আশিয়ানা - পর্ব ৯২ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


চারদিন পর প্যারিস থেকে ফিরল তূর্ণ! নিজ গৃহে ফিরে মানসিক শান্তি পেল ও। সময়টা এমন হয়েছে যে ঘর ছাড়া বাহিরে কোথাও ভালো লাগে না। দিনের সমস্ত পরিশ্রম শেষে স্ত্রীর মুখখানা দেখলে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ছোট্ট মেয়ে যখন বাবা ডাকে তখন মনে হয় হৃদপিণ্ডটা হাতে চলে আসছে। ব্যক্তিগত কাজ পাশে রাখল তূর্ণ। বহুদিন পর পরিবার নিয়ে বাহিরে বের হবে সে। একা নয়, বন্ধুদের ও সঙ্গে নিবে। সেহরিশ আর সাদাফ কে কল করে রেস্তোরাঁর নাম বলল। আজ বিকালেই যাবে। 

দুপুরের খাবার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর বের হওয়ার জন্য রেডি হয়ে যায় তূর্ণ। জুবিয়া, সোহাকে রেডি করে তূর্ণর কোলে দিয়ে সে রেডি হতে লাগল।

তূর্ণ সোহার গালে হাত রেখে বলল, 
   'তুমি বাবাকে বেশি ভালোবাসো নাকি মা-কে?'

সোহা ঠোঁট উল্টিয়ে ফেললো। তূর্ণর প্রশ্নের উত্তরে সে বলল,
  'বাবা।'
তূর্ণ হেসে উঠল। সোহাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। সিড়ির কাছাকাছি আসতেই ফোন বাজতে লাগল। সাদাফ ইতিমধ্যে রেস্তোরাঁয় পৌঁছে গেছে অথচ ওদের দুজনের খবর নেই। রাগে, ক্ষোভে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিল সাদাফ। 

তূর্ণ বলল, 
  'আমার বউ এখনই রেডি হয় নাই। তুই সেহরিশকে কল কর।'

সাদাফ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, 
  'কল করে ছিলাম। ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।'

তূর্ণ বলল, 
  'ওও, তাহলে চলে আসবে। আমরাও আসছি।'

সাদাফ কল কাটলো। একা একা বসে থেকে বোর হচ্ছে রেস্তোরাঁর ভেতর ঘুরে দেখার জন্য উঠে দাঁড়াল।

রাস্তার দু'ধারে উঁচু উঁচু বিল্ডিং। বেশ কয়েকটা বাড়ির পরের গলিতে রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁর সামনের গলিতে গাড়ি পার্ক করল সেহরিশ। বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় টেবিল চেয়ার পাতা।পশ্চিম দিকের কর্ণারের একটা টেবিলে বসে আছে ওরা। সেহরিশ, রোদেলাকে নি ওদের কাছে গেল। দু'জনে চেয়ার টেনে বসল। সোহা ওর চেয়ার থেকে নেমে রোদেলার দিকে ছুটে গেল। রোদেলা তাকে কোলে নিল। সোহা রোদেলা কে পেলে অনেক অনেক কথা বলতে চায়। কয়েকটা কথা স্পষ্ট আর বাকি কথা সোহা ছাড়া কেউ বোঝে না।

তূর্ণ পিঞ্চ মে'রে শুধাল,
  'তুই আমার আগে বেরিয়েছিস। তাহলে, আসতে এতো দেরি হলো কেন?'

সেহরিশ তাকাল তূর্ণর দিকে। তারপর শক্ত গলায় বলল, 
  'আমার বাড়ি থেকে এই জায়গাটা অনেক দূর।'

সাদাফ তূর্ণর উদ্দেশ্য বলল,  
  'প্যারিসের প্রোগ্রাম কেমন ছিল?'

তূর্ণ মাথা নাড়লো, 
  'সবই ঠিক আছে। কিন্তু তোদের অনেক মিস করেছি। আর একটা কথা ক্রিস্টিয়ানো এরচেন এইবার ওর গেস্ট হাউজে পার্টির আয়োজন করবে। আমাদের সবাই কে পরিবার নিয়ে যেতে হবে। যদি কেউ না যায় তাহলে পরবর্তী সময়ে তাকে ডাকা হবে না। সদস্যদের নাম কাটা হবে।'

সেহরিশ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
  'আমরা যাবো। '

সাদাফ সোজা হয়ে বসল। চা বানানোর জন্য একটু ঝুঁকলো সে। সেহরিশ চারপাশে চোখ বুলিয়ে মেনু কার্ড হাতে নিল। পছন্দ মতো খাবার খুঁজতে লাগল। অর্ডার লিখার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন ওয়েটার বয়। রেস্তোরাঁর একটা সুন্দর দিক আছে। অনেকের কাছে অদ্ভুত লাগে। খাবার টেবিলের মাঝখানে চা-কফি বানানোর ব্যবস্থা করা। এখানকার অতিথিদের চা-কফি নিজেদের বানাতে হয়। তূর্ণর জায়গাটা ভীষণ পছন্দের। সাদাফ আসার পরপর জায়গাটা ঘুরে দেখেছে তার-ও মন্দ লাগেনি। 
সাদাফ বলল,
  'এই রেস্টুরেন্টের মালিক খুব শৌখিন! তার রেস্তোরাঁয় অনেক কিছু দেখার আছে। দক্ষিণ পাশে বইয়ের লাইব্রেরী। আর মালিক নিজেই কবি! যারা সাহিত্য ভালোবাসে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে বসে বসে চা পান করে, বই পড়ে।'

সেহরিশ দু'বার মাথা নাড়লো। ওয়েটার বয়, সেহরিশের দিকে বারবার তাকাচ্ছে, কিছু বলতে চাচ্ছে। জড়তা কাটিয়ে ইংরেজিতে বলল,
  'স্যার, আমি আপনাদের অনেক বড় ফ্যান। আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিবেন প্লিজ?'

ওয়েটারের কথায় ওর দিকে তাকাল সবাই। সে তখন অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে ফেলল। মনে মনে ভাবলো, সে বোধহয় ভুল সময়ে এই অনুরোধটা করেছে। তার এই কথা এখন বলা উচিত হয়নি। সেহরিশ তাকে অবাক করে দিয়ে বলল,
  'অটোগ্রাফ দিবো কিসে? সাথে কোন কাগজপত্র নেই।'

ওয়েটার বয়ের মুখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল। যেনো সূর্যের কিঞ্চিৎ আলো উপচে পড়েছে ভেজা বালুতে। সে হাসিহাসি মুখে বলল, 
  'এক মিনিট সময় দিন স্যার, আমি এখনই কাগজ নিয়ে আসছি।'
মিনিট দুই ঘুরতে সে একটা কাগজ নিয়ে এল। সেহরিশ, তূর্ণ আর সাদাফ অটোগ্রাফ দিয়ে তার সঙ্গে একটা সেলফিও তুললো।

রোদেলা সাদাফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
  'উমাইয়া কে রেখে আসলেন কেন? ওকে ছাড়া ভালো লাগছে না।'

সাদাফ ম্লান কণ্ঠে বলল, 
  'ও বাড়ি থেকে বের হতে চায় না। আমি অনেকবার বলেছি রাজি করাতে পারিনি।'

দুজন ওয়েটার সাবধানে খাবার সার্ভ করে। সে-সময় একটা ছেলে ওদের দিকে এগিয়ে আসলো। ছেলের বয়স আনুমানিক তেরো কিংবা চৌদ্দ বছর। সেহরিশ কে দেখে একগাল হাসি উপহার দিল। সেহরিশ সহ অন্যরাও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা ভাবলো কোনো ফ্যানবয়। ছেলেটার মুখে কোনো কথা নেই। সে শুধু হাসছে।

একজন ওয়েটার বলল,
  'ও আপনাদের অনেক বড় ফ্যান! সারাক্ষণ আপনাদের গান শুনে, ড্যান্স দেখে। আমাদের রেস্তোরাঁর একজন মহিলা স্টাফের নাতি ও।'

সেহরিশ ভ্রুকুটি করল। বলল,
  'তোমাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।'

ছেলেটার হাসি চওড়া হলো। এতক্ষণে সে বলল, 
  'আমি ইফান।'

সেহরিশ মনে করতে পারল না। তার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া দ্বিগুন কুঁচকে গেল। এ-সময় এখানে এল ইফানের বড় ভাই। ইভান। সেহরিশ কে দেখে তার মুখেও হাসি ফুটলো। দ্রুত দৌঁড়ে কাছে এলো সে। দু'জন কে একসঙ্গে দেখে বিস্মিত সেহরিশ।

