মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৪৮ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


অনন্যা শুকনো বাথরোব পরে বাথরুমের টুলে বসে আছে। ভেজা চুল থেকে পানি টপটপ করে পড়ছে, কিন্তু সে তা খেয়াল করছে না। দুই হাত উঁচু করে আঙুলের ফাঁক গলে ছাদের জোনাকি ভরা আকাশটা দেখতে ব্যস্ত সে। আচমকা ডান হাতের দুই আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে কৌশিক স্যারকে দেখা গেলো। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্যার, অন্ধকার বাথরুমেও তার চোখ দিয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে। হাত দুটো পেছনে রাখা, ওলোটপালোট চুল থেকে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। অনন্যা বিস্ময়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল।

কোনো পূর্বভাষণ ছাড়াই কৌশিক ধীরে সুস্থে অনন্যার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে এলো। নিঃশব্দে, নিখুঁত ভাবে, প্লাটিনামের একটি রিং তার বাম হাতের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিলো। ঠান্ডা ধাতুর স্পর্শে অনন্যার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে তার।

কৌশিক নিচু হয়ে অনামিকা আঙ্গুলে চুমু খেলো, ফিসফিসিয়ে বললো,
তোমার মামার বাসায় আরো আগেই যেতাম, কিন্তু মাঝরাস্তায় শোরুমটা চোখে পরলো। এজন্য আসতে দেরি হয়ে গেছে।

অনন্যা হতবাক হয়ে হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে রইল। আঙুলের ওপর চিকচিক করছে প্লাটিনামের রিংটা, মনে হলো এক টুকরো চাঁদ ধরা পড়েছে তার হাতের আঙুলে। কয়েক মুহূর্ত সে নিঃশব্দ, তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
"স্যার! আপনি এতটা রোমান্টিক! আমি ভেবেছিলাম, আপনি তো ফিলিংসের ফও বুঝেন না। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, বুঝতে পারছি, আপনি তো এই সাবজেক্টে পিএইচডি করে এসেছেন!"

কৌশিক হেসে ফেললো,
"পিএইচডি করার দরকার পড়েনি। তুমি একদিন বলেছিলে, আমার মন আছে। তারপর আমিও নিশ্চিত হলাম, সত্যিই আমার মন আছে! মন যেখানে টানছে, সেখানে যাচ্ছি। যা মন চায়, তাই করছি। আর তুমিও আমার মনের ইচ্ছার একমাত্র ভুক্তভোগী।"

অনন্যা কিছুক্ষণ বিস্তৃত হাসলো, হঠাৎ মুখ লটকিয়ে বললো,
" কিন্তু আমি তো কিছুই দিলাম না আপনাকে!"

কৌশিক ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে মৃদু স্বরে বললো,
"লাগবে না।"

অনন্যা চোখ তুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো স্যারের দিকে, তারপর আলতোভাবে হাত বাড়িয়ে স্যারের গালে হাত রাখলো। উষ্ণ কণ্ঠে বললো,
"শুনুন, কাল থেকে আমি নিয়মিত টিউশনিতে যাবো। দরকার পড়লে আরো খুঁজব, একদম কামাই করবো না। তারপর টাকা জমিয়ে আপনার জন্যও এমন একটা রিং কিনবো। ওকে?"

কৌশিক মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দিলো,
"তোমার টিউশনি করার কোনো দরকার নেই। আমি তোমার ব্যাংক একাউন্টে টাকা দিয়েছি। সেগুলো ব্যবহার করতে পারো।"

অনন্যার চোখ কিছুটা বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল,
"আমার ব্যাংক একাউন্ট?"

"হ্যাঁ।"

"আমার ব্যাংক একাউন্ট আছে?"

"হুম! জানো না? উমম...কিন্তু তোমার ফোন নাম্বার সেখানে অন্যটা দেওয়া।"

"আমার ব্যাংক একাউন্ট যে আছে, এটা তো আমি আজ জানলাম।"

কৌশিক ও অবাক হলো, চিন্তিত গলায় বললো, 
"তাই? তাহলে হয়তো তোমার বাসার কেউ এটা কন্ট্রোল করে।"

"ওয়েট! এর অর্থ আমার মা বাবা ব্যাংকে টাকা পাঠাতো, আর আমি জানতাম না?"

