বজ্রমেঘ - পর্ব ১৪ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


শাওলিন চোখদুটো চরম বিস্ফোরিত হল। বিস্ময়ে ঠোঁট দিয়ে কথা ফুটল না। একবার মনে হল স্বপ্ন দেখছে। আবার মনে হচ্ছ কোনো স্বপ্ন না। সত্যি সত্যিই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। যাকে আশা করেনি এই পার্বত্য জেলার চট্টগ্রামে। গলায় বিষ্ময়ের প্রাবল্য ঠেকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠল শাওলিন, 

  - আপনি এখানে? 

প্রশ্নটা করলে শোয়েব মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দেখে। তার চওড়া মসৃণ কপালে অসংখ্য ভাঁজ গাঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। ঘটনার ক্ষেত্রবিশেষ কিছুতেই বুঝতে পারে না। দরজার কাছে আর কেউ নয়, বরং হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেগুফতা। পিলে চমকে ওঠার মতো স্থির হয়ে সে যেন নির্বাক হতভম্ব! শোয়েব ব্যাপারটা লক্ষ করে ভারিকণ্ঠে ডেকে উঠল, 

  - ভাবী! 

ভ্রম ভাঙার মতো হঠাৎ চমকে তাকায় সেগুফতা। চোখজোড়া বিপুল আশ্চর্যে থমথম করে উঠল। মেঝেতে বসা দেবরের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে চোখদুটো বিছানার দিকেই ফেলল। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এই মেয়েটা এখানে! এই বাংলোয়! এই পার্বত্য জেলায়! পা বাড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই মেঝে থেকে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায় শোয়েব। চশমা ঢাকা চোখদুটো ভাবীর দিকেই উপর্যুপরি স্থির রেখে কপাল কুঁচকে বলল, 

  - আপনি এদিকে? কিছু প্রয়োজন আপনার? 

প্রশ্নকর্তার দিকে দৃষ্টি ঘুরাতেই মুখ তুলল সেগুফতা। বরাবরের মতো বুঝল, দৈহিক উচ্চতায় আজও খাটো সে। কাঁধের নিচে পরে আছে। একমাত্র ওর সামনেই কথা বলতে গেলে মাথাটা কিঞ্চিত উপরে তুলতে হয়। গলা খাঁকারি দিয়ে অপ্রীতিকর ভাবটা দূর করে সেগুফতা বলল, 

  - আমি জানতাম না তোমার ঘরে অন্য কেউ আছে। রাতে আমি উপরতলায় আসিনি। কিন্তু এখন এসে মনে হচ্ছে ---

কথাটা বলতে গিয়ে আচমকা বিরতি কষল সেগুফতা। যেন আশু কোনো ঘটনার বিপত্তি নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত। চোখদুটো শোয়েবের পেছনে ফেললে সরাসরি একজোড়া নিষ্পলক চোখে নিবদ্ধ করল। মেয়েটাকে ভুলেনি সেগুফতা! স্পষ্ট মনে আছে। ওই চেহারা, ওই চাহনি, ওই বাচনভঙ্গি, ওই ব্যক্তিগত আদল কিছুই ভুলেনি! চোখদুটো পেছন থেকে সরিয়ে পুনরায় শোয়েবের দিকে ফেলল সেগুফতা। কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলল, 

  - তুমি এক মিনিট বাইরে আসতে পারবে? আর্জেন্ট? আমার কিছু কথা ছিল। কথাগুলো এই মুহুর্তে বলা জরুরি। তোমার কাজ শেষ করতে কতক্ষণ? 

শোয়েব উদ্বিগ্ন আঁচটা ভালোভাবে টের পায়। এটাও বুঝতে পারে, কোনো এক বিচিত্র অদ্ভুত কারণে সেগুফতার মুখ সাদা হয়ে গেছে। চোখদুটো বিপন্ন দেখাচ্ছে। তবে বাইরে থেকে কিছু বুঝতে দিচ্ছে না। একমুহুর্ত নিজের ভাবনা সেরে জবাবটা দিল শোয়েব, 

  - আপনি এক মিনিট বাইরে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি কিছুক্ষণের ভেতর। আজ রাতেই উদ্ধার করা হয়েছে। দাদীর কথা মোতাবেক এখানে রেখেছি। আপনি চাইলে পাশের কামরায় বসতে পারেন। দরজা খোলা আছে।

  - ঠিকআছে। আমি তাহলে সেখানেই অপেক্ষা করছি। তুমি একটু দ্রুত করো। আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করব না। রাত বেশি জাগলে আমার জন্য সমস্যা হয়ে যায়। মাথাব্যথা বাড়ে। 

  - বেশিক্ষণ লাগবে না। ও ঘরে গিয়ে বসুন। 

সেগুফতা সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাবার পূর্বে আচমকা থমকে পিছন ফিরে তাকিয়েছে। দুটো অদ্ভুত চোখে আপাদমস্তক শাওলিনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কী দেখে তা জানা যায় না। এরপরই শশব্যস্ত হয়ে বাইরে চলে যায় সেগুফতা। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি শোয়েবের। মাথা ঘুরিয়ে নিজের ব্যক্তিগত শয্যায় তাকালে ওকেও চুপচাপ বসে থাকতে দেখে। শান্ত মুখটায় রা নেই। কোলের ওপর হাতদুটো ফেলে রাখা। বাঁদিকের জানালা দিয়ে বাইরের রাতটা দেখছে। কানের কাছে চুলগুলো উড়ছে, কিন্তু চোখদুটো কালো আকাশে অটল। ও সেগুফতা ভাবীকে কীভাবে চিনল? কোন সূত্র থেকে দুজনের সাক্ষাৎ ঘটল? যদি নিজেদের চিনেও থাকে, এরকম অচেনা অজানা ভঙ্গি কেন? 

•••••••••••••

বাইরে প্রচণ্ড জোরে ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। মুশকো কালো আঁধারে চারপাশটা ঢেকে গিয়েছে। যে ঘরটা স্রেফ ব্যক্তিগত মুহুর্তের জন্য বরাদ্দ, সেখানে একটা উজ্জ্বল বাতি জ্বলছিল। বিদ্যুৎ না থাকলেও বৈদ্যুতিক বাতির মতো সিস্টেমটা করা। সারা ঘর আলোয় ভরপুর করে দরজার বাইরে করিডোরটাও উজ্জ্বল করেছে। শোয়েব ঘরে পা রাখতেই সোজা বাঁদিকে সেগুফতাকে দেখতে পেল। দেয়ালজুড়ে মস্ত বড় বড় শেল্ফগুলোর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা রাশান লেখকের বই। পাতা ওল্টাচ্ছে সে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে প্রতিটি অক্ষর খুঁটে খুঁটে পড়ছে। অথচ, শোয়েব দেখতে পাচ্ছে, বইটা উলটো ভাবে ধরা। নিছক ভণিতা বাদ দিয়ে সরাসরি মোদ্দাকথায় ফিরল শোয়েব। কফি স্টেশনের কাছে গ্লাসে পানি ভরতে ভরতে বলল, 

  - কিছু বলতে চাইছিলেন? 

হাতের খোলা বইটা বন্ধ করল সেগুফতা। এতোটাই অন্যমনষ্ক ছিল যে, বই যে হাতে উলটো ধরা, সেটাও ধ্যানে নেই। শেলফের ফাঁকা স্থানে উলটো বইটা ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, 

  - যে ব্যাপারে বলতে চাচ্ছিলাম, সেটা এখন গুরুত্বপূর্ণ না। আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে শুরু করব। কিন্তু, কথাটা না বললে না। তার আগে জানতে চাইব, তুমি কী কাউকে জেনে-শুনে আশ্রয় দাও? নাকি নরমালি উদ্ধার করে বাড়িতে আনো? 

পেছন থেকে চিন্তা জড়ানো প্রশ্নটা শুনতে পায় সে। হাতে পানির গ্লাসটা ধরতে গিয়েও হাত থামায় শোয়েব। মাথাটা ডান কাঁধ বরাবর আস্তে আস্তে পিছনে ঘুরাতেই স্থির-শক্ত-কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল। গলাটা যেন বরফ-খণ্ডের মতো হিম হয়ে বলল, 

  - বুঝিনি সেগুফতা ভাবী। আমাকে কথাটা বুঝিয়ে বলুন। 

সামান্য একটা দম ফেলে সেগুফতা স্থির থাকে। বড়োত্ব, চাতুর্য, পাণ্ডিত্য, দম্ভ সে ভুলেও প্রকাশ করে না। সেগুফতা ভালোমতো জানে, তার সামনে ওই ঋজু, সংযমী, শৃঙ্খলাপ্রিয় পুরুষটা বয়সে তার চেয়ে বড়ো। চিন্তায়, বুদ্ধিতে, সামাজিক পদ-মর্যাদায় উঁচুস্তরে। তবু সম্পর্কের দিক বিচারে শোয়েব তার দেবর। নাম ধরে ডাকার ব্যাপারটা তাই হয়েছে। নয়তো, বাড়ির বউ ব্যতীত কাউকে ওর নাম ধরে ডাকতে শুনেনি। সেগুফতা তাই রয়েসয়ে সাবধান হয়ে কথাগুলো বলে, 

  - তোমার ঘরে যে মেয়েটাকে রেখেছ, তাকে আমি চিনি শোয়েব। মেয়েটার ভেতর কিছু সমস্যা আছে। প্রথম কথা, কেউ দেখতে পারে না ওকে। যেই দলটার সঙ্গে ঘুরঘুর করতে দেখছ, এই সাতজনই একটু মিশে। তুমি আমাকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন কোরো না। আমি তোমাকে মেয়েলি ঝঞ্ঝাটে ফাঁসাতে চাচ্ছি না। সেবা করছ, করো। কিন্তু লিমিটেশন রেখে কাজ-টাজ করো। এরা কেউ আন্তরিকতা ডিজার্ভ করে না। 

শোয়েব তখনো কিছু বুঝতে পারে না। একেকটা কথার মর্ম তার কাছে প্রশ্নবোধক লাগল। সে নিজেই ওকে চেনে কতটুকু? আর কতটুকুই বা ওদের সঙ্গে কথা বলেছে? হাসপাতালে একবার যখষ দুই মিনিটের আলাপ হয়েছে, তখন বাকি ছয়জনকে মনে হয়নি কোনোরূপ খারাপি আছে। বরং, সদা সতেজ, হাসিতে মুখর, তারুণ্যে টগবগ করা কয়েকটা প্রাণ। সেই তুলনায় ভাবীর কথাগুলো খাপমতো বসল না। শোয়েব পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে বলল, 

  - সমস্যা কী দলটার ভেতর? নাকি দলের ভেতর থাকা মেয়েটার মধ্যে? 

  - ওই মেয়েটার মধ্যেই। তোমার কাছে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু সত্যি এটাই। আমি ওদের গেস্ট ফ্যাকাল্টি শোয়েব! ওরা আমার আণ্ডারে ক্লাস করছে। আমার চাইতে ওদের খবর আর কেউ জানেও না। 

  - খবরটা কীরকম?  

পানির গ্লাসটা রেখে সোজা প্রশ্ন ছুঁড়ে শোয়েব। সেগুফতাও প্রশ্নের জবাবে সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল, 

  - খবরটা জটিল। এটা এখন বিস্তারিত বলা যাবে না। শুরু করলে রাত শেষ হয়ে যাবে। তোমাকে আমি এটুকু জানিয়ে রাখি, মেয়েটা খুব অদ্ভুত। ওর মধ্যে অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার আছে। আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। ক্লাসে চুপচাপ আসে, অ্যাটেণ্ড করে, এরপর নিজের মতো করে ফিরে যায়। ঢাকার কোন্ এলাকায় যেন ওর বাসা। কিন্তু বাসায় কেউ থাকে না। শুনেছি বেশিরভাগ সময় একা থাকে। কখনো কখনো একজন বুড়ো মহিলা নাকি সঙ্গে থাকে। কিন্তু সেখানেও বড় ধরণের একটা ঘাপলা আছে। বলতে পারো একটা আজগুবি সমস্যা!  

অমন টানটান পর্যায়ে উত্তেজনা তুলে হঠাৎ থামে সেগুফতা। এটা ওর বিশ্রী ধরণের মুদ্রাদোষ। কথার মাঝখানে আগ্রহ বাড়াতে বাড়াতে আচমকা দাড়ি বসিয়ে দেয়! শোয়েব বুঝতে পারে না এখানে অদ্ভুত ব্যাখ্যাটা কোথায়। ঢাকায় তো অহরহ এরকম ঘটনা ঘটে। ক্যাম্পাস থেকে বাসা দূর হলে অনেকেই কাছাকাছি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। কেউ থাকে হোস্টেল বা কেউ আবার সাবলেট। সেক্ষেত্রে এই মেয়ের বেলায় 'অদ্ভুত' তকমা জুটবে কেন? কালো শার্টের উপর মজবুত হাতদুটো ভাঁজ করল শোয়েব। শার্টের স্লিভদুটো পেশিতে ফুলে টানটান ফুটল। একটা গমগমে কায়দায় ভারিকণ্ঠে সে বলল, 

  - আচ্ছা, ঢাকায় একা থাকাটা আজগুবি? আমি একজেক্টলি বুঝতে পারছি না কোনটাকে মিন করছেন। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে স্পেসিফিক হয়। 

সেগুফতা শেলফের কাছ থেকে এক পা এগোয়। মনে মনে ভাবল কতটুকু বললে ঠিক, আর কতটুকু বললে না। চোখদুটো ডানে বামে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঘুরাতে থাকলে হঠাৎ দৃষ্টি থামল তার। নিচের অধরে জিভ বুলিয়ে হালকা স্বরে বলল, 

  - শোয়েব, 

বলেই শেষবার একটু থামে সেগুফতা। জোরে একদফা দম ছেড়ে বলল, 

  - শোনো। ঢাকায় থাকাটা আজগুবি না। কিন্তু ঢাকায় ওইভাবে চলাফেরা করাটা আজগুবি।আণ্ডার টুয়েন্টি একটা মেয়ের মধ্যে ওরকম আচরণ অবশ্যই টলারেব্যাল না। তুমি ওকে চেনো না বলে বিষয়টা বুঝতে পারছ না। ও কিন্তু ভীতু প্রকৃতির মেয়ে না, আবার অবলাও না। যখন কথা বলে ঠিকভাবেই বলে। কিন্তু কথা বলার আগপর্যন্ত চুপ করে থাকে। এই চুপটাই মাঝে মাঝে অসহ্যকর। ওকে ক্লাস আওয়ারে কোনো কোয়েশ্চ্যান করলে তুমি কোনোদিন আন্সার পাবে না। কিন্তু এমনও না, ও রেজাল্টে খারাপ। বরং, এভারেজ থি পয়েন্ট ফাইভ আপ। কিন্তু ওর চলাফেরায় একটা খাপছাড়া ব্যাপার আছে। যেটা সচরাচর আমাদের অধরাও করে না। অধরা তো চঞ্চল, জানো তো? 

  - হুঁ। 

সংক্ষিপ্ত স্বরে জবাব দেয় শোয়েব। তার মনোযোগ এখন অন্যদিকে। কতটুকু চেনে ওকে? আর কতটুকুই বা কথা হয়েছে? তবু এই বিষয়গুলো জানার পর একটা অদম্য ঝোঁক কাজ করছে। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় কী আছে, কেন সবটা এলোমেলো, কেন ব্যাপারগুলো জড়ানো, সবটা জানার জন্য অবচেতন মন ব্যগ্র ব্যাকুল হচ্ছে। সেগুফতা দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাতেই সময়ের ভুলোমনায় আঁতকে উঠে। কণ্ঠে তাড়াহুড়ো ফুটিয়ে 'শোয়েব, যাই! তুমি ঘুমাও। জেগে থেকো না!' বলে চটপট চলে যায়। এদিকে শোয়েব অতল ভাবনায় বিভোর। পাজ্যালের অংশগুলো চোখের সামনেই দেখতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, ভ্রমণ, রেসোর্ট, বাংলো, সেগুফতা ভাবী . . . 

••••••••••

ভোরের সূর্য নতুন দিনের মোড়ক উন্মোচন করল। পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিল আশার আলো। যে আশাতে মুখ ভাসিয়ে মানুষ স্বপ্ন বোনে। স্বপ্নের কাঁথায় ফোঁড় তুলে অপেক্ষা করে। যখন যেদিন স্বপ্নের কাঁথাটা তৈরি হয়ে যায়, সেদিনটা হয়ে যায় সুখের স্বর্গ। এমনই একটা দিনের জানান দিয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় সকাল হলো। ঘুমের আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসল রাফান। আধো আধো চোখজোড়া মেলে জানালা দিয়ে তাকাতেই হঠাৎ দৃশ্যটা দেখে কপাল কুঁচকায়। পাশে ঘুমন্ত পার্থর দিকে এক লাত্থি দিয়ে জোর গলায় হাঁক ছাড়ে, 

  - পার্থ! গেট আপ! বাইরে এটা কার গাড়ি এসেছে? অ্যাই, পার্থ! 

রাফানের ক্রমাগত চিৎকারে পার্থ ঘুম চোখে তাকাল। কণ্ঠে এক ছটাক বিরক্তি ঢেলে বলল, 

  - কী হচ্ছে কী রাফান! ডাকাডাকি কেন হচ্ছে শুনি? ভদ্রভাবে ঘুমোনো যায় না? 

  - আরে ব্যাটা, ঘুম বাদ দিয়ে উঠ্। উঠে দ্যাখ, বাইরে কীসের গাড়ি। ইয়্যু . . ওয়েইক আপ পার্থ! 

  - আরে, আশ্চর্য তো! কী হয়েছে? 

বলতে বলতে পার্থ এবার উঠেই বসে। চোখদুটো ডানহাতে কচলে জানালার দিকে তাকাতেই চোখ কচলানো থমকে যায়। তড়াক করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামতেই অস্থির কণ্ঠে বলে, 

  - ব্যাপারটা কী হল? নিচে এই গাড়ি কীভাবে? স্যার . . উনি কী জানেন? রাফান, তুই এদিকে থাক। আমি চট করে উপরটা দেখে আসছি। 

  - দ্রুত কর। 

রাফানকে জানালার কাছে বসিয়ে পার্থ ওমনেই বাইরে বেরুল। এক ছুটে সমস্ত ফাঁকা জায়গা পার করে সিঁড়ি বরাবর ছুটল। ধপ ধপ সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ ফুটতেই নিচ থেকে তাহিয়া বিস্ময় চোখে বলল, 

  - পার্থ! তুমি ওভাবে কোথায় উঠছ? তোমার স্যার তো উপরে নেই। 

চটান করে পাদুটো থামিয়ে ফেলে পার্থ। সিঁড়ি মাঝপথে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে তাহিয়ার দিকে দেখল। উদ্বিগ্ন ভরা মুখে চরম দ্বিধাটা আড়াল করে বলল, 

  - স্যার কোথায়? 

  - জানি না তো। বলে যায়নি। ভোরের আলো ফুটার আগেই বেরিয়েছে এটুকু জানি। তুমি কী কোনো সমস্যায় পড়েছ? 

পার্থ একমুহুর্ত ভেবে চাপা উত্তরটা দিল, 

  - না, কিন্তু স্যারের খোঁজটা এখন দরকার। উনি কী ফর্মাল ড্রেসআপে বেরিয়েছে? 

  - না, ওয়ার্ক-আউটের পোশাকে বেরিয়েছে। কী হয়েছে বলো তো? এই সাতসকালে তোমার স্যারের খোঁজ করছ কেন?

সিঁড়ি মাঝপথ থেকে ধীরেসুস্থে নেমে আসে ও। মুখে তেমন একটা কথা জোগায় না। মিথ্যা বলার অভ্যাসটা ভালো রপ্ত করা আছে, কিন্তু পরিবারের কাছে এটা প্রয়োগ করতে চায় না। পার্থ হালকা গলায় সম্মান ফুটিয়ে বলল, 

  - সেরকম কিছু নয় ভাবী। স্যারকে কিছু ব্যাপারে দরকার ছিল। বাইরে বোধহয় একটা গাড়ি থেমেছে। এটা নিয়ে স্যারের কাছে আলাপ ছিল। 

তাহিয়া কথাটা শুনে মৃদু হেসে দিল। হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে জানাল, 

  - তুমি বোধহয় জানো না ওটা রোজাদের গাড়ি। কাল যে মেয়েটা সবার সঙ্গে উদ্ধার হল, ওই রোজা মেয়েটার! ওর বাবা গাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছে। ওরা সবাই একটু আগে জেগেছে। রোজাই বাইরে গিয়ে সবটা দেখে এল। 

পার্থ এবার ভালোই বিস্মিত হল। রোজার জন্যে গাড়ি? রোজার বাবা রাতারাতি মেয়ের অবস্থা শুনে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে? তার মানে বাইরে দাঁড়ানো ওই সরকারি গাড়িটা রোজার বাবার। তাহলে ওরা সবাই জেগেও গেছে। বুক থেকে ভারি পাথরের চিন্তাটা নেমে গেল। জোরে বুকভর্তি করা দমটা বাতাসে ছেড়ে দিতেই তাহিয়া সৌজন্য হেসে বলল, 

  - থাকো তাহলে। রান্নাঘরে কাজ আছে। যাই। 

  - আচ্ছা ভাবী। ধন্যবাদ। 

কথাটা জানিয়ে পুনরায় নিজ ঘরের দিকে পা ঘুরাল পার্থ। পায়ে পায়ে ঘরে প্রবেশ করতেই রাফান ততক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে ফেলেছে। টাওয়ালে ভেজা মুখ ডলতে ডলতে বলল, 

  - স্যার নেই? 

  - না। ভোরের দিকে বেরিয়ে গেছেন। 

  - গাড়ির ব্যাপারে কী খবর? 

পার্থ সংক্ষিপ্তে সবটা জানাল। কথা শুনে রাফান ভেজা টাওয়েলটা সেন্টার টেবিলে রেখে বলল, 

  - হলি মলি! এখন তো দেখছি উপরমহল থেকে প্রেশার আসবে। এই রেসোর্ট ঘটনার সুরাহা না করলে ওই মিনিষ্টার কেমন ব্লাণ্ডার করবে কে জানে। ব্যাপারটা ভালো হল না। ওদের ছয়জনের সাথে কথা বলেছিস? 

ফিটফাট কেতাদুরস্ত কায়দায় বসে ছিল রাফান। গায়ে রাতের টিশার্ট বদলে একটা টানটান ছাইবর্ণ শার্ট, সঙ্গে ঘরোয়া কালো প্যান্ট। পার্থ ওর দিকে আগুন দৃষ্টি বর্ষণ করে উত্তপ্ত গলায় বলল, 

  - বাসিমুখে ওদের সামনে যাব? 

  - তাহিয়া ভাবীর সামনে কী পবিত্র মুখে ছিলি? 

  - ভাবী রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল, আমি সিঁড়ির দিকে ছিলাম! 

  - আচ্ছা থাম, তর্ক করিস না। বাথরুম থেকে মানুষের মতো বেরিয়ে আয়। রেজার, লোশন সব রাখা আছে। 

কথাটা বলেই বিছানা থেকে উঠে যায় রাফান। চলে যায় বাইরের দিকে। এদিকে ঘুম থেকে উঠেই হাতমুখ ধুয়ে বসে আছে ওরা। সবাই সকালে প্রাতঃকাজ সেরে নিয়েছে। বিছানার উপর শ্রেষ্ঠা, রোজা, নাযীফ বসে আছে। বিছানার ডানদিকে লম্বা সোফায় জিদান ও সেলিম বসা। সোহানা ঘরের বাইরে গিয়ে ফোনে কথা বলছে। ঘরের ভেতর চলছে অখণ্ড নীরবতা। কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সকাল নয়টায় কীভাবে রওনা দিবে। এখনো ওদের একজন সুস্থ না। উপরে যাবার অনুমতি পায়নি। ঘরের অটুট নীরবতা ভঙ্গ করল জিদান,

  - গাড়িটা ফেরত পাঠানো উচিত। এভাবে একজনকে ছেড়ে যাওয়া যাবে না। এমনিই ভুল একটা হয়ে গেছে। আর সেরকম রিপিট না হোক। 

জিদানের কথা শুনে মুখ খোলে শ্রেষ্ঠা। তেমনি শান্তকণ্ঠে সায় জানিয়ে বলে, 

  - কিন্তু দোস্তো, যেনতেন কারণ দেখিয়ে পাঠানো যাবে না। বিশ্বাস করাতে আমরা পুরোপুরি ঠিক আছি। কিছু হয়নি। এখানে ফরেস্ট অফিসারের বাংলোয় আমরা ফুল সেফ। 

গতকাল ফরেস্ট অফিসারের ঝাড়ি খাওয়ার পর চুপ হয়ে গেছে রোজা। আর একটা কথাও বলেনি। সারারাত অনেক কিছুই ভেবেছে। কিন্তু দিনশেষে মনে হয়েছে বাবাকে ফোন দেয়াটা ঠিক হয়নি। যত যা-ই হোক, ওর পাঁচ সঙ্গী কখনো একজনকে ছেড়ে যাবে না। বুকের ভেতর থেকে দমটা টেনে সশব্দে ছাড়ে রোজা, সেভাবেই ছাড়তে ছাড়তে বলে, 

  - আমি বাবাকে কিছুই বলিনি গাইজ। অতো টেনশনের কিছু নেই। জাস্ট খালি বলেছি একটা গাড়ি পাঠানো হোক। যেন আমরা একটু রিল্যাক্সে ঘুরাঘুরি করতে পারি। কালরাতের ঘটনা বাবার কানে পৌঁছালে বাবা আমাকে খুন করে ফেলবে! এমনিই উনি চাননি আমি তোদের সাথে ঘুরতে আসি। এই জায়গাটা নাকি ভালো না। অনেক খারাপ কিছু আছে। 

রোজার এই স্বীকারোক্তি শুনে ঠাণ্ডা হয় নাযীফ। মেজাজটা তার জ্বলন্ত কয়লার মতোই দপদপ করছিল। কিছুক্ষণ নিস্তেজ থাকার পর গলায় বল এনে বলল, 

  - আঙ্কেলের গাড়ি থাকুক। এটা দিয়ে আমরা ঘুরাঘুরি করব। এখন আর সেলিমের সোর্সে গাড়িতে চড়ব না। সরকারি গাড়ির সীল দেখলে ব্যাপারটা সেইফে থাকবে। কিন্তু আরো একটা কথা, 

কথাটা বলতেই সবার দিকে তাকাল নাযীফ। বুক ভরে ভরে অক্সিজেন টেনে ছাতি ফুলিয়ে বলল, 

  - জানার কাছে আমরা সবাই স্যরি বলব। স্যরি বললে কেউ ফকিন্নি জিগিন্নী হয়ে যাবি না। ওর কাছে মাফ চাওয়াটা দরকার। সবাই যে কর্মটা করছিস, ওটা পূণ্য মানুষের কর্ম না। বিপদের সময় বিবেক বুদ্ধি পায়খানার রাস্তা দিয়ে ছেড়ে দৌড় মারছিস। যেটা একদম ঠিক হয়নাই। আমি যদিও রেসের বাইরে ছিলাম, তবু তোদের দোষে দোষ কবুল করছি। আমিও তোদের মতো সমান পাপী। 

নাযীফের কথা শেষ হতে দেরি, সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পরেছে। গতরাতের ভয়াবহতা কাটিয়ে এই প্রথম হাসছে সবাই। রোজার কাছে মনে হল, সেই ছোটবেলার মিনা কার্টুন! মিনার মুখে শোনা বিখ্যাত 'পায়খানা' শব্দ! হাসির দমকে সবাই কিছুটা টালমাটাল হলে এমন সময় ঠক্ ঠক্ দুবার করাঘাত শুনল। সবাই হাসি হাসি মুখে দরজার দিকে তাকালে ঝপ করে অন্ধকার নামল। প্রস্তরমূর্তির মতো জড়বৎ দাঁড়ানো শোয়েব ফারশাদ। ওদের প্রত্যেকের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিস্পৃহ স্বরে বলল, 

  - শাওলিন নাশতার পর দেখা করতে চায়। যেতে চাও? 

বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল সবার! এটাই চাচ্ছিল ওরা! ঠিক এটাই! মুখোমুখি এবং সামনা-সামনি! উত্তেজনার তোড়ে সবাই একসঙ্গে চ্যাঁচানো সুরে বলে, 

  - যেতে চাই স্যার!! 

••••••••••

সকালের প্রাতঃকাল শেষে বিছানায় বসেছে শাওলিন। হাতমুখ ধোঁয়ার পর এখন কিছুটা চাঙা। একটু আগে কাজের মেয়েটা ওকে দেখে গেছে। খুশি খুশি মুখে ছুটে গিয়েছে নিচে। এরপর থেকেই মস্ত বড়ো ঘরটার ভেতর ও একা। দিনের সোনা রোদ্দুর জানালা গলে ঢুকছে। সমস্ত ঘরটা মিঠে আলোয় ঝলমল। বিছানায় বসে হাতের ব্যাণ্ডেজটা খোলার চেষ্টা করল শাওলিন। ছোট্ট গিঁটটা দাঁতের ফাঁকে চেপে টান দিতেই কেউ বাঁধা দিয়ে বলল, 

  - জংলী দেখাচ্ছে। 

চট করে মুখটা ডানে ফেরায় শাওলিন। ফেরাতেই বুঝে, গতকালকের আদলটা আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে! নেই কালকের ঘরোয়া সামান্য চিহ্নটুকু। কোমরে ইন করেছে সাদা শার্ট, বেল্টের সঙ্গে ফর্মাল প্যান্ট। বাঁহাতে ঝুলিয়ে রেখেছে কালো স্যূটটা। চোখে চশমা থাকায় তাকে দেখাচ্ছে কর্তৃত্বসুলভ, বুদ্ধি-প্রোজ্জ্বল, ব্যক্তিত্বপূর্ণ। ঠোঁটের কাছ থেকে ব্যাণ্ডেজটা অজান্তেই নামিয়ে ফেললে পেশাদার পোশাকে হাজির হল শোয়েব। বাঁহাতের স্যূটটা নামিয়ে রাখল চেয়ারে। পায়ে পায়ে অগ্রসর হতেই এবার আর ফ্লোরে বসল না। বসল না সোজা শাওলিনের পাশে। মাথা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে ওর হাতটা দুহাতে ধরল শোয়েব। ঝিমঝিম কাঁপনে কাঁপল শাওলিন! জানে না কেন এমনটা হচ্ছে! আর কেনই বা এই লোক নিকটে এলে এরকম হয়!একটা বৈদ্যুতিক স্পর্শ ছুঁয়ে যায়! নিঃশব্দে ঢোক গিলল শাওলিন। কিন্তু এবার আর খেয়াল করল না, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেগুফতা। ঠিক গতরাতের মতো অবাক চোখ! ঠোঁটদুটো হাঁ করা। 
.
.
.
চলমান.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp