তোকে চাই - পর্ব ০৪ - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - ধারাবাহিক গল্প


উনাকে আমার কলেজের সামনে দেখে অবাক হলাম। উনি এখানে কেন? কোনো কাজে এসেছেন কি? আমাকে দেখা মাত্রই উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। উনাকে আমি কোনো কালেই বুঝতে পারিনি, আর আজ কি বুঝবো। তাই নিজের মাথায় খিচুড়ি না পাকিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
"ভাইয়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি?"

উনি কোনো উত্তর করলেন না। তাই আবারও বললাম,
"ভাইয়া? বলুন না কোথায় যাচ্ছি? আর কেনই বা যাচ্ছি? মা কি জানে?"

উনি আবারও সাইলেন্ট। পুরো রাস্তা আমি এমন করেই হাজারো প্রশ্ন করে গেছি, আর উত্তর হিসেবে পেয়েছি এক ঝাঁক নিস্তব্ধতা। প্রায় আধা ঘন্টা পর, একটা প্রকান্ড বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলেন উনি। যাওয়ার সময় শুধু বললেন,
"চলো আমার সাথে।"

আমি আর কি করতাম? বাধ্য মেয়ের মতো উনার সাথে বাড়িটাতে ঢুকলাম। ড্রয়িংরুমের সোফায় কিছু ভাইয়া বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমরা ঢুকতেই এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে আবার আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি খুবই অস্বস্তি ফিল করছিলাম তবু শুভ্র ভাইয়ার পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। শুভ্র ভাইয়া একটা রুমের দরজা খুলে আমাকে ভিতরে যেতে বললেন, আমিও একরাশ ভয় নিয়ে রুমের ভিতরে পা রাখলাম। রুমে ঢুকে আমার অবাক হওয়ার মাত্রা যেনো আরো বেড়ে গেলো। বেডের উপর বিয়ের জন্য মেয়েদের যা যা লাগে প্রায় সব জিনিসই সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আচ্ছা শুভ্র ভাইয়া আমাকে কারো সাথে বিয়ে টিয়ে দিয়ে দেবে না তো? ব্যাপারটা চিন্তা করতেই ভয়ে শরীর কাঁপতে লাগলো। কি বলবো কিছু ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই আলমারি খুলে একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তখনো একই ভাবে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি। যাওয়ার সময় শুধু বলে গেলেন,
"ড্রেসটা চেন্স করে নাও।"

আমার সাথে কি হচ্ছে আর ঠিক কি হতে চলেছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্যাকেটটা খুলে দেখলাম, একটা পিংক কালারের ড্রেস। বার্থ ডে গার্লরা সাধারনত এমন ড্রেস পরে, কিন্তু আমাকে এই ড্রেস দেওয়ার কারন কি? উনি কি তাহলে আমাকে কোনো বার্থডে পার্টিতে নিয়ে যাবেন? যদি তাই হয়, তাহলে এভাবে আনার কি দরকার ছিলো? আর এসব বিয়ের কাপড়-চোপড়েরই বা রহস্য কি? চারদিকে শুধু প্রশ্ন প্রশ্ন আর প্রশ্ন। বুঝে উঠতে পারছি না ড্রেসটা পরে ফেলবো না কি রেখে দিবো? রেখে দেওয়াটাই বেটার হবে, আবার যদি উনি রেগে যান? তারচেয়ে বরং পরেই নিই। কি হবে সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। ড্রেসটা চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই উনি হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়লেন। আবারো সেই আগের স্টাইলে টানা-হ্যাঁচড়া করে গাড়িতে বসালেন আমাকে। নিজেকে আমার পুতুল বলে বোধ হচ্ছে। উনার যেমন ইচ্ছা উনি আমাকে সেভাবেই চালাচ্ছেন। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করছেন না। নেহাত উনি আমার মামুর ছেলে নয়তো চিৎকার চেঁচামেচি করে গণধোলাই খাওয়াতাম, হুহ। আজিব জনগন। আরে ভাই নিয়ে যাচ্ছিস নিয়ে যা, আমি কি মানা করেছি? করিনি তো? তাহলে উত্তর দিতে সমস্যাটা কই? যত্তসব।

নিজের মনেই বকবক করছিলাম, হঠাৎই গাড়ি থেমে গেলো। বিরক্ত হয়ে উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম,
"কি ব্যাপার, থামালেন কেনো?"

উনি আমার প্রশ্নটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন,
"ভিতরে যাও।"

এতক্ষণে আমি সামনের দিকে তাকালাম। একি? এ তো নীলিমা আপুদের বাড়ি। কিন্তু উনি আমাকে এখানে আনলেন কেনো? আবারও উনার দিকে প্রশ্নমাখা চোখে তাকালাম। উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলেন,
"ভিতরে গিয়ে নীলির বাবাকে বলবে, আজ তোমার জন্মদিন। আর নীলিকে ছাড়া তুমি কেক কাটবা না। তাই তুমি নীলিকে নিতে আসছো, বাবা-মা সহ সবাই ওয়েট করছে তোমার পথ চেয়ে। যেহেতু তুমি নীলির সাথে ওদের বাসায় কয়েকবার আসছো আর নীলি তোমাকে ওর স্যারের মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সো ওর বাবা মানা করবে না। সহজেই রাজি হয়ে যাবে আর নীলিকে নিয়ে তুমি বেরিয়ে আসবে। আমি এখানে ওয়েট করছি, গো নাও।"

উনার কথা শুনে আমি উনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। এসবের মানে কি? আমার ভাবনার মাঝেই উনি ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
"কি হলো? যাও।"

"ক...কিন্তু এতো ভনিতা করার কি দরকার? আর এতো ন...নাটকই বা কেনো?" (অবাক চোখে)

"তোমাকে যেতে বলছি..." (দাঁতে দাঁত চেপে)

আমিও আর কিছু বললাম না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভিতরে চলে গেলাম। নীলামা আপুর বাবা কোনো এক অজানা কারনে খুব ভালোবাসে আমায়। সেই ভালোবাসাকে ব্যবহার করছি ভেবে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। ভেতরে গিয়ে আংকেল কে ভালো-মন্দ জিগ্যেস করে, শুভ্র ভাইয়ার শিখিয়ে দেওয়া বুলি আওড়ালাম। কাজ হয়েও গেলো। নীলি আপুর রুমে গিয়ে দেখলাম সে একদম তৈরি হয়ে বসে আছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, সবকিছুই প্রি-প্লেইনড। একমাত্র আমিই এক আহাম্মক যে কিছুই জানি না। নীলিমা আপুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শুভ্র ভাইয়া গাড়িতে ওয়েট করছিলো। আমরা বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলেন তিনি। পনেরো মিনিটের মাথায় আবারও গাড়ি থামলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, কাজি অফিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে। এবার কিছু কিছু বুঝতে পারছিলাম। আমরা নামতেই উনার বাকি ফ্রেন্ডদের দেখতে পেলাম যারা ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো। তাদের মধ্যে একজন কিছু শপিং ব্যাগ এনে আপুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
"সব রেডি আছে, তৈরি হয়ে নাও হবু ভাবি। রোদ তোমাকে হেল্প করবে।"