"তোমাকে কখনো বলেনি?"

"হ্যাঁ, প্রথম দিকে বলেছিল, আমার জন্য টাকা পাঠানো হয়েছে এবং সেটা পৌঁছেছে কিনা চেক করতে। কিন্তু যেহেতু তখন আমি এত কিছু বুঝতাম না, তাই টাকা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। বিষয়টা প্রথমেই আমি মামাকে জানিয়ে ছিলাম, কারণ আমার সব দায়িত্ব তখন মামার উপর ছিল। মামাকে জানানোর পর তিনি বলেছিলেন, টাকা তার একাউন্টে এসেছে। এরপর কখনো এই ব্যাপারে কিছু শুনিনি। মা বাবাও কখনো এটা উল্লেখ করেনি। তবে আমি জানতাম না যে ব্যাংক একাউন্টটা আমার নামে ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ফোন নাম্বার আমারটা দেয়নি কেনো?"

অনন্যা কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবতে থাকলো। তারপর হঠাৎ মাথা চেপে ধরে কৌশিক স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে,
"বুঝতে পেরেছি। যখন মা বাবা চলে গিয়েছিল, আমি তখন কলেজে পড়তাম। আমার কাছে নিজস্ব কোনো ফোন ছিল না। অনেক তাড়াহুড়োর মধ্যে চলে গিয়েছিল তারা, আর আমাকে তেমন কিছু জানায়নি। আমি অনেকবার জানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই বলেনি। শুধু বলেছিল, খুব জরুরি কাজে যাচ্ছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য পরবর্তীতে মামা আমাকে ফোন কিনে দিয়েছিল। তাই হয়তো ফোন নাম্বারটা আমার দেওয়া হয়নি। আর ব্যাংক একাউন্ট হয়তো আগেই করা হয়েছিল। এই ব্যাপারে আমার কিছুই মনে নেই।"

অনন্যা মাথায় হাত চেপে পায়চারি করতে লাগলো। পরক্ষণেই ভাবলো, বাসায় একটা ফোন দেওয়া দরকার। কৌশিক অনন্যার বাহু ধরে তার সামনে আনলো।
"রিলেক্স!"

অনন্যা ঝটপট উত্তর দিলো,
"না জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাংক একাউন্টে টাকা দেওয়া ঠিক হয়নি আপনার। তাছাড়া আমার টাকার প্রয়োজন নেই। লাগলে আমি নিজেই বলবো, স্যার।"

"কিন্তু!"

অনন্যা ধীর গতিতে হাত বাড়িয়ে কৌশিকের ঠোঁটে তর্জনী আঙুল রাখল, কৌশিক কিছু বলতে গেলেই অনন্যা ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ প্রকাশ করলো, তার তর্জনী আঙুল দিয়ে কৌশিকের ঠোঁটে চাপ প্রয়োগ করে বললো,
"স্যার! আমি কোনো বাচ্চা নই। আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, জামাকাপড় দিয়েছেন, খাবারও দিয়েছেন। আমি না খেয়ে থাকছি না, রাস্তায় বসে ভিক্ষাও করতে হচ্ছে না। সেমিস্টারের ফি টা মামা দিয়েছিল, কিন্তু সামনের গুলো আমি নিজে দেবো।

আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। আপনাদের এই সাহায্য যদি চলতেই থাকে, তাহলে আমি কখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো না। তাই, প্লিজ, আর কখনো টাকা দেবেন না। আর এখন থেকে আমাকে যাতায়াতের জন্য তামংকে অপেক্ষা করতে বলবেন না। আমি এখন সাইকেল চালাতে পারি, বাসার ঠিকানাও মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। তাই আমি একাই পারবো।"

কৌশিক নিঃশব্দে অনন্যার আঙুলের দিকে তাকালো। নিজের হাতের মুঠোয় তর্জনী আঙুল নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করে দিল, আঙুলের এক পাশে ছোট্ট একটা তিল। কিছু সময়ের জন্য চুপচাপ দৃষ্টিতে সেটা দেখলো কৌশিক, তারপর আলতো করে সেখানে এক চুমু দিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
"ওকে, এস ইউর উইশ। আমি তোমাকে বাধা দেবো না।"

অনন্যা হা হয়ে কৌশিকের কান্ড কারখানা দেখছে। এই লোকটা অনন্যার ছোট ছোট বিষয় এতো নিখুঁতভাবে খেয়াল করছে। অনন্যা বিস্ময় না হয়ে পারছে না। 

বার কয়েক পলক ফেলে নিজেকে সামাল দিলো অনন্যা। মৃদু হাসল সে, তারপর মাথায় একরাশ দুষ্টুমি ভর করলো। সে পায়ের আঙুলের উপর ভর রেখে একটু উঁচুতে উঠে অনেক কষ্টে কৌশিকের থুতনিতে ওষ্ঠ ছোঁয়াল। কৌশিক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হলো, তারপর সেও দুষ্টুমি করে আরেকটু উঁচুতে ওঠার চেষ্টা করল, অনন্যা কৌশিকের নাগাল পেলো না। তাই সঙ্গে সঙ্গে বাথরোবের কলার চেপে ধরে কটমট করে তাকাল।
"নিচে নামুন।"

কৌশিক চোখে প্রশ্রয়ের ছোঁয়া নিয়ে মাথা নাড়ল, 
"না। শুধু টাকা রোজগার করলে হবে না, তোমাকে লম্বাও হতে হবে। এই দেখো, আমার সাইজের থেকে একটু নিচুতে হলেই হবে।"
কৌশিক হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো।

"হ্যাঁ?"

কৌশিক অনন্যার হাত ধরে কাছে টেনে নিল, নিজের শক্ত বাহুপাশে তাকে আবদ্ধ করল। নেশাক্ত গলায় ফিসফিস করে বলল,
"প্রিন্সেস, দেখো! তোমার মাথাটা আমার বুকের ঠিক নিচে এসে ঠেকে। যদি আর একটু লম্বা হতে, তাহলে তোমার মাথা আমার বাঁ পাশে এসে ঠেকত এন্ড ইউ ক্যান ফিল মাই হার্ট।"

অনন্যা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল, তার দেহ কৌশিক স্যারের শক্ত শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে একদম। স্যারের চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে, পানির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা উষ্ণ ত্বকের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে নামছে, অনন্যার চোখ দ্বয়ে ছোট্ট মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে সেই প্রতিটি ফোঁটা। অনন্যা ঢোক গিলে তাকিয়ে রইল সেখানে। ধীরে ধীরে দু হাত দিয়ে কৌশিককে জড়িয়ে ধরল। তার শরীর থেকে ভেসে আসা ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি গন্ধ বুক ভরে নিল। চোখ বুজে বাথরোবে মুখ গুঁজে দিল অনন্যা।

কিন্তু কৌশিক ততক্ষণে কাজে লেগে গেছে। তোয়ালে নিয়ে অনন্যার ভেজা চুল আলতো করে মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনন্যা মুখ তুলে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে দূরে সরে গেল অনন্যা। নাক মুখ কুঁচকে স্যারের কাছ থেকে তোয়ালে ছিনিয়ে নিলো। টুলটা সামনে টেনে তার উপর কষ্ট করে দাঁড়িয়ে বলল,
"লম্বা হওয়া কি আপনার হাতের চুটকি বাজানোর মতো সহজ কিছু? যে যা চাইবো তাই হয়ে যাচ্ছে ?"

কৌশিক মুচকি হাসল। প্রতিউত্তর করলো না।অনন্যা এবার কৌশিকের চুল মুছে দিচ্ছে। স্যারের চুলের পানির বিন্দু চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
কৌশিক বললো,
"তুমি কাঁদছিলে কেনো?"

অনন্যা ভ্যাবাচ্যাকা খেলো,
"কখন?"

"মামার বাড়িতে তোমার চোখ লাল দেখাচ্ছিলো।"

অনন্যা বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করলো,
"মা বাবার কথা মনে পড়ছিল।"

"ওহ!"

কৌশিক নিশ্চুপ থাকলো কয়েক মুহূর্ত। আচমকা অনন্যার হাত ধরে থামিয়ে কৌশিক বললো,
" তুমি জানতে নিক ভ্যাম্পায়ার?"

অনন্যা চমকে উঠলো। ধাতস্থ হয়ে বললো,
"না, আজকে জেনেছি।"

"তো তোমার প্রতিক্রিয়া এতো স্বাভাবিক? আর নিককে নোহারার দিকে কেনো ঠেলে দিতে চাইছো?"

টুলে দাঁড়িয়ে অনন্যা কৌশিকের থেকে লম্বা হয়ে গেছে। সে আনমনে গলায় বললো,
"দি গ্রেট মিস্টিরিয়াস ম্যানের সাথে থাকছি। প্রতি পদে পদে চমক দেখতে হচ্ছে। তার মধ্যে নিক হচ্ছে আপনার বন্ধু। নিশ্চয়ই তার মধ্যে ঘাপলা আছে নাহলে আপনার মতো প্যাঁচানো একজনের বন্ধু হতো? তাই স্বাভাবিকভাবেই নিলাম। কিন্তু খারাপ লেগেছে যখন উনি নিজের পরিচয় আমাকে বলে নি। আমি ভেবেছিলাম নিক আমার বন্ধুর মত। 

সে যাই হোক, ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে তাই নিক ভাইয়াকে বলেছিলাম সব মিটমাট করে নিতে।"

কৌশিক মাথা নাড়লো। অনন্যা আবারো চুল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কৌশিক ও হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে। তার শ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে, বুক ওঠানামা করছে অস্বাভাবিকভাবে। অনন্যা চুল মুছে ধীরে ধীরে নেমে এলো, কিন্তু স্যারের এমন নিশ্চুপ, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাকে অস্বস্তিতে ফেলল।

"স্যার?"

কোনো সাড়া পেলো না অনন্যা।

পরের মুহূর্তেই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল কৌশিক। বুকের ডান পাশ শক্ত করে চেপে ধরে চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠল, সেই শব্দ অনন্যার রক্ত জমিয়ে দিল। মনে হলো কোনো অসহনীয় যন্ত্রণা ছিঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে তার ভেতর থেকে।

অনন্যা ভয় পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে তার চওড়া কাঁধে হাত রাখল। 

"স্যার! কী হয়েছে? প্লিজ কিছু বলুন!"

কৌশিক ধীরে ধীরে মুখ তুলল। তার আকাশি মণির চোখ চোখের পলক পড়তেই দপ করে গভীর নীলে রূপ নিল। ধকধক করে জ্বলতে লাগলো মণিদ্বয়। অনন্যা শিউরে উঠল। ওর ভেতরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। তবু ভয়কে দূরে সরিয়ে আবারও কাঁপা গলায় ডাকল, 
"স্যার!"

কৌশিক এবার সাড়া দিল। কিন্তু এই সাড়া স্বাভাবিক ছিল না। তার হাত দুটো হঠাৎ করে অনন্যার কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরল। অনন্যার নিশ্বাস আটকে এল। এই দৃশ্য একবার আগেও দেখেছে সে। যেদিন কৌশিক স্যার তার গলা শক্ত করে চেপে ধরেছিল এরকমই লাগছিল তাকে।

দ্রুতগতিতে হাত বাড়িয়ে তার গালে হাত রাখল অনন্যা, কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, 
"স্যার! আপনি ঠিক আছেন?"

কৌশিকের চোখের নীল আগুন তীক্ষ্ণ হয়ে অনন্যার দৃষ্টি ভেদ করে যেতে লাগল। অনন্যার কাঁধে স্যারের হাতের চাপ আরও শক্ত হলো, অনন্যার কাঁধে ব্যথার এক স্রোত ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু সে টু শব্দও করল না। 
স্যারের গালে হাত রেখেই জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,
"প্রিন্স! দেখুন, আমি আপনার প্রিন্সেস!"

অনন্যার কথা শুনে কৌশিকের শ্বাস প্রশ্বাস কিছুটা শান্ত হলো, সে কয়েক বার পলক ফেললো। থেমে থেমে শ্বাস নিলো, হঠাৎ বুকে এক ধরনের টান অনুভব করলো। হাত দুটো অনন্যার কাঁধ থেকে ধীরগতিতে সরে যেতে লাগলো। নিচু হয়ে ডান হাত দিয়ে নিজের বুকের দিকে হাত চেপে ধরলো। অন্য হাত দিয়ে অনন্যার হাতের কব্জি ধরে রাখলো। সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে, অনন্যাও কৌশিকের সাথে দাঁড়ালো। সময় না ব্যয় করে অনন্যাকে ওর রুমে নিয়ে গিয়ে সামনে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো কৌশিক। এমন ব্যবস্থা করল যাতে অনন্যা দুয়ার না খুলতে পারে। অনন্যাকে রুম বন্দি করে এই অবস্থায়ই নিচে নেমে গেলো কৌশিক।

কিছু সময়ের মধ্যে কি হলো অনন্যা বুঝতে পারলো না। দরজার হাতলে হাত রাখল সে, ধাক্কা দিল। কিন্তু দরজা খুললো না। মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো অনন্যার। 

সময় ব্যয় হতেই অনন্যা নিজের রুমে এসেও কিছুটা অন্যরকম অনুভব করলো। মনে হলো কিছুটা পরিবর্তন এসেছে এই রুমে। অনন্যা ধীরে ধীরে পিছনে ফিরল। চোখ আটকালো বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানির দিকে। ফুলদানিতে তিনটি লাল গোলাপ ঠিক আগের মতোই সজ্জিত, তবু সেগুলো অস্বাভাবিকভাবে আজ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। পাপড়িগুলো আরও বিস্তৃত, আরও প্রাণবন্ত! এক ধরনের মৃদু আলো ঠিকরে পড়ছে ফুল তিনটে হতে।

অনন্যার কপালে ভাঁজ পড়ল। সন্দিহান দৃষ্টিতে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ফুলগুলোর দিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো ফুলগুলো। হাত বাড়িয়ে আঙুলের আলতো ছোঁয়া দিতেই এক বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটল!

লাল গোলাপগুলো মুহূর্তের মধ্যে সাদা রঙে রূপান্তরিত হলো।একদম রক্ত হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মত। আচমকা তিনটে ফুল থেকে টেবিলের ওপর এক ফোঁটা লাল রঙ চুঁইয়ে পড়ল। গাঢ়, ঘন সেই লাল রং!

ঠিক তখনই প্রবল বজ্রপাত! জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল, রুমে অন্ধকার নেমে এলো এক ঝলকে। অনন্যা চমকে উঠল, পায়ের নিচের শক্ত জমিন কেমন টলে উঠল। ধপ করে বসে পড়ল সে, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো তার। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ঢিপঢিপ শব্দ হতে লাগলো।

********

"রুশা আপু! আকাশের ওই দিকটায় হঠাৎ বজ্রপাত হলো না?"

আরণ্যক কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললো। কথাগুলো বলতে বলতে আঙুল তুলে আকাশের এক কোণে ইঙ্গিত করল।

রুশা বিরক্ত ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকে সেই স্থানে তাকিয়ে বললো,
"পাগল হয়েছিস? আমি এদিকে রিকশা খুঁজে পাই না, আর তুই এই ওয়েদারে বজ্রপাত খুঁজে বেরাচ্ছিস? বেকুব কোথাকার!"

আরণ্যক চিন্তিত স্বরে বলল,
"কি বলছো আপু? আমি আওয়াজটা স্পষ্ট শুনেছি। আর নিজ চোখে বজ্রপাত দেখলাম!"

রুশা বিরক্ত মুখে ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত বাড়ছে। হাসপাতালের আশেপাশের পথঘাট ফাঁকা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দুজনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। 
রুশা গলা নামিয়ে বলল,
"শোন ভাই! এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, আমি আর দেরি করতে চাই না। এই রাতের বেলা ভূতের গল্প শুনাইস না!"

"আপু! দেরি কী আমি করেছি? ডাক্তার তো সেই কখন ডিসচার্জ করিয়ে দিতে চাচ্ছিলো। তুমিই তো আসছি আসছি বলে বসিয়ে রাখলে!"

রুশা ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
"আমারও তো কাজ ছিল রে ভাই! আজকে অফিসে নাইট করেছি।"

সামনে একটা খালি রিকশা দেখে আরণ্যকের বোন রুশার মুখে স্বস্তি এলো। সঙ্গে সঙ্গেই হাত তুলে ডাক দিলো,
"এই যে ভাই, যাবে?"

রিকশাওয়ালা মাথা নাড়তেই অনেক কষ্ট করে আরণ্যককে উঠাতে গেল।

"আহ্! আস্তে তো আপু!"

আরণ্যকের মুখ বিকৃত হয়ে গেল ব্যথায়। হাতে আর বুকে ব্যথা এখনো। বাইরের সবাই ভেবে নিয়েছে তেমন কিছুই হয়নি, কিন্তু গত দু'দিন টানা জ্বরে ভুগেছে সে। শরীর এমন দুর্বল ছিল যে নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছিল। আজ একটু ভালো লাগছিল বলেই ডাক্তার ছেড়ে দিয়েছে।

রিকশা চলতে শুরু করতেই আরণ্যক চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো, ক্লান্ত শরীরটা আর টানতে পারছে না। বাতাসে হালকা ঠান্ডা ভাব, দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকছে। রাতটা বেশ অদ্ভুত লাগছে আজ।

রুশা আরণ্যকের ব্যাগ আর নিজের ব্যাগ কোলে নিয়ে বসেছে। এক হাত দিয়ে পোশাক ঠিক করতে করতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
"এক সপ্তাহ ভার্সিটিতে যাওয়া নিষেধ। মনে আছে তো?"

আরণ্যক বাইরে তাকিয়েছিল, ধীর স্বরে বললো,
"নাহ, আপু। আমাকে যেতেই হবে।"

রুশা আরণ্যকের আরণ্যকের কান মুচড়ে ধরলো,
"কেন যাবি? ভার্সিটি কী তোকে খাওয়ায়, না তোর চিকিৎসার টাকা দেয়? সারাদিন শুধু এই কাজ, ওই কাজ! নিজের শরীরের দিকে একটু খেয়াল রাখবি না?"

"আহ্! ছাড়ো তো!" 
আরণ্যকের কপাল কুঁচকে উঠলো ব্যথায়।

রুশা ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটলো, তারপর কান ছেড়ে দিলো। আরণ্যক নিচু গলায় বললো,
"আমাকে একজনের জন্য ভার্সিটিতে যেতেই হবে।"

"শুনেছি। সব শুনেছি। ওই মেয়েটা! কি নাম যেন! দ্বিতীয় বার তোকে হসপিটালে এসে দেখে গেছে? ফাজিল একটা মেয়ে। সামনে পেলে কষায় একটা থাপ্পড় বসাতাম। আমার ভাইকে পেছনে ঘোরায় হু?"

আরণ্যক শান্ত হয়ে বললো,
"আমিই ঘুরেছি। ও ঘুরায় নি। ওর এখন স্বামী আছে। তার কাছেই তো থাকবে। আমার কথা কেন চিন্তা করবে?"

"ফাউল!"

"আপা, জানো একতরফা ভালোবাসাও সুখ পাওয়া যায়? আমার অনু আরেকজনের মাঝে সুখী আছে, ওই সুখ দেখলেও তো শান্তি লাগে।"

"চুপ থাক! এসব ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগছে না।"

আরণ্যক থামলো না,
"ভালোবাসা কি কেবল কাছে পাওয়ার নাম রে, পাগলি আপু? কাউকে সুখী দেখেও যদি মন ভরে যায়, তবে সেটাই তো সবচেয়ে নিখাদ ভালোবাসা। তাই না?"

"কষ্ট পাস না নাকি? কেমন হৃদয় তোর?"

আরণ্যক মুচকি হাসলো,
"কষ্ট? কষ্ট তো সেই দিনই শেষ হয়ে গেছে, যেদিন বুঝলাম, ও সুখে আছে। ওর সুখই আমার সুখ, আপু।"

রুশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এই ছেলেটাকে বুঝিয়ে সত্যি লাভ নেই।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp