চোখের পলকে মিলি বেগমের হাত উঠে গেলো। তবে ক্ষণেই নিজেকে বাধা দিলেন তিনি। এত বড় মেয়ের গায়ে হাত উঠাতে নেই। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করলেন। তবে পারলেন না। ক্রোধিত গলায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
"কোন সাহসে তুই আর স্মরণ প্রেম করছিস নীলিমা? বল?"
নীলিমা জবাব দিলে না। নত চাহনিতে দাঁড়িয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রইলো। মিলি বেগম ফের জিজ্ঞেস করলেন,
"কি হলো? বল। কি ভেবে তুই আর স্মরণ প্রেম করছিস? তুই জানিস স্মরণ কে? স্মরণ তোর মামাতো ভাই হয়। ওর সাথে প্রেম করলিই বা কি করে?"
নীলিমা নীরব। চোখ দুটো ছলছল করছে। কখন যেনো টুপ করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে! মিলি বেগম এবার নিজেকে খানিক ঠান্ডা করলেন। তবে রোষাগ্নি স্বরে বললেন,
"তোকে স্বাধীনতা দিয়েছি মানে এই না যে প্রেম করে বেড়াবি। সেটাও আবার মামাতো ভাইয়ের ছেলের সাথে। কই আমাদের বংশে তো কেউ প্রেম করেনি! সবাইকেই আব্বা আম্মা নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছে। নওরীনকে দেখ, ওকেও তো আমরা পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছি। সেখানে তুই প্রেম করতে গেলি কেনো?"
বলেই তিনি নীলিমার বাহু চেপে জোর দিলেন। বললেন,
"কতদিনের প্রেম তোদের? বল? কই এতগুলো বছরেও তো তোকে প্রেম করতে দেখলাম না? নাকি আমাদের আড়ালে আরও আগে থেকে তোরা দুজন প্রেম করেছিস?"
নীলিমা এবার কেঁদেই দিলো। তার দু চোখ বেয়ে অশ্রুকণা ঝরে পড়ছে। নাক লাল টুকটকে হয়ে এলো। এ দেখে মিলি বেগমের সামান্যতম মায়াও হলো না। তিনি পূর্বের ন্যায়ই বললেন,
"কি হলো বল? জবান খুলে না এখন? জবাব দিচ্ছিস না কেনো?"
নীলিমা কম্পমান সিক্ত গলায় বললো,
"না আম্মু।"
মিলি বেগম এবার গর্জে উঠলেন,
" 'না আম্মু' কি! পুরো জবাব দে। ভালোভাবে দে।"
মায়ের কথায় কেঁপে উঠলে নীলিমা। নাক টানলো সে। এখনও অব্দি সে কান্না করছে৷ তার কান্নার গতি বাড়ছে বৈ কমছে না। বললো,
"তুমি যা ভাবছো তা না আম্মু। আমি আর স্মরণ ভাই দু মাসেরও কম সময় ধরে ইনভলভড।"
মিলি বেগম এবার নীলিমার বাহু ছেড়ে দিলেন। তাঁর কণ্ঠও কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়লো এবার। অর্ধ সিক্ত গলায় বললেন,
"কিভাবে তোরা প্রেম করলি রে নীলু? তোর দাদাবাড়ি, নানাবাড়ির কেউ কি কখনো এভাবে মামাতো চাচাতো ভাইদের সাথে প্রেম করেছে, দেখেছিস? আমাদের কারোর বংশেই তো এমন ভাইবোনের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে নেই। তুই কি একবারো এ নিয়ে ভাবিসনি?"
নীলিমা জবাব দেয় না। ঠিক এসব কারণেই সে স্মরণকে বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছিলো। সে জানে এ নিয়ে বড় ধরণের ঝামেলা বাঁধবে। কিন্তু তাই বলে এত দ্রুত!
মিলি বেগম এবার লম্বা লম্বা শ্বাস টানলেন। অতঃপর নীলিমাকে বললেন,
"স্মরণকে বাসায় ডাক।"
নীলিমা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। তার কান্না থেমে গিয়েছে মুহূর্তেই। মা'কে জিজ্ঞেস করলো,
"কেনো আম্মু? স্মরণ ভাইকে কেনো ডাকছো?"
মিলি বেগম ক্রোধাগ্নি গলায় বললেন,
"কত বড় সাহস তোর! ভুল করে আবার বড় গলায় কথা বলছিস! তোর ফোনের লক খোল এখনই। আমিই বলছি ওকে।"
নীলিমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনের লক খুলে দিলো। মিলি বেগম স্মরণকে কল করলেন। স্মরণ নীলিমা ভেবে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
"কি ব্যাপার নীলি? এখন ফোন দিলে যে? ভার্সিটিতে যাওনি?"
"আমি নীলির মা বলছি স্মরণ।"
আকস্মিক মিলি বেগমের কণ্ঠ শুনে থতমত খেলো স্মরণ। নড়ে চড়ে বসলো সে। আমতা আমতা করে বললো,
"ফু- ফুপি? আপনি?"
"হ্যাঁ আমি। কোথায় তুমি?"
"অফিসে ফুপি।"
"সন্ধ্যায় অফিস থেকে সোজা আমাদের বাসায় আসো।"
"আপনাদের বাসায়? কেনো ফুপি? কোনো সমস্যা?"
"সমস্যা যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। তুমি না এলে আরও সমস্যা হবে। এজন্য বলছি দেরি না করে চলে এসো। তোমার ফুপা ঢাকায় নেই। তাই বাসায়ই ডাকছি। কথা বলতে সুবিধা হবে।"
স্মরণ ঢোক গিললো। সে বুঝে গিয়েছে মিলি বেগম কি নিয়ে কথা বলতে ডাকছেন ওকে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। কি আশ্চর্য! এভাবে তো ভয় পাবার কথা না। পরিবারের একজনই মাত্র জেনেছে। তাতেই এ অবস্থা! না জানি সবাই জানলে কি হবে! স্মরণ ঢোক গিলে বললো,
"আচ্ছা ফুপি।"
মিলি বেগম আর কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দিলেন। নীলিমার দিলে রোষাগ্নি চাহনিতে চেয়ে বললেন,
"আপাতত ফোন আমার কাছেই থাকবে।"
বলেই তিনি চলে গেলেন। মিলি বেগম যেতেই দরজা আটকে কান্নায় ভেঙে পড়লো নীলিমা। তার মনে হচ্ছে সবকিছুই বোধহয় শেষ। এতদিন যাবত দেখে আসা সংসারের স্বপ্ন বোধহয় চোখের পলকে শেষ হয়ে গেলো।
-----------------
স্মরণ অস্থিরতা নিয়ে বসে আছে সোফায়। তার চেহারায় শঙ্কার ছাপ স্পষ্ট। ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করছে। আজ যে ছোটখাটো কোনো অঘটন হবে এটার আঁচ করতে পারছে সে।
মিলি বেগম বসে আছেন সোফায়, স্মরণের ঠিক বিপরীতে। আর নীলিমা বসে আছে তার পাশে। তার মাথা নত, দৃষ্টিতে তীব্র অপরাধ বোধ। আফসোস হচ্ছে সে দিনটির জন্য যেদিন স্মরণকে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছিলো সে।
মিলি বেগম বেশ কিছুক্ষণ নীরবে থেকে অতঃপর গলা পরিষ্কার করলেন। গমগমে স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
"তোমরা দুজন কি কাজ করেছো জানো স্মরণ?"
স্মরণ ঢোক গিললো। বুকে কিঞ্চিত সাহস জুগিয়ে বললো,
"ফুপি, আমি জানি আমরা কি করেছি। কিন্তু এতে ভুল কোথায়? আমি তার নীলিমা একে অপরকে পছন্দ করি।"
মিলি বেগম গর্জে উঠলেন,
"ভুল! এখন কি তোমরা কোথায় ভুল করেছো সেটাও ধরিয়ে দিতে হবে? এটুকু বোঝার বুদ্ধিশুদ্ধি হয়নি তোমাদের? আমাদের বংশে কখনও প্রেম করে বিয়ে করতে দেখেছো? তার উপর এমন মামাতো ফুপাতো ভাই বোন!"
স্মরণের বাকি কথাগুলো বলতে বেশ ভয় হচ্ছে। কারণ মিলি বেগমের ক্রোধ যেনো ধীরে ধীরে আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। তাঁর চাহনি, মুখের ভাব সবটাই নেতিবাচক ইশারা দিচ্ছে। স্মরণ তবুও সাহস নিয়ে বললো,
"এটাতে খারাপ কিছু নেই তো ফুপি৷ এমনও তো না যে আমাদের ধর্মে এমনটা হারাম।"
"এখানে হারাম হালালের কথা হচ্ছে না স্মরণ। দৃষ্টিকটু জিনিস বুঝো না? আমার নিজেরই তো পছন্দ না। আর সেখানে নীলিমার বাবার রিয়েকশন কেমন হবে বুঝতে পারছো?"
স্মরণ আর কোনো পন্থা চেষ্টা করে দেখতে চাইলো না। সোজা উঠে গিয়ে মিলি বেগমের সামনে দু হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো। অনুনয়ের দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
"ফুপি? কার কাছে ব্যাপারটা কেমন দৃষ্টিকটু এটুকু ভাববার আগে কি এটা ভাবা উচিত না আপনার মেয়ে কেমন ছেলের কাছে যাচ্ছে? আপনার মেয়েকে কতোটা ভালোবাসে সে?"
স্মরণ এবার মিলি বেগমের হাঁটুতে দুই হাত রাখলো। চাহনিতে নম্রতা ও তীব্র অনুনয় নিয়ে বললো,
"আমি নীলিমাকে অনেক ভালোবাসি ফুপি। ও জানে আমি কতোটা ডেস্পারেট ছিলাম ওকে পাওয়ার জন্য৷ আমি জানি আমাদের বিয়ে অসম্ভব কিছু না। শুধু আপনাদের রাজি করানোটা একটু টাফ, এই তো। আর আমি তো এই ঈদে বলতেই যাচ্ছিলাম। সামনের সপ্তাহে আমার প্রমোশন হবে ফুপি। বেতনও বাড়বে। বিয়ের পর নীলিমাকে আমি ভালো একটা বাসায় তুলতে পারবো।"
মিলি বেগম এবার কিছুটা নরম হলেন। কণ্ঠে কিঞ্চিৎ শান্ত ভাব এনে বললেন,
"দেখো স্মরণ, তুমি যত যা-ই বলো না কেনো ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।"
"ফুপি আপনি এসব পারিপার্শ্বিক ব্যাপার সাইডে রেখে শুধু নীলিমার ভালো চিন্তা করুন। আপনার যদি মনে হয় আমি খারাপ ছেলে, নীলিমার যোগ্য নয়, তবে নির্দ্বিধায় 'না' বলতে পারেন। কিন্তু এসব ছোট ছোট ব্যাপারকে ইস্যু বানিয়ে নীলিমা ও আমার ভবিষ্যত নষ্ট করবেন না ফুপি।"
মিলি বেগম নিশ্চুপ রইলেন। তিনি স্মরণের চরিত্র, আচরণ সম্পর্কে অবগত আছেন। ভাগ্নেকে দেখছেন ছোটবেলা থেকে। স্মরণকে ভালো ভাবে চিনেন তিনি। সেক্ষেত্রে স্মরণের চরিত্রের গ্যারান্টি দিতেও তিনি দ্বিধাবোধ করবেন না। যে কোনো মেয়ের মা স্মরণকে নিজের জামাই বানাতে চাইবেন। ছেলেটার যেমন চেহারা সুরত, তেমন আচরণ, তেমন ভালো চাকরি আছে। কে না চাইবে স্মরণকে নিজের মেয়ের জন্য নির্বাচন করতে! কিন্তু মিলি বেগম পারছেন না। স্মরণের কথামতো পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো পাশ কাটিয়ে যেতে পারছেন না তিনি৷ উপরন্তু নীলিমার বাবা কিছুতেই এ বিয়েতে রাজি হবেন না। তাহলে উপায়!
ওদিকে নীলিমা নীরবে চোখের জল ফেলছে। স্মরণের কথাগুলো তাকে দূর্বল করে দিচ্ছে। অথচ সে এ সম্পর্কের ভবিষ্যত দেখতে পারছে না।
মিলি বেগম ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ছেন। স্মরণের চোখের চাহনি বলে দিচ্ছে সে কতোটা সত্য বলছে, নীলিমাকে কতোটা ভালোবাসে সে। কিন্তু স্বামীর কথা ভাবলে এসব নিয়ে আর চিন্তাভাবনা এগুতে পারেন না তিনি। এ পরিস্থিতিতে মিলি বেগম পড়লেন অথৈ সাগরে।
------------------
বাহাদুর শেখ আজকাল নড়াচড়া কম করেন। শরীরটা যেনো জ্যাম হয়ে আসছে দিনকে দিন। এ নিয়ে আবার আসমানী বেগমের যত্নের কমতি নেই। এই বয়সে এসেও স্বামীর সেবা শুশ্রূষায় দিন কাটে তাঁর।
মাগরিবের নামাজ পড়ে বসে আছেন দুজন। আসমানী বেগম তসবি তিলাওয়াত করছেন। বাহাদুর শেখ বসে আছেন কিছু বলার জন্য। আসমানী বেগম বেশ কিছুক্ষণ ধরেই ব্যাপারটা খেয়াল করছেন। এক পর্যায়ে তিলাওয়াত থামিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেই বসলেন,
"তুমি কি কিছু কইবা?"
বাহাদুর শেখ তাঁর অর্ধ কম্পিত গলায় বললেন,
"মানতাসার তো বিয়া হয়ে গেলো আনোয়ারের মা। এবার আছে আমাগো নীলু। ওরেও তো বিয়া দিতে হইবো।"
"তা তো ঠিক কইছো। ওর মা বাপরে বলা লাগবো ছেলে খুঁজার জন্য।"
"আরে ছেলে খুঁজা লাগবো ক্যান৷ কোলের কাছে ছেলে থাকতি ছেলে খুঁজবা ক্যান।"
আসমানী বেগম জিজ্ঞাসু চাহনিতে চেয়ে বললেন,
"কার কথা বলতেছো তুমি?"
বাহাদুর শেখ দূর্বল হাসলেন। বললেন,
"স্মরণ।"
আসমানী বেগম বিস্মিত হলেন। বললেন,
" স্মরণ!"
"হুম। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবো। আর কোনো চিন্তাই নাই।"
"এইডা ঠিক কইছে। কিন্তু ওগোর মা বাপের যেমন লাগে!"
"ওগোর কথা বাদ দাও। সংসার করবে আমার নাতি নাতনি। ঐ দুইডার কথায় কি সংসার চলবে নাকি! এবার কও, আমার নাতনির সাথে তোমার নাতির বিয়া দিবা দিল?"
.
.
.
চলবে.........................................................................