বাহারি আলোর তেমন ঢক নেই। গুটিকয়েক মরিচবাতি আর সফেদ আলোর সম্মেলনে আঁধারে নিমজ্জমান জায়গাটি চোখের মধ্যবিন্দু হয়ে ফুঁটে আছে। বিশাল বড় না হলেও তিন-চার জন বসতে পারবে এমন ছোট একটা বিছানার মতো স্টেজ। মানুষী লজ্জায় রাঙা হলুদে মাখো মাখো কনেকে বেশ সময় নিয়ে দেখলো। মেয়েটা রূপবতী। হাসলে টোল পরে। অকারণেই বারংবার ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত করায় টোলটা স্পষ্ট হয়ে ভেসে আছে।
স্টেজের মুখোমুখি চেয়ারে ওরা সবাই অনেক্ষণ ধরে বসে ছিল। কৃষ্ণ পাঁচ মিনিটের কথা বলে কোত্থেকে দশ মিনিট পর হাজির হলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, 'চল, সবাই গিয়া আগে খানা খাইয়া লই। খানা বলে হেব্বি টেস্ট হইছে। আমি এইমাত্র শুইনা আইলাম।'
প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, 'তুমি কি খাবার দাবারের কোয়ালিটি দেখতে এতক্ষণ হারিয়ে গেছিলে?'
পাশ হতে রঞ্জন লম্বা হামি ছাড়লো, 'ওকে আমি পাঠিয়েছিলাম। এত কষ্ট করে এই রাতের বেলা শিয়ালের ভয় নিয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এসেছি! খাবার কেমন রেঁধেছে জানতে হবে না?'
'এই গ্রামে কি শিয়ালও আছে?' প্রান্তর ভীতু কণ্ঠস্বর। বোঝা গেল, ছেলেটা শিয়াল ভয় পায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খিলখিলিয়ে হাসলো ধুতরা, 'শুধু কি শিয়াল একা? শিয়ালের চোদ্দগুষ্টিও এ গ্রামে থাকে। রাতের বেলা ঘর থেকে বের হলেই বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ঘাড় মটকে দেয়। কেন, তুই জানতিস না?'
প্রান্ত বাস্তবিকই জানতো না। ক্লাস ফোরে পড়া তার ছোট্ট হৃদয়ে ধুতরার কঠিন চতুরতা ধরা পরেনি। বরং অজান্তেই তা যেন গভীর দাগ কাটলো। আগের সেই চঞ্চলতা, দুষ্টুমি হারিয়ে গেল না বলেই। ভয়ে মানুষীর হাত চেপে ধরলো প্রান্ত। মিটমিটে কণ্ঠে হাজারটা ভয়, শঙ্কা নিয়ে বললো, 'আমার হাতটা ছাড়বে না বুবু। শক্ত করে ধরে রাখবে।'
খেতে গিয়ে দেখা গেল, প্রান্ত মিতা আর মানুষীর মাঝখানে আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে। ভয়ে বিরিয়ানিটুকু ভালো ভাবে খেতে পারছে না বেচারা। মানুষীর মায়া হলো। ধীর কণ্ঠে শুধালো, 'আমি খাইয়ে দেবো? খাবি?'
'দাও।'
হালকা আওয়াজে সাউন্ড বক্সে গান বাজছে। সচরাচর শোনা হিন্দি কিংবা বাঙালী কোনো বিয়ের গান নয়। তথাকথিত জনপ্রিয় গান 'কথা কইও না'।
কৃষ্ণ খেতে খেতেই গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠলো,
'বারো মাসে বারো ফুল রে
ফুইট্টা থাকে ডালে রে
এই পন্থে আইসে নাগর
পড়তি সন্ধ্যা কালে রে
দেখিতে সোনার নাগর গো
চান্দেরও সমান।'
মিতা মুখের ভাতটুকু গিলে তাড়াহুড়ো গলায় বললো, 'তোমার গানের গলা কিন্তু মারাত্বক, কৃষ্ণ দা! কোথাও কোনো গানের প্রোগ্রামে ট্রাই করতে পারো না?'
কৃষ্ণ লাজুক হাসলো। কেউ তার গানের গলা নিয়ে প্রশংসা করলে তার ভালো লাগে। আনন্দ হয়।
'এখনো ভাবি নাই। ছোটো চাচায় অনুমতি দিলে দেখুম... আমার ইচ্ছা আছে।'
মানুষী প্রান্তকে খাইয়ে দিতে দিতে একদফা সাদিফের দিকে তাকালো। লোকটা চুপচাপ বিরিয়ানির লোকমা মুখে তুলছে। বেশি একটা হু,হা করছে না। জ্বরে কাহিল অবস্থা নিয়ে যে এখনো বসে আছে, সে-ই ঢের। নয়তো তাদের কাজিন মহলে এ লোক ত্যাড়া কথা বলা ছাড়া থাকতে পারে না।
আচমকা! সাদিফ মানুষীর দিকে তাকালো। দূর্বল, অস্পষ্ট চাহনি। মানুষী চট করে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললেও সাদিফ সরালো না। নিশ্চুপ হয়ে মেয়েটার ধরা পরে যাওয়া আনাড়ি মুখ লুকানো দেখলো। তার জিহ্বা তিঁতা তিঁতা ঠেকছে। ঘুম আসছে। কিন্তু আশ্চর্য! মানুষীর দিকে তাকালে ওই নিষ্ঠুর ঘুমকে পরোয়া করতে মন সায় দেয় না। জ্বরকে জ্বর মনে হয়না। তার মনটা কি অসহ্য রকম ব্যাকাত্যাড়া!
