আশিয়ানা - পর্ব ৯০ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


সূর্য ডুবে গেলে, অর্ধেক পৃথিবীর ওপর অন্ধকার নেমে আসে, দৃশ্যমান বস্তুগুলো অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। চারপাশের শতশত জিনিস আঁধারের সঙ্গে অস্পষ্ট হয়ে যায়। এই আঁধার নামা রাতের মতো কিছু অন্ধকার মানুষের মতো জীবনে নামে। সে সঙ্গে বাড়ে হাহাকার, আর্তচিৎকার শোনা যায় লোকের। অচিরেই অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যায় চিরতরে। মধ্যরাতে! চৌধুরী বাড়িতে আগুন লেগেছে। আগুনে পুড়ে মারা গেছে পরিবারের সব সদস্য। প্রতিবেশীরা যখন পোড়ার গন্ধ পান তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। লোকজন দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করে। যে যার ঘর থেকে বালতি নিয়ে বেরিয়ে আসে। পানি ছিটিয়ে দেয় জলন্ত চৌধুরী বাড়ির দিকে। খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসের। কাকডাকা ভোরে আগুন নেভানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অনেক কষ্ট করে এই আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। থানা থেকে পুলিশ আসে। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মৃতদেহ বের করে বাড়ির সামনে রাখা হয়। চারটা বডি। একটু পর লাশগুলো পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ইন্সপেক্টর শায়ের মির্জা।  

ইন্সপেক্টর শায়ের মির্জা খবরটা সেহরিশ কে জানান। কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় সেহরিশ। এসময় তাকে আস্থা দেয় রোদেলা ও সাদাফ। নিজেকে সামলে নিল সেহরিশ। অল্প সময়ের মধ্যে রোদেলা ও সাদাফের সঙ্গে দেশে আসার জন্য রওনা হয় সেহরিশ। ১৭ ঘন্টা প্লেন জার্নির পর বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছাল। ইমিগ্রেশন থেকে বের হতেই কয়েকজন লোক রিসিভ করে ওদের। সাদাফ ফ্রন্ট সিটে বসেছে। বার বার মাথা ঘুরিয়ে সেহরিশ কে দেখছে। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। রোদেলা সেহরিশ হাতখানা শক্ত করে ধরে আছে। সেহরিশের দৃষ্টি জানালার বাইরে ছুঁইছুঁই করছে। ১৭ ঘন্টার থেকেও বেশি সময় সে জার্নি করেছে। কিন্তু কখনো এত ক্লান্ত সে হয়নি। বা লাগেনি। আজ শরীর থম মেরে আছে। বুকের ভেতর ভারী অনুভব হচ্ছে। 

সিরাজগঞ্জ! চৌধুরী বাড়ি। সেহরিশ বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দুদিন আগে আগুন লাগছে। উত্তাপ এখনো আছে। চোখের সামনে ছোট্ট বেলার হাজারো স্মৃতি জড়িত বাড়িটার করুণ অবস্থা দেখে সেহরিশের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠল। বাবা-মা, ভাই-ভাবী আর ছোট্ট মারিয়া? আগুনে যখন ওদের শরীর জ্বলছিল তখন নিশ্চয়ই ওরা চিৎকার করেছিল। শোনেনি কেউ ওদের আর্তচিৎকার? আর গার্ড! যারা চব্বিশ ঘণ্টা এই বাড়ি ও বাড়ির সদস্যদের পাহারায় ছিল। ওরা কোথায়? ওদের সাথে কি হয়েছে? 

গ্রামের লোকজন সেহরিশের কাছে আসছেন। সুখ দুঃখের গল্প শোনাতে শোনাতে মৃতদের জন্য আহাজারি করছেন। সেহরিশ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ রোদেলা কে এসবের থেকে দূরে রাখার জন্য ওর মামি পুতুল বেগমের কাছে পাঠিয়ে দিল। 
ইন্সপেক্টর শায়ের মির্জা, খবর পেয়েছে সেহরিশ এসেছে। খবর পাওয়া মাত্র তিনি থানা থেকে বের হোন। চৌধুরী বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখতে পান সেহরিশ কে। 
শায়ের মির্জা এগিয়ে এল। সেহরিশের দৃষ্টি অনুসরণ করে পোড়া বাড়ির দিকে তাকালেন। 

শায়ের মির্জা বললেন, 
  'সরি সেহরিশ! আমরা আপনার পরিবারের কাউকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা এখানে যখন পৌঁছেছি তখন...'

শায়ের মির্জা দম নিল। তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। সেহরিশের মুখের হাবভাব কঠিন হলো। এ-সময় শায়ের মির্জা একটু চিন্তিত গলায় বললেন,
  'এর আগের বার যখন আপনার বাড়িতে আসছিলাম তখন আপনার ছোটো ভাইঝিকে দেখেছি বোধহয়। কিন্তু গতকাল ছোট কোনো লাশ পাইনি। পড়াশোনার জন্য তাকে কি হোস্টেলে ভর্তি করিয়েছিলেন?'  

সেহরিশ ভ্রুকুটি করল। চোখজোড়া ছোটো ছোটো করে তাকাল শায়ের মির্জার দিকে। কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল, 
  'মরিয়াকে পাননি মানে? ওর মাত্র নয় বছর। বাড়ি ছাড়া বাহিরে বা হোস্টেলে থাকবে কেন?'

সাদাফ এগিয়ে এল। একহাত রাখল সেহরিশের কাঁধে। সেহরিশ উত্তেজিত হয়ে ওঠল। সাদাফ বলল,
  'হয়তো মারিয়া বেঁচে আছে।'

শায়ের মির্জা বলল,
  'সাত দিন পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসবে। আমি নিজে চারটা ডেডবডি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছি। আগুন লাগছে তখন হয়তো মারিয়া জেগে উঠে। তারপর কোনোরকমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়ে। সাদাফের মতো আমারও মনে হচ্ছে মারিয়া বেঁচে আছে। আমরা খুঁজলে তাকে পেয়ে যাব।'

সেহরিশের নিঃশ্বাস ভারী হলো। ব্যাপারটা তার কাছে এতো স্বাভাবিক লাগছে না। সব কিছু স্বাভাবিক হলে গার্ডরা কোথায়? 

সেহরিশের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, 
  'আমার মন হচ্ছে, কেউ ইচ্ছা করে আগুন লাগিয়েছে। বাড়িতে এতগুলো মানুষ ছিল অথচ আগুন লাগছে কেউ টের পায়নি। হাস্যকর! এমন অযৌক্তিক কথাবার্তা বাচ্চাও বিশ্বাস করবে না।' বলে সে একটু থামল। সেহরিশ দমবন্ধ অনুভব করছে। তার চোখে হতাশা ছড়িয়ে পড়ল। সেহরিশ চলে সরু করে তাকাল। বলল,
  'ওরা যারা আগুন লাগিয়েছে তারা মারিয়া কে তুলে নিয়ে যায়নি তো?'

কথাটা শেষ করতে পারল না সেহরিশ। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে আসছে। শায়ের মির্জা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ ধীর স্বরে বলল, 
  'অলওয়েজ থিংক পজিটিভ সেহরিশ। মারিয়া হয়তো পাশের ঝোপে লুকিয়ে আছে। চল একটু খুঁজে দেখা যাক।'

সেহরিশ একটু থামল। তারপর ওদের সঙ্গে মারিয়া কে খুঁজতে লাগল। এদিক ওদিক খুঁজে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল। জঙ্গলের অনেকটা ভেতরে পৌঁছে গেল ওরা। ফিরে আসবে পেছনে ঘুরে তাকাল। এমন সময় সেহরিশের বুকটা ভারী হয়ে উঠল। থেমে গেল সে। বিশাল বড় কড়ুই গাছের নিচে তাকাতে ওর শরীর শিরশির করে উঠল।

মারিয়া বিধস্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। শরীরের এক টুকরো জামা নেই। সেহরিশ ওর শরীর থেকে জ্যাকেট খুলে ফেলল। নিশ্চল হেঁটে মারিয়ার পাশে এসে বসল। তারপর জ্যাকেটটা দিয়ে মারিয়ার শরীর ঢেকে দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। সেহরিশ চোখ বন্ধ করে। চোখের পাতায় ভেসে উঠছে চার বছর আগের সে পাঁচ বছর বয়সী মারিয়া। ওর মুখের চাচ্চু ডাক! মিষ্টি কণ্ঠে আবদার, চাচ্চু মজা কিনে দিবা? দুই বছর আগে এসেছিল আরুশির মৃত্যুর জন্য তখন মারিয়ার সাথে তেমন দুষ্টুমি করা হয়নি। সারাক্ষণ পড়ে ছিল আরুশির স্বামী ছদ্মবেশী অনিককে খোঁজার কাজে। 
সেহরিশের চোখ দুটো রক্তিম হয়ে উঠল। বাড়ির সবাই কে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আর মারিয়াকে? ধর্ষণ করে। 
সেহরিশের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। 

দুদিন হয়ে গেছে। সেহরিশ আর সাদাফ ব্যস্ত হয়ে গেছে খুনিকে খুঁজে বের করার। শূন্য থেকে শুরু করে আবারও শূন্য তে এসে থামছে সে। একটা ক্লু নেই। বিকেল ৪টার দিকে শায়ের মির্জা আবারও এল। একটা কথা তার ওদের জানানো হয়নি। এটা জানানোর জন্যই তার আসা। কথাটা উনি ফোনেই জানাতে পারতো কিন্তু সামনা-সামনি বলা জরুরি মনে করেছেন। বিখ্যাত গায়কের বাড়ি আগুনে পুড়েছে। এটা নিয়ে সাংবাদিকদের রেষারেষির শেষ নেই। যে যা পারছে তাই বলে নিউজ কভার করছে। সেহরিশ ওদের কারো সাথে কথা বলেনি। দুদিন পর আজ চৌধুরী বাড়ির চৌকাঠ ছেড়ে চলে গেছে সাংবাদিকরা।

শায়ের মির্জার সঙ্গে চৌধুরী বাড়ির দক্ষিণ দিকে এল সেহরিশ আর সাদাফ। এদিকে দেয়াল পুড়েনি। দেয়ালে গোটা গোটা অক্ষরে কিছু লিখা। অন্য দেশের শব্দ এজন্য ওখানে কি লিখা শায়ের মির্জা বুঝতে পারে নি। সেহরিশ ও সাদাফ কে এই লেখার কথা বলে এখানে নিয়ে আসেন শায়ের। 

সেহরিশ আর সাদাফ দুজন একসঙ্গে চোখ দুটো ছোট করে ফেলল। শব্দটা বুঝতে তাদের বিলম্ব হলো না। ইতালিয়ান ভাষায় লিখা আছে,
 
                               'মরবে! সবাই মরবে!'

দুটো বছর খুব শান্তিতে কেটেছে। আবার সে পুরোনো শত্রু মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রথমের অ্যাটাকর করেছে সেহরিশের পরিবার। কিন্তু কেনো? তাহলে ওরা কি চাচ্ছিল? পরিবারের সবাই মারা গেছে শুনে সেহরিশ দেশে ছুটে আসুক। এতে ওদের কী লাভ? না-কি এখানেও অন্য উদ্দেশ্য আছে?

সেহরিশ তাকাল সাদাফের দিকে। সেহরিশ সাদাফের উদ্দেশ্য বলল, 
  'আমি তূর্ণ কে কল দিচ্ছি আর তুই উমাইয়াকে কর। আমার মনে হচ্ছে আসল খুনি আমাদের এখানে ব্যস্ত রেখে ওখানে ওদের কোনো ক্ষতি করবে।'

সেহরিশ ওর ফোনে তূর্ণর নাম্বার ডায়াল করবে। এমন সময় তূর্ণর কল এল। সেহরিশ তাকাল সাদাফের দিকে। ইতস্তত করে কল রিসিভ করে সে। তূর্ণ আধভাঙ্গা গলায় বলল, 
  'সাদাফ কোথায়? ওকে কতগুলো কল করেছি। ধরছে না কেন?'

শেষ কথাটা একটু চেঁচিয়ে বলল তূর্ণ। সেহরিশ লাউডস্পিকারে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
  'আমার সঙ্গে আছে। তোকে এমন উত্তেজিত লাগছে কেন? ওদিকে সব ঠিক আছে তো?'

তূর্ণ এলোমেলো কণ্ঠে বলল, 
  'কিচ্ছু ঠিক নাই ভাই। উমাইয়া, সাদকে নিয়ে একটু আগে পার্কে গিয়েছিল। সাদ পার্ক থেকে গায়েব হয়ে গেছে। একজন মানুষও তাকে দেখেনি। আমি ওকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। পুলিশ ও খুঁজছে। আমি কি করব? মাথা কাজ করছে না।'

সেহরিশের পা নড়বড়ে হয়ে গেল। সাদাফের কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমছে। সেহরিশের আশংকা সত্যি হয়ে গেল না তো? সেহরিশ কল কাটলো। ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে সাদাফকে চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিল সে। এদিকটা সে নিজে একাই সামলে নিবে। সাদাফ মাথা ঝাঁকাল। শায়ের মির্জা ও সেহরিশের থেকে বিদায় নিয়ে সে ওর ম্যানেজারকে কল করে ফ্লাইটের টিকিটের ব্যবস্থা করতে বলে।

শায়ের মির্জা জিজ্ঞেসু চোখে সেহরিশের দিকে তাকাল। সেহরিশ তাকে দেখে হাঁটতে লাগল। শায়ের জিজ্ঞেস করল,
  'আপনার এতো শত্রু কেনো সেহরিশ? তবে সবাই আপনার পরিবারের পেছনে পড়ে আছে। আপনাকে মারার চেষ্টা তাদের মধ্যে নেই। আশ্চর্য লাগছে।'

সেহরিশ চলতে লাগল। একটু পর বলল,
  'এর একটাই অর্থ! শত্রু সব প্ল্যান ঠান্ডা মাথায় করছে। তার একমাত্র উদ্দেশ্য আমাকে নৃশংস ও ধ্বংস করা। আমার পরিবারের সবাই কে মেরে আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছে বা ও চাচ্ছে আমি যেনো একা হয়ে যাই। চারিদিকের হাজার মানুষের মধ্যে আমি একা। এটাকে বলা যায় শত্রুকে ভেতর থেকে দূর্বল করা। যার ভেতর দূর্বল তার বাহিরেও দূর্বল। আর দূর্বল শত্রু পাল্টা আক্রমণ করতে পারে না। আমার এই শত্রু যেই হোক সে চায় আমার ধ্বংস!'

শায়ের মাথা ঝাঁকাল। বলল,
  'মানতেই হচ্ছে আপনি অনেক কঠিন মনের মানুষ। পরিবারের সবাই মারা গেল কিন্তু আপনার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল ও বের হলো না।'

সেহরিশ হাসল। তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল,
  'বাহিরের ক্ষত সবাই দেখে কিন্তু ভেতরের ক্ষতের খোঁজ কেউ রাখে না। সামান্য কষ্টে চোখ দিয়ে দুটো জল পড়া মানেই কষ্ট জাহির করা। আর যে কষ্টে চোখ দিয়ে জল পড়ে না তার ক্ষত দীর্ঘ স্থায়ী। দীর্ঘ স্থায়ী ক্ষত শুধু পোড়ায়। জ্বালা বাড়ায় ক্ষণে ক্ষণে।'

••••••••••••

চারদিন হয়েছে নিখোঁজ সাদ। ওকে খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সাদাফ। সেহরিশের সতর্ক বার্তা ও মাথায় রেখেছে সে। তূর্ণ কে কঠোর ভাবে বলেছে জুবিয়া আর সোহা যেনো বাড়ির বাহিরে না বের হয়। সোহার দুই বছর হতে আরও একমাস বাকি। সোহা পুরোপুরি হাঁটতে পারে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হাঁটে ও। 
তূর্ণ ওর বাড়ির সুরক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছে। সাদাফ আর তূর্ণর সঙ্গে উমাইয়া ও ছেলের খোঁজে বেরিয়েছে। ওর তিন বছরের ছোট্ট ছেলেটাক চারদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘুম, খাওয়া দাওয়া কিছুই হচ্ছে না তার। শরীর ভেঙে পড়েছে। বহুদিনের ক্লান্ত লাগছে তাকে। ছেলের জন্য কান্না করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। 
জোর করেও কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না।

ঘড়িতে সময় তিনটা। গভীর রাত। পুলিশের কল এল। একটা জায়গার নাম বলে। জায়গাটা শহরের বাহিরে। সুনসান এলাকা। রাস্তার পাশে ঘন অরণ্য।
পুলিশের দেওয়া ঠিকানায় যাওয়ার জন্য বের হতে লাগল সাদাফ আর তূর্ণ। এ-সময় উমাইয়া বলল সে-ও যাবে। উমাইয়ার ফ্যাকাশে হওয়া মলিন মুখটা দেখে সাদাফ তাকে সঙ্গে নিয়ে বের হলো। ওরা প্রথম গাড়িতে ওঠল। আর পেছনের দুই গাড়িতে বডিগার্ড।

পুলিশের গাড়ির পেছনে থামল সাদাফের গাড়ি। 
সাদাফ, উমাইয়া আর তূর্ণ গাড়ি থেকে নামে। এরপর একটু এগিয়ে যেতে একজন অফিসারকে দেখতে পায়। পুলিশ অফিসার সাদাফের সঙ্গে কথা বলে। কথার এক পর্যায়ে তিনি বললেন,
  'আমরা এখানে একটা বাচ্চার লাশ পেয়েছি। মুখটা আপনার সন্তানের সাথে মিলে যায়। তাই এত রাতে আপনাকে কল করেছি। আপনারা দেখে কনফার্ম করুন।'

উমাইয়ার শরীর কাঁপছে। ও শক্ত করে ধরল সাদাফের হাত। এরপর তিনজন ফলো করলো অফিসার কে। পাহাড়ি রাস্তা। উঁচু নিচু পাহাড়। খুব সাবধানে চারজন উঠে গেল। ভেতরে আরও চারজন পুলিশ অফিসার আছে। ওরা চারজন সরে দাঁড়াল। ওদের হাতের টর্চ লাইটের আলোয় বাচ্চার মুখটা স্পষ্ট হলো। উমাইয়া আঁতকে উঠল । সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালো সে। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

সাদাফ একহাতে উমাইয়া কে ধরল। মাটিতে হাঁটু ভাজ করে বসল সে। ছলছল চোখে সাদের মৃত্যু দেহের দিকে তাকাল। একটু পর দৃষ্টি সরিয়ে তাকাল তূর্ণর দিকে। তূর্ণ হাঁটু ভাজ করে বসল। উমাইয়া কে ধরল তূর্ণ। সাদাফ এক বছরের বাচ্চাদের মতো পা হেঁচড়ে এগিয়ে গেল বাচ্চার দিকে। দু'হাতে জড়িয়ে ধরে সাদকে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, 'সাদ' বলে। দুচোখ বেয়ে অশ্রু জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল। তূর্ণ আড়ালে চোখের জল মুছে নিল।

একজন অফিসার বললেন,
  'হত্যা করার সাইন একজন সিরিয়াল কিলার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।'

••••••••••••

সূর্য ডুবে গেছে। চারিদিকে সন্ধ্যা নামছে। পুলিশ স্টেশন থেকে কল আসে সেহরিশের ফোনে। সেহরিশ তাত্ক্ষণিক বেরিয়ে গেল। ত্রিশ মিনিট পর, থানায় পৌঁছাল সে। সেহরিশ মেরুদণ্ড টানটান করে শায়ের মির্জার সামনে থানায় বসে আছে।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসছে। শায়ের মির্জা রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে দেখল, এরপর সবগুলো কাগজ সেহরিশের দিকে বাড়িয়ে দিল। 
শায়ের মির্জা বলল,
  'আপনার ধারণা ঠিক। ইচ্ছাকৃত ভাবে প্ল্যান করে আগুন লাগানো হয়েছে। আর ওরা জেনো বাঁচতে না পারে এজন্য প্রত্যেকের খাবারে ঘুমের ঔষধ মেশানো হয়। আর মারিয়া.'' শায়ের থামল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে ফের বলল, 
  'মারিয়ার সঙ্গে অধিক লোক যৌন মিলনের ফলে ওর মৃত্যু ঘটেছে।'
সেহরিশ আলগোছে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। 
ক্রমশ রাগ বাড়ছে তার৷ যেদিন এই অদৃশ্য শত্রু কে সে হাতে পাবে। সেদিনটা ওর জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন হবে।

সাদাফের ম্যানেজার কল দিয়েছে। ওদিকের খবর শুনে সেহরিশের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সেহরিশ তাত্ক্ষণিক থানা থেকে বেরিয়ে গেল। 
উমাইয়ার বাবা-মা, রোদেলার মামি-ছোট ভাই ও তূর্ণর মা এত লোকের জন্য কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে দিয়ে রাতের ফ্লাইটে বাংলাদেশ ছাড়ল সেহরিশ।
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp