিয়েছিল, কিন্তু সারা রাত তার মনে ঝড়ের তাণ্ডব বইল। রাইহা যদি নারী হয়ে বন্ধুত্বের পরিধিতে নাভেদকে স্থান দিতে পারে, তবে তার পক্ষে কেন নয়? শব্দরের প্রতি তার দায়িত্ব, তার স্নেহ কি বন্ধুত্বের কারণে ম্লান হবে? রাতভর এই চিন্তার দোলায় দুলতে দুলতে শেষে জয়ী হলো হৃদয়ের আহ্বান।
ভোরের প্রথম কিরণ যখন পূর্ব আকাশের প্রান্তে আবির ছড়িয়ে দিল, জুলফা ধীরপায়ে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠল। খাঁচার ভেতর অপেক্ষায় ছিল ছোট্ট চড়ুই। ক্ষীণ সুরে কিচিরমিচির করে যেন বলছিল, মুক্তি দাও, মুক্তি দাও।
দুরুদুরু বুকে জুলফা খাঁচার দরজায় আঙুল রাখল। স্পর্শমাত্রেই দরজা খুলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে পাখিটি উড়াল দিল অনন্ত আকাশের দিকে। সঙ্গে মুক্তি পেল তার হৃদয়ও।
চোখ নামাতেই দেখতে পেল, নিচে বাগানের ধারে দাঁড়িয়ে আছে নাভেদ। তার চোখে এক চিলতে প্রশান্তির দীপ্তি। সে হাসল, জুলফাও বিনিময় করল নিঃশব্দ হাসি।
এরপর সম্পর্কের জটিলতা কোথায় যেন গলে গিয়ে নিখাদ সরলতায় রূপ নিল। আগের সংকোচ, দ্বিধা মিলিয়ে গেল নদীর ভেসে যাওয়া শৈবালের মতো। যেন তারা দুই শৈশবের সাথী, বিস্তীর্ণ কোনো কুয়াশাময় প্রান্তরে হেঁটে চলেছে পাশাপাশি।
নাভেদ মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব গল্প বলে। হাসির রোল ওঠে, জুলফা কখনো হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, কখনো আবার মুখ ঢেকে নাভেদের ঘোড়ার পিঠে উঠে ছুটে চলে সবুজ বনভূমির পথে।
এক বিকেলে নাভেদ হাতে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। মৃদু হেসে বলল,
“আপনার জন্য।”
জুলফা লাজুক হেসে ফুলগুলো ঘরে এনে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল।
আজ বৈশাখের একুশতম দিন। সময়ের ছোঁয়ায় ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে, তবু তাদের গায়ে লেগে আছে স্মৃতির মিষ্টি গন্ধ। সেগুলো হাতে নিয়ে কিছু ভাবছিল জুলফা...
তখনই শুনতে পেল, কোহিনূর এসে পৌঁছেছেন, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন গুলনূরকে। শুকনো ফুলগুলো হাত থেকে নামিয়ে রেখে সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। জাওয়াদ কি গুলনূরকে বিয়ে করেছে? গুলনূরও কি এখন তার মতো বেগম?
নীচে এসে দেখে ললিতাও নেমে এসেছেন। আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্লান্ত, শীর্ণ দেহটিতে একরাশ অবসাদ। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কাউকে খুঁজলেন, তারপরই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“জাওয়াদ আসেনি? আমার ছেলে কোথায়?”
কোহিনূর তার স্বভাবসুলভ শীতল ভঙ্গিতে বললেন, “না, আসেনি।”
ললিতার চোখ বিস্ফোরিত হলো। তার দৃষ্টি গেল জড়োসড়ো হয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা গুলনূরের দিকে।
তিনি দাঁতে দাঁত চেপে চাপা রাগের সঙ্গে গর্জে উঠলেন, “ও মেয়ে এখানে কেন?”
কোহিনূর ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন,
“সেই কৈফিয়ত তোমাকে দেব না। তুমি ওর থেকে দূরে থাকবে। গুলনূর, ঘরে যাও। আমি না বলা পর্যন্ত বেরোবে না।”
বলেই তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বিশ্রামের জন্য নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
গুলনূর ভয় পাওয়া বাচ্চার মতো মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে সেই ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল, যেখানে সে আগে থাকত। তখনই ঝড়ের মতো সামনে এসে পড়ল ললিতা।
তার চোখের দহন এতটাই তীব্র যে, গুলনূর আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে এল।
ললিতা একটানে গুলনূরের হাত মুচড়ে ধরে চিৎকার করে উঠলেন, “ডাইনি! আমার ছেলে কোথায়? তুই এখানে কেন এসেছিস?”
গুলনূর ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল, ঠোঁট ফাঁক হলো, কিন্তু শব্দ বেরোল না।
ললিতা এবার আরও শক্ত করে চেপে ধরলেন, দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,
“হারামজাদি তোর হাত ভেঙে দেব আমি!”
অসহ্য যন্ত্রণায় গুলনূরের চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা।
এই দৃশ্য দেখে জুলফার অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বোবা মেয়েটার ওপর এ কেমন অত্যাচার! সে তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে গুলনূরকে মুক্ত করার চেষ্টা করল।
কিন্তু ললিতা তখন প্রতিশোধের দহন জ্বালায় দগ্ধ হচ্ছেন, আক্রোশে অন্ধ। শিকারের গলায় ছোবল দেওয়া সাপের মতো আঁকড়ে রেখেছেন গুলনূরের হাত।
জুলফা বাধা দিতে গেলে হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝটকায় ললিতা গুলনূরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন মেঝেতে।
গুলনূর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কপালের এক পাশ মেঝেতে আঘাত লেগে লালচে হয়ে ফুলে উঠল।
ললিতা এবার আঙুল তুলে শাসালেন , “ফুফুজান চলে গেলে তোকে আমি খুন করে ফেলব। বাঁচতে চাইলে তার আগেই এখান থেকে পালা নিমকহারামের বাচ্চা!”
গুলনূর কাঁপতে কাঁপতে চোখ তুলে তাকাল ললিতার দিকে। তার দৃষ্টি ফ্যাকাশে, ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্ত।
.
.
.
চলবে..........................................................................