আপু ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলেন। তারপর হালকা সাজগোজ। আপুকে এত্তো সুন্দর লাগছিলো কি বলবো। ছেলে হলে হয়তো প্রেমেই পড়ে যেতাম। আপুকে সাজাতে গিয়ে যা জানতে পারলাম তার সারাংশ এই, আপুর হঠাৎ করেই কাল বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাই এই গোপন বিয়ের আয়োজন। বাবা অনেক হার্ড, লাভ মেরেজ মেনে নিবেন না, তাই এই কান্ড যেনো ছেলেকে কাবিন নামা দেখিয়ে ভাগানো যায়। আধাঘন্টার মধ্যেই আপুর সাজ কমপ্লিট। আপুকে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখ আটকে গেলো, শুভ্র ভাইয়াকে দেখে। হোয়াইট শেরওয়ানি আর নীল পাগড়ী পরেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে উনাকে। চরম রকম ক্রাশ খেলাম। চোখ সরানোর ইচ্ছা না থাকলেও সরালাম। হাজার হলেও অন্যের বর বলে কথা। এদিকে শুভ্র ভাইয়া, হা করে নীলিমা আপুকে দেখছে। এই নিয়ে উনার ফ্রেন্ডরা কি মজাই না করছে। অবশেষে বিয়ে পর্ব শেষ হলো, আপু আবার ড্রেস চেঞ্জ করে নিলেন। এই অবস্থায় বাসায় গেলে আংকেল নির্ঘাত সন্দেহ করবেন। আমরা সবাই কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। শুভ্র ভাইয়াকে সবাই মিলে পিন্চ করে চলেছে। আমিও সে সব ইনজয় করছি। হঠাৎ নীলি আপুর কথা মনে পড়তেই দেখি উনি পাশে নেই। আশে পাশে তাকাতেই যা দেখলাম তাতে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। একটা পিচ্চি রাস্তায় বসে কাঁদছে, আর আপু তাকেই তুলতে গেছে। কিন্তু একটা ট্রাক যে তার দিকেই ধেয়ে আসছে, তা হয়তো তার খেয়ালেই নেই। ভয়ের চোটে আমার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। হাত-পা গুলো অবশ হয়ে আসছে। আমি যেই না সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিতে যাবো ওমনি এক প্রকান্ড শব্দে আমরা সবাই স্থির হয়ে গেলাম। শুভ্র ভাইয়া দুই মিনিট স্থির দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকেই নীলি বলে গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে ছুটে গেলেন, সাথে সবাই। কিন্তু আমি নড়ার ন্যূনতম শক্তি পর্যন্ত পাচ্ছি না। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। এর আগে এমন কোনো পরিস্থিতির সম্মুখিন হইনি আমি। নীলি আপুকে আমি নিজের বোনের মতো ভালোবাসতাম, তাই চোখের সামনে প্রিয় মানুষটির রক্তাক্ত শরীর দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু বলার বা করার শক্তি আমার নেই।

নীলি আপু দুইদিন যাবৎ আই.সি.ইউ.তে লাইফ সাপোর্টে আছেন। উনার বাবা-মা খবর পেয়ে তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছেন। উনাদের বিয়ের কথাটা বলার সাহস বা পরিস্থিতি কোনটাই ছিলো না, তাই আর বলা হয়ে উঠেনি। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে আন্টি তো পাগল প্রায়। আংকেলও বার বার সেন্স হারাচ্ছেন। কলিজার টুকরা বলে কথা। আমি আমার নিঃশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে দোয়া করছিলাম, যেনো আপু ভালো হয়ে যায়। সবার মুখে চিন্তার ছাপ, হঠাৎ ডাক্তার এসে বললো, নীলি আপুর জ্ঞান ফিরেছে। কথাটা শুনে এতো খুশি লাগছে কি বলবো। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু না আমি ভুল ছিলাম। নীলি আপু মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি চিৎকার করে কাঁদছি, একটা অপরাধ বোধ আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কেন গেলাম নীলি আপুকে আনতে? কেনো? আমি না গেলে, না উনি আসতেন, আর না এভাবে হারিয়ে যেতেন। সবাই কান্না করছে কিন্তু শুভ্র ভাইয়া? না, উনি কান্না করছেন না। একদম শক্ত হয়ে বসে আছেন, যেনো এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছেন তিনি। নীলি আপুর চলে যাওয়া উনি মেনে নিতে পারেননি, পারার কথাও না। আমি খুব করে চাচ্ছি উনি কাঁদুক, কেঁদে নিজেকে হাল্কা করুক। কিন্তু না উনি এক ফোঁটাও চোখের জল ফেললেন না, শুধু নিস্তেজ হয়ে বসে রইলেন। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়, কিন্তু শুভ্র ভাইয়া স্বাভাবিক হননি। এরপর তাকে আর হাসতে দেখা যায়নি। আমিও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, সামনে এইচ.এস.সি. এক্সাম, মাত্র তিনমাস বাকি। ব্যস্ততার মধ্যে সময় যে কিভাবে যায়, বোঝাই যায় না। তাইতো দেখতে দেখতে কিভাবে যে তিন মাস কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। সাথে এইচ.এস.সি. এক্সামও শেষ হলো। এর মধ্যে একবার শুধু উনাকে দেখেছিলাম। উশকো-খুশকো চুল, গালের খোঁচা দাঁড়ি গুলো বড় হয়ে জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। চোখ দুটো লাল আর হাতে সিগারেট। উনার চোখে মুখে রাত জাগার স্পষ্ট চিন্হ দেখতে পেয়েছিলাম।

সেদিন বুকের কোথাও একটা বড্ড কষ্ট হয়েছিলো। তারপর এলো আমাদের বিয়ের দিন, আমার এক্সামের পরের দিনই আপুর বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হলো। শুভ্র ভাইয়ার এই অবস্থায় কেউ আর ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার মুডে ছিলো না, তাই ঘরোয়া ভাবেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। আপুর কাবিন হওয়ার কিছুক্ষণ পর মামু হঠাৎ আব্বু আম্মুকে রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন, তার কিছুক্ষণ পর মা একটা শাড়ি আর কিছু গহনা নিয়ে আমার রুমে ঢুকলেন। তারপর যা হলো তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, মা শুধু বলেছিলেন, 'মামুর কাছে মা ঋনি আর এই ঋনটা আমাকে শোধ করতে হবে, শুভ্রকে বিয়ে করার মাধ্যমে।' কথাটা শুনে আমি শুধু মার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, কি বলছে মা এসব? আমাকে তার ঋন পূরনে বলি দিয়ে দিচ্ছে? চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছিলো সেদিন। আরে আমারও তো কিছু স্বপ্ন আছে, আশা আছে, সেগুলোর কি কোনো গুরুত্ব নেই? আমি জানতাম শুভ্র ভাইয়া নীলি আপুকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে, আর আমাকে যে কোনোদিন মেনে নিবে না, তাও জানতাম। সব জানার পর কেনো নিজের স্বপ্নগুলোকে জলাঞ্জলি দিবো? কেনো? কিন্তু মার চোখের পানির সামনে আমার চোখের পানিটাকে ঢাকতে হলো আর বসতে হলো বিয়ের পিড়িতে।

★★★★★

——————
বর্তমান......
——————

হঠাৎ কিছুর তীব্র আলো চোখে পড়ায় আমার ভাবনার ঘোর কাটলো। চোখ ধাঁধানো এই আলোর উৎস খুঁজে না পেয়ে চমকে উঠলাম। আচ্ছা নতুন কোনো বিপদের পূর্বাভাস নয় তো এই আলো? ভয়ে ভেতরে ভেতরে জমে যাচ্ছিলাম। তখনই দু'জোড়া পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তারা যেনো দৌড়ে আসছে আমার দিকে, কিন্তু আলোর অপজিটে থাকায় চেহারাগুলো অন্ধকারে ঢাকা। চোখের উপর চাপ প্রয়োগ করেও তাদের চেহারা দেখতে ব্যর্থ হয়ে চুপচাপ শেষ পরিনতির অপেক্ষায় চোখ খিঁচে বসে রইলাম। হঠাৎ কোনো পরিচিত কন্ঠে চোখ মেলে তাকালাম,
"রিদু, বোন, কাদঁছিস কেন বোকা মেয়ে?" (দুই গালে হাত রেখে)