•••••••••••••••
রঞ্জনের পেট খারাপ হয়েছে। যেই সেই পেট খারাপ নয়, ম্যারাথন জয় করতে গিয়ে শেষ মুহুর্তে পা মচকে যাওয়ার মতো দূর্বিষহ ডায়রিয়া। সকাল থেকে গুণে গুণে দশবার সে টয়লেটে গেছে। তবুও কিছুতেই শান্তি মিলছে না, মনে স্বস্তি নেই। চিরুনি তল্লাশি করে জানা গেছে, গতকাল রাতের অনুষ্ঠানে হাভাতের মতো চার প্লেট বিরিয়ানি সাভার করেছেন মহাশয়। পেটের জ্বালায় এখন টিকতে পারছেন না। কিছুক্ষণ পরপর তুমুল আহাজারিতে চিৎকার করে উঠছেন, 'ও মা! আর পারি না। কিছু করো। কই গেলা? ও মা!'
নিস্তব্ধ পরিবেশে চিৎকার করা ডাকগুলো কানে তালা লাগিয়ে দেয়। শীতের মৌসুমে তাই সকাল থেকেই বাড়ি উত্তপ্ত। ওরস্যালাইন, ডাব, ঠান্ডা পানির ছেঁক— সবকিছুর টোটকাই তখন ব্যর্থ। বাধ্য হয়ে কৃষ্ণ আর মেজো চাচা গ্রামের মুরশিদ ডাক্তারকে আনতে গেছেন।
সোফায় বসে মানুষী তখন লাল শাক বাছছে। সম্মুখে থাকা টিভির পর্দায় গোপাল ভাঁড়ের অতি পুরোনো এপিসোড চলমান। এপিসোডটা সে আরও কয়েকবার দেখেছে। ওইযে? হিংসাপরায়ণ মন্ত্রী রাজার কানে গোপাল ভাঁড়ের দুর্নাম করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে যায়? ওটা।
সাদিফ কোত্থেকে ঘুমুঘুমু চোখ নিয়ে মানুষীর পাশে ধপ করে বসলো। কিঞ্চিৎ দূরত্ব রেখে। কণ্ঠে মিছেমিছি গম্ভীরতা এঁটে বললো, 'কিরে ফকিন্নি.. সারাদিন খাওয়া, ঘুম আর কার্টুন! আর কোনো কাজ নেই?'
বোঝা গেল, দু'দিনের জ্বরে মুমূর্ষু রোগী সাদিফ এখন সুস্থ। জ্বর সেরে এখন ইতর সাদিফের বান্দ্রামি শুরু হয়েছে। আর সেই বান্দ্রামির প্রথম ছাগল মানুষী। সবসময়কার মতো।
মানুষী টিভি থেকে নজর সরিয়ে সাদিফের দিকে তাকালো। সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসার দরুণ গায়ের কালো শার্ট কুঁচকে আছে। পরনে হাফ-প্যান্ট। কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো। ঘন দাঁড়ির অদলে খচ্ছর লাগছে। চোখ-মুখ কুঁচকে হাতের লাল শাকের ঝুঁড়ি দেখিয়ে মানুষী বললো, 'অন্ধ আপনি? কাজ করছি যে দেখতে পারছেন না?'
সাদিফ যেন পাত্তাই দিলো না সেদিকে। রিমোট নিয়ে নিমিষেই পালটে দিলো চ্যানেল। টিভির পর্দায় তখন গোপাল ভাঁড়ের বদলে ফুটবল ম্যাচের টানটান উত্তেজনাপূর্ণ খেলা চলছে। ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা।
মানুষীর বিরক্ত মাখা চেহারা পরখ করে কেমন ঢং করে বললো, 'আমার সোনামণি জরিনার মা! যাহ্, আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আয়। দ্রুত!'
'পারবো না। ফালতু লোক!'
এবং পরপরই মানুষীর নরম বাম গালটা একহাতে টেনে ধরলো সাদিফ। একটু নিষ্ঠুর ভাবেই। মানুষী ব্যথা পেল। রাগী গলায় বললাম, 'গাল ছাড়ুন, সাদিফ ভাই।'
'তুই নাস্তা আনবি না?'
'না। আপনি আমার গাল ছাড়ুন।'
'ছাড়বো না।'
'আমি কিন্তু আপনার মাথা ফাটিয়ে দিবো!'
চূড়ান্ত ধৈর্যের শেষ ক্ষোভটুকু একেবারে তুচ্ছ করে মাটিতে ফেলল সাদিফ, 'ফাটা! আমি তোরে ভয় পাই?'
তিরতির করে বাড়তে থাকা রাগটা হঠাৎই সীমা ছাড়ালো। সাদিফের হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে আচমকাই লোকটার কপালে আঘাত হানলো মানুষী। গালে থাকা সাদিফের হাত ঢিলে হয়ে এলো। চোখ পিটপিট করলো। তামাটে কপালের একপাশ নিমিষেই লাল হয়ে ফুলে গেছে। একটু একটু রক্তের কণা দেখে চমকে উঠলো মানুষী। ভ্রু কুঁচকালো। এই ঠুনকো টিভির রিমোটটার এত ধার!
.
.
.
চলবে.........................................................................