আমি বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছি, আর মাফ চাচ্ছি। হঠাৎ চমকে উঠলাম যখন বাবা বললেন,
"তিন্নি কাল সন্ধ্যায় আদনানকে বাসায় আসতে বলো। কথা বলব।"
তারপর বাবা নিজের পা ছাড়িয়ে উঠে চলে গেলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর চাচ্চু বাদে সবাই ড্রয়িং রুম ছেড়ে চলে গেলেন। চাচ্চু এসে পাশে বসলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
"ভাইজান যখন একবার আদনানকে আনতে বলেছেন তখন আনতে হবে। এর অন্যথা হবে না। আদনান যদি না আসতে চায় তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হবে। এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তোর।"
আমি কিছু বলতে পারলাম না। কাঁদছি তো কাঁদছিই। চাচ্চু বললেন,
"ভেঙে পড়িস না। জীবনের কিছু মুহূর্ত আসে এমন যে পেছনে ফেরার আর পথ থাকে না। স্থিরও থাকা যায় না। সামনে এগোতেই হবে। এখন তোর জীবনে সেই মুহূর্তটা এসেছে। এখন তোকে শক্ত থাকতে হবে।"
আমি চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
"কমল যদি সত্যি সত্যি মামলা করে?"
"কী মামলা করবে? বিয়ে ভাঙার জন্য মামলা হয়? উলটো তুই মামলা করতে পারবি নারী নির্যাতন আইনে। তোর গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে।"
"আমি এসব করতে চাই না।"
"কথার কথা বললাম। যা তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে দরজা আটকে আদনানকে ফোন কর। ভাবি চলে আসলে আবার ছিলতে শুরু করবে।"
ঘরে এসে কান্না থামা পর্যন্ত কিছুটা সময় নিলাম। এরপর আদনানকে ফোন করলাম। বললাম,
"বাবা তোমাকে আগামীকাল সন্ধ্যায় আসতে বলেছেন।"
আদনান অবাক হয়ে বলল,
"আমি অবশ্যই আসব কিন্তু কিছুক্ষণ আগে না বললে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? এর মধ্যে আবার তুমি আমার কথা আংকেলকে বলেছো?"
"হ্যাঁ। কমলকেও বলেছি মানে যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল।"
"তারপর?"
"তারপর কমল বাসায় এসে গ্যাঞ্জাম করে গেছে। এখন বাবা বলেছেন তোমার সাথে কথা বলতে চায়।"
"তোমার সাহস আছে বলতে হবে।"
"আমি জানি না আদনান। আমি কী করছি জেনে বুঝে করছি না। আমি জানি না আমি ঠিক করছি নাকি ভুল। প্রচন্ড দিশেহারা লাগছে। আজ আমার বাসায় কতবড় ঝড় বয়ে গেছে তুমি জানো না।"
"জানাও।"
"সব জানতে হবে না তোমার।"
"আচ্ছা। বিয়ে কি ভেঙে গেছে?"
"অফিশিয়ালি না। তবে আজ বাসায় যা ঘটেছে এরপর এই বিয়ে হবে না। আমার বাবা প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছেন।"
"সরি তিন্নি।"
"তোমার সরি বলার কোনো কারণ নেই। যাই হোক, আমার কথা শোনো। আমাদের বাসার সবাই তোমাকে অনেক প্রশ্ন করবে। বিশেষ করে আমার বাবা। তুমি কিন্তু তোমার ওই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের কথা ভুলেও তুলবে না।"
"কেন?"
"ওটা শুধু একটা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ ছিল সে কথা তারা বিশ্বাস নাও করতে পারে।"
"তিন্নি আমি জানি না সব ঠিক করতে পারব কি না কিন্তু আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব। আই প্রমিস ইউ।"
ফোন রেখে আমি ভাবতে লাগলাম, কত সহজে কমলের সাথে আমার বিয়ে ভেঙে গেল। এত সহজে এই বিয়ে ভেঙে যাবে কল্পনাও করিনি। অথচ আমি খুশি হতে পারছি না। বিয়ে ভাঙতে গিয়ে আমার বাবাকে এত কষ্ট আমি দিতে চাইনি। বাবার এই অপমান, ওই দীর্ঘশ্বাস আমি সহ্য করতে পারছি না। বিয়েটা সত্যিই ভেঙে গেল। কীভাবে কী হলো আমি জানতে পারলাম না। শুধু মা এসে এটুকু বললেন,
"আপনার জন্য খুশির খবর আছে। কমলের মা বলেছেন, এমন দুশ্চরিত্র মেয়ে তারা তাদের ছেলের জন্য নেবে না। আমাদের বিয়ে ভাঙার সুযোগ দেয়নি, তারাই বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। নিন আপনার রাস্তা পরিস্কার। সন্ধ্যাবেলা আপনার প্রেমিক আসবেন নাকি সে এখন পিঠ দেখিয়েছে?"
আমি শুধু বললাম,
"আসবে।"
মা চলে গেলেন। কেউ কেউ আমার মায়ের কথায় অবাক হতে পারেন। আমার মা রাগলে এভাবেই কথা বলেন। ছোটবেলায় যখন মার খেয়ে এসে বলতাম, মা অমুক আমাকে মেরেছে। কাজিন বা বন্ধু বান্ধবদের মাকে শুনতাম সবসময় নিজেদের সন্তানের সাপোর্টে কথা বলতে। কিন্তু আমার মা বলতেন, কেন মারলো তুই কী করেছিলি? তার শাসনের ধরনটাই এমন। তার মানে এই না যে সে আমাকে ভালোবাসেন না। ভালোবাসাটা প্রকাশ করে না শুধু। যেমন এখন উনি আদনানের জন্য বিভিন্নরকম নাস্তা বানাবেন। সারাটাদিন আমার ভীষণ অস্থিরতায় কাটলো। অপরাধ বোধে আমি বাবার সামনে যেতে পারলাম না আর। আদনান যখন এলো, আমাকে তখন ড্রয়িং রুমে ডাকা হলো। এত নার্ভাস আমি আমার জীবনে আর এক দিন হয়েছিলাম। আদনানের সাথে প্রথম দেখার দিন। পরিবারের বাকি সকলেই সেখানে ছিল। কিন্তু কথা বলছিল শুধুমাত্র বাবা এবং আদনান। বাবা নাকি সবাইকে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞার কারণটাও জানা গেল না। আদনানের সাথে আমার একবার দৃষ্টি বিনিময় হলো। শুরুতে সেখানে কী কী কথা হয়েছিল তা শুনতে পাইনি। আমি যাওয়ার পর শুনলাম বাবা আদনানকে বললেন,
"তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে এত কথা জানতে চাচ্ছি বলে কিছু মনে করো না।"
আদনান বলল,
"না না আংকেল মনে করব কেন? আমার সব বিষয়েই আপনার জানা থাকা প্রয়োজন।"
"হ্যাঁ। আচ্ছা আদনান আমার আরও কিছু প্রশ্ন আছে।"
"জি অবশ্যই।"
"নয় ভাইবোন তোমরা, অথচ কারও সাথেই তোমার যোগাযোগ নেই! বিষয়টা অদ্ভুত।"
আদনান বলল,
"বড় বোনের সাথে যোগাযোগ আছে।"
"বাকিদের সাথে নেই কেন?"
"আংকেল আমি অনেক ইন্ট্রোভার্ট এবং স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। যারা আমাকে অপছন্দ করে বা অবহেলা করে তাদের সাথে মিশতে পারি না। এ কারণেই আর যোগাযোগ করা হয় না ওদের সাথে। ওরাও করে না।"
"তারা তোমাকে অপছন্দ কেন করে?"
"সঠিক কারণ আমার জানা নেই। অন্যসব ভাইবোনদের সাথে আমার বয়সের গ্যাপ অনেক বেশি। বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখেছি বড় আপা বাদে বাকিরা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। আমার মায়ের ধারণা ছিল এত বছর পর সম্পত্তির একজন অংশীদার বাড়ায় আমার ভাইবোনেরা আমাকে অপছন্দ করে। আমি জানি না আমার মায়ের ধারণা কতটুকু সঠিক।"
"তোমার বাবার সম্পত্তি কী অনেক বেশি?"
"ছিল। এখন কিছু নেই। আমি আমার ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে ডেনমার্ক চলে যাই।"
"সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়?"
"না, সবার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম।"
"ভাইবোনেদের অবহেলার কারণে?"
আদনান মাথা নিচু করে বলল,
"জি।"
"বড় বোন তো তোমাকে আদর করত বললে। তাহলে তার বাসা ছেড়ে কলেজের হলে কেন গেলে?"
"দুলাভাই আমার ওখানে থাকাটা পছন্দ করতেন না। আমাকে নিয়ে প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া হত তাই আমি হলে চলে গিয়েছিলাম। আমি চাইনি আমার জন্য আপার
সংসারে অশান্তি হোক।"
"সবই বুঝলাম কিন্তু একজন লোকাল গার্জিয়ান তো দরকার যার সাথে আমরা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে পারি? তোমার দাদাবাড়ি নানাবাড়ির ঠিকানা দরকার। তোমার সম্পর্কে খোঁজখবর তো নিতে হবে। ফ্যামিলি থাকলে এত চিন্তা করতে হত না। আশা করি বুঝতে পারছ।"
আদনান বলল,
"আমার সেরকম গার্জিয়ান কেউই নেই। তবে আপনারা চাইলে আমার মামা আর বড় আপার সাথে কথা বলতে পারেন। আমি তাদের সাথে যোগাযোগের ফোন নাম্বার দিচ্ছি। আর দাদাবাড়ি নানাবাড়ির ঠিকানাও দিয়ে দিচ্ছি। তবে তারা কেবল আমার ছোটবেলাটা সম্পর্কেই জানে। আমার বর্তমান সম্পর্কে তাদের সবার থেকে বেশি জানে ডেনমার্কের এম্বেসি। আমি আমার পাসপোর্ট, আইডেন্টিটি কার্ড, জব সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় আরও কিছু কাগজপত্র আজই দিয়ে যাব। আর যেটা জানার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম সেটা আমি বলে দিচ্ছি। আমি চার বছর আগে ডেনমার্কে অনেক সমস্যার মধ্যে ছিলাম। সিটিজেনশিপ পেলে সেই সমস্যাগুলো মিটে যায়..."
এটুকু শুনেই আমার দিশেহারা লাগলো৷ ও কি ওর বিয়ের কথাটা বলে দেবে? মানা করা স্বত্বেও বলবে? সর্বনাশ! আমি মানলেও এসব আমার ফ্যামিলি কখনোই মানবে না। আমার এসব ভাবনার মাঝেই আদনান তার কথা শেষ করলো,
"তখন আমি সিটিজেনশপের জন্য একটা ড্যানিশ মেয়ের সাথে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করি। পেইড ম্যারেজ। নির্দিষ্ট সময় পরে ডিভোর্সও হয়ে যায়। সেই হিসেবে আমি ডিভোর্সি।"
আমি হতাশ, প্রচন্ড হতাশ হয়ে গেলাম! আমার বাবা, মা, দাদাজান, চাচ্চু এবং মিন্নি সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে।
.
.
.
চলবে.........................................................................