বিকট শব্দে বজ্রপাত ঘটে, খুব কাছাকাছি। ঝুম তবে ধারালো বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির শব্দে আলোড়ন হয় চতুর্দিক জুড়ে। হলদেটে দানব আকৃতির ট্রাকটি এলোমেলো গতিতে তেড়ে আসছে বৃষ্টি মেখে। ট্রাকের সামনের দুটো বাতির সূক্ষ্ম আলো এসে ছুঁয়েছে তন্ময়ের থমকানো মুখ। তীক্ষ্ণ বৃষ্টি, চোখে লাগা গাড়ির আলোতে বন্ধ হয় চোখের পাতা। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়, এই যেন ধার্যমাণ মরণ ডাক। এই যেন পৃথিবীর অন্যতম নিষ্ঠুর সত্যের বাস্তব রূপ তার সামনেই। সেমুহূর্তেই তন্ময়ের পকেটের সেলফোন বেজে ওঠে। এবং বেজে চলে বিরতিহীন। ত্বরিত চোখ মেলে চায় তন্ময়।
ওদিক ড্রাইভিংয়ে বসা সুমনের হাত দুটো ভয়ে বরফের মতো জমে আছে হুইলের ওপর। মরণ ভয়ে মস্তিষ্ক শূন্য, মাত্রাতিরিক্ত বড়ো হয়ে গিয়েছে চোখ দুটো। বুকের ওঠানামার গতি নেই, শ্বাস বন্ধ। নড়ছে না, কিচ্ছুটি করছেও না।
তন্ময় চোখের পলকে তেড়েমেরে কাছে আসা ট্রাকটির চেয়েও দ্বিগুণ গতিতে সুমনকে শক্ত হাতে ঠেলে সরিয়ে হুইল ধরে দু'হাতে। গাড়ি নিজের আয়ত্তে এনে বিশ্রী ধরনের এক বাঁকা মোড় নেয়—আগেপাছে কিচ্ছু দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। শুধুই যেন এই ট্রাকটিকে এড়ানোই তার একমাত্র লক্ষ্য। তৎক্ষণাৎ এক ভয়াবহ বিকট শব্দে জমিন সহ কেঁপে ওঠে চতুর্দিক। সেই শব্দে যেন বৃষ্টি থামে, উড়ে যায় আশ্রিত পাখিরা। সেই উৎকৃষ্ট শব্দের পরপর সব নীরব, শান্ত। মিনিটের মাথাতেই নীরবতা চিড়ে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের ফুলকি। সেই ভয়াবহ আগুনের ওপর নামছে ঝুম বৃষ্টি। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ।
আশেপাশে, সামনে-পেছনে নেই একটি গাড়ি। নেই কোনো বাড়ি, নেই লোকজন। বিধাতার দোয়াতেই যেন বৃষ্টির গতি বাড়ে। সেই ধারালো বৃষ্টির স্পর্শে দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে পারছে না আগুন। ধীরে ধীরে বাধ্য হচ্ছে নিভছে, শান্ত হতে। কালো ধোঁয়ার মাত্রা তখন অতিরিক্ত ভবে ছড়িয়ে পড়ছে।
নিভে গিয়েছে আগুন। পুরোপুরি। উল্টে পড়ে থাকা গাড়ির ভেতর থেকে সড়ক পথের জমিন ছুঁয়ে দেয় র ক্তা ক্ত, দুর্বল একটি হাত। জানালার কাঁচ ভেঙে গুড়িয়েছে চতুর্দিক। বৃষ্টির স্পর্শে র ক্ত ধুয়ে জমিন লা ল করে ফেলে। বেয়ে যায় র ক্তাক্ত বৃষ্টি। সে হাতটার অনামিকা আঙুলে একটি নির্ভেজাল, ডিজাইন বিহীন একটি আংটি। খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে আংটির গায়ে লেখা ছোটো 'অ' অক্ষরটির। তন্ময়ের ফরসা হাতটা কেঁপে ওঠে। চেষ্টা করে হাতটা নাড়াবার। কিন্তু পারে না। ব্যথার ভার যে খুব অতিরঞ্জিত। কিঞ্চিৎ জ্ঞান থাকা তার কপালের র ক্ত বেয়ে ছুঁয়েছে আধবোজা চোখ। তারপর ঠোঁট, এরপর গলা বেয়ে শার্ট। নিভুনিভু চোখের পাতায় নিজের পরিবার ব্যতীত কেউ নেই। বাবার গম্ভীর তবে আহ্লাদী মুখ, মায়ের আদুরে মুখ আর… আর অরুর অভিমানে ভেজা মুখ। টলমলে চোখ আর ওর কণ্ঠের ডাক,
‘তন্ময় ভাই।’
তন্ময়ের ডান চোখ বেয়ে গড়ায় একফোঁটা অশ্রুজল। সে জল গাল বেয়ে গড়ায় গলায়। ফোনটা ফের বেজে ওঠে। বাজতেই থাকে। সুমন জ্ঞান হারিয়ে মাথা বেঁকিয়ে পড়ে আছে। র ক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর মাথা। তন্ময়ের আধবোজা চোখজোড়াও ধীরে ধীরে বন্ধ হতে চায় চিরতরে। সে চেষ্টা করেও পারে না চোখদুটো মেলে রাখতে।
— — —
‘হেই, হেই…স্টপ দ্য কার। স্টপ।’
মালকিনের কথা মতো ড্রাইভার গাড়ি থামায়। সে অদূরের দৃশ্য দেখে ভয়ে ভয়ে বলে,
‘ম্যাম, এক্সিডেন্ট মনে হচ্ছে। যাব?’
রোশানারা আশ্চর্য হয়, ‘যাব মানে? দৌড় দাও।’
ড্রাইভার দ্রুত বেরোয়। বৃষ্টিতে ভিজেই ছুটে সামনের ট্রাকটির সামনে। ট্রাকে কেউ নেই। হয়তো-বা ভেগেছে। ইতোমধ্যে রোশানারা নিজেও গাড়ি থেকে বেরিয়েছে। মুহূর্তেই ভিজে জবজবে হয় শরীর। উঁচু হিলে বড়ো কদমে শব্দ তুলে এগোয় সামনে। ড্রাইভার চ্যাঁচায়,
‘ম্যাম মানুষ আছে ভেতরে। গোঙ্গানির শব্দ শুনলাম। জীবিত আছে।’
রোশানারা অশান্ত কণ্ঠে আদেশ ছুঁড়ে, ‘তাড়াতাড়ি টেনে বের করো। ভেতরে ক'জন?’
ড্রাইভার ইতোমধ্যে বসে পড়েছে সড়কপথে ঠিক গাড়ির সামনে। জানালাটা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু হচ্ছে না। গাড়িটা সোজা করা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কোথাও একটা কেউ নেই, নেই কোনো গাড়ি অবধি। রোশানারা তার হাসপাতালে কল দিয়েছে। খুব দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলেছে।
ড্রাইভার অসহায় গলায় বলে,
‘ম্যাম, গাড়িটা সোজা করতে হবে।’
রোশানারা শাড়ির আঁচল কোমরে বেঁধে নিজেও জমিনে বসে। ফোনের বাতি জ্বালায়। গাড়ির ভেতরে তাঁক করতেই দেখতে পায় তন্ময়কে। যার দু’চোখ কাঁপে সেই আলোর স্পর্শে। রোশানারা উচ্চস্বরে ডাকে,
‘মিস্টার, হ্যালো? শুনতে পারছেন?’ বলতে বলতে সে তন্ময়ের হাতের নল অনুভব করে। খুব স্বাভাবিক গতিতে চলছে। রোশানারা ফের ডাকে। এবার ঝুঁকে হাতও বাড়িয়ে গা ছুঁয়ে ঝাঁকি মারে। অদূর হতে গাড়ি আসার শব্দ কর্ণধার ছুঁতেই ড্রাইভার লাফিয়ে ওঠে। দ্রুত চিৎকার করে,
‘ইমার্জেন্সি সাহায্য লাগবে। হেল্প করুন।’
ড্রাইভারের হয়তো-বা ডাকতে হতো না৷ কারণ গাড়িটি কাছাকাছি পৌঁছাতেই— তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এদিকেই ছুটে আসছে। ড্রাইভার দ্রুত গলায় বলে,
‘স্যার, দু'জন ভেতরে। বেঁচে আছে। গাড়িটি সোজা না করলে বের করা সম্ভব হচ্ছে না।’
তিনজনই ড্রাইভারের সাথে হাত লাগায় গাড়িটি সোজা করার জন্যে। চার বারের সময় সোজা হয়।
ড্রাইভার ভাঙা জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে গাড়ির জানালা পুরোপুরি খুলে দেয়। বের করে আনে তন্ময়ের মৃদু সজাগ দেহ খানা। রোশানারা বলে চটজলদি গলায়,
‘উনি স্বাভাবিক আছেন। উনাকে এখানেই, গাড়ির সাথে লাগিয়ে বসাও। অন্যজনকে দেখো।’
ড্রাইভার তন্ময়কে গাড়িতে পিঠ ছুঁইয়ে সড়কপথে বসায়। তন্ময়ের পকেটের ফোন ফের বেজে ওঠে। এবং বেজেই যায়। আগন্তুক পুরুষদের একজন নিজের গাড়ি থেকে পানির বোতল এনে এগিয়ে দেন রোশানারার দিক। রোশানারা পানির বোতল নিয়ে তন্ময়কে অনেকটা খাইয়ে দেয়। বাজতে থাকা ফোন বন্ধ হয়ে ফের বাজে। রোশানারা বিড়বিড় করে,
‘আপনার পরিবারকে জানানো দরকার।’ বলেই সে হাত বাড়ায় তন্ময়ের পকেটে। ফোনটা বের করতে চায়। তখনই তার হাতটা তন্ময়ের দুর্বল, র ক্তাক্ত কাটা হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। মৃদু চোখে চাইতে চেয়ে অস্পষ্ট গলায় আদেশের মতো করে বলে,
‘ডোন্ট।’
সেই কণ্ঠে রোশানারা চমকে ওঠে। তন্ময় বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে৷ পুরুষালি বুকের ওঠানামার গতি অস্বাভাবিক দ্রুত। ক্লান্ত মাথাটা সে গাড়িতে ঠেলে স্পর্শ করায়। তার রুক্ষ হাতের মুঠোয় থাকা হাতটা ছেড়ে দিয়ে ফের দমবন্ধ হয়ে আসা দাম্ভিক গলায় আওড়ায়,
‘ডোন্ট টাচ মাই ফোন।’
আগন্তুকদের তিনজন পুরুষের একজন বসে তন্ময়ের কাছে। আলতো হাতে কাঁধ ছুঁয়ে বলে,
‘হেই, ব্রাদার। ইউ ওলরাইট? ফোন না ধরলে আপনার বাসায় কল করব কীভাবে?’
তন্ময় তখনো দুর্বল, অজ্ঞান প্রায়। কোনোরকমে জবাবে বলে,
‘তারা পাগল হয়ে যাবে। হয়তো-বা আমার থেকেও খারাপ অবস্থা হবে তাদের। ডোন্ট কল দেম। প্লিজ!’
রোশানারার ড্রাইভার সুমনকে বের করেছে গাড়ি থেকে। অজ্ঞান, তবে বেঁচে আছে৷ প্রথমে অনেক খারাপ অবস্থা মনে হলেও, অতটা খারাপ নয়। ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। অতিরিক্ত র ক্ত মূলত ডান কানের লতি কেটে বেরুচ্ছে। কপালে খানিক কেটেছে। বাদবাকি সব ঠিকাছে। রোশানারা দেখে নিয়েছে সুমনকেও। বৃষ্টির জল চোখে পড়তেই ও পিটপিট করে চোখ মেলে চায়। তন্ময়ের থেকে ভালো অবস্থা শরীরের। কিছুটা সজাগ হয়েই ও পাগলের মতো ডেকে ওঠে,
‘স্যার? স্যার?’
বলতে বলতে সুমন হাঁটুতে হেঁটে দ্রুত তন্ময়ের সামনে আসে। বিচলিত কণ্ঠে ডাকে,
‘স্যার? স্যার? অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন তাড়াতাড়ি।’
তন্ময় সময় নিয়ে থেমে থেনে দুর্বল প্রত্যুত্তর করে, ‘অ্যা-ম্বু-লেন্স লাগবে না। হস-পিটাল চলো। এভা–বে বাসা-য় যাওয়া যাবে না।’
রোশানারা দ্রুত বলে, ‘আমাদের হসপিটাল কাছেই। চলুন, আসুন।’
আগন্তুক পুরুষদের দু'জন মিলে তন্ময়কে ধরে তোলে। লম্বাচওড়া সুঠাম গতরের তন্ময়কে আড়চোখেই অবলোকন করে। তখনো সুমন দুর্বল পায়ে পিছু নিতে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলে,
‘বড়ো স্যারকে জানাই, স্যার? নাইলে পরে আমাকে মে রে ফেলবে।’
তন্ময় সে অবস্থাতেও গম্ভীর গলায় ধমকের সুরে আওড়ায়, ‘তোমা-র বড়ো স্যার মা-রার আগে আমিই তোমাকে মেরো ফেলব সুমন।’
এমন এক পরিস্থিতিতেও রোশানারার কেন যেন হাসি পায়। সে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসি দমায়। আড়চোখেই চায় তন্ময়ের ক্লান্ত মুখে। পরপর নজরে আসে ডান হাতের অনামিকা আঙুলের আংটির ওপর।
.
.
.
চলবে….....................................................................