উত্তাল সমুদ্রের মাঝে পড়েছি যেন। আমি সাদা স্বচ্ছ ফেনার সাথেই ভাসছি। বড় বড় ঠেউ এসে আমার অবস্থানকে বার বার নাড়িয়ে দিচ্ছে। জানি না কী আছে কপালে। আদনানকে ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা মাথায় আসছে না। আদনানের পুরো কথা না শুনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার অপরাধে নিজেকে মৃত্যুদণ্ড দিতে ইচ্ছে করছে। আমার কাছে যে'কটা পথ খোলা আছে তারমধ্যে এটা সবচেয়ে সহজ। কিন্তু বাবা মায়ের কথা চিন্তা করলে আমি সেই সিদ্ধান্তও নিতে পারছি না। যখন আমি আমার মায়ের সামনে দাঁড়িয়েও আদনানকে ভালোবাসার কথা স্বীকার করতে পারলাম তখন আরও ভালো করে বুঝতে পারলাম আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। ৬ মাসে কোনো যোগাযোগ নেই অথচ আজ যখন সামনে এলো আমি পাগল হয়ে গেলাম!
চাচ্চু ও মা দুজনের হাতে দুটো চড় খেয়ে নিজের ঘরে এসে সারাটা দিন চুপচাপ শুয়ে রইলাম। কমল ফোন করছিল, তখন ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখলাম। কয়েক দফা কান্নাকাটি করেছি তাই ইচ্ছে করছিল না কথা বলতে। তাছাড়া আমার এখন অন্যকারো সাথে কথা বলার চেয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করাটা বেশি জরুরি। কিন্তু এই যুদ্ধ বারবার আমাকে আদনানের দিকেই ঠেলছে। কমলের বাবা-মা ভাইবোনসহ ভরা একটা পরিবার আছে। সে আমাকে ভালোও বাসে না। কষ্ট পেলেও দুদিন পর নিজেকে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু আদনানের তো কেউ নেই। আবার আমাকে ভালোও বাসে, আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই। ৬ মাসের এত কষ্টের অপেক্ষার পর আমাকে হারালে তার কী অবস্থা হবে? আর কত কষ্ট পাবে এই ছেলেটা! আর এদিকে কত কষ্টে আমি নিজেকে কমলের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। এই বিয়ে হয়তো সুখেরই হত কিন্তু আদনানের সব কথা শোনার পরে এখন আর কিছুতেই কমলের সাথে আমার সংসার সুখের হবে না। যার নিজের মনে শান্তি নেই সে অন্যকে সুখী করবে কী করে?
সন্ধ্যার পর কমলকে ফোন করলাম। কমল বলল,
"কী ব্যাপার তিন্নি তোমাকে কতবার ফোন করেছি, ধরছো না। কোনো সমস্যা হয়নি তো?"
আমি বললাম,
"অনেক বড় সমস্যা হয়ে গেছে। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।"
"কী সমস্যা? ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন?"
"আদনান বাংলাদেশে এসেছে।"
"আদনান কে?"
"ভুলে গেছো? যাকে আমি ভালোবাসতাম।"
কমল একটু দমে গিয়ে বলল,
"ওহ। কিন্তু তাতে সমস্যা কোথায়? সে তো বিবাহিত।"
"সমস্যা এটাই যে আমি ভুল বুঝেছিলাম। ও বিবাহিত না।"
"মানে?"
আমি কমলকে পুরো ঘটনা বিস্তারিত বললাম। সব শুনে কমল জিজ্ঞেস করলো,
"তুমি তাকে বলোনি আমাদের এঙ্গেজমেন্টের কথা?"
"আমি ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। হুট করেই বাসায় চলে আসায় বলা হয়নি।"
কমলের কথার টোন বদলে গেল। কড়া গলায় বলল,
"তিন্নি তুমি এক্ষুণি আদনানকে ফোন করো। আমাদের এঙ্গেজমেন্টের কথা বলে ফিরে যেতে বলো। তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে তার সাথে দেখাও করে এসেছ! তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি।"
এটা কি সত্যিই কমল? বড্ড অপরিচিত লাগছে। এধরনের কথাবার্তা তার ক্যারাক্টারের সাথে ঠিক যায় না। আমি জানি অন্যায় আমি করেছি। কিন্তু গত তিন মাসে সে আমাকে কখনো বুঝতে দেয়নি সে আমার হবু স্বামী৷ সবসময় বন্ধুর মত আচরণ করেছে। এই প্রথম সে হবু স্বামীর মত আচরণ করলো। অথচ এই সময়টাতেই তার বন্ধুত্বের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।
আমি হুট করেই বলে ফেললাম,
"আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না কমল।"
কমল এবার চেঁচিয়ে উঠল,
"সেটা তোমার খেয়ালি ইচ্ছেতে হবে না তিন্নি। তুমি যদি তাকে এতই ভালোবাসতে তাহলে তার সেদিনের পুরো কথা শুনতে। তার জন্য অপেক্ষা করতে। কিংবা একটু সময় নিতে। এত দ্রুত শূন্যস্থান পূরণের জন্য বিয়ে করতে চাইতে না। আজ প্রেম করছ, প্রেম ভাঙতে না ভাঙতেই বিয়ে করতে যাচ্ছ। আবার বয়ফ্রেন্ড ফিরে এসেছে বলে বিয়ে ভেঙে দিতে চাচ্ছ।"
আপনাদেরকে আগেও বলেছি আমার মাথা প্রচন্ড গরম। হুটহাট রেগে যাই। তার এই কথাতেও রেগে গেলাম। বললাম,
"তুমি কি আমাকে জোর করে বিয়ে করবে নাকি?"
সে আরও উত্তেজিত হয়ে বলল,
"প্রয়োজনে তাই করব।"
আমি দৃঢ় গলায় বললাম,
"আদনানের সাথে কিছু না হলেও এখন আর তোমাকে বিয়ে করব না। তোমার আজকের ব্যবহারের জন্য।"
"তুমি কি আশা করো তুমি পাগলের মত কথাবার্তা বলবে আর সবাই তোমাকে মাথায় তুলে নাচবে? তুমি আদনানকে ফোন করে শুধু বলে দেখো কতবড় প্যাঁচ তুমি লাগিয়েছো। সেও তোমার সাথে একই রকম ব্যবহার করবে। ভালো ব্যবহার পাওয়ার মত কোনো কাজ তুমি করোনি। আমার ধারণা হচ্ছে তোমার মাথায় সমস্যা আছে তিন্নি। তোমার চরিত্রেও সমস্যা আছে!"
আমি ফোন রেখে দিলাম। সাথে সাথে আদনানকে ফোন করলাম। আদনান সব শুনে কী ব্যবহার করে তা আমার এখনই দেখতে হবে। ওপাশে রিং হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন রিসিভ হলো,
"হ্যালো।"
"তিন্নি বলছি।"
"থ্যাংকস গড! সারাটাদিন তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।"
"তোমাকে খুব জরুরি একটা কথা বলব।"
"বলো।"
"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এঙ্গেজমেন্টও হয়ে গেছে।"
ওপাশে পিনপতন নীরবতা। আমিও চুপ। ওদিকে কমল ফোন করছে। আদনান কিচ্ছুক্ষণ পর বলল,
"কবে হলো এসব?"
তার গলা শুনে প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু একটু নিস্তেজ মনে হলো। আমি বললাম,
"বিয়ে ঠিক হয়েছে ৩ মাস হলো। মাসখানেক আগে এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে।"
"এত দেরি করে ফেললাম আসতে! সরি তিন্নি।"
"তুমি কেন সরি বলছো?"
অবাক হলাম আমি! সে বলল,
"কারণ ভুলটা তো আমারই। আমার আরও আগে আসা উচিত ছিল। তার উপর এখন ভুল সময়ে এসে তোমাকে বিরক্ত করেছি।"
আমার কান্না পেয়ে গেল। আমি তাকে বললাম,
"পরে কথা বলি আদনান।"
"শিওর।"
আমি আদনানের সাথে কথা বলতে বলতে কমল অনেকবার ফোন করে ফেলল। জানি এখন আরও ফোন করবে। আমি ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমি জানতাম আদনান খারাপ ব্যবহার করবে না। কিন্তু তার এমন প্রতিক্রিয়া হবে সেটা বুঝিনি। আবার ওটাও বুঝিনি যে খারাপ সময়ে কমল খোলস থেকে বের হয়ে আসবে।
সবসময় যার ব্যাপারে যা ভাবি যা বুঝি, তার উল্টোটাই হয়। একারণেই নিজের উপর চরম বিরক্ত আমি। আমি কারও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই নই। কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। তবে আমি এটা নিশ্চিত কমলকে আমি বিয়ে করছি না। যা কিছুই হয়ে যাক না কেন। যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে কমলকে বিয়ে করতেই হবে, আর কোনো উপায় নেই; তাহলে নিজেকে শেষ করে দেব।
আমি চোখ মুখ ধুয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম। তারপর বাবার কাছে গেলাম। বাবা ড্রয়িংরুমে বসে নিউজ পেপার পড়ছিলেন। দাদাজান ও চাচ্চু পাশেই বসে দাবা খেলছেন। মা ডাইনিংয়ে কিছু একটা করছেন। মিন্নি তার ঘরে পড়ছে।
আমাকে বাবার কাছে আসতে দেখে মা ডাইনিংরুম থেকেই ইশারা করলেন যেন বাবাকে কিছু না বলি। কিন্তু আমি বলেই ফেললাম,
"বাবা আমি কমলকে বিয়ে করতে পারব না।"
বাবাকে ছোটবেলা থেকেই জমের মত ভয় পাই। শুধু আমি নই, আমাদের বাসার সবাই ভয় পায়। যেদিন আফতাবকে বিয়ে করব না বলতে এসেছিলাম সেদিনও ভয় পাচ্ছিলাম। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আজ আমার ভয় লাগছে না। আমার কথায় দাদাজান ও চাচ্চু দুজনেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। বাবা নিউজ পেপার থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"তোমার মাথা ঠিক আছে? কমলকে তোমার পছন্দ হয়েছে বলেছ, তারপরেই তো আমরা এগোলাম।"
"দুটো কারণে বিয়ে করতে পারব না।"
বাবা চোয়াল শক্ত করে বললেন,
"দুটোই শুনি।"
আমি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম,
"বাবা আমি একজনকে ভালোবাসতাম।"
"তিন্নি এখন এসব বললে হবে না। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার পছন্দ আছে কি না। তুমি বলেছিলে, নেই। এখন এভাবে আমাদের বিপদে ফেলার অধিকার তোমার নেই।"
"বাবা পুরো ঘটনা শুনলে তুমি বুঝতে পারবে কেন তখন বলিনি।"
"কেন বলোনি সেসব জেনে এখন তো কোনো লাভ নেই। দ্বিতীয় কারণটা বলো।"
"কমল আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।"
"কেন?"
"বিয়ে করতে পারব না বলেছিলাম তাই।"
বাবা কিছু বলার আগেই মা এবার বললেন,
"তুই এসব কমলকে বলেও দিয়েছিস?"
আমি দৃঢ় গলায় বললাম,
"হ্যাঁ।"
"তাহলে তো খারাপ ব্যবহার করাটা অস্বাভাবিক না।"
বাবা এবার বললেন,
"তিন্নি তুমি যেহেতু আমার সাথে কথা বলতে এসেছো তোমার উচিত হয়নি তার আগে কমলের সাথে কথা বলা।"
"সরি বাবা। আমি আসলে এটাই বুঝতে পারছি না আমার কোনটা করা উচিত আর কোনটা উচিত না। আমার মাথা কাজ করছে না।"
ঠিক সেই মুহূর্তেই কলিং বেল বেজে উঠলো। চাচ্চু এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকল কমল। কমলের চেহারাটা এখন ঠিক যেন অগ্নিমূর্তি। রাগে কাঁপছে। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কারও সাথে কোনো ফর্মালিটিজে না গিয়ে সরাসরি আমার সামনে এসে চিৎকার করে বলল,
"তোর এতবড় সাহস কীভাবে হয় যে তুই আমার ফোন কাটিস?"
ওর মুখে তুই শব্দটা শুনে আমি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না। বলে ফেললাম,
"আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তাই ফোন কেটেছি। প্রয়োজনে তোমাকেও কাটতে পারব।"
সাথে সাথে কমল আমার গালে একটা চড় মারলো। তারপর চুলের ঝুটিটা খামচে ধরে বলল,
"কী বললি তুই? কী বললি কাকে কাটবি?"
আমি ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম। মা আচমকা কেঁদে ফেলল। চাচ্চু এসে কমলের হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিলো। বাবা সটান দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল ,
"কমল! তুমি আমার সামনে আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলছো!"
চেঁচামেচি শুনে মিন্নি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কমল বাবাকে বলল,
"মেয়ে মানুষ করতে পারেননি যখন তখন তো আপনার সামনেই শাসন করতে হবে। আফসোস! যেটা আপনার করার দরকার ছিল সেটা আমাকে করতে হচ্ছে।"
চাচ্চু কমলকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,
"পাগল নাকি এই ছেলে!"
"পাগল আমি না। পাগল আপনাদের মেয়ে। শুধু পাগলই না, চরিত্রহীনও। আজ বাদে কাল বিয়ে, আজ পুরোনো প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যায়। এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে, এখন বলে বিয়ে করবে না। এসব কোনো ভালো মেয়ে করে?"
বাবা বলল,
"এই বিয়ে হবে না। যে ছেলে আমাদের সামনে আমাদের মেয়ের গায়ে হাত তুলতে পারে, সে পরে কী করবে সেটা সুস্পষ্ট।"
কমল আরও জোরে জোরে চিৎকার করে বলল,
"এই বিয়ে হতেই হবে। এই বিয়ে না হলে মামলা করব। এই পরিবারের সবকটাকে জেলে ঢোকাব।"
দাদাজান বললেন,
"জোর করে বিয়ে করলে সেই বিয়েতে কেউ সুখী হয় না। তুমি বাসায় যাও ভাই। মাথা ঠান্ডা করো আগে।"
কমল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"জোর করেই বিয়ে করব। সুখের দরকার নেই। এই বিয়ে কে কীভাবে ভাঙে সেটাও দেখে নেব আমি।"
কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাচ্চু কমলকে ধাক্কা দিয়ে বাসা বের করে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর বলল,
"বদ্ধ উন্মাদ।"
দাদাজান বললেন,
"কত খোঁজ খবর করলাম ছেলেটার আমরা। কোনো নেগেটিভ কিছু পাইনি। অথচ আজ এ কী ব্যবহার দেখলাম! যে মানুষ রাগের সময় নিজের হাতকে আর মুখকে সংযত রাখতে পারে না সে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।"
মা বললেন,
"তাহলে সেটা আমাদের মেয়েও বাবা। কী দরকার ছিল ওর মুখে মুখে অমন কথা বলার।"
দাদাজান বললেন,
"ও তো ছোট মানুষ বৌ।"
"২১ বছর বয়সে কেউ ছোট থাকে না বাবা।"
চাচ্চু বলল,
"মেয়ে হয়েছে বলে কি আজীবন চুপ থাকতে হবে না কি ভাবি?"
"তুই চুপ কর। তোর আস্কারা পেয়ে এই মেয়ে মাথায় উঠেছে।"
কমল কি যেন ভাংচুর করলো। সম্ভবত সিড়ির সামনের আয়না আর পাতাবাহার গাছগুলো। তারপর সে চলে গেল। বাবা বসে পড়ে হতাশ গলায় বললেন,
"আসলেই কি মেয়ে মানুষ করতে পারিনি আমি!"
আমি ছুটে গিয়ে বাবার পা জড়িয়ে ধরলাম। কাঁদতে কাঁদতে বারবার একটা কথাই বললাম শুধু,
"আমাকে মাফ করে দাও বাবা। আমাকে মাফ করে দাও। আমাকে মাফ করে দাও। আমাকে মাফ করে দাও...."
.
.
.
চলবে.........................................................................