সামনে ভাইয়াকে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। এতোক্ষণের আটকে থাকা ভয়, জ্বালা ধরানো অতীত, সবকিছু থেকে মুক্তি পেতেই যেনো ভাইয়ার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি জানি এখানে আমার ভয় নেই। ভাই নামের এই মানুষটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পুরো পৃথিবীর সাথে লড়ে যেতে পারে অবলীলায়। আমার বিয়েটা আটকাতে, বাবা-মার বাধ্য ছেলেটাও অবাধ্য হয়ে উঠেছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলো, শেষ রক্ষা না হওয়ায় বেরিয়ে গিয়েছিলো বাড়ি থেকে।

"রিদু, এই রিদু, কাঁদিস না বোন। দেখ আমি এসে গেছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস বোন?"

"ভাইয়া?" (ঠোঁট ফুলিয়ে)

"কি হলো? ব্যাথা পেয়েছিস কোথাও? সরি রে, আমি আসতে দেরি করে ফেলেছি। সরি...!"

"তুমি কাঁদো কেন? কিছুই হয়নি আমার। কিন্তু উনার হয়েছে, সেন্সলেস হয়ে গেছেন। আমাকে ছেড়ে উনাকে ধরো।"

"উপপপস্, সরি, অভ্র ভাইয়া? আমি একা পারবো না, আপনিও ধরেন। আপনার ভাইয়ের স্বাস্থ্য ভয়ানক।"

"রাহাত? তুমি এই পরিস্থিতিতেও মজা করছো?"

"মজা কই করলাম? আমি সিরিয়াস ভাই, উনাকে একা তোলা আমার কর্ম নয়।"

ভাইয়ার কথা শুনে এমন একটা পরিস্থিতিতেও আমার হাসি পাচ্ছে। ভাইয়াটা যে কি? যখন দেখছে বোন ঠিক আছে, তার মানে জগৎ-সংসারের সব ঠিক আছে।

শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে। কি নিষ্পাপ লাগছে মুখটা। ডাক্তার আংকেল বলে গেছেন টেনশনের কিছু নেই, অতিরিক্ত মানসিক চাপে এমনটা হয়েছে। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছে, সেই দিন ওভাবে কথাগুলো বলাটা ঠিক হয়নি। উনি অসুস্থ তবু কেমন একটা ভালোলাগা কাজ করছে সারা শরীর জুড়ে। সেই বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, ইভেন গাড়িতেও উনি আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন। এই প্রথম তাকে কাছে পাওয়া, উনার এই ক্লান্ত -নিষ্পাপ মুখ আমায় বড্ড টানছে। ইচ্ছা করছে খুব করে আদর করে দেই। কিন্তু একটা সংকোচ ভিতরে কড়া নেড়ে চলেছে অনবরত। উনি তো আমার নন, উনি নীলিমা আপুর ভালোবাসা। উনাকে ছোঁয়া বা ভালোবাসার অধিকার কি আমার আছে? কেনো থাকবে না? উনি যে আমার স্বামী। অধিকার আমার, কিন্তু.........। নিজের সাথে নিজেরই করা হাজারো তর্ককে থামিয়ে দেয় একটি মাত্র কিন্তু। এই কিন্তুর ভেতর কতো হাজার প্রশ্ন? যে প্রশ্নগুলো বেঁধে রেখেছে হাজারো চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্নগুলো থেকে। রাত ১২ঃ২০ বাজে, উনার ঘুম এখনো ভাঙেনি, হয়তো ভাঙবেও না। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, উনার কপালে আলতো একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে দিলাম।

ঘুমের মধ্যেই মনে হচ্ছিলো কেউ হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বয়সটা এমন একটা বয়স যখন মস্তিষ্ক ঘুমালেও শরীরটা জেগে থাকে সবসময়, হালকা স্পর্শেও কেঁপে ওঠে এই শরীর। হাজারো কৌতূহল নিয়ে ঘুম মাখা চোখ মেলে তাকালাম, শুভ্র আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে সে। আমি নড়েচড়ে উঠতেই উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
"থাঙ্কস। আমায় সামলে নেওয়ার জন্য।"

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। উনার মুখে প্রথম থাঙ্কস শুনে কি রিয়েকশন দেওয়া উচিত তাই যেনো ভুলে গেছি। "আমার দায়িত্ব ছিলো" বলে কোনো রকম কাটিয়ে দিলাম কথাটাকে।

"রোদ?"

"হুমম, কিছু বলবেন?"

"হ্যা, তোমার সাথে ইম্পর্টেন্ট কথা ছিলো।"

"জ্বি বলুন।" (অবাক হয়ে)

তুমি এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে, ১৮ এর গন্ডিতে পা রাখতে পারোনি এখনো। আর আমার জন্য তোমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো। বাবা খুব স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে রোদ। নিজের ছেলের খুশির ঝোলা ভরতে গিয়ে তোমার ঝুলিটা ফাঁকা করে দিয়েছেন একদম। কিন্তু আফসোস, না পারলাম আমি হ্যাপি হতে, না পারলে তুমি। কিন্তু আপাতত একজনের তো ভালো থাকা উচিত তাই না?"

কথাগুলো উনি খুব শান্ত কন্ঠে বলছিলেন, খুব গুছিয়ে। মনে হচ্ছিলো হয়তো আগে থেকে ভেবে রাখা কথাগুলো আওড়ে চলেছেন। আর আমি নিস্তব্ধ হয়ে শুনছি, কি বলতে চান তিনি? উনি একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন,
"তোমার ভালো থাকা উচিত রোদ, ইউ ডিজার্ভ ইট। আমি জানি, যা হয়েছে তাতে তোমার লাইফে দাগ পড়েছে। সাথে সাথে তোমার মনেও। আমি সেই দাগ মেটাতে পারবো না, কিন্তু আর কোনো দাগ যেনো না লাগে সেই চেষ্টা করতেই পারি। আমি তোমাকে তোমার সবটুকুই ফিরিয়ে দিতে চাই রোদ। তোমাকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি দিতে পারবো না, কারন বাবা সেটা মেনে নিবে না। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, আমি কখনো স্বামীর অধিকার নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াবো না। তোমার স্বাধীনতায় কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াবো না। তুমি তোমার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাও, আমাদের সম্পর্ক তাতে বাধা হবে না। কখনোই না।"

বলেই উনি ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি, কতো ইজিলি কথাগুলো বলে গেলেন। সবটুকু আমাকে ভেবেই বলেছেন উনি কিন্তু সেই আমিই তো মেনে নিতে পারছি না। যে পরিনাম জানাই ছিলো, সেই পরিণামটাকেই যে মেনে নিতে এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কাঁদতে ইচ্ছা করছে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।


দুদিন হলো আমাদের বাড়ি থেকে শুভ্রদের বাড়ি এসেছি, এই দুই দিনে উনার সাথে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা হয়নি। আগে তবু ঝগড়ার ছলে কথা হতো কিন্তু এখন সেই ঝগড়াটাও নেই। খুব ইচ্ছা করে উনার সাথে গল্প করতে, হাসতে। কিন্তু, আবার সেই কিন্তু। এই কিন্তুটাই আমার জীবনের বড্ড বড় বাধা। যাকে আমি অতিক্রম করতে পারছি না। আজ মামু আমাকে আর শুভ্রকে রুমে ডেকে পাঠিয়েছে, জানি না কেন? জানার কোনো ইচ্ছাও নেই। আজকাল কৌতূহল জিনিসটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মনে হয়। তবু যেতে হবে, মামুর জরুরি তলব বলে কথা। শুভ্রর জন্য অপেক্ষা করছি, সে এখন পড়াশুনার পাশাপাশি মামুর অফিসও সামলাচ্ছে। অভ্র ভাইয়ার দায়িত্বটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, হয়তো কষ্ট ভোলার জন্যই নিজেকে এই ব্যস্ততায় আটকে রাখা। বড্ড একা লাগে এখন। আপুও অভ্র ভাইয়ার সাথে চট্টগ্রাম চলে গেছে। আপু চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে পড়ে, পড়াশোনা শেষ হতে আরো দু'বছর তাই মামু ডিসিশন নিয়েছে আপুর পড়াশুনা চলাকালীন সময়ে অভ্র ভাইয়া চট্টগ্রামের কোম্পানি সামলাবে আর আপুর সাথে ওখানেই থাকবে। বাড়ির বউকে তো আর এতোদূর একা রাখা যায় না, এটাই মামুর বক্তব্য। রুমে পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, হয়তো উনি এসেছেন, তাই চটপট ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকলাম। আমার দিকে একনজর তাকিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন তিনি, আমিও কফি আনতে চলে গেলাম নিচে। নিচে নামতেই আরিফ চাচা জানালেন মামু রুমে যেতে বলেছে। আমিও মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে কফি হাতে উপরে চলে এলাম। সাধারনত বাড়ির কাজের লোকদের নাম হয় রহিম, করিম, জদু, কদু। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই বাড়ির প্রায় সব কাজের লোকদের নামগুলোই সুন্দর, যেমন... আরিফ, মাধবী, রাহেলা। মামু হয়তো নাম যাচাই করে সবাইকে কাজে নিয়েছে, নিতেও পারে, হু নোস? একদিন জিগ্যেস করে দেখতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই রুমে পা রাখলাম, উনি এতোক্ষণে ফ্রেশ হয়ে লেপটপ নিয়ে বসে গেছেন। আমি উনার সামনে কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
"মামু ডেকেছে।"

উনি ভ্রু কুচঁকে আমার দিকে তাকিয়ে কফি হাতে নিলেন। আমি আবার বললাম,
"মামু আমাকে আর আপনাকে উনার রুমে যেতে বলেছেন।"

"কেনো?" (অবাক হয়ে)

"আমি কি করে বলবো? গেলেই না বুঝতে পারবো।"

"ওহ! আচ্ছা চলো। এখনি যেতে হবে?"

"হুম। আচ্ছা শুনুন?"

"হুম। কিছু বলবা?"

"হ্যা। আচ্ছা আপনারা কি বাড়ির কাজের লোকদের নাম দেখে এপোয়েন্ট করেন?" (কৌতূহলী দৃষ্টিতে) 

"কেনো? আর এমন অদ্ভূত কথা মনে হওয়ার কারন?" (ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে)

"অদ্ভুত কেমনে হলো? কাজের লোকদের নাম সাধারনত হয় রহিম, করিম, কমলা, জমেলা, জদু, মদু, কদু। কিন্তু আপনাদের বাড়ির কাজের লোকদের নাম যথেস্ট স্মার্ট, লাইক আরিফ, মাধবী।" (হাত উল্টে ঞ্জানী ঞ্জানী ভাব নিয়ে)

উনি আমার কথা না কি বলার ভঙ্গী দেখে জানি না, তবে দু'সেকেন্ড আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে রুম কাঁপিয়ে হুহু করে হেসে উঠলেন। আর আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কতোদিন পর তিনি মন খুলে হাসছেন। ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসে দেখলাম দরজার পাশে মামানি এসে দাঁড়িয়েছে। পাশে কাজের লোকগুলো আর মামু। মামু আর মামানির চোখে জল যেনো বহু প্রত্যাশিত কিছু পেয়ে গেছেন। আর কাজের লোকদের চোখে বিস্ময়......
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp