জাওয়াদ যেতে পড়াবাবা চোখ বন্ধ অবস্থাতেই শুধালো,
“ভালো আছো জাওয়াদ? তোমাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করছিলো।”
জাওয়াদ স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে পড়াবাবার দিকে। পড়াবাবা এমন অদ্ভুত কথা বলেন। তিনি অপর মানুষটিকে চমকে দিতে চান। এটাই তার ব্যবসা। ফলে চোখ বন্ধ করে তার আগমণ অনুমান করা খুব কঠিন কাজ নয়। জাওয়াদ সেলের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। পড়াবাবা চোখ মেলে চাইলেন। তার মুখে সেই স্মিত হাসি। তার আন্দাজ লেগে গেছে বলেই কি এতো আনন্দিত! বোঝা গেলো না। তিনি উঠে বসলেন। জেলেও তার মুরিদের অভাব নেই। ওই সেলের অন্য কয়েদি তার চটি এগিয়ে দিল। সে তাতে পা গলিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে এলেন। সামনাসামনি দাঁড়ালো জাওয়াদের। জাওয়াদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। পড়াবাবা স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“তোমার মামী কেমন আছেন? উনাকে বলো চিন্তা না করতে। আমি চলে আসবো খুব দ্রুত। এটা কাইন্ড অফ ভ্যাকেশন আমার জন্য।”
“জেলে বসেও ভাওতাবাজী বাদ দিতে পারলেন না?”
পড়াবাবা রহস্য করে হাসলেন। যেন খুব মজার কথা বলেছে জাওয়াদ। জাওয়াদের কপালে ভাঁজ পড়লো। ভ্রু কুঞ্চিত হলো। জেলে থেকেও একটা মানুষ এতো স্বাভাবিক কি করে থাকে। পড়াবাবা তাকে অবাক করে কন্সটেবলকে বললো,
“ভাইজান, একটু বের হব। দমবন্ধ লাগছে। একটু হাওয়া খাব।”
কন্সটেবল তার পান খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে বললো,
“বাবাজি যে কি বলেন? অনুরোধ না হুকুম করেন।”
“না না, আমি অন্যায় করি না।”
জাওয়াদকে অবাক করে তার সেলের দরজা খুলে দিলো কন্সটেবল। পড়াবাবা বের হলেন। হাত-পা টানা দিলেন। হাসি মুখে জাওয়াদকে বললেন,
“চলো একটু হেটে আসি।”
*********
পুলিশস্টেশনের পেছনে বিশাল জায়গা। একদম শেষ প্রান্তে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। লাল রঙ্গে নুয়ে গেছে গাছের ডালগুলো। কি চমৎকার লাগছে রক্তাক্ত গাছটা। নীল আকাশের নিচে রক্তাক্ত কৃষ্ণচূড়া। পড়াবাবা সেই গাছের নিচে হেলান দিলেন। একটা বেনসন সিগারেট ধরালেন। অঙ্গভঙ্গি, মুখভাব দেখে মনে হচ্ছে এই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরানো তার রোজকার ব্যাপার। একজন জেলের কয়েদি এতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে যেন কিছুই হয় নি। অবশ্য কনস্টেবলের আচারণ দেখে জাওয়াদ অনুমান করেছে জেলে জামাই আদরই পাচ্ছে মহাশয়।
দু-আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলছে সিগারেট। কুন্ডলীত ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে সমীরণে। জাওয়াদ ক্রুদ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ দিনের পর দিন অতিপ্রাকৃতিক ভঙ ধরে মানুষকে ঠকাচ্ছে। মানুষ অন্ধভাবে তাকে বিশ্বাস করছে। তাকে পীর, মুরিদ ভাবছে। তার কাছে সাহায্য চাচ্ছে। পড়াবাবা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,
“কি দেখছো?”
“দেখছি একটি মানুষ কতটা জানোয়ার হয়। অন্য মানুষকে ঠকিয়েও কতটা স্বাভাবিক চিত্তে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে পারে।”
“আমি মোটেই মানুষ ঠকাই না। আমি তাদের সাহায্য করি।”
“ভুংভাং বুঝিয়ে মানুষের টাকা হাতানো সাহায্য?”
“তুমি কি স্বপ্ন থেকে পরিত্রাণ পাওনি জাওয়াদ?”
তাচ্ছিল্য করে শুধালেন পড়াবাবা। জাওয়াদ একটু থমকালো। পড়াবাবা সিগারেটে টান দিলেন। স্মিত হাসি অক্ষত রেখে বললেন,
“তুমি স্বপ্ন থেকে পরিত্রাণ পেয়ে এখন বাস্তব জীবনে তাকে দেখছো। প্রতিনিয়ত দেখছো। অন্যের মাঝে তাকে দেখছো। আবার মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছেতেও তাকে দেখছো। কি ভুল বললাম?”
জাওয়াদ সূচালো নয়নে তার পানে চেয়ে রয়েছে। পড়াবাবা সিগারেট এগিয়ে বললেন,
“খাবে?”
“না।”
“রাগ করছো কেন?”
“আমি এতো কিছু জানেন কি করে? বলবেন না আপনার আধ্যাত্মিক শক্তি আছে।”
“নেই, তো?”
পড়াবাবা আবার রহস্য করে হাসলেন। লোকটির হাসি বিশ্রী। মেকি হাসি। মানুষকে চমকে দিতেই এই ঘনঘন হাসির ঢং। পড়াবাবা তার সিগারেট শেষ করলেন। ফিল্টার পিষলেন স্যান্ডেল দিয়ে। তারপর বললেন,
“তোমার কি মনে হয়? আমি কি?”
“একজন ঠগ।”
“সেটা তো বটেই। আর?”
জাওয়াদ উত্তর দিলো না। পড়াবাবা তার দিকে চাইলেন। জাওয়াদের চোখে মুখের ক্ষিপ্রতা কমে কৌতুহল ফুটে উঠেছে। পড়াবাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
“মানুষের সমস্যা কি জানো? তারা সবকিছুর সমাধান খুঁজে। বিপদ, আপদ, দুঃখ, জীর্ণতা—ব্যাপারগুলোকে তারা মোকাবেলা করতে চায় না। চায় শুধু পরিত্রাণ। আমিও তাদের পরিত্রাণ দেই। বিনিময়ে একটু পারিশ্রমিক নেই। এটা দোষের কিছু নয় নিশ্চয়ই। আমি তো খুন করছি না। শুধু তাদের বিশ্বাসের সাহায্য নিচ্ছি।”
“আপনি এতো কিছু কি করে বলতে পারেন?”
“ট্রিক। মাইন্ড রিডিং, ম্যানুপুলেশন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অবজারবেশন, লজিক - ওহে ছোকরা আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। প্যারা সাইকোলজির উপর কাজ করেছি। এই দেশে এসব কিছুর মূল্য নেই। চাকরি নেই। টাকার অভাবে যখন ট্রেন স্টেশনে ঘুমালাম তখন আমার মাথায় এই বুদ্ধি এসেছে। ওখানে একজন তাবিজ দিত। মানুষ সেই তাবিজ কিনতো, আর বলতো আমি সফল হলে আপনাকে খুশি করে দিব। সেখান থেকেই এই ব্যবসা।”
“আর ওই ডিম আর চুল?”
“ওগুলো ট্রিক ছিলো। আসল ডিম নয় ওগুলো।”
“আমাকে এগুলো বলছেন কেন?”
পড়াবাবা হাসতে হাসতে বললেন,
“কারণ তুমি বাজারের শ্রেষ্ঠ বোকা। তাই বলছি। নয়তো কেউ নিজের মনের অনুভূতি বুঝতে পারে না?”
জাওয়াদ তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বলছেন উনি? পড়াবাবা জাওয়াদের কাধে হাত রেখে হতাশ স্বরে বললো,
“আমি তোমাকে লালার ট্রিকটা বলেছিলাম এই ভেবে যেন তুমি মেয়েটিকে চুমু খাও। চুমু খাবার পর তোমার মনের দ্বিধা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি একটা বেকুব।”
“মানে?”
“মানে হলো তোমার কেসটা প্রেম সংক্রান্ত ছিলো। স্বপ্ন টপ্ন সবই তোমার আবেগের জর্জরিত অবচেতন মনের কারসাজি। তোমার বেড়ে উঠা ভিন্ন ভঙ্গিতে। তোমাকে ছোটবেলা থেকে বলা হয়েছে "ইউ হ্যাভ টু বি এ গুড বয়"; এটাই তোমার জীবনের মটো। তুমি সেটাই সারাজীবন করেছো। সবার চোখের নিজের একটা আলাদা ইমেজ তৈরি করেছে। সেকারণে তোমার মাঝে দম্ভের জন্ম। তোমার ধারণা তোমার এই গুড ভয় ইমেজ আর সৌন্দর্য্যের জন্য সবাই তোমার দেওয়ানা। তোমার ধারণা তুমি কারোর প্রতি দূর্বল নও। তুমি তোমার মনে বিরাজ কর, কিন্তু তোমার মনে রাজ করার কেউ নেই। সে কারণে তুমি কারোর প্রেমে পড়ো না। কারোর প্রতি দূর্বলতা তৈরি হয় না। কিন্তু তোমার এই আত্মপ্রেমী হৃদয়কে গ্রাস করলো পনেরো বছরের চিংকি। রোজালিন্ড কার্টরাইট এর মতে আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে অবচেতন মনের আবেগজনিত অভিজ্ঞতাকে প্রক্রিয়া করতে সাহায্য করে। তুমি যখন প্রথম চিংকির মেয়েটাকে নিয়ে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিলে সেটা ছিলো তোমার অবচেতন মনের আবেগ। অবচেতন মন একটা রহস্যের খনি। সে হুটহাট খেলা খেলে। খেলা খেলতে সে মজা পায়। চেতন মনকে আমরা শাসন করতে পারি, বাধা দিতে পারি কিন্তু অবচেতনকে নয়। তোমার বাবা যখন তোমার বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লাগলো তখন তোমার অবচেতন মন চিংকিকে অংকন করলো। তার সাথে বিয়ের একটি স্বপ্ন দেখালো। এটার অবশ্য কোনো সঠিক ব্যখ্যা আমি দাঁড় করাতে পারিনি। আমার ধারণা চিংকি-ই প্রথম রমনী ছিল যার সাথে তুমি খারাপ আচারণ করেছিলে। অবচেতন মনে সেই স্মৃতিটার জন্য অপরাধ বোধ সৃষ্টি হয়েছে। সেই অপরাধ বোধ থেকেই তোমার অবচেতন মন তোমাকে এই স্বপ্ন দেখিয়েছে। স্বপ্নে তোমাকে চিংকি বলেছে সে তোমার থেকে বদলা নিবে। তুমি ভয় পেয়ে গেলে। এটাকে "মুড কনগ্রুয়িটি ইফেক্ট" বলে। ভয় ভীতি থেকে মানসিক অবস্থার অধঃপতন, সেই থেকে তোমার বাস্তব জীবনে তার প্রভাব। তোমার প্রেমিকার সাথে ব্রেকাপটা আগেই হত। কিন্তু স্বপ্ন দেখার পরদিন হয়েছে বলে তুমি মেনে নিয়েছো সেটা স্বপ্নের জন্য। বাকি ঘটনাগুলোও তেমন। যেদিন তুমি চিংকির দেখা পেলে তার প্রতি তোমার আবেগ ঘন হলো। অবচেতন মন তার প্রতি ঝুঁকলো। সে ক্ষণে ক্ষণে তাকে দেখতে চাইতো। অকারণেই তার সান্নিধ্য চাইতো। এসব কারণে সে তোমাকে বোকা বানালো। কিন্তু চেতন মন তো দৃঢ়, সে চিংকির প্রেমকে অস্বীকার করলো। সেই চেতন আর অবচেতনের দ্বন্দ্বে তুমি ফেঁসে গেলে। এখন যখন স্বপ্নে সে দেখা দিচ্ছে না। অবচেতন মন তাকে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে নিয়ে এসেছে।”
জাওয়াদ মাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার অনুভূতিগুলো কেমন জট পেকে গেছে। সে কি সত্যিই চিংকির প্রেমে পড়েছে? তাহলে সেটাকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন? পড়াবাবা ধীর স্বরে বললেন,
“তুমি চিংকির প্রেমে আকন্ঠ ডুবেছো জাওয়াদ। রিয়েলিটি মেনে নেও। অহেতুক দ্বন্দ্ব কর না। ভাব তো চিংকির সাথের মুহূর্তগুলো তোমার কাছে কি বিরক্তিকর? তার সাথে কথা বলতে, তার সান্নিধ্যে থাকতে তোমার কি ভালো লাগে না?”
“লাগে। সেটা তো আমার সবার সাথেই লাগে।”
“উহু সবার সাথে লাগে না জাওয়াদ। আচ্ছা ধর, চিংকির সাথে কাটানো এই মুহূর্তগুলো তুমি কি কখনো তোমার এক বছরের প্রেমিকা শাম্মীর সাথে কাটিয়েছো? তার মান ভাঙ্গতে তার বাড়ির নিয়ে শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে জ্বর বাঁধিয়েছো?”
“সেগুলো তো স্বপ্নের জন্য।”
পড়াবাবা হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“আসলেই তুমি নির্বোধ, ছাগল, গাধা—একটা গন্ডমূর্খ।”
জাওয়াদ চুপ করে রইলো। পড়াবাবা এবার থমথমে স্বরে বললো,
“আচ্ছা, ভাব তো চিংকির সাথে তুমি একটা লম্বা বাইক ড্রাইভে যাচ্ছো কেমন লাগবে?”
“ভালো।”
“এবার ভাব চিংকি অন্য একজন পুরুষের সাথে লম্বা বাইক ড্রাইভে যাচ্ছে তোমার কেমন লাগবে?”
জাওয়াদের কপাল কুঁচকে গেলো। সে উত্তর দিলো না। পড়াবাবা ধীর স্বরে বললেন,
“ভাব, অন্য একজন পুরুষের সাথে চিংকি রাতভর কথা বলছে, তার সাথে মেলায় ঘুরতে যাচ্ছে, তার জন্য গিফট কিনছে, তার জন্য চিঠি লিখছে, তাকে চুমু খাচ্ছে—কেমন লাগবে? চিংকির বিয়ে অন্য একজনের সাথে হচ্ছে। সে অন্য কাউকে ভালোবাসছে। আর তুমি তার ত্রিসীমানায় কোথাও নেই। তার জীবনে তোমার অস্তিত্ব নেই। তার চিন্তাচেতনায় তোমার অস্তিত্ব নেই। তুমি কোথাও নেই।”
জাওয়াদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তার চোখ কাঁপছে। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ। মুখশ্রীতে সূক্ষ্ণ যন্ত্রণার ছাপ। পড়াবাবা হাসলেন। মৃদু স্বরে বললেন,
“এখনো বলবে চিংকিকে ভালোবাসো না?”
“সেদিন এগুলো কেন বুঝাননি? কেন ভুংভাং বলেছিলেন।”
খুব ধীর স্বরে শুধালো জাওয়াদ। কণ্ঠে বিরহের ছাপ। পড়াবাবা বললো,
“তুমি জাদুর পরিত্রাণে এসেছিলে জাওয়াদ। প্রেম খুজতে না।”
“আজ কেন?”
“ঐ যে তুমি বাজারের সবচেয়ে বড় গাধা। দয়া হল। সবাই নিজের স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পায় না জাওয়াদ। তুমি পেয়েছো। হারিও না। আমি আসছি। ওসি এসে আমাকে না দেখলে গোসা করবেন।”
পড়াবাবা চলে গেলেন। জাওয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। সে ভালোবাসে চিংকিকে। কিন্তু চিংকি যে তার প্রতি বিশাল চায়নার প্রাচীর তুলে দিয়েছে। সেটা রুখবে কি করে? চিংকি তাকে ঘৃণা করছে না, অভিমান করছে না, অভিযোগ করছে না। চিংকির জীবনের কোথাও সে নেই। নিজের দোষে সব নষ্ট করে দিয়েছে সে। কি করে আবার সব ঠিক করবে? চিংকি কি বুঝবে তার মনের ব্যথা? ক্ষমা করে ভালোবাসবে কি তাকে?
.
.
.
চলবে.........................................................................