ইভান বলল,
  'স্যার৷ আজ কতগুলো বছর পর আবার আপনাকে দেখছি। আপনি সেদিন ঝড়ের রাতে আমাদের ছাতা দিয়ে ছিলেন।'

ওদের কথা শুনে অতীতের কথা মনে পড়ল সেহরিশের। রাস্তার পাশে ওদের দু'জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও একটা ছাতা এগিয়ে দিয়ে ছিল। অপরিচিত বলে ওরা সেহরিশের সঙ্গে যেতে চায়নি। পাঁচ বছর আগের কথা! এই পাঁচ বছরে ওরা দুজন অনেক বড় হয়েছে। এজন্য প্রথম দেখায় চিনতে পারে নি। সেহরিশ চিনতে পেরে মৃদু হাসলো। ওদের সঙ্গে কথা বলে অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। 

ইভান বলল, 
  'সরি স্যার! আমরা সেদিন রাতে আপনাকে চিনতে পারিনি। তাই আপনার সঙ্গে ওইভাবে কথা বলেছিলাম। আমরা এতগুলো বছর শুধু আফসোস করেছি।'

সেহরিশ ওদের মাথায় হাত রেখে বলল, 
  'তোমাদের কোনো দোষ নেই। প্রতিটা বাচ্চার তোমাদের মতো হওয়া উচিত। অপরিচিত লোকেদের সঙ্গে যাওয়া সত্যি বিপদজনক হতে পারে। বলা যায় না, কার মনে কি চলছে?'

ইফান বলল,
  'সেদিন রাতে আমাদের দাদিমা নিতে গেছিল একটু দেরিতে। আবহাওয়ার জন্য রাস্তায় দেরি হয় ওনার। আমাদের হাতে ছাতা দেখে দাদিমা অনেক অবাক হন। বাড়ি যাওয়ার পর আমাদের মা-বাবা ছাতার ওপর ডিজাইন ও আপনাদের নামের অক্ষর দেখে চিনতে পারে আপনাকে। কারণ আমাদের বাড়ির সবাই আপনার অনেক বড় ফ্যান। আপনাদের ছোট্ট ছোট্ট জিনিস ও লাইফস্টাইল সবকিছু লক্ষ্য করে। আমাদের মুখে ঘটনা শুনে অনেক আফসোস করে তারা। তখন আমরা ও আফসোস করি। আপনাকে চিনতে পারিনি।'

সাদাফ বলল,  
  'এখন তো আবার দেখা হয়ে গেল। এইবার না হয় আফসোসের বিষয়টা চুকিয়ে নাও।'

তূর্ণ বলল, 
  'তোমাদের মতন আণ্ডাবাচ্চা ফ্যান দেখলে আমাদের ও ভীষণ আনন্দ লাগে।'
তূর্ণর কথায় হাসির ঢোল নামলো। সবাই হাসতে লাগল। ইভান আর ইফান দুজন জমজ। এক রকম চেহারা বলে অনেকে ওদের গুলিয়ে ফেলে। সেহরিশ ওদের কে নিজেদের সাথে খেতে অফার করে। সাথে সাদাফ, তূর্ণ জোর করায় ওরা বসল। একটু পর এদিকটায় আসে ইভানের দাদিমা। একজন ওয়েটারের মুখে উনি ঘটনা শুনে তবেই আসলেন। সেহরিশের উদ্দেশ্য বললেন, 
  'মাফ করবেন স্যার, আমার নাতিরা আপনাদের অনেক জ্বালিয়েছে। ওরা কখনো এমন করে না। ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। দয়া করে মালিকের কাছে কমপ্লেইন করবেন না।'

সেহরিশ হাসি মুখে বলল, 
  'আপনি ভুল করছেন। আমরা বিরক্ত হইনি। বরং এতো বছর পর ওদের আবারও দেখে খুব ভালো লাগল। আমরা খাবারটা ও ওদের জন্য এনজয় করলাম। আপনি চিন্তা করবেন না আমার কমপ্লেইন করব না। বরং ফাইভ স্টার রিভিউ দিয়ে যাব।'
বৃদ্ধা তৃপ্তির সঙ্গে হাসলেন।